বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মহল থেকে আবারো সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। এবার আলোচনার ডাক দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। সরকারের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া এ আহ্বানের ব্যাপারে জানা না গেলেও অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন আবারও সংলাপের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে সরকারের ইতিবাচক সাড়া দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান। বলেছেন, জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। তিনি বারবার আমাদের সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। তিনি চান বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পতাকা সমুন্নত থাকুক। এজন্য আমরা তার আহ্বানকে সাধুবাদ জানাই। এখন সরকারের উচিত এ আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেয়া। গতকাল জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর মহানগর দক্ষিণের নতুন কমিটি গঠন উপলক্ষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। মাহবুবুর রহমান বলেন, বান কি মুনের এ আহ্বানে সাড়া দেয়া না হলে আমরা ধরে নেব সরকার সংঘাত চাচ্ছে। কিন্তু আমরা সংঘাত চাই না। সংঘাত অনেক হয়েছে, রক্ত অনেক ঝরেছে। আর কত? ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের কবর রচনা হয়েছে মন্তব্য করে সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু আজ সেই গণতন্ত্রে ধস নেমেছে। এই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে সংলাপ সমঝোতার কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টসহ গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্ব চায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে নিরসন হোক। আমরাও চাই শান্তিপূর্ণভাবে চলমান সংকট নিরসন হোক।
দেশের অপরাপর প্রধান রাজনৈতিক দল, যেমন জামায়াতে ইসলামীও সংলাপ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন সকল দলই মূলত সংলাপকে সমঝোতার পথ বলে স্বীকার করে। গণতন্ত্রে সংলাপ সমস্যা ও সঙ্কট দূরীকরণের একটি বিশেষ পদ্ধতিও বটে। কিন্তু বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট, অচলাবস্থা ও বিভেদের বিপক্ষে সংলাপের পন্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। ফলে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও সকলের আস্থা, গ্রহণযোগ্যতা আর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে চারদিকে শোনা যাচ্ছে সুশাসনের অভাব-হেতু সন্ত্রাস ও বল-প্রদর্শনের উচ্চকণ্ঠ আর একদলীয় হুঙ্কার। প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য যা সত্যিই বিপজ্জনক।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সংগ্রাম নতুন কোনো বিষয় নয়। নতুন হলো সেই স্বপ্ন ও সংগ্রামের বর্তমান দুরবস্থা। ক্ষমতার মোহ কিভাবে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থীদের আবহমান ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুৎ করে, বর্তমান বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে তার প্রকৃষ্ট নমুনা। ইতিহাস ভবিষ্যতে এই স্খলন-পতনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে, এটা বলা সম্ভব যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের আগামী অধ্যায়ে বহুজন নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে উত্তীর্ণ হতে পারবেন না। কিছু কালি হয়ত তাদের শরীরে লেগে যাবে না। শুধু কালিমার কথাই বলা হচ্ছে কেন? কিছু রক্তের দাগও তো অনেকের শরীরে লাগছে, সেটাও তো অমোচনীয় হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গণতন্ত্রের শরীরে যখন কালির আঁচড় বা রক্তের দাগ লাগে, তখন গণতান্ত্রিক বলে দাবিদাররাও সেসব কলঙ্ক দাগের বাইরে থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন না। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, গণতন্ত্র কলঙ্কিত হওয়ার বা করার দায়ভাগ তাদের উপরও এসে বর্তায়।
পরিস্থিতি যা-ই হোক, সেটাকে প্রশমিত ও শান্তিপূর্ণ করাই নেতৃত্বের কৃতিত্ব। ভালো নেতৃত্ব মানে ভালো ব্যবস্থাপক। সঙ্কট মোচনে দক্ষতার পরিচয় দেয়াও নেতৃত্বের দায়িত্বের একটি অপরিহার্য অংশ। সেটা করতে না পারলে কোনো সফলতাই শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। বিশেষত, বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সংবিধানের যে সংশোধন করা হলো, তা নিয়েও তো কথা শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। অতএব, পরিস্থিতি যারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি করছেন বা সে রকম মনে করছেন, তারা বোকার স্বর্গে না হলেও সেটার কাছাকাছিই বসবাস করছেন। কিংবা বলা যায়, নিজের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করার জন্য মুখে মুখে নানা রকম কথা বলে যাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা রাজনীতিতে ফতুর এবং যাদের মাটির নিচে আদৌ কোনো রাজনৈতিক মাটিই নেই, তারাই বরং মহাজোটকে আশ্রয় করে নানা ধরনের কথার ফানুস উড়িয়ে যাচ্ছেন। মাইনাস আওয়ামী লীগ, এরা এতোটাই দেউলিয়া আর কথা-বার্তায় এরাই একেক জন অগ্রসেনানী!
কথাকারদের বাক্যাবলিকে আশ্রয় করে সিদ্ধান্ত নিলে প্রকৃত সমস্যার সমাধানের কাছে পৌঁছা যাবে না। বরং জাতিসংঘের মতো সর্বজন স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রধানের সংলাপের প্রস্তাব অনুধাবন করলেই লাভ হবে। জাতিসংঘ তার বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থার দ্বারা বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র অবশ্যই সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেছে এবং তারই ভিত্তিতে মহাসচিব আবারো সংলাপের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু হায়! সে ডাক যাদের শোনার কথা, তারা তো শুনছেন না!
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সঙ্কটে ও সমস্যায় নানা সমাধান-সূত্র ও ডাক নানা স্থান থেকে এসে হাজির হয়। এসব ডাক বা আহ্বান বা প্রস্তাবের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সমাধানের সুপ্ত ইঙ্গিত। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণরা সেসব বিবেচনা করে সমস্যার পরিধিকে কমিয়ে সম্ভাবনার দিগন্তকে প্রসারিত করে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় উদারতা, দূরদর্শিতা ও মুক্তমনের। গোঁয়ার্তুমি বা একরোখা মনোভাব আঁকড়ে থাকলে সমঝোতা বা সংলাপের পথে সমস্যার সমাধান করে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনার সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। অতীতের কৃতীবিদ নেতা ও ব্যক্তিবর্গ এভাবেই ইতিহাস ও সভ্যতায় নিজের কৃতিত্বের ছাপ রাখতে পেরেছেন। গো-ধরে কেউই সফল বা কৃতীবিদ হননি।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সমস্যা, বিদ্যমান দলসমূহের মধ্যকার বিভেদ ও দূরত্ব, বিভিন্ন মতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রতিপক্ষের প্রতি আইন-বহির্ভূত আগ্রাসী আচরণ কমানোর জন্য উচ্চমেধা ও নৈতিক অবস্থানের জাতীয় নেতার প্রয়াজনীয়তা আজ সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। এ কথাও স্বীকার্য যে, স্বাধীনতার পর পরই জাতি গঠনে ও জাতির সার্বিক ঐক্য সাধনে আওয়ামী লীগের মূল নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও কৃতিত্বও ছিল ঐতিহাসিক। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করতে এবং ভারতীয় বাহিনীকে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশত্যাগ করাতে যে সাফল্য দেখিয়েছেন, সেটাও ইতিহাসের এক মহান অর্জন। তদুপরি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে এনে এবং দেশের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে ঘোলা পানিতে যারা মাছ শিকার করছিল, তাদের দৌরাত্ম্যও বন্ধ করে তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার দলের মধ্যেই ঘাপটি-মেরে থাকা শত্রুপক্ষ শেখ মুজিবকে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় কাজ করার মাধ্যমে দেশ ও জাতির সেবার সুযোগ দেয়নি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তার সরকারকেই শুধু উৎখাত করা হয়নি, তাকেও সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বর্তমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার মতো বড় মাপের নেতার অভাব সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। আজকে শেখ মুজিবের দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যদি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে তাদের যেমন মঙ্গল হবে, তেমনি জাতির জন্যও কল্যাণকর হবে। সরকারের জন্য এখন চারদিকে শত্রু তৈরি বা শত্রু খোঁজার বদলে বন্ধু সৃষ্টি করাই তাদের মুখ্য কাজ হওয়া উচিত। ‘৭৫-এর আগে শেখ মুজিবকে স্তাবক ও অসৎ অনুসারীরা যেভাবে জনবিচ্ছিন্ন করে বিভ্রান্ত করেছিল, আজকেও যেন কোনো স্বার্থান্বেষী-মতলববাজ-বন্ধুবেশী-শত্রু সেটা করতে না পারে। কারণ, বাইরে কাল্পনিক শত্রুর ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে ভেতরের শত্রুরা সহজে হীন চক্রান্ত সফল করতে পারে। প্রবাদেই আছে, ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ।’ অতএব, বাইরের শত্রুদের চেনা যায়; ভেতরে লুকিয়ে থাকাদের সহজে চেনা যায় না। অতএব, বাইরের প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও সংলাপ করে শত্রুতা হ্রাস করুন; মিত্রতা ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্র প্রসারিত করুন এবং ঘরের শত্রুদের ব্যাপারে সাবধান থাকুন।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বা অন্য যারাই সংলাপ বা আলোচনার পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা কেউই সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। তারা সরকার ও বিরোধী, উভয় পক্ষেরই বন্ধু এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, শান্তি ও উন্নয়ন চান। তাদের ভালো পরামর্শ শোনার মধ্যে তো কল্যাণ ছাড়া ক্ষতির কিছু নেই। আর এটা তো সর্বজনবিদিত যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই এবং রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলেও কিছু নেই। অতএব, সরকারের দিক থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মতলববাজদের প্ররোচনা ও উস্কানির ফাঁদে পা দেয়ার বদলে শান্তি ও সংলাপের মাধ্যমে বাস্তবতা বোধের যুক্তিপূর্ণ নীতি ও কৌশলের অনুসরণ করাই শ্রেয়। এতে সকলের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও মঙ্গল নিশ্চিত হবে। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ও আশাবাদ সৃষ্টি হবে। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এটাই হোক শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের পথ।
দেশের অপরাপর প্রধান রাজনৈতিক দল, যেমন জামায়াতে ইসলামীও সংলাপ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন সকল দলই মূলত সংলাপকে সমঝোতার পথ বলে স্বীকার করে। গণতন্ত্রে সংলাপ সমস্যা ও সঙ্কট দূরীকরণের একটি বিশেষ পদ্ধতিও বটে। কিন্তু বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট, অচলাবস্থা ও বিভেদের বিপক্ষে সংলাপের পন্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। ফলে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও সকলের আস্থা, গ্রহণযোগ্যতা আর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে চারদিকে শোনা যাচ্ছে সুশাসনের অভাব-হেতু সন্ত্রাস ও বল-প্রদর্শনের উচ্চকণ্ঠ আর একদলীয় হুঙ্কার। প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য যা সত্যিই বিপজ্জনক।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সংগ্রাম নতুন কোনো বিষয় নয়। নতুন হলো সেই স্বপ্ন ও সংগ্রামের বর্তমান দুরবস্থা। ক্ষমতার মোহ কিভাবে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থীদের আবহমান ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুৎ করে, বর্তমান বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে তার প্রকৃষ্ট নমুনা। ইতিহাস ভবিষ্যতে এই স্খলন-পতনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে, এটা বলা সম্ভব যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের আগামী অধ্যায়ে বহুজন নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে উত্তীর্ণ হতে পারবেন না। কিছু কালি হয়ত তাদের শরীরে লেগে যাবে না। শুধু কালিমার কথাই বলা হচ্ছে কেন? কিছু রক্তের দাগও তো অনেকের শরীরে লাগছে, সেটাও তো অমোচনীয় হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। গণতন্ত্রের শরীরে যখন কালির আঁচড় বা রক্তের দাগ লাগে, তখন গণতান্ত্রিক বলে দাবিদাররাও সেসব কলঙ্ক দাগের বাইরে থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন না। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, গণতন্ত্র কলঙ্কিত হওয়ার বা করার দায়ভাগ তাদের উপরও এসে বর্তায়।
পরিস্থিতি যা-ই হোক, সেটাকে প্রশমিত ও শান্তিপূর্ণ করাই নেতৃত্বের কৃতিত্ব। ভালো নেতৃত্ব মানে ভালো ব্যবস্থাপক। সঙ্কট মোচনে দক্ষতার পরিচয় দেয়াও নেতৃত্বের দায়িত্বের একটি অপরিহার্য অংশ। সেটা করতে না পারলে কোনো সফলতাই শেষ পর্যন্ত সফল হবে না। বিশেষত, বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সংবিধানের যে সংশোধন করা হলো, তা নিয়েও তো কথা শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। অতএব, পরিস্থিতি যারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি করছেন বা সে রকম মনে করছেন, তারা বোকার স্বর্গে না হলেও সেটার কাছাকাছিই বসবাস করছেন। কিংবা বলা যায়, নিজের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করার জন্য মুখে মুখে নানা রকম কথা বলে যাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা রাজনীতিতে ফতুর এবং যাদের মাটির নিচে আদৌ কোনো রাজনৈতিক মাটিই নেই, তারাই বরং মহাজোটকে আশ্রয় করে নানা ধরনের কথার ফানুস উড়িয়ে যাচ্ছেন। মাইনাস আওয়ামী লীগ, এরা এতোটাই দেউলিয়া আর কথা-বার্তায় এরাই একেক জন অগ্রসেনানী!
কথাকারদের বাক্যাবলিকে আশ্রয় করে সিদ্ধান্ত নিলে প্রকৃত সমস্যার সমাধানের কাছে পৌঁছা যাবে না। বরং জাতিসংঘের মতো সর্বজন স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রধানের সংলাপের প্রস্তাব অনুধাবন করলেই লাভ হবে। জাতিসংঘ তার বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থার দ্বারা বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র অবশ্যই সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেছে এবং তারই ভিত্তিতে মহাসচিব আবারো সংলাপের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু হায়! সে ডাক যাদের শোনার কথা, তারা তো শুনছেন না!
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সঙ্কটে ও সমস্যায় নানা সমাধান-সূত্র ও ডাক নানা স্থান থেকে এসে হাজির হয়। এসব ডাক বা আহ্বান বা প্রস্তাবের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সমাধানের সুপ্ত ইঙ্গিত। বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণরা সেসব বিবেচনা করে সমস্যার পরিধিকে কমিয়ে সম্ভাবনার দিগন্তকে প্রসারিত করে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় উদারতা, দূরদর্শিতা ও মুক্তমনের। গোঁয়ার্তুমি বা একরোখা মনোভাব আঁকড়ে থাকলে সমঝোতা বা সংলাপের পথে সমস্যার সমাধান করে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনার সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। অতীতের কৃতীবিদ নেতা ও ব্যক্তিবর্গ এভাবেই ইতিহাস ও সভ্যতায় নিজের কৃতিত্বের ছাপ রাখতে পেরেছেন। গো-ধরে কেউই সফল বা কৃতীবিদ হননি।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সমস্যা, বিদ্যমান দলসমূহের মধ্যকার বিভেদ ও দূরত্ব, বিভিন্ন মতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, প্রতিপক্ষের প্রতি আইন-বহির্ভূত আগ্রাসী আচরণ কমানোর জন্য উচ্চমেধা ও নৈতিক অবস্থানের জাতীয় নেতার প্রয়াজনীয়তা আজ সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। এ কথাও স্বীকার্য যে, স্বাধীনতার পর পরই জাতি গঠনে ও জাতির সার্বিক ঐক্য সাধনে আওয়ামী লীগের মূল নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও কৃতিত্বও ছিল ঐতিহাসিক। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠিত করতে এবং ভারতীয় বাহিনীকে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশত্যাগ করাতে যে সাফল্য দেখিয়েছেন, সেটাও ইতিহাসের এক মহান অর্জন। তদুপরি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে এনে এবং দেশের মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করে ঘোলা পানিতে যারা মাছ শিকার করছিল, তাদের দৌরাত্ম্যও বন্ধ করে তিনি সবাইকে সাথে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার দলের মধ্যেই ঘাপটি-মেরে থাকা শত্রুপক্ষ শেখ মুজিবকে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় কাজ করার মাধ্যমে দেশ ও জাতির সেবার সুযোগ দেয়নি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তার সরকারকেই শুধু উৎখাত করা হয়নি, তাকেও সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বর্তমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তার মতো বড় মাপের নেতার অভাব সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। আজকে শেখ মুজিবের দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যদি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, তাহলে তাদের যেমন মঙ্গল হবে, তেমনি জাতির জন্যও কল্যাণকর হবে। সরকারের জন্য এখন চারদিকে শত্রু তৈরি বা শত্রু খোঁজার বদলে বন্ধু সৃষ্টি করাই তাদের মুখ্য কাজ হওয়া উচিত। ‘৭৫-এর আগে শেখ মুজিবকে স্তাবক ও অসৎ অনুসারীরা যেভাবে জনবিচ্ছিন্ন করে বিভ্রান্ত করেছিল, আজকেও যেন কোনো স্বার্থান্বেষী-মতলববাজ-বন্ধুবেশী-শত্রু সেটা করতে না পারে। কারণ, বাইরে কাল্পনিক শত্রুর ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে ভেতরের শত্রুরা সহজে হীন চক্রান্ত সফল করতে পারে। প্রবাদেই আছে, ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ।’ অতএব, বাইরের শত্রুদের চেনা যায়; ভেতরে লুকিয়ে থাকাদের সহজে চেনা যায় না। অতএব, বাইরের প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও সংলাপ করে শত্রুতা হ্রাস করুন; মিত্রতা ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্র প্রসারিত করুন এবং ঘরের শত্রুদের ব্যাপারে সাবধান থাকুন।
জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বা অন্য যারাই সংলাপ বা আলোচনার পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা কেউই সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। তারা সরকার ও বিরোধী, উভয় পক্ষেরই বন্ধু এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, শান্তি ও উন্নয়ন চান। তাদের ভালো পরামর্শ শোনার মধ্যে তো কল্যাণ ছাড়া ক্ষতির কিছু নেই। আর এটা তো সর্বজনবিদিত যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই এবং রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলেও কিছু নেই। অতএব, সরকারের দিক থেকে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মতলববাজদের প্ররোচনা ও উস্কানির ফাঁদে পা দেয়ার বদলে শান্তি ও সংলাপের মাধ্যমে বাস্তবতা বোধের যুক্তিপূর্ণ নীতি ও কৌশলের অনুসরণ করাই শ্রেয়। এতে সকলের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও মঙ্গল নিশ্চিত হবে। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ও আশাবাদ সৃষ্টি হবে। দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এটাই হোক শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের পথ।
কনক জ্যোতি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন