১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে লেখা খোলা চিঠিতে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ‘স্বাধীন বাংলাদেশে পত্রিকা প্রকাশের সাধারণ অধিকারটুকুও না থাকলে আমি এদেশে থাকতে চাই না। হয় পত্রিকা প্রকাশনার অনুমতি দানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দাও, নয়তো আমাকে এদেশ থেকে বহিষ্কার করো।’ অবাধ-তথ্য প্রবাহের এই যুগে আজ আবার স্বাধীনতার ৪২ বছর পর সংবাদপত্রের জন্য অসনিসংকেত। কালোমেঘের ঘনঘাটা চতুরদিকে খিটমিট করছে। বাংলার আকাশে-বাতাসে অসংখ্য বনি আদমের লাশের সাথে সাংবাদিকদের লাশও আজ ভেসে উঠছে বনে-জঙ্গলে, ডোবা-নালায়। এমনকি শোবার রুমেও ক্ষত-বিক্ষত সাংবাদিক দম্পতির লাশ এ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এর বিচার এখনো আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু এর শেষ কোথায়? এখনতো মওলানা ভাসানীর মত বলিষ্ঠ নেতা নেই!! যিনি সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়াবেন। দৃঢ়তা আর অধিকার নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করবেন। মান-ইজ্জত হারানোর ভয়ে এখন অন্তত প্রবীণ সাংবাদিক মরহুম এ বি এম মুসা আর মরহুম আতাউস সামাদের মত সাহসী হয়ে মুখ খুলবে না কেউ। প্রতিবাদ করবে না জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে। তাছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেয়ার থেকে যখন দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অপমান করা হয়। তখন এ জাতির কল্যাণে কেউ কি আর এগিয়ে আসার হিম্মত রাখে??
মূলত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্লজ্জ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছে। এবার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ আইন করে এখন তারা অনেকটা নির্ভেজাল বাকশালের দিকে রওয়ানা হয়েছে। এটি জাতির জন্য মহা দুঃসংবাদ হলেও অন্তত পৃথিবীবাসী জানতে পারলো আওয়ামী লীগ এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আর আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না। গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচারীর তালিকাভুক্ত আওয়ামী লীগ এখন জাতির শেষ প্রত্যাশাটুকুও তোয়াক্কা না করে জাতির সামনে তাদের ’৭২-৭৫-এর বাকশালী মুখোশ উন্মোচন করেছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বললেন- “গণতন্ত্র দিয়ে দেশের উন্নতি হয়না”। এর আগে এ নেতাই বলেছেন-” আওয়ামী লীগ এখনো চেতনায় বাকশালকে লালন করে”। এখন মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেক ঢুকালো।
খুন আর গুম-প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন নির্ভেজাল বাকশাল আর একনায়কতান্ত্রিকতারই পথযাত্রী। সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্য, আচরণে আর শৃঙ্খলিত আইন কানুনে বাংলার জনগণ এখন সেই প্রতিধ্বনি খুঁজে পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। নতুন প্রজন্ম আবার জানল আওয়ামী লীগ সত্যপন্থী মিডিয়া, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে কেমন শত্রুতা পোষণ করে। কারণ নতুন প্রজন্ম বাকশালের ইতিহাস পড়েছে কিন্তু আওয়ামী লীগের দুঃশাসন দেখেনি। আমার বিশ্বাস এসময়ের সংবাদপত্র আর মিডিয়ার অধিকাংশ সাংবাদিক, রিপোর্টার, কলামিস্ট, আর কলা-কৌশলীরা নতুন হওয়ায় তারাও মিডিয়ার উপর আওয়ামী লীগের খড়গহস্ততা দেখার সুবর্ণ সুযোগটি পাবে। যে প্রজন্মের তরুণরা তাদের মেধা, দক্ষতা দিয়ে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে জানে। আওয়ামী লীগ তাদেরকে অনিয়ম, অবৈধ ও বিবেকের চেতনাকে বিরোধী কোন নীতিমালা আর আইন দিয়ে শৃঙ্খলিত করতে পারবে না। নতুন প্রজন্ম ফ্যাসিস্টদের সংজ্ঞা পড়েছে কিন্তু আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট চরিত্র, হিং¯্রতা আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত প্রমাণ দেখেনি। কারণ গোটা পৃথিবীতে তরুণরা এখন সত্য ও সুন্দরকে আলিঙ্গন করার দুঃসাহসিক চেতনায় বিভোর। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে সেই ইতিহাস এখন জীবন্ত। বিশ্বের সর্বশেষ আধুনিক রাষ্ট্র ইসরাইলকে পরাজিত করে মুসলিম যুবক তরুণরা সে ইতিহাস বিনির্মাণ করেছে। বাংলাদেশেও তরুণ প্রজন্মের কাছে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে ইনশাল্লাহ।
আওয়ামী লীগ জন্ম থেকেই মিডিয়ার ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ সৎ-সংবাদ ও সাংবাধিকদের উপর চালিয়েছে দমন-নিপীড়ন। ’৭২-৭৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ৩ বছর শাসনামল ছিল সংবাদপত্রের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়। ৪টি পত্রিকা বাদে সকল সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে দেয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, সম্পাদক গ্রেফতার, প্রেসে তালা লাগানো- এ সবই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই আওয়ামী লীগই জাসদের তৎকালীন সমাজতন্ত্রের ধারক বাহক দৈনিক গণকণ্ঠকে বন্ধ করে পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার করার নির্লজ্জ ইতিহাস কায়েম করেছিল। জাসদের ৪০ হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছিল। অথচ সেই জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনু সাহেব এখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকা অবস্থায় আবার যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে তাতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কি আছে? কারণ ক্ষমতার হালুয়া-রুটির কাছে আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা খুবই তুচ্ছ!! জাসদ আজ সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ‘নায়েবে মার্কস’ হাসানুল হক ইনুর রাজনৈতিক দল জাসদ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিয়ে মহাজোটের সরকার গঠনের পর থেকে আওয়ামী লীগে বিলীন প্রায়। অথচ ’৭২ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই ছিল জাসদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জেহাদ। (দৈনিক আমার দেশ, ২৫.০৭.১০)। রাষ্ট্রযন্ত্র সংবিধানে একদিকে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ অধিকার দেয়। অন্যদিকে গণমাধ্যম পীড়নের বিতর্কযুক্ত অধ্যায় তৈরি করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি সংবিধানে থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্র ভিন্নমতের কয়েকটি পত্রিকার প্রতি ছিল কঠোর, রূঢ় ও অসহনশীল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরের বছর থেকে শুরু হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের সংবাদপত্র দলন। শামসুল হকের বাংলা সাময়িকপত্র ১৯৪৭-৭১ বইয়ের তথ্য মতে, পাকিস্তান আমলে ’৪৭ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৯০টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে ২৭টি দৈনিক, ১২৮টি মাসিক, ১৭টি মহিলা বিষয়ক, ৩৩টি শিশু-কিশোর বিষয়ক আর ২৭টি ছিল ত্রৈমাসিক। স্বাধীনতা লাভের বারো মাসের মধ্যে গণশক্তি, হক কথা, লাল পতাকা, মুখপত্র, বাংলার মুখ, স্পোকসম্যান ইত্যাদি সাপ্তাহিক পত্রিকা নিষিদ্ধ হয়। পত্রিকাগুলোর সম্পাদক গ্রেফতার হন। এসব পত্রিকা বন্ধের ফলে তখন ‘প্রায় চারশ সাংবাদিক বেকার হন।
সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ এবং স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী রাজনীতিকে সহিংস পন্থায় দমনের ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। মুজিব সরকার শুধু ১৯৬০ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব সরকারের প্রবর্তিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সকেই ১৯৭৩ সালে সে কালাকানুনটিকে ‘মুদ্রণযন্ত্র ও প্রকাশনা অর্ডিন্যান্স’ নামে প্রবর্তন করেছিল। এই অধ্যাদেশের আড়ালে সরকার একদিকে সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছে, অন্যদিকে একের পর এক সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানীর ‘হক-কথা’ ছাড়াও নিষিদ্ধ হয়েছিল পাঁচটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের মূল দল জাসদের মুখপত্র দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ও নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তখন তথাকথিত ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ আড়ালে নিজের একচ্ছত্র নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং সরকারের বিরোধিতাকে সমূলে উৎখাত করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ও বিলুপ্ত কওে দেশে একটি মাত্র দল রাখার বিধান করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে সরকারনিয়ন্ত্রিত চারটি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক বাংলা’, ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ ও ‘বাংলাদেশ টাইমস’ ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৬ জুন।
আওয়ামী লীগ কখনই মিডিয়াবান্ধব ছিলো না। তাদের জন্মই হয়েছে জনগণের অধিকার হরণ, কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে। প্রতিনিয়ত হামলা-মামলার শিকার হচ্ছে সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কলম সৈনিকরা। বর্তমান সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, আমার দেশ পত্রিকার সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আওয়ামী শাসনের অধিকাংশ সময়ই থাকতে হয়েছে কারাগারে। বিগত দিনে এই সরকার ঠুনকো অজুহাতে বন্ধ করে দিয়েছে চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, আমার দেশ পত্রিকা ,অনলাইন মিডিয়াসহ মত প্রকাশের অনেক গণমাধ্যম। হুমকির শিকার হয়েছে, দৈনিক ইনকিলাব, মানব জমিনসহ অনেক পত্রিকা ও সাময়িকী। সরকার আবার সংবাদ নিয়ন্ত্রণ আইন করে বিরোধী ঘরানার মিডিয়াগুলো বন্ধ করার পাঁয়তারা করছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের ব্যাপারে দেশে-বিদেশী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একের পর এক অশনি সংকেত ও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসলেও আওয়ামী লীগ এর কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে আসছে বরাবরই। এজন্য যেমন খুশি তেমন শাসনই তাদের জন্য বৈধ। সুতরাং বাংলাদেশের জনগণের উপর যেকোন প্রকারের কালো আইন, অর্থনৈতিক শোষণ, দুর্নীতি, লুটপাট এগুলো তাদের অধিকারেরই অংশ মনে করে আওয়ামী লীগ। এখন আবার পুরনো কায়দায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের গভীর কূট-কৌশল আঁটছে প্রতিনিয়ত। এই নীতিমালা তারই প্রকৃত উদাহরণ। বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীন নয় বলে তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ফ্রিডম অব দ্য প্রেস। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘ফ্রিডম অব দ্য প্রেস’ ২০১৪-এর বার্ষিক রিপোর্টে নিউইয়র্ক ফরেন প্রেস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বের গণমাধ্যমের অবস্থা তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডাগ ফ্রান্দটজ ও ফ্রিডম হাউজের প্রজেক্ট ডিরেক্টর ড. কেরিন কারলেকার। রিপোর্টে বলা হয়েছে গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা কমেছে। সূচকে এবার বাংলাদেশ ১১৫তম অবস্থানে রয়েছে। ”
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাকে চরম অগণতান্ত্রিক ও শঙ্কাজনক বলে মনে করেন দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, পত্রিকার সম্পাদক, সুশীল সমাজ এবং দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা মনে করেন, সংবাদমাধ্যম জাতির বিবেক। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে তা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে। দেশের মানুষকে তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। সম্প্রচার নীতিমালা তৈরিতে দৈশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়নি বরং দলীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা প্রণয়ন হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব কওে টেলিভিশনে সংবাদ ও মতামত প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে দেশে গণতন্ত্র বিঘিœত হবে। কোন সরকারের উচিত নয়, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করা। এতে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আসলে বিধিনিষেধ দিয়ে কোন দিন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। প্রস্তাবিত নীতিমালাকে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের একটি প্রয়াস হিসেবে দেখছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. পিয়াস করিম। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন কথা বলা যাবে না- এমন নীতিমালার বাস্তবায়ন হলে র্যাবের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। বাহিনীগুলোকে দলীয়করণ সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। অথচ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা মিডিয়াতে আলোচনার কারণেই উদঘাটিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মোহসিন বলেন, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তথ্য সেটা কে যাচাই করবে? জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মাধ্যমে এই অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। সিনিয়র সাংবাদিক আশরাফ কায়সার বলেন, সম্প্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণেœর জন্যই তৈরি করা হয়েছে। এটি আসলে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রক্ষাকবচের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। মিডিয়া কর্মীরা কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতি, অপকর্মের সংবাদ পরিবেশন করবে না? নীতিমালার মাধ্যমে এটা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে অনুমোদিত নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের হাত-পা কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আমরা এ সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে শঙ্কিত। এটা চরম অগণতান্ত্রিক। এ নীতিমালার মাধ্যমে সরকার টকশোসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যেসব অনুষ্ঠান সরকারের পছন্দ হবে না সে সব অনুষ্ঠানকে সরকার তার নিজের ভাষায় রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে অভিহিত করবে এবং বন্ধ কওে দেবে। গ্রেপ্তার করবে আলোচকদের। আমরা এ নীতিমালা প্রত্যাখ্যান করছি।” (সূত্র:মানব জমিন) দি ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, জনাব মাহফুজ আনাম ‘একটি পশ্চাৎপদ নীতি’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লিখেছেন-‘স্বাধীন গণমাধ্যম ও সরকারের মধ্যে যে কোন দ্বন্দ্বে প্রাথমিকভাবে সরকার জিতলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন গণমাধ্যমেরই জয় হয়। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের কারণে জাতির গঠনমূলক মূল্যবান সময়ের বিপুল অপচয় হয়। সরকার প্রাথমিকভাবে জয় লাভ করে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী প্রভৃতির ব্যবহার, পেশীশক্তির প্রয়োগ ও অর্থেও জোরে। প্রাথমিকভাবে এই বিজয় সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত বাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের জয় হয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে। তবে এই প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আমাদের সরকার মনে হয় ইতিহাসের এই ধারা থেকে কিছুই শিখছে না। কেন এই নতুন সম্প্রচার নীতিমালা? স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্জন হলো স্বাধীন গণমাধ্যম। তিনি আরো লিখেছেন- ‘আমরা মনে করি এরকম একটি আইন তৈরি করতে প্রথমেই একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা উচিত। সাংবাদিক সমিতিগুলো এবং সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর সমিতি এ্যাটকোও এ বিষয়ে একমত। সরকার সাময়িকভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন গণমাধ্যমেরই জয় হবে’।
কিন্তু দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের বৈধতা নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠেছে তখন সরকার কেন এমন নীতিমালা করতে যাচ্ছে? এর কয়েকটি কারণ বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার ডালপালা গজিয়ে এখন গ্রামের চায়ের দোকানেও ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলো- (ক) দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক জরিপে সরকারের জনসমর্থন যখন হিমাঙ্কের নিচে অবস্থান করছে, দেশের সকল পেশা ও শ্রেণীর মানুষ যখন সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ, তখন তথাকথিত এই নীতিমালার মাধ্যমে মিডিয়ার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা ব্যতীত সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার আর কোন সুযোগ আছে কি? (খ) দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং সরকারের এমপি, মন্ত্রী এবং দলবাজ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সকল অনিয়মের তথ্য-উপাত্তই মিডিয়ার কাছে জ্ঞাত। তাই এগুলো প্রকাশিত হওয়ার ভয়েই সরকার নীতিমালার মাধ্যমে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যে কারণে সাগর-রুনির মত সাংবাদিক দম্পত্তিকে জীবন দিতে হয়েছে। (গ) পুলিশ, র্যাব এবং প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তা ব্যক্তিদের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে জঘন্য ইতিহাস আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে তাদেও সেফটির জন্য মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের এই উদ্যোগ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। (ঘ) সরকার দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে মিডিয়াকে এক অ-ঘোষিত নীতিমালার বন্দী খাঁচায় আবদ্ধ করেছে অনেক আগেই। আর এই নীতিমালা গ্রহণ করার মাধ্যমেই আরো দু-একটি চ্যানেল ও পত্রিকা বন্ধ করার উদ্যোগ হয়ত অচিরেই গ্রহণ করবে সরকার। আর বাকী মিডিয়ার সামনে বন্ধ করার ভয়ের তরবারি ঝুলিয়ে দিলো সরকার। (ঙ) আগামী দিনে বিরোধী মত দমনে সরকার আরো কঠোর হতে পারে। সেই খবর যাতে দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসী জানতে না পারে তার জন্য নীতিমালার নামে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ চায় বিরোধীদল শূন্য রাজপথ ও বিরোধী আওয়াজ শূন্য মিডিয়া। এভাবে কেল্লা ফতেহ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী কোন অপকর্মকে আইন, নীতিমালা দিয়ে প্রোটেকশান দেয়া যায় না। হয়ত সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন কোন কিছু দিয়েই সরকারের শেষ রক্ষা হবে না। বীরজনতার বিজয় প্রত্যাশীরা এখন সেই প্রহরই গুণছে। সর্বশেষ ’৭৫ সালে আওয়ামী লীগের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ নিয়ে সাংবাদিকরা অনেক কার্টুন, চুটকি, রম্যগল্প তৈরি করেছে। তার একটি চুটকি দিয়ে আজকের লেখার ইতি টানলাম-“বঙ্গবন্ধুর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা স্বপ্নে দেখেন, মৃত্যুর পর নরকে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি নরকের দূতের কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের পরও কি স্বর্গে যাওয়ার সৌভাগ্য হতে পারে না?’ ঈশ্বর তাকে বলেন- ‘যে পরিস্থিতি তোমরা সাড়ে তিন বছরে তৈরি করেছ, এরপর নরকই তোমার কাছে মনে হবে স্বর্গের মতো।’
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন