এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্ট ভবন প্রাঙ্গণে হামলা হয়েছে। তাকে কিল-ঘুষি মেরে, জামা-কাপড় ছিঁড়ে ধরাশায়ী করে ফেলা হয়। এই ঘটনায় সারা দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ ও সাধারণ মানুষ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। ড. মাহবুবউল্লাহ ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্র জীবনের যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারের সৈনিক। পাকিস্তানী শাসকদের হাতে তিনি বারবার নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার রয়েছে বিশাল অবদান। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের পর টালমাটাল সরকার তাকে কারাগারে বন্দি করে। ১৯৭১ সালের পুরো সময়টাই ইয়াহিয়া খানের রুদ্রেরোষে তিনি কারাবন্দি ছিলেন। মৃদুভাষী, সত্য প্রকাশে অকুতোভয় ড. মাহবুবউল্লাহ ন্যায়, সত্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এখনও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ষাটের দশক থেকে এই নেতা অন্যদের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। যার সঙ্গে যত রাজনৈতিক বিরোধই থাকুক না কেন ড. মাহবুবউল্লাহ কারো সম্পর্কে কোনোদিন একটি কটূক্তিও করেননি। সেটি তার স্বভাববিরুদ্ধ। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করার নীতিতে তিনি বিশ্বাসী। তাকে কেউ শারীরিকভাবে নিগ্রহ করার চিন্তা করতে পারেনÑ এ যেন ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সেটি সম্ভব হলো।
এই ঘটনার প্রতিবাদে এদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষ, নাগরিক সমাজ ধিক্কার এবং জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এরকম দাবি সরকারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে এবং তারা একেবারে ভদ্র-সভ্য হয়ে যাবেন, সত্যি সত্যি জড়িতদের গ্রেফতারে উদ্যোগী হবেনÑ এমনটি কেউ আশা করেন না। আসলে তা ঘটেওনি। এদেশে নাকি সুশীল সমাজ আছে। সুশীলদের পত্র-পত্রিকাও আছে। তারা স্বঘোষিত সুশীল। এই সুশীলরাও যখন ধারাবাহিকভাবে বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন, সরকারি নিগ্রহের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, তখন আমরা যারা অসুশীল কিংবা সুশীল কাতারে তালিকাভুক্ত নই, তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছি। আমাদের মতো অসুশীলদের নীতি এই যে, তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল না থাকতে পারে, দুই মতের দূরত্ব যোজন যোজন হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনভাবে তোমার মত প্রকাশের জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।
কিন্তু সুশীল সংবাদপত্রগুলোর কাছ থেকে কিংবা স্বঘোষিত সুশীল সমাজের কাছ থেকে আমরা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই পেলাম না। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায় স্থির হয়ে রইলো। কেউ কেউ ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর হামলার ঘটনা এমনভাবে প্রকাশ করলো যে, তিনি যেন জাতীয় পর্যায়ের কোনো বুদ্ধিজীবীই নন। কেউ কেউ লিখলেন, তিনি বিএনপি ঘরানা বা বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী মাত্র। মনে হলো, এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ড. মাহবুবউল্লাহ এক অচেনা মুখ। ‘বিএনপি-ঘেঁষা’ বুদ্ধিজীবী এটিই তার একমাত্র পরিচয়। অতএব তার ওপর হামলা যেন একেবারেই যৌক্তিক। এ হামলার প্রতিবাদে সমাজের ভেতরে যে উত্তাপ সে উত্তাপ এই সুশীলদের স্পর্শ করে না। করেনি। কিন্তু তারা যখন হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন, তখন মাহবুবউল্লাহ মতো ব্যক্তিরা উপযাজক হয়েই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কারণ অন্যকিছু নয়, মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করাই তার লক্ষ্য।
এদেশে গণতন্ত্রের যে আলোকবর্তিকা পুনরায় প্রজ্বলিত হয়েছে ১৯৯১ সাল থেকে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তা ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন থেকেই সে মশাল পিদিমে রূপ লাভ করতে থাকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সে শিখা এখন নিবন্তপ্রায়। গণতন্ত্র তিরোহিত হয়ে গেছে। অনির্বাচিত সরকার ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। মামলা, হামলা, গুম, খুন, নির্যাতন এখন ক্ষমতা জবরদখলকারীদের ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এখানে ভিন্নমত গায়ের জোরে পদদলিত হচ্ছে। ভিন্নমত দলনের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন আইনপ্রণয়ন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জন-আকাক্সক্ষার মোটেও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। সরকারের কৌশল জনগণকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার কৌশল।
আর সে কারণে প্রশাসন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ সর্বত্র নির্লজ্জ দলীয়করণ হচ্ছে। মেধা বা যোগ্যতার কোনো মূল্যই দেয়া হচ্ছে না। তার পরিণতি কী হতে পারে তার কিছু কিছু উদাহরণ এখন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। দলীয় বিবেচনায় এক ছাত্রলীগ নেতা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দলীয় বিবেচনায়ই তাকে সুবিধাজনক পদে বদলি করে নিয়ে আসা হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা কী দেখলাম! এই শিক্ষক ছাত্রলীগের আর এক পিস্তলবাজের কাছ থেকে বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মনে হয় দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। সব ছাত্রলীগার শিক্ষক, পুলিশ, প্রশাসন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে হত্যার উদ্দেশ্যে। আর একজন ছাত্রলীগার, যোগ্যতা থাক বা না থাক, তাকেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে অধিকতর সন্ত্রাসী সেবার আশা নিয়ে তাকে বিসিএস ক্যাডারে চাকরি দেয়া হয়েছে। তিনিও নিচ্ছেন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। কারণ ভবিষ্যতে এদেশ থেকে বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য, তাদের গুলী করে হত্যা করার জন্য এই প্রশিক্ষণ অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আর একজন ছাত্রলীগারকে মাত্র এক বছর আগে পুলিশের এএসআই পদে চাকরি দেয়া হয়েছে। তিনি অন্য ছাত্রলীগারদের সঙ্গে মিলে রীতিমতো অস্ত্র ব্যবসা শুরু করেছেন।
আর আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, সরকার এখন পর্যন্ত এদের সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। অপরাধবোধে তাড়িত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। কথা বলেননি ফটর-ফটর আওয়ামী নেতা মাহবুবুল হক হানিফ কিংবা হাছান মাহমুদ। কালো-বেড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত ফটর-ফটরও। তিনি ড. কামালের বিরুদ্ধে বলছেন, আমীর-উল ইসলামের বিরুদ্ধে বলছেন। তাদের নানা রকম চ্যালেঞ্জ-ফ্যালেঞ্জ করছেন। কিন্তু ঐ যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ঐ যে বিসিএস ক্যাডার, ঐ যে পুলিশের এএসআই, তাদের সম্পর্কে কিছু বলেননি। শেখ হাসিনা তো নয়ই। শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত যা বলেছেন, তাতে আশা করছি, তিনি ভবিষ্যতে হয়তো বলবেন যে, বিএনপি-জামায়াতের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভবিষ্যতে তাদের অস্ত্র চালাতে হতে পারে। সে কারণেই তারা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। আর পুলিশের এএসআই এমন কোনো দোষের কাজ করেননি। আত্মরক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে যদি অস্ত্র বিতরণের বাণিজ্যিক উদ্যোগ সে নিয়ে থাকে, তবে খারাপ কী করেছে? তিনি এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো কথা বলেননি। তবে বলবেন না যে এমন কথা বলা যায় না।
আওয়ামী সন্ত্রাসীরা শিক্ষকদের ওপর এই প্রথম হামলা চালালো এমন নয়; এর আগেও তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বহু শিক্ষককে পিটিয়েছে, অবরুদ্ধ ও বন্দি করে রেখেছে। কখনও কখনও এদেরকে লোক দেখানোর জন্য অল্প সময়ের জন্য বহিষ্কারও করা হয়েছে। তারপর তাদের ওপর আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তখন নতুন দানব হিসেবে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে। ক্ষমতা জবরদখলকারী সরকার তাতে ধারাবাহিকভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। আর সে কারণেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তি ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর তারা এই হামলা করতে সাহস পেয়েছে।
আর হামলাটি হলো কোথায়? খোদ সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে, যেখানে ডিবি, পুলিশ, এসবি গিজগিজ করে ঠিক সে রকম একটা ‘পবিত্র অঙ্গনে।’ এতসব বাহিনীর কেউই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে পারলো না। এরকম একটি বর্বর পৈশাচিক হামলা শেষে তারা নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দিতে পারলো, এও কি বিশ্বাসযোগ্য? নাকি সরকারের ছত্রছায়ায় তাদের গা ঢাকা দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো? এই প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। সরকার হয়তো ভেবেছে, এভাবে একের পর এক সরকারের সমালোচক বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা চালিয়ে তারা জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিবে। এ ধরনের ঘটনাও এখন শুরু হয়নি। এর আগে ভিন্ন মতের জন্য অপেক্ষাকৃত তরুণ দুই শিক্ষক ড. পিয়াস করিম ও ড. আসিফ নজরুল প্রায় একই রকম নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এবারে ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর হামলা চালিয়ে অন্যদেরও সর্তক করে দেয়া হলো যে, সরকারের সমালোচনায় সাবধান। পরিণতি ভয়াবহ হবে। কিন্তু আকাশে যখন চাঁদ ওঠে তখন জোয়ারের জল রোধ করা যায় না।
ফ্যাসিস সরকার যখন একেবারেই নিরূপায় হয়ে যায়, যখন চারদিকে অন্ধকার দেখে, তখনই তারা বুদ্ধিজীবীদের ওপর এ ধরনের হামলা পরিচালনা করে। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের আচরণ একই রকম। এমনকি বাংলাদেশেও। ইয়াহিয়া সরকার যখন বুঝতে পারলো যে, তাদের পতন অনিবার্য। তখনই তারা বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান যখন বুঝতে পেরেছিলেন, সময় শেষ হয়ে আসছে, তখন তিনি ভিন্নমতের সব বুদ্ধিজীবীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন শুরু করেন। পত্রিকা বন্ধ করা। কারারুদ্ধ করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা। এর সবই ছিল তার অন্তর্গত। এর সবই ছিল শেখ মুজিব সরকারের পতনের ঘণ্টা। ড. মাহ্বুবউল্লাহর ওপর হামলায় প্রমাণিত হলো যে, সরকারের পতন ঘণ্টা বেজে উঠেছে। কান পাতলেই শোনা যায়।
যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ষাটের দশক থেকে এই নেতা অন্যদের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। যার সঙ্গে যত রাজনৈতিক বিরোধই থাকুক না কেন ড. মাহবুবউল্লাহ কারো সম্পর্কে কোনোদিন একটি কটূক্তিও করেননি। সেটি তার স্বভাববিরুদ্ধ। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করার নীতিতে তিনি বিশ্বাসী। তাকে কেউ শারীরিকভাবে নিগ্রহ করার চিন্তা করতে পারেনÑ এ যেন ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু এই ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সেটি সম্ভব হলো।
এই ঘটনার প্রতিবাদে এদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষ, নাগরিক সমাজ ধিক্কার এবং জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এরকম দাবি সরকারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে এবং তারা একেবারে ভদ্র-সভ্য হয়ে যাবেন, সত্যি সত্যি জড়িতদের গ্রেফতারে উদ্যোগী হবেনÑ এমনটি কেউ আশা করেন না। আসলে তা ঘটেওনি। এদেশে নাকি সুশীল সমাজ আছে। সুশীলদের পত্র-পত্রিকাও আছে। তারা স্বঘোষিত সুশীল। এই সুশীলরাও যখন ধারাবাহিকভাবে বিপদের মুখোমুখি হয়েছেন, সরকারি নিগ্রহের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন, তখন আমরা যারা অসুশীল কিংবা সুশীল কাতারে তালিকাভুক্ত নই, তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছি। আমাদের মতো অসুশীলদের নীতি এই যে, তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল না থাকতে পারে, দুই মতের দূরত্ব যোজন যোজন হতে পারে, কিন্তু স্বাধীনভাবে তোমার মত প্রকাশের জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।
কিন্তু সুশীল সংবাদপত্রগুলোর কাছ থেকে কিংবা স্বঘোষিত সুশীল সমাজের কাছ থেকে আমরা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই পেলাম না। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায় স্থির হয়ে রইলো। কেউ কেউ ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর হামলার ঘটনা এমনভাবে প্রকাশ করলো যে, তিনি যেন জাতীয় পর্যায়ের কোনো বুদ্ধিজীবীই নন। কেউ কেউ লিখলেন, তিনি বিএনপি ঘরানা বা বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী মাত্র। মনে হলো, এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে ড. মাহবুবউল্লাহ এক অচেনা মুখ। ‘বিএনপি-ঘেঁষা’ বুদ্ধিজীবী এটিই তার একমাত্র পরিচয়। অতএব তার ওপর হামলা যেন একেবারেই যৌক্তিক। এ হামলার প্রতিবাদে সমাজের ভেতরে যে উত্তাপ সে উত্তাপ এই সুশীলদের স্পর্শ করে না। করেনি। কিন্তু তারা যখন হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন, তখন মাহবুবউল্লাহ মতো ব্যক্তিরা উপযাজক হয়েই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কারণ অন্যকিছু নয়, মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করাই তার লক্ষ্য।
এদেশে গণতন্ত্রের যে আলোকবর্তিকা পুনরায় প্রজ্বলিত হয়েছে ১৯৯১ সাল থেকে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তা ক্রমেই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন থেকেই সে মশাল পিদিমে রূপ লাভ করতে থাকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সে শিখা এখন নিবন্তপ্রায়। গণতন্ত্র তিরোহিত হয়ে গেছে। অনির্বাচিত সরকার ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। মামলা, হামলা, গুম, খুন, নির্যাতন এখন ক্ষমতা জবরদখলকারীদের ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এখানে ভিন্নমত গায়ের জোরে পদদলিত হচ্ছে। ভিন্নমত দলনের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন আইনপ্রণয়ন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জন-আকাক্সক্ষার মোটেও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। সরকারের কৌশল জনগণকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার কৌশল।
আর সে কারণে প্রশাসন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ সর্বত্র নির্লজ্জ দলীয়করণ হচ্ছে। মেধা বা যোগ্যতার কোনো মূল্যই দেয়া হচ্ছে না। তার পরিণতি কী হতে পারে তার কিছু কিছু উদাহরণ এখন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। দলীয় বিবেচনায় এক ছাত্রলীগ নেতা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দলীয় বিবেচনায়ই তাকে সুবিধাজনক পদে বদলি করে নিয়ে আসা হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা কী দেখলাম! এই শিক্ষক ছাত্রলীগের আর এক পিস্তলবাজের কাছ থেকে বন্দুক চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মনে হয় দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। সব ছাত্রলীগার শিক্ষক, পুলিশ, প্রশাসন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে হত্যার উদ্দেশ্যে। আর একজন ছাত্রলীগার, যোগ্যতা থাক বা না থাক, তাকেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে অধিকতর সন্ত্রাসী সেবার আশা নিয়ে তাকে বিসিএস ক্যাডারে চাকরি দেয়া হয়েছে। তিনিও নিচ্ছেন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। কারণ ভবিষ্যতে এদেশ থেকে বিএনপি-জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য, তাদের গুলী করে হত্যা করার জন্য এই প্রশিক্ষণ অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আর একজন ছাত্রলীগারকে মাত্র এক বছর আগে পুলিশের এএসআই পদে চাকরি দেয়া হয়েছে। তিনি অন্য ছাত্রলীগারদের সঙ্গে মিলে রীতিমতো অস্ত্র ব্যবসা শুরু করেছেন।
আর আশ্চর্যের ঘটনা এই যে, সরকার এখন পর্যন্ত এদের সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। অপরাধবোধে তাড়িত সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। কথা বলেননি ফটর-ফটর আওয়ামী নেতা মাহবুবুল হক হানিফ কিংবা হাছান মাহমুদ। কালো-বেড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত ফটর-ফটরও। তিনি ড. কামালের বিরুদ্ধে বলছেন, আমীর-উল ইসলামের বিরুদ্ধে বলছেন। তাদের নানা রকম চ্যালেঞ্জ-ফ্যালেঞ্জ করছেন। কিন্তু ঐ যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ঐ যে বিসিএস ক্যাডার, ঐ যে পুলিশের এএসআই, তাদের সম্পর্কে কিছু বলেননি। শেখ হাসিনা তো নয়ই। শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত যা বলেছেন, তাতে আশা করছি, তিনি ভবিষ্যতে হয়তো বলবেন যে, বিএনপি-জামায়াতের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভবিষ্যতে তাদের অস্ত্র চালাতে হতে পারে। সে কারণেই তারা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। আর পুলিশের এএসআই এমন কোনো দোষের কাজ করেননি। আত্মরক্ষার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে যদি অস্ত্র বিতরণের বাণিজ্যিক উদ্যোগ সে নিয়ে থাকে, তবে খারাপ কী করেছে? তিনি এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো কথা বলেননি। তবে বলবেন না যে এমন কথা বলা যায় না।
আওয়ামী সন্ত্রাসীরা শিক্ষকদের ওপর এই প্রথম হামলা চালালো এমন নয়; এর আগেও তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বহু শিক্ষককে পিটিয়েছে, অবরুদ্ধ ও বন্দি করে রেখেছে। কখনও কখনও এদেরকে লোক দেখানোর জন্য অল্প সময়ের জন্য বহিষ্কারও করা হয়েছে। তারপর তাদের ওপর আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তখন নতুন দানব হিসেবে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে। ক্ষমতা জবরদখলকারী সরকার তাতে ধারাবাহিকভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। আর সে কারণেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তি ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর তারা এই হামলা করতে সাহস পেয়েছে।
আর হামলাটি হলো কোথায়? খোদ সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে, যেখানে ডিবি, পুলিশ, এসবি গিজগিজ করে ঠিক সে রকম একটা ‘পবিত্র অঙ্গনে।’ এতসব বাহিনীর কেউই সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে পারলো না। এরকম একটি বর্বর পৈশাচিক হামলা শেষে তারা নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দিতে পারলো, এও কি বিশ্বাসযোগ্য? নাকি সরকারের ছত্রছায়ায় তাদের গা ঢাকা দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো? এই প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। সরকার হয়তো ভেবেছে, এভাবে একের পর এক সরকারের সমালোচক বুদ্ধিজীবীদের ওপর হামলা চালিয়ে তারা জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিবে। এ ধরনের ঘটনাও এখন শুরু হয়নি। এর আগে ভিন্ন মতের জন্য অপেক্ষাকৃত তরুণ দুই শিক্ষক ড. পিয়াস করিম ও ড. আসিফ নজরুল প্রায় একই রকম নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এবারে ড. মাহবুবউল্লাহর ওপর হামলা চালিয়ে অন্যদেরও সর্তক করে দেয়া হলো যে, সরকারের সমালোচনায় সাবধান। পরিণতি ভয়াবহ হবে। কিন্তু আকাশে যখন চাঁদ ওঠে তখন জোয়ারের জল রোধ করা যায় না।
ফ্যাসিস সরকার যখন একেবারেই নিরূপায় হয়ে যায়, যখন চারদিকে অন্ধকার দেখে, তখনই তারা বুদ্ধিজীবীদের ওপর এ ধরনের হামলা পরিচালনা করে। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের আচরণ একই রকম। এমনকি বাংলাদেশেও। ইয়াহিয়া সরকার যখন বুঝতে পারলো যে, তাদের পতন অনিবার্য। তখনই তারা বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান যখন বুঝতে পেরেছিলেন, সময় শেষ হয়ে আসছে, তখন তিনি ভিন্নমতের সব বুদ্ধিজীবীদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন শুরু করেন। পত্রিকা বন্ধ করা। কারারুদ্ধ করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা। এর সবই ছিল তার অন্তর্গত। এর সবই ছিল শেখ মুজিব সরকারের পতনের ঘণ্টা। ড. মাহ্বুবউল্লাহর ওপর হামলায় প্রমাণিত হলো যে, সরকারের পতন ঘণ্টা বেজে উঠেছে। কান পাতলেই শোনা যায়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন