কোনো দিবস পালনের কথায় মানুষ সাধারণত উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, এর মধ্যে আনন্দ খুঁজতে চায়। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে গত ৩০ আগস্ট। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী সারাবিশ্বে দিনটি ‘আন্তর্জাতিক গুম দিবস’ হিসেবে পালিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট সেদিন গুম বিরোধী মানববন্ধনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। অন্যদিকে একইদিন প্রধানমন্ত্রী জনসভা করবেন বলে পুলিশ মানববন্ধনের অনুমতি দেয়নি। সে কারণে ৩০ আগস্টের পরিবর্তে ২০ দলকে মানববন্ধন করতে হয়েছে ২ সেপ্টেম্বর। জনগণ অবশ্য কষেই জবাব দিয়েছে সরকারকে। কাকরাইলের মোড় থেকে ফকিরেরপুল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে। হাতে হাত মিলিয়ে তারা গুম ও গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে, গুম হয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। আর যেন কোনো মানুষকে গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার না হতে হয় সে দাবিও তুলেছে মিলিত কণ্ঠে। ২০ দলীয় জোটের নেতাদের ভাষণেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে জনগণের দাবি। তারা বলেছেন, ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আগত এ অবৈধ সরকার বিরোধী দলকে দমন ও স্তব্ধ করার জন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকে দিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। এসব বাহিনীকে নিজেদের গদি রক্ষার কাজে ব্যবহার করছে। গুম, খুন ও অপহরণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করছে। এর ফলে সারাদেশে সন্ত্রাসের এক ভীতিকর রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সরকার ভীতি সঞ্চার করতে চায় যাতে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সাহস না পায়। সরকারকে সতর্ক করতে গিয়ে নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, জনগণ আর কোনো গুম, খুন ও অপহরণ সহ্য করবে না। নেতারা একই সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, নীরবে বসে থেকে গুম, খুন ও অপহরণ দেখার আর কোনো সময় নেই। প্রতিরোধের আন্দোলনে জনগণকে অংশ নিতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেয়ার দাবি মানতেও সরকারকে বাধ্য করতে হবে। অন্য একটি বিশেষ কারণেও ২০ দলের এ মানববন্ধন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর ছেলেসহ গুম হয়ে যাওয়া আরো অনেক নেতা-কর্মীর স্বজনরা এতে অংশ নিয়েছেন। দাবি জানিয়েছেন স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। কেউ কেউ এমনকি শুধু লাশ ফিরিয়ে দেয়ার জন্যও আকুতি জানিয়েছেন। স্বজনহারাদের এই আকুতি শুনে চোখে পানি এসে গেছে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী মানুষের। এভাবে সব মিলিয়েই কর্মসূচিটি সত্যিকারের মানববন্ধনে পরিণত হয়েছিল।
বিশ্বের সব দেশেই গুম ও গুপ্তহত্যার মতো বিচারবহির্ভূত কর্মকা-কে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে এবং অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে দেখা হয়। গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গুম করা হবে এবং পরে এখানে সেখানে তাদের লাশ পাওয়া যাবে এমন অবস্থা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনস্থ হয়ে পড়া বাংলাদেশে গুম শুধু হচ্ছেই না, কখনো কখনো গুমের রীতিমতো ধুমও পড়ে যাচ্ছে। অনেকের এমনকি খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও এখনো ইলিয়াস আলীর কোনো খোঁজ মেলেনি। সরকারকেও বিশ্বাসযোগ্য তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি। গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমসহ রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের আরো অনেক নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন। আমিনুল ইসলামের লাশ তবু টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে পাওয়া গিয়েছিল। আরো অনেকের লাশও দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী বা খালের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু চৌধুরী আলমের মতো অধিকাংশেরই এখনো কোনো খবর নেই। কথা শুধু এটুকুই নয়। দায়িত্ব যেখানে ছিল গুম-খুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, সরকার সেখানে এ সংক্রান্ত খবর যাতে প্রকাশিত না হতে পারে সে ব্যাপারেই বেশি তৎপরতা দেখিয়ে চলেছে।
আমরা মনে করি, কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টা চালানোর পরিবর্তে উচিত গুম ও গুপ্তহত্যার মতো ভয়ংকর অপরাধ বন্ধের দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশই বিভিন্ন সময়ে গুম-খুনের কঠোর বিরোধিতা করেছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম এবং গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-কে এসব দেশ তো বাংলাদেশ বিরোধী একটি প্রধান ইস্যুই বানিয়ে ছেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার পেছনেও রয়েছে একই কারণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে জানিয়ে দিয়েছে, ইলিয়াস আলীর গুম এবং আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রফতানির মতো অনেক সুবিধা হারিয়ে ফেলবে। আমরা মনে করি, বিদেশিদের হুমকির কারণে শুধু নয়, দেশের ভেতরে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও গুম ও গুপ্তহত্যা বন্ধে সরকারের উচিত কঠোর অবস্থান নেয়া। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, গুম, খুন ও অপহরণের পেছনে সরকারের ইন্ধন ও ভূমিকার বিষয়টিও কারো কাছে আর গোপন নেই। সুতরাং সতর্ক হওয়া উচিত এখনই। একই সঙ্গে সরকারের উচিত নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা, যাতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রধান দলগুলো অংশ নিতে পারে। যাতে ‘নির্বাচিত’ সরকারকে বৈধতার সংকটে না পড়তে হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন