মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

জাতীয় পার্টির অন্তিম সময়

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি কখন কী সিদ্ধান্ত নেয় তা অনুমান করা কঠিন। জাতীয় পার্টির প্রকৃত নেতৃত্ব কার হাতে তা বোঝাও দুষ্কর। আসলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বহু ভাগে জাতীয় পার্টি এখন অন্তিম সময় অতিক্রম করছে। জাতীয় সংসদে এই দলের অবস্থান বিরোধী দল। আবার দলের দুইজন মন্ত্রী সরকারে রয়েছে। ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করার জন্য দলের আরো কয়েকজন মন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা-তদবিরে আছেন। এর মধ্যে বিরোধী দলের উপনেতা হওয়া নিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে বিরোধ এখন তুঙ্গে। দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আর সংসদে বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদের মধ্যে লড়াই অনেক আগেই প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। যারা এক সময় রওশনের পক্ষ নিয়ে এরশাদকে কুপোকাত করেছিলেন, তারা আবার এরশাদের দলে যোগ দিয়েছেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে রওশনের পাল্লা ভারী। 
রওশনের অনুগত হাফমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা দলের মহাসচিব জিয়া উদ্দিন বাবলুর চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। বলছেন, টাকা দিয়ে দল চালাই। মহাসচিব হয়ে যা ইচ্ছে তাই করছেন। সহ্য করা হবে না। এর আগে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান একটি টেলিভিশন টকশোতে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টর রফিকুল ইসলাম মিয়ার চোখ তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। রাঙ্গা হয়তো তার কেবিনেটের এই সিনিয়র মন্ত্রীর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি সংসদ ভবনে তার দলের নেতার চোখ তোলার হুমকি দিয়েছেন। চোখ তুলে নেয়ার মতো ক্ষমতাবান মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়ছে।
একসময় রাঙ্গার মতো জিয়াউদ্দিন বাবলু ছিলেন রওশনের ঘনিষ্ঠ। এখন তিনি এরশাদের ঘনিষ্ঠ। রওশনের বলয় থেকে ছিটকে পড়েছেন। কারণ রওশন চান কাজী ফিরোজ রশীদ হবে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা। তার সমর্থনে বিরোধী দলের নেতা স্পিকারকে চিঠিও দিয়েছেন; কিন্তু এরশাদ তাতে রাজি নন। বাবলুও চান না ফিরোজ রশীদ উপনেতা হোক।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এরশাদের অবস্থানের বিপক্ষে ছিলেন বাবলু। তিনি এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নির্বাচনে যাওয়ার জন্য এরশাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। রওশনকে জাতীয় পার্টির প্রধান করে নির্বাচনে গিয়েছিলেন। এরশাদকে পাঠানো হয়েছিল হাসপাতালে। এই নির্বাচনে যাওয়ার ঘটনা কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির আরেক নেতা এরশাদের ভাই জি এম কাদেরের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবলু। জি এম কাদের এখন অনেকটাই নিশ্চুপ। কার্যত জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব বানিয়েছিলেন রওশন এরশাদ; কিন্তু নির্বাচনের পর আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর রাঙ্গা মন্ত্রী হলেও তার ভাগ্যে কিছ্ইু জোটেনি। আফটার অল কিছু একটা পাওয়ার জন্যই তো রাজনীতি। এত কাঠখড় পুড়িয়ে খোদ এরশাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি মন্ত্রী হতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত উপনেতার পদটিও চলে যাচ্ছে ফিরোজ রশীদের হাতে। ক্ষোভে বাবলু বেরিয়ে এলেন রওশন বলয় থেকে। যোগ দিলেন এরশাদের সাথে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ যেমন একেক সময় একেক কথা বলে চমকে দেন, তেমনি তার পার্টির ভেতরের রাজনীতি কম উপভোগ্য নয়। 
উপনেতার পদ নিয়ে এই বিরোধের সাথে যোগ হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রকৃত বিরোধী দল হওয়া নিয়ে বিরোধ। এরশাদ চান দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করে জাতীয় পার্টি প্রকৃত বিরোধী দলের অভিনয়টা অন্তত করুক; কিন্তু মন্ত্রীরা কেউ-ই পদত্যাগ করতে রাজি নন। বরং তারা উল্টো প্রশ্ন তুলেছেন, এরশাদ নিজেও তো সরকারের মন্ত্রী। তিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত। পদত্যাগ করলে তো তাকেও করতে হয়। এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন এরশাদ। সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলও চায় না জাতীয় পার্টির দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করুক। কারণ এরশাদের কথার কোনো বিশ্বাস নেই। কখন কী করে বসেন। আসলে জাতীয় পার্টির মূল রশি প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি রশি টান দিলে এরশাদ চেষ্টা করেও দলকে আর তার অনুগত করতে পারবেন না। কারণ রওশন আর জাপার দুই মন্ত্রী কখনো মন্ত্রিত্ব ছাড়বেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা তো প্রধানমন্ত্রীর অধীন। 
শেষ পর্যন্ত তথাকথিত বিরোধী দলের ঘরের ভেতরের বিরোধ মীমাংসার জন্য সবাই প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন। এরশাদ এবং রাঙ্গা দুপক্ষই প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী নন, সংসদের বিরোধী দলের নীতিনির্ধারকও বটে। এমন শান্তিপূর্ণ বিরোধী দল দুনিয়ার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিরোধী দলের কোন্দল থামানোর জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন এমন নজির বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। জাতীয় পার্টি এ দেশের রাজনীতিতেও বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কে বলেছে বাঙালি কলহপ্রিয় জাতি! ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মধ্যে এমন বন্ধুত্ব যে দেশে সম্ভব, সে দেশের রাজনীতিতে কোনো দ্বন্দ্ববিবাদ বা সঙ্ঘাত থাকতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা সৃষ্টির জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ইতিহাসে অন্যভাবে লেখা থাকবে। এই বিরোধ মীমাংসায় প্রধানমন্ত্রী কী পরামর্শ দিয়েছেন সে তথ্য জানা যায়নি। তিনি উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনেছেন; কিন্তু তিনি কোনো সমাধান দেবেন বলে মনে হয় না। কারণ সমাধান যদি তিনি দিয়েই দেন, তাহলে তো আর রাজনীতি জমে না। 
জাতীয় পার্টির দ্বন্দ্ব মেটানোর জন্য দুই পক্ষের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বেশ উপভোগ করছেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৮৬ ও ৮৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরি করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার কৌশল নিয়েছিলেন। ৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের অংশগ্রহণ এরশাদের ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করেছিল। পরে ৮৮-এর নির্বাচনে জামায়াত-আওয়ামী লীগ যোগ না দিলেও অজ্ঞাত পরিচয় ৭৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে সংসদে গৃহপালিত বিরোধী দল তৈরি করেছিলেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস এরশাদের দল এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দল। আর সেই বিরোধী দলের নেতা এরশাদ না তার বিবি রওশন হবেন, তা নিয়েই আসলে লড়াই। এই লড়াইয়ে এরশাদ বারবার হেরে যাচ্ছেন। কারণ দলের মূল প্রাণভোমরা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। আর তিনি রয়েছেন রওশনের পক্ষে। ফলে এরশাদ যত কথাই বলুক, জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ এখন কোনোভাবেই তিনি আর পাবেন না। 
ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকা বহু ভাগে বিভক্ত জাতীয় পার্টির বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর কোনো ভবিষ্যৎ আছে বলে কেউ মনে করেন না। দলের নেতারাও তা ভালো করেই জানেন। ফলে ব্যক্তিগতভাবে কে কতটা সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন এখন সেই প্রতিযোগিতা চলছে। অপর দিকে ক্ষমতাসীনেরা এটা ভালো করেই জানেন, শুধু জাতীয় পার্টি নয়, যত বেশি দলকে সাথে রাখতে পারবেন তত লাভ। কারণ এই সরকার যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, তাতে জনগণের কোনো সমর্থন নেই। জনসমর্থনহীন সরকারের রাজনৈতিক সহযোগী যত বাড়বে দায়দায়িত্বের চাপ কিছুটা হলেও কমবে। এ কারণে এ ধরনের সরকারে ছোট দলের নেতারা বড় মন্ত্রী হয়ে যান। তাদের সব সময় সরব রাখা হয়। জনগণের দৃষ্টি এদের দিকে থাকে। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়েও সরকার একই কৌশল নিয়েছে। 
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক গুরুত্ব এখন নেই বললেই চলে। বহু আগেই জাতীয় পার্টি বৃহত্তর রংপুরকেন্দ্রিক একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। গত উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, রংপুর অঞ্চলেও জাতীয় পার্টির ভিত ধসে পড়েছে। বৃহত্তর রংপুরে মাত্র দুটি উপজেলায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে একজন আবার কাজী জাফর আহমদের সমর্থক। রংপুর অঞ্চলে বেশির ভাগ উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। কিছু কিছু স্থানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীও বিজয়ী হয়েছেন। ফলে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক শক্তি বেড়েছে। এর বড় কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে আন্দোলনের সুফল দল দুটি পেয়েছে। অন্য এলাকার মতো উত্তরাঞ্চলের মানুষ এই নির্বাচন বর্জন করেছিল। বরং অন্যান্য এলাকার চেয়েও উত্তরাঞ্চলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। ফলে সরকারের সহযোগী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সাধারণ মানুষের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। এর মধ্যে এরশাদের একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্যে সাধারণ মানুষ শুধু বিরক্ত নন, তিনি হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন। এতদিন নির্বাচনের আগে এরশাদ প্রচারণা চালাতেন তাকে যদি বিজয়ী করা না হয় তাহলে তাকে জেলে রাখা হবেÑ এমনকি ফাঁসি দেয়াও হতে পারে। এসব যে এরশাদের ভোট পাওয়ার আবেগি বক্তব্য তা মানুষ এখন বুঝে গেছে। ফলে এরশাদের বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে মানুষ জাতীয় পার্টিতে ভোট দেবে, এমন দিন শেষ হয়ে গেছে। 
আগেই বলেছি, জাতীয় পার্টি  অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আসলে দলটি চূড়ান্ত বিলুপ্তির পথে রয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে দলটির এমন পরিণতি হবে তা হয়তো এরশাদ খানিকটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ কারণে সে সময় তিনি হয়তো ভিন্ন অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু দলটির ভেতরের ক্ষমতালোভী অংশটি আগেই সরকারের সাথে যোগসাজশ করে এরশাদকেই দল থেকে আউট করে দিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে মহাজোট থেকে এরশাদের ছুটে যাওয়ার চেষ্টা নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীনেরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এ জন্য এরশাদকে যে চড়া মূল্য দিতে হবে তা সে সময়ই বোঝা গিয়েছিল। এরশাদকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা ভালো করেই জানে ক্ষমতাসীনেরা। কারণ আওয়ামী লীগের সাথে এরশাদের সম্পর্ক আজকের নয়, অনেক পুরনো। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এরশাদকে যেমন ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে সমর্থন জুগিয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে এরশাদের সমর্থন নিয়ে। ফলে এরশাদের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি প্রধানমন্ত্রী খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারেন।
এরশাদের ছুটে যাওয়ার পথ বন্ধ করতে ক্ষমতাসীনেরা খুব ভালোভাবেই জাতীয় পার্টির মধ্যে নানা ধরনের উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ফলে এরশাদকে সব সময় দলের মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে থাকতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করতেই হবে যে, এরশাদের মতো একজন ধূর্ত রাজনীতিককে তিনি তার আঁচলের সাথে এমন এক গিট্টু লাগিয়ে দিয়েছেন, যা আর কখনোই খুলতে পারবেন না। এই গিট্টু খুলতে গেলে তা গলায় ফাঁস হিসেবে লেগে যাচ্ছে। আর এই ফাঁস থেকে জাতীয় পার্টির মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। 
আলফাজ আনাম


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads