এক
আজকে আমার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের একটি খণ্ড চিত্র তুলে ধরার কথা ছিল কিন্তু প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও টিভি টকশোর নন্দিত ব্যক্তিত্ব ড. মাহবুব উল্লাহর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আমি এতোই মর্মাহত হয়ে পড়েছি যে, এ দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হবার মতো এমন কিছু আমার সামনে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। মর্মাহত হবার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ড. মাহবুব উল্লাহ অখ্যাত বা কুখ্যাত কোনও ব্যক্তি নন, ষাটের দশকের অন্যতম জাঁদরেল ছাত্রনেতা, আইয়ুব ইয়াহিয়ার স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সারিরও তিনি একজন নেতা। তিনি দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদেরও অন্যতম। ড. মাহবুব যুক্তি নির্ভর একজন ব্যক্তিত্ব, ইনসাফ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে মানুষকে উজ্জীবিত করেন এবং শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তার উপর হামলা নিছক কোনও ব্যক্তির উপর হামলা নয় বরং স্বাধীনতার মৌল চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর হামলা। দুঃখের বিষয় দেশের জনগণের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাদের কেউ এ যাবত এই হামলার প্রেক্ষিতে নিন্দা তো দূরের কথা, সামান্যতম দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতিও প্রকাশ করেননি। ড. মাহবুব উল্লাহ হাসপাতালে আছেন, তার খোঁজ-খবরও তারা নেননি। আবার ঘটনাটি এমন এক স্থানে ঘটেছে যার পবিত্রতা ও নিরাপত্তা অলংঘনীয় থাকার কথা। সুপ্রিম কোর্ট চত্বর, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের অঙ্গন। এখানে মানুষ ইনসাফ ও নিরাপত্তার জন্য আসে। ঐ রকম একটি স্থানে একটি আলোচনা সভা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হন, তারা তাকে মারধর-অপদস্থ করে নিরাপদে সরে যায়। পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার ছিল। সরকারের ভূমিকা এখানে প্রশ্নবোধক। ড. মাহবুব উল্লাহর প্রতি সহানুভূতি জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমি বিস্মিত হই, স্বৈরাচারী পাকিস্তান আমল এবং পরাধীন বৃটিশ আমল থেকেও আমাদের অবস্থার এতো অবনতি ঘটলো যে আমরা আমাদের সমস্ত মূল্যবোধ হারিয়ে ফেললাম; ক্ষমতা, অর্থ-বিত্তই আমাদের জন্য মুখ্য হয়ে উঠলো। এর নাম কি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র?
দুই
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পাঁচটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ১। সরকার ব্যবস্থার ধরন প্রকৃতি নির্ধারণে ব্যক্তির অপরিহার্য ভূমিকা আছে। যে সংসদ অথবা বিধান সভা আইন প্রণয়ন ও ব্যস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাতে প্রতিনিধি নির্বাচনে তার অলংঘনীয় অধিকার রয়েছে। একই সাথে তিনি তার বিদ্যমান প্রতিনিধির উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে পরবর্তী নির্বাচনে নতুন লোককে যেমন প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন তেমনি বর্তমান প্রতিনিধির উপর আস্থা অব্যাহত রাখার অধিকারও তিনি সংরক্ষণ করেন। এই সুযোগ কতিপয় তাৎপর্য মণ্ডিত:
ক) সমাজের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে ভোটারের দায়বদ্ধতা অস্বীকার্য।
খ) নাগরিক দায়িত্ব পালন এবং ভোটার হিসেবে বিচার-বিবেচনা করে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মানের শিক্ষা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এই শিক্ষা মূল্যবোধের এবং মানবিক গুণাবলী বিকাশের শিক্ষাকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা বালুর উপর প্রাসাদ নির্মাণের মতো। যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও শিক্ষাঙ্গনকে অস্ত্রাগারে পরিণত করেন তাদের দ্বারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
গ) গণতন্ত্র তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে এবং ভুল-ভ্রান্তিই হচ্ছে তার শিক্ষক।
২। গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যার অধীনে একজন নারী বা পুরুষ ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি ও তাদের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পান। গণতন্ত্র প্রকৃতিগতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ; এই পদ্ধতির সাথে অন্য কোনো পদ্ধতির জোড়াতালি দেয়া যায় না। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের প্রধান ড. সিএইচ নর্থকটের ভাষায়, “It is more a leaven revealing itself by developing a situation. It is a dynamic experimental factor, which, once started, goes on yeasting.”
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সমাজে তার চর্চা পরোক্ষভাবে সমাজের গতিশীলতাকে ত্বরান্বিত করে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। এর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করতে গেলে সামাজিক বিস্ফোরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
৩। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা বা নেতৃত্ব কুক্ষিগত থাকে না; তা অধস্তনদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়। এর ধরন প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নির্ণীত হয় নির্বাচনী এলাকার চাহিদার ভিত্তিতে। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, ভোটাররা যদি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ না পান তাহলে যারা শাসন ক্ষমতায় বসেন তারা প্রকৃতপক্ষেই গণবিচ্ছিন্ন। তারা গণতন্ত্র দিতে পারেন না, পারেন জাতির ঘাড়ে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দিতে।
৪। গণতন্ত্রে নেতৃত্ব হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজকে বিশেষ পরিস্থিতি অথবা পারস্পরিকভাবে স্বীকৃত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেয়ার সামর্থ্য ও ক্ষমতা, জনগণের ইচ্ছা ও অধিকারের পরিপন্থী কোনও কিছু করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেতা বা নেত্রীর নেই। তার অনুসারীরা তার সমালোচনা করার পূর্ণাঙ্গ অধিকার ভোগ করেন।
৫। যেখানে নিয়ন্ত্রণ নৈর্ব্যক্তিক এবং আইনের নির্ধারিত পন্থায় প্রয়োগ করা হয় সেখানে গণতন্ত্র মানেই বিকল্প পথ ও পুনর্বিবেচনার অধিকার যার মূল শিকড় মানুষের স্বাধীন সত্তার মধ্যে প্রোথিত রয়েছে।
দুর্ভাগ্য বশতঃ গণতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিই এখন বাংলাদেশে নেই। এখানে স্বাধীনতা একটি বিশেষ দলের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের অর্থ-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও স্বৈরাচারের এমন একটি রূপ যাকে ফ্যাসিবাদ ছাড়া আর কোন নামেই আখ্যায়িত করা যায় না। এখানে শতফুল বিকশিত হবার কোনও সুযোগ যেমন নেই তেমনি ভিন্নমত পোষণ করা অথবা সত্য প্রকাশ করা রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ।
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পাঁচটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ১। সরকার ব্যবস্থার ধরন প্রকৃতি নির্ধারণে ব্যক্তির অপরিহার্য ভূমিকা আছে। যে সংসদ অথবা বিধান সভা আইন প্রণয়ন ও ব্যস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাতে প্রতিনিধি নির্বাচনে তার অলংঘনীয় অধিকার রয়েছে। একই সাথে তিনি তার বিদ্যমান প্রতিনিধির উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে পরবর্তী নির্বাচনে নতুন লোককে যেমন প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন তেমনি বর্তমান প্রতিনিধির উপর আস্থা অব্যাহত রাখার অধিকারও তিনি সংরক্ষণ করেন। এই সুযোগ কতিপয় তাৎপর্য মণ্ডিত:
ক) সমাজের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে ভোটারের দায়বদ্ধতা অস্বীকার্য।
খ) নাগরিক দায়িত্ব পালন এবং ভোটার হিসেবে বিচার-বিবেচনা করে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মানের শিক্ষা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এই শিক্ষা মূল্যবোধের এবং মানবিক গুণাবলী বিকাশের শিক্ষাকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা বালুর উপর প্রাসাদ নির্মাণের মতো। যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও শিক্ষাঙ্গনকে অস্ত্রাগারে পরিণত করেন তাদের দ্বারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
গ) গণতন্ত্র তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখে এবং ভুল-ভ্রান্তিই হচ্ছে তার শিক্ষক।
২। গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যার অধীনে একজন নারী বা পুরুষ ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি ও তাদের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা পান। গণতন্ত্র প্রকৃতিগতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ; এই পদ্ধতির সাথে অন্য কোনো পদ্ধতির জোড়াতালি দেয়া যায় না। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের প্রধান ড. সিএইচ নর্থকটের ভাষায়, “It is more a leaven revealing itself by developing a situation. It is a dynamic experimental factor, which, once started, goes on yeasting.”
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সমাজে তার চর্চা পরোক্ষভাবে সমাজের গতিশীলতাকে ত্বরান্বিত করে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। এর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করতে গেলে সামাজিক বিস্ফোরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
৩। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা বা নেতৃত্ব কুক্ষিগত থাকে না; তা অধস্তনদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়। এর ধরন প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নির্ণীত হয় নির্বাচনী এলাকার চাহিদার ভিত্তিতে। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, ভোটাররা যদি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ না পান তাহলে যারা শাসন ক্ষমতায় বসেন তারা প্রকৃতপক্ষেই গণবিচ্ছিন্ন। তারা গণতন্ত্র দিতে পারেন না, পারেন জাতির ঘাড়ে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ চাপিয়ে দিতে।
৪। গণতন্ত্রে নেতৃত্ব হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজকে বিশেষ পরিস্থিতি অথবা পারস্পরিকভাবে স্বীকৃত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেয়ার সামর্থ্য ও ক্ষমতা, জনগণের ইচ্ছা ও অধিকারের পরিপন্থী কোনও কিছু করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেতা বা নেত্রীর নেই। তার অনুসারীরা তার সমালোচনা করার পূর্ণাঙ্গ অধিকার ভোগ করেন।
৫। যেখানে নিয়ন্ত্রণ নৈর্ব্যক্তিক এবং আইনের নির্ধারিত পন্থায় প্রয়োগ করা হয় সেখানে গণতন্ত্র মানেই বিকল্প পথ ও পুনর্বিবেচনার অধিকার যার মূল শিকড় মানুষের স্বাধীন সত্তার মধ্যে প্রোথিত রয়েছে।
দুর্ভাগ্য বশতঃ গণতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিই এখন বাংলাদেশে নেই। এখানে স্বাধীনতা একটি বিশেষ দলের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের অর্থ-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও স্বৈরাচারের এমন একটি রূপ যাকে ফ্যাসিবাদ ছাড়া আর কোন নামেই আখ্যায়িত করা যায় না। এখানে শতফুল বিকশিত হবার কোনও সুযোগ যেমন নেই তেমনি ভিন্নমত পোষণ করা অথবা সত্য প্রকাশ করা রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ।
তিন.
আমার একজন জাপানী সহকর্মী ছিলেন, নাম মিনারো হরিয়ে। জাইকার একজন বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এক সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আমরা কাজ করেছি। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হচ্ছে অনন্য সম্ভাবনাময় দেশ; দেশের আধা পার্সেন্টেরও কম লোক ছাড়া আর সকলেই একই ভাষায় কথা বলে। একই পটভূমি, চাল চলন, অভ্যাস বিশ্বাসের অধিকারী। ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আকিদার ব্যবধান থাকলেও তা এত প্রকট নয়। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য যে ঐক্য এ সংহতির প্রয়োজন তার সবগুলো উপাদানই বাংলাদেশে রয়েছে। তিনি বলতেন, এই উপাদানগুলো একত্রিত করে কাজে লাগানোর জন্য যে নেতৃত্বের প্রয়োজন তার অভাবই বাংলাদেশের প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় যে সমস্যাটি তার চোখে ধরা পড়েছিল তা হচ্ছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সব কৃতিত্ব একটি দল কর্তৃক দাবি করা এবং দলটির নেতা ও তার আত্মীয় পরিজনের নামে সব কিছুর নামকরণের প্রবণতা। এই সমস্যার একটি সমাধান অবশ্য তিনি দিয়েছিলেন এবং তা হচ্ছে দেশের নাম পরিবর্তন করে ঐ নেতার নামে নামকরণ। রসিকতার মত মনে হলেও প্রস্তাবটি মন্দ নয়।
আসলে শুধু বিদেশীরা কেন আমরাও আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু দেশকে একশ্রেণীর স্বার্থপর রাজনীতিক এবং রাজনৈতিক দল যেভাবে বিভক্ত করে ফেলেছেন এবং ফেলছেন তাতে দেশটির সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও দেশ স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ বিতর্কে লিপ্ত। কোনও বিশেষ দলের পছন্দ না হলে ব্যক্তি ও সংস্থা দেশদ্রোহী-রাজাকার-আলবদরে পরিণত হতে এখানে সময় লাগে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, উপ-প্রধান সেক্টর কমান্ডারÑ তারাও রাজাকার আল-বদর, পাকিস্তানী চর অথবা আইএসআই এর দালাল কিন্তু যে কোন সময় যুদ্ধাপরাধীতে পরিণত হতে পারেন। এই এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার দেশ। এখানে ক্ষমতার মসনদ আর জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠের দূরত্ব খুবই কম। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, এই কথাটিই অনেকেই মনে রাখেন না, যেমন ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেন না।
আমার একজন জাপানী সহকর্মী ছিলেন, নাম মিনারো হরিয়ে। জাইকার একজন বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এক সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আমরা কাজ করেছি। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হচ্ছে অনন্য সম্ভাবনাময় দেশ; দেশের আধা পার্সেন্টেরও কম লোক ছাড়া আর সকলেই একই ভাষায় কথা বলে। একই পটভূমি, চাল চলন, অভ্যাস বিশ্বাসের অধিকারী। ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আকিদার ব্যবধান থাকলেও তা এত প্রকট নয়। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য যে ঐক্য এ সংহতির প্রয়োজন তার সবগুলো উপাদানই বাংলাদেশে রয়েছে। তিনি বলতেন, এই উপাদানগুলো একত্রিত করে কাজে লাগানোর জন্য যে নেতৃত্বের প্রয়োজন তার অভাবই বাংলাদেশের প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় যে সমস্যাটি তার চোখে ধরা পড়েছিল তা হচ্ছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সব কৃতিত্ব একটি দল কর্তৃক দাবি করা এবং দলটির নেতা ও তার আত্মীয় পরিজনের নামে সব কিছুর নামকরণের প্রবণতা। এই সমস্যার একটি সমাধান অবশ্য তিনি দিয়েছিলেন এবং তা হচ্ছে দেশের নাম পরিবর্তন করে ঐ নেতার নামে নামকরণ। রসিকতার মত মনে হলেও প্রস্তাবটি মন্দ নয়।
আসলে শুধু বিদেশীরা কেন আমরাও আমাদের দেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু দেশকে একশ্রেণীর স্বার্থপর রাজনীতিক এবং রাজনৈতিক দল যেভাবে বিভক্ত করে ফেলেছেন এবং ফেলছেন তাতে দেশটির সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও দেশ স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ বিতর্কে লিপ্ত। কোনও বিশেষ দলের পছন্দ না হলে ব্যক্তি ও সংস্থা দেশদ্রোহী-রাজাকার-আলবদরে পরিণত হতে এখানে সময় লাগে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, উপ-প্রধান সেক্টর কমান্ডারÑ তারাও রাজাকার আল-বদর, পাকিস্তানী চর অথবা আইএসআই এর দালাল কিন্তু যে কোন সময় যুদ্ধাপরাধীতে পরিণত হতে পারেন। এই এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার দেশ। এখানে ক্ষমতার মসনদ আর জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠের দূরত্ব খুবই কম। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, এই কথাটিই অনেকেই মনে রাখেন না, যেমন ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেন না।
চার.
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান জনাব একে খন্দকার স্বাধীনতার ৪২ বছর পর “১৯৭১ : ভেতরে বাইরে” শীর্ষক একটি তথ্যবহুল পুস্তক রচনা করে সারা বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এতে তার এক সময়ের সতীর্থরা তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি এবং পাকিস্তানী চর আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। সংসদে বইটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়, তা বাজেয়াপ্ত করার দাবি উঠে। অনেক এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করারও দাবি জানান। এতে তার একটা লাভ হয়েছে বইটির কাটতি বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ইন্টারনেটে-ফেইসবুকে এখন অনেক সাইট পাওয়া যাচ্ছে যেখান থেকে বইটির হাজার কপি ডাউনলোড করে বিতরণ করা হচ্ছে।
‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটির ব্যাপারে দু’টি কারণে আমার আগ্রহ ছিল। একটি হচ্ছে, একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক হিসেবে তার তথ্যের সাথে আমার স্মৃতির সংগতি দেখা এবং দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের প্রধান হিসেবে তিনি জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে যারা বিচারের দাবিতে সক্রিয় ছিলেন তাদেরই শীর্ষ নেতা ছিলেন। একাত্তরের ভিতরে বাইরে তাদের এই দাবির অনুকুলে কি কি তথ্য উপাত্ত তিনি উপস্থাপন করেছেন তা দেখার লোভ আমি সামলাতে পারিনি।
আমি দুঃখিত তার বইতে আমি আমার দ্বিতীয় আকাক্সক্ষাটি পূরণের কোনও তথ্য উপাত্ত পাইনি। তিনি এই বিষয়ের ধারে কাছেও যাননি। যদিও পুস্তকের সূচনাকে প্রচলিত মত ও আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি প্রকৃত ঘটনার তথ্য পরিবেশন ও বিশ্লেষণের অঙ্গীকার করেছিলেন। কথাটি এ জন্য বলছি যে তাদের এই অন্যায় দাবির ভিত্তিতে দেশের সৎ, নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ও বরেণ্য আলেম ওলামা শিক্ষাবিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে সরকার তাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন, আদালতের নির্দেশে একজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এবং কয়েকজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছে।
জনাব খন্দকার তার বইতে অনেকগুলো সত্য কথা বলেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে একাত্তর সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশব্যাপী যে সন্ত্রাস ও লুটপাট হয়েছে তাতে বাঙ্গালীরাও অংশ নিয়েছে। এই বাঙ্গালীরা কারা তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। অবাঙ্গালীদের উপর অত্যাচারের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। অনেকে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সূচনা বলে দাবি করে থাকেন। তিনি তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে ভাষণটিকে ভাবাবেগপূর্ণ ও দিক নির্দেশনাহীন বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে শেখ মুজিব ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ শব্দগুলো দিয়ে ভাষণ শেষ করেছেন। জনাব খন্দকার এখানে সঠিক কথাই বলেছেন। আমরাও তা শুনেছি। ২৫ মার্চের কালো রাতে শেখ মুজিব ধরা পড়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এ তথ্যের সাথে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন। তার গ্রেফতারী এবং স্বাধীনতার ঘোষণা না দেয়ায় তিনি মর্মপীড়া অনুভব করেছেন এবং বলেছেন যে, যদি তিনি (শেখ মুজিব) এই ভুল না করতেন তা হলে “মুক্তিযুদ্ধে আমরা অনেক ভাল করতে পারতাম। হয়ত অনেক মানুষকে জীবন দিতে হতো না বা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হতো না। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন অথচ গ্রেফতারের আগে কোন আদেশ নির্দেশ বা উপদেশ দেননি এবং পরিষ্কারভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে কিছু বলেননি। তার আদেশ বা নির্দেশের অভাবে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়।” তার দেয়া তথ্যানুযায়ী ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রূপ নেয় এবং এখান থেকে মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম ও পরে লে. জে. ও রাষ্ট্রপতি) স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি স্বয়ং তা শুনেছেন। আমরাও শুনেছি। তার পুস্তকটিতে অনেক বাস্তবতা প্রতিফলন ঘটেছে। তার সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। বইটি সম্পর্কে বারান্তে বিস্তারিত আলোচনার আশা রাখি।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান জনাব একে খন্দকার স্বাধীনতার ৪২ বছর পর “১৯৭১ : ভেতরে বাইরে” শীর্ষক একটি তথ্যবহুল পুস্তক রচনা করে সারা বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। বইটি প্রকাশের সাথে সাথে ভিমরুলের চাকে ঢিল পড়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এতে তার এক সময়ের সতীর্থরা তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি এবং পাকিস্তানী চর আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। সংসদে বইটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়, তা বাজেয়াপ্ত করার দাবি উঠে। অনেক এমপি এবং আওয়ামী লীগ নেতা তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করারও দাবি জানান। এতে তার একটা লাভ হয়েছে বইটির কাটতি বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ইন্টারনেটে-ফেইসবুকে এখন অনেক সাইট পাওয়া যাচ্ছে যেখান থেকে বইটির হাজার কপি ডাউনলোড করে বিতরণ করা হচ্ছে।
‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বইটির ব্যাপারে দু’টি কারণে আমার আগ্রহ ছিল। একটি হচ্ছে, একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক হিসেবে তার তথ্যের সাথে আমার স্মৃতির সংগতি দেখা এবং দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের প্রধান হিসেবে তিনি জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে যারা বিচারের দাবিতে সক্রিয় ছিলেন তাদেরই শীর্ষ নেতা ছিলেন। একাত্তরের ভিতরে বাইরে তাদের এই দাবির অনুকুলে কি কি তথ্য উপাত্ত তিনি উপস্থাপন করেছেন তা দেখার লোভ আমি সামলাতে পারিনি।
আমি দুঃখিত তার বইতে আমি আমার দ্বিতীয় আকাক্সক্ষাটি পূরণের কোনও তথ্য উপাত্ত পাইনি। তিনি এই বিষয়ের ধারে কাছেও যাননি। যদিও পুস্তকের সূচনাকে প্রচলিত মত ও আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি প্রকৃত ঘটনার তথ্য পরিবেশন ও বিশ্লেষণের অঙ্গীকার করেছিলেন। কথাটি এ জন্য বলছি যে তাদের এই অন্যায় দাবির ভিত্তিতে দেশের সৎ, নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ও বরেণ্য আলেম ওলামা শিক্ষাবিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ এনে সরকার তাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছেন, আদালতের নির্দেশে একজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এবং কয়েকজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছে।
জনাব খন্দকার তার বইতে অনেকগুলো সত্য কথা বলেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে একাত্তর সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশব্যাপী যে সন্ত্রাস ও লুটপাট হয়েছে তাতে বাঙ্গালীরাও অংশ নিয়েছে। এই বাঙ্গালীরা কারা তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। অবাঙ্গালীদের উপর অত্যাচারের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। অনেকে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সূচনা বলে দাবি করে থাকেন। তিনি তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে ভাষণটিকে ভাবাবেগপূর্ণ ও দিক নির্দেশনাহীন বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে শেখ মুজিব ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ শব্দগুলো দিয়ে ভাষণ শেষ করেছেন। জনাব খন্দকার এখানে সঠিক কথাই বলেছেন। আমরাও তা শুনেছি। ২৫ মার্চের কালো রাতে শেখ মুজিব ধরা পড়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এ তথ্যের সাথে তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন। তার গ্রেফতারী এবং স্বাধীনতার ঘোষণা না দেয়ায় তিনি মর্মপীড়া অনুভব করেছেন এবং বলেছেন যে, যদি তিনি (শেখ মুজিব) এই ভুল না করতেন তা হলে “মুক্তিযুদ্ধে আমরা অনেক ভাল করতে পারতাম। হয়ত অনেক মানুষকে জীবন দিতে হতো না বা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হতো না। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন অথচ গ্রেফতারের আগে কোন আদেশ নির্দেশ বা উপদেশ দেননি এবং পরিষ্কারভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে কিছু বলেননি। তার আদেশ বা নির্দেশের অভাবে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়।” তার দেয়া তথ্যানুযায়ী ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রূপ নেয় এবং এখান থেকে মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম ও পরে লে. জে. ও রাষ্ট্রপতি) স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি স্বয়ং তা শুনেছেন। আমরাও শুনেছি। তার পুস্তকটিতে অনেক বাস্তবতা প্রতিফলন ঘটেছে। তার সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। বইটি সম্পর্কে বারান্তে বিস্তারিত আলোচনার আশা রাখি।
ড. মোঃ নূরুল আমিন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন