গত ১৩ আগস্ট শনিবার সুপ্রিম কোর্ট
চত্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ
সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখা ‘বাংলাদেশ : ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ : ২০০৭-২০০৮’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে আলোচনায়
অংশগ্রহণ করেন। প্রকাশনা অনুষ্ঠান থেকে বের হওয়ার পথে অজ্ঞাতপরিচয়ধারী কয়েকজন
দুর্বৃত্ত তথা সন্ত্রাসী তার ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা তাকে
কিল, ঘুষি ও লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং তার পরিহিত শার্ট ছিঁড়ে
ফেলে তাকে রক্তাক্ত করে। এ সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা করার ভাষা আমাদের
জানা নেই। কী অপরাধে ড. মাহবুব উল্লাহর মতো একজন শান্ত, সদালাপী, বন্ধুবৎসল, নিরীহ শিক্ষাবিদ এমন হামলার শিকার হলেন আমরা তথা জনগণ তা জানতে
চায়। মাহবুব উল্লাহ কোনো সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত নন। শিক্ষকতাই তার পেশা। তিনি
কাউকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য দেন না। সর্বদা সত্য ও তথ্যনির্ভর বক্তব্য দেয়ার
চেষ্টা করেন। এ কথা ঠিক যে, সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের
টকশোতে মাঝে মধ্যে অংশগ্রহণ করেন; কিন্তু কোনো আক্রমণাত্মক এবং অযৌক্তিক
বক্তব্য দিতে তাকে দেখিনি, বরং তার বক্তব্য সব সময় বস্তুনিষ্ঠ ও
তথ্যনির্ভর মনে হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহবুব উল্লাহর
ছাত্রজীবন শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। মেধাবী ও সমাজসচেতন মাহবুব উল্লাহর সংগ্রামী জীবনের
শুরুও তখন থেকেই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে
তখনকার সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেন এবং নেতৃত্ব দেন। তখনো তিনি
বারবার অত্যাচারী,
জুলুমবাজ শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে
সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন। আমার আজো স্পষ্ট মনে আছে সেদিনকার আদর্শবাদী
তরুণ মাহবুব উল্লাহকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এনেক্স চত্বরে স্বৈরাচারী শাসক
আইউব-মোনেমের পেটোয়াবাহিনী এনএসএফের ছাত্র নামধারী গুণ্ডারা আক্রমণ করে এবং
শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। তাকে বাঁচানোর জন্য কাসরুম থেকে ছুটে আসেন ড. আবু মাহমুদ, ড. নাজমুল করিমসহ অন্য শিক্ষকেরা। প্রতিবাদী মাহবুব উল্লাহ
তাতে ভীত হননি। তার পরের কাহিনী সবার জানা। ছাত্রনেতা হিসেবে তার স্বাভাবিক উত্থান, ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলনের
নেতৃত্বদান,
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়
অংশগ্রহণÑ
আজ এসব ইতিহাসের অংশ। তদানীন্তন পূর্ব
পকিস্তানে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন যখন চলতে থাকে, তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠন আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই
জনসভায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক
পূর্ববাংলা কায়েমের ঘোষণা প্রদান করেন। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের
পক্ষে মাহবুব উল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত ‘স্বাধীন
জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার ১১ দফা কর্মসূচিÑ দু’টি কথা’ শীর্ষক
এক প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। এই সভায় আপত্তিকর বক্তৃতা ও প্রচারপত্র বিলির অভিযোগে
সামরিক আদালতে কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর
মাসাধিককাল পর মাহবুব উল্লাহ গ্রেফতার হন। এ কথা ঠিক যে, ছাত্রজীবনের শেষদিকে তিনি আদর্শবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন, যুক্ত হন শ্রেণী সংগঠনের সাথেÑ মেহনতি
মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পর কারামুক্ত হয়েও তিনি
কিছু দিন সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি
আর সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের মধ্য
দিয়ে তার শিক্ষকতা জীবনের শুরু হয়। একপর্যায়ে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির
দায়িত্ব পালন করেন। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ড. মাহবুব উল্লাহ
একজন নিষ্ঠাবান,
নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। এটাই তার
সার্বক্ষণিক পেশা। সরাসরি রাজনীতির সাথে তিনি এখন আর যুক্ত নন।
তবে একজন শিক্ষকেরও সামাজিক দায়িত্ব
আছে। তারও একটি দর্শনে বিশ্বাস থাকতে পারে। সেই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তিনি যদি
তার মত প্রকাশ করেন এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন, সেটা
তো দোষের হতে পারে না। মাহবুব উল্লাহর মতো শিক্ষাবিদেরা সুশীলসমাজের অংশ। এ সমাজের
একজন হয়ে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে কোনো রাজনৈতিক
মতাদর্শে ও দলকে সমর্থন করার অধিকারও তার আছে। ইদানীং মাহবুব উল্লাহ যেসব আলোচনায়
অংশ নিয়েছেন,
দেখা যাবে যে তার বক্তব্য ছিল যুক্তি ও
তথ্যনির্ভর। তাকে গায়ের জোরে কোনো কথা বলতে আমরা শুনিনি। তাহলে কেন এই সন্ত্রাসী
হামলা? তার রাজনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে তার বক্তব্য
কোনো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে যেতে পারে এবং কোনো দলের কর্মসূচির প্রতি তার
সমর্থন থাকতে পারে। সেই সমর্থন ব্যক্ত করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দোষের হতে পারে
না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অতএব মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এ
দেশের নাগরিকদের একটি মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। শুধু অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী সরকার এ অধিকার কেড়ে নিতে পারে। অতীব পরিতাপের বিষয়, আজ এ দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত।
আজ দেশে আইনের শাসন বলতে কিছু নেই।
দুর্নীতি,
স্বজনপ্রীতি, সমাজকে গ্রাস করেছে। সরকার এতটাই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে, হত্যা-গুম-খুনের কোনো প্রতিকার এ রাষ্ট্রে হয় না। রাষ্ট্রীয়
সন্ত্রাসের কবলে পড়েছে ভিন্নমতাবলম্বীরা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের
দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এত গুম-খুন-নির্যাতন-নিপীড়নের
ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। আজ এ দেশের মানুষ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে অনিশ্চিত
জীবন যাপন করছে। মানবতা আজ এখানে সম্পূর্ণরূপে ভূলুণ্ঠিত। বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন
অতীতের সব সীমা অতিক্রম করেছে। এই পরিস্থিতিতে হামলার শিকার হয়েছেন শিক্ষাবিদ ড. মাহবুব
উল্লাহ। এ ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
দাবি করছি।
স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের
ফ্যাসিবাদী আক্রমণ লজ্জাজনক এবং অনভিপ্রেত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মাহবুব উল্লাহর
বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা, তথ্য ও যুক্তিনির্ভর বক্তব্য শাসকগোষ্ঠীর
তথা সরকারের কোনো মহলে গাত্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। তার সত্যভাষণ তাদের কাছে
পীড়াদায়ক। মাহবুব উল্লাহ একজন শিক্ষক, একজন
দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী। তাই সত্য কথা বলতেই তিনি অভ্যস্ত; কিন্তু সত্য অনেক ক্ষেত্রে অপ্রিয় হয়। তার সত্যভাষণ যদি শাসক-শোষক-লুটেরা
ও দুর্নীতিবাজদের পক্ষে না যায়, তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যায়? যুগে যুগে পৃৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মাহবুব উল্লাহর মতো
দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা নির্যাতিত, নিপীড়িত
ও লাঞ্ছিত হয়েছেন;
কিন্ত পরিণামে এসব স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর শোচনীয় ও ভয়াবহ পরিণতি ঘটেছে। শোষণ-নির্যাতন
কোনো সমাজে চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই এ দেশের মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষা বৃথা
যেতে পারে না। একদিন যে আইউবশাহীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মাহবুব উল্লাহ, সেই আইউবশাহী তাসের ঘরের মতো উড়ে গেছেন। যে ইয়াহিয়া সরকার
মাহবুব উল্লাহকে কারারুদ্ধ করেছিল সে ইয়াহিয়া সরকারকে পরাজিত করে স্বাধীন
বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। অতএব আজো যারা মাহবুব উল্লাহকে
নির্যাতিত করেছে তাদেরও পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। এই নির্যাতন নিপীড়নের জন্য তাদেরকে
একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
ড. আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন