মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

জিয়ার হাতে কোদাল



মনিরুজ্জামান মনির
অতি সম্প্রতি ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের বর্ষীয়ান আধুনিক কবি আল মাহমুদ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তার সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছিল দেশ-ভাবনা। তিনি আমাকে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘জাসাস’-এর সভাপতি এবং তরুণ রাজনীতিবিদ রেজাবুদ্দৌল্লা চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করলেন। একঝাঁক মেধাবী ছাত্র, কিছু সঙ্গীত শিল্পী এবং আমাদের নিয়ে হিযবুল বাহার জাহাজে করে সমুদ্র বিহারে গেলেন। আমাদের শেষ জলসীমান্ত হিরণ পয়েন্টের কাছাকাছি যেতেই একটি পানি ভরা তেলের শিশি সাগরে ফেলে দিয়ে আমাকে বললেন, ‘কবি সাহেব, এর নিচে আমাদের তেল-গ্যাস আছে।’ আজ অনেক বছর পর সত্যি সত্যি আমাদের বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চলছে। মিয়ানমারের সঙ্গে জলসীমা নির্ধারণী মামলার ফলাফলের মাধ্যমে আমাদের ন্যায্যটুকু প্রাপ্ত হয়েছে এবং সেখানে নাকি তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। অবশ্য বিরোধী দল বিএনপি এবং কিছু সমুদ্র বিশ্লেষক এই প্রাপ্তিকে শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে সমালোচনা করেছেন। অজ্ঞতার কারণে হোক বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হোক আওয়ামী সরকার অতীতে সাগরে তেল-গ্যাসের স্বপ্নদ্রষ্ট্রা জিয়াউর রহমানের নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে কখনও উচ্চারণ করবে না, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কেননা এর মধ্যে সর্বজনস্বীকৃত জিয়ার অবদানগুলো থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলা হয়েছে বা হচ্ছে নির্লজ্জভাবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এ সরকার এতটাই নিষ্ঠুর এবং বেপরোয়া যে, দীর্ঘ দীর্ঘ মাস-বছর বাস করা শহীদ জিয়ার স্মৃতিঘেরা আবাসস্থল বেগম জিয়ার নামে বরাদ্দকৃত ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ভেঙেচুরে ধূলিস্মাত্ করে দিয়েছে। ওরা একবারও ভাবল না জিয়াউর রহমান ছিলেন এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জেনারেল এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি। বেগম জিয়া দু’বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। দেশ যাকে নাম দিয়েছে দেশনেত্রী। আমাদের সবার স্মরণে থাকা উচিত, রাষ্ট্রপতি জিয়া শহীদ হওয়ার পর ধানমন্ডিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত আব্দুস সাত্তার একটি বাড়ি তাদের সন্তানদের জন্য দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এছাড়া কুমিল্লা কক্সবাজারে কত মূল্যবান আবাসভূমি বেগম জিয়াকে দান করার জন্য কত জিয়াভক্ত পাগল মানুষ ছুটে এসেছিলেন। কই, বেগম জিয়া তো সেসব দান গ্রহণ করেননি? তিনি ধন্যবাদের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এতে কি বোঝা যায় না, বেগম জিয়া আবাসভূমির জন্য লোভাতুর নন? সরকার শহীদ জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলতে চাইলেও ইতিহাসের পাতা থেকে, মানুষের অন্তর থেকে তার নাম মুছে ফেলতে পারবে না। শহীদ জিয়ার কর্মজীবন প্রথমত শুরু হয় সামরিক পোশাক পরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জিয়া অংশগ্রহণ করেন ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে। আবার রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে ‘বীর উত্তম’ খেতাব নিয়ে। ১৯৭৫-এর ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে সামরিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়। সারা জাতি ঢাকা পড়ে সঙ্কট ও অনিশ্চয়তার কুয়াশায়। সেই ঝাপসা কুয়াশা ভেদ করে সিপাহী-জনতা তাদের নতুন নেতা, ত্রাণ কর্তাকে নির্বাচিত করে, যার নাম জিয়াউর রহমান। ওই বিপ্লবের পরিণতি ছিল রক্তপাতহীন। পৃথিবীতে এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আমরা জানি, আধুনিক বিশ্বে অসাংবিধানিকভাবে কোনো সামরিক শাসক দ্রুত গণতন্ত্রকে মুক্তি দেয় না। বরং শ্বৈরশাসন করে দীর্ঘায়িত। কিন্তুু জিয়ার বেলায় ঘটল উল্টো। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে ১৯৭৭ সালে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নিলেন এবং পরবর্তী সময়ে দ্রুততম সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। যেখানে সব রাজনৈতিক দল এবং অধিকাংশ ভোটার অংশগ্রহণ করল উত্সবপূর্ণ পরিবেশে। শহীদ জিয়া হয়তো এক নতুন ইতিহাস গড়ার জন্য সামরিক শাসক হয়েও এই অবাধ গণতন্ত্রের বাঁধ নিজের হাতে ভেঙে দিয়েছিলেন। জনতার রায় পাওয়ার পর তার শরীর থেকে সামরিক পোশাক খুলে ফেলেন জেনারেল জিয়া।
শুরু হলো তার জীবন কাহিনীর দ্বিতীয় পর্ব। তিনি গঠন করলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত রাজনৈতিক দল বিএনপি। তার প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নের রাজনীতি। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ কয়েক হাজার গ্রামের সমষ্টিগত নাম। গ্রামের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে। তাই প্রেসিডেন্ট জিয়া বারে বারে ছুটে গেছেন গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি ঘোষণা করলেন ১৯ দফা উন্নয়ন কর্মসূচি। যার অধিকাংশ জুড়ে ছিল বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটানোর অঙ্গীকার। জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি।’ এই মাটিতে ফলা ফসলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিএনপি’র দলীয় প্রতীক তাই চিহ্নিত করলেন ‘ধানের শীষ’। তিনি আরও বুঝতে পেরেছিলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের পানিতে মারবে। আমাদের সমস্ত নদীর উজানে একে একে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেবে। ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী শুকনো মৌসুমে পানি দেবে না। তাই আত্মরক্ষা এবং আত্মসমৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি শুরু করলেন মরা নদীতে ড্রেজিং এবং ভরাট খাল খনন কর্মসূচি। তিনি নিজের হাতে তুলে নিলেন ‘কোদাল’। সারা বাংলাদেশে খালগুলো হলো জীবন্ত, বহমান। বৃষ্টির পানি, নদীর পানি, সেই খালগুলোতে হলো সংরক্ষিত ১২ মাস। চৈতি খরাতে মাঠে বইয়ে দিল পানির বন্যা। এক ফসলি জমিতে হলো তিন ফসলের চাষ। উত্তর ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট কিম ইল সুংও চীনের আধুনিক রূপকার প্রেসিডেন্ট দেংপিয়াং দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জিয়া আমাদের দেশে কৃষি কাজে করলেন আধুনিকায়ন, নতুন নতুন যন্ত্রপাতির সংযোজন। ফলদায়ক সারের উত্পাদন। তাই তো জিয়ার শাসনকালে সুখী সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশী নাগরিকরা প্রাণ খুলে গাইল—
‘ধানের এ দেশ
গানের এ দেশ
আমার এ দেশ ভাইরে।’
monirlyric@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads