সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

সিপিডির মূল্যায়ন : তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ : আগামী বছর আরও বিপর্যয়



সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। সম্প্রতি উত্পাদন ও রফতানিতে প্রবৃদ্ধি কমছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে বিরাজ করছে বেহাল দশা। সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বড় ধরনের চাপে পড়েছে। এসব বিবেচনায় চলতি অর্থবছরকে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে দুর্বলতম বছর হিসেবে অভিহিত করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালে বিশাল ভর্তুকির কারণে দেশের অর্থনীতির অবস্থা নাজুক। আগামী অর্থবছরেও সরকার ভর্তুকির ধারা থেকে বের হতে পারবে না। এতে আগামী অর্থবছর হবে অর্থনীতির বিপর্যয়ের বছর।
গতকাল সিপিডি আয়োজিত ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনামূলক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। সিপিডির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, গবেষণাপ্রধান ড. ফাহমিদা খাতুন, গোলাম মোয়াজ্জেমসহ বিভিন্ন গবেষক উপস্থিত ছিলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমাদের অর্থনীতির সার্বিক দিক বিবেচনায় বিনিয়োগ প্রসারিত করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর নজর দেয়া প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দুর্নীতিকে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, ভৌত অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্নীতি ও অর্থের দুষ্প্রাপ্যতা বিনিয়োগের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। এর আগের বছরগুলোতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অর্থের দুষ্প্রাপ্যতাজনিত বাধা ছিল, তবে তার প্রকোপ ছিল কম। এ বছর এই দুটি বাধা বেশ বড় হয়ে উঠেছে।
দেশে এ বছর কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়ার কারণ হিসেবে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতাকে দায়ী করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ কমানো হলেও সরকারের ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছে। এ ধরনের মুদ্রানীতির কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির গতি এখনো কমেনি।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চলতি অর্থবছরে এককভাবে বিদ্যুত্ খাত দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রগুলোতে অনেক বেশি পরিমাণে ডিজেল ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারের রাজস্ব ব্যয় ব্যবস্থাপনা চাপের মুখে পড়েছে। প্রাক্কলনের চেয়ে শত ভাগ ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় সরকার তা অর্থায়নে বেশ চাপের মুখে পড়ে যায়। অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব পড়েছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে এর অর্থায়ন করায়।
ড. ভট্টাচার্য আরও বলেন, ভর্তুকি চাহিদা অপ্রত্যাশিত হারে বেড়ে যাওয়া চলতি অর্থবছরের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতার একটি বড় কারণ। বছরের শুরুতে ভর্তুকির প্রাক্কলন ছিল ২০ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এখন এটা বেড়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এতে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাজেটে অন্তর্নিহিত অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা রয়েছে। এ বছরের মধ্যে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের যে পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে জ্বালানির দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হিসেবে ভর্তুকি হঠাত্ না কমিয়ে ধীরে ধীরে কমানোর পরামর্শ দেন তিনি। বছরের শুরুতে ভর্তুকির ব্যাপারে যে প্রাক্কলন করা হবে বছর শেষে যেন তা ছাড়িয়ে না যায়—এ ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, এ বছর ব্যাংক থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার প্রবণতা, জ্বালানি সঙ্কট এবং বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করতে না পারায় সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো বেশ প্রভাবিত হয়েছে। খরচ বৃদ্ধিজনিত কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে জনগণ বেশ কষ্টে পড়ে গেছে। বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় জনগণের আয় প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে দেশের বিনিয়োগ বাড়েনি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কাটছাঁট করায় সরকারি বিনিয়োগও কমেছে। বিনিয়োগ না বাড়া সত্ত্বেও দেশের জিডিপি কীভাবে বাড়ল, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, উত্পাদনশীলতা বাড়লে স্থবির বিনিয়োগেও উত্পাদন বাড়তে পারে। তবে তারও একটা সীমা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মর্মে প্রকাশিত বিবিএসের পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বৈদেশিক লেনদেনের পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. ভট্টচার্য বলেন, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য এখনও বিপদসীমার বাইরে নয়। রফতানি প্রবৃদ্ধি আগের তুলনায় কমেছে, বৈদেশিক ঋণও প্রত্যাশা অনুযায়ী আনা যাচ্ছে না। এদিকে নিট বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম। বিশ্ববাজারের অনিশ্চয়তায় দেশের রফতানি খাত আগামী কয়েক মাস চাপের মধ্যেই থাকবে। এ অবস্থায় বৈদেশিক ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে আগামীতে লেনদেনের ভারসাম্যে বেশ চাপ সৃষ্টি হতে পারে। সার্বিক দিক বিবেচনায় সরকারকে বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড় করার ব্যাপারে বেশি মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads