বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ইমপিচ করতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য সংসদ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাঠানোর জন্য গতকালও দাবি জানিয়েছেন এমপিরা। গতকাল জাতীয় সংসদে সরকারি দলের প্রভাবশালী সদস্যরা বিচারপতি মানিকের অপসারণে তাদের অনড় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। আগের দিনের ধারাবাহিকতায় তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও রাশেদ খান মেনন তাদের কঠোর অবস্থান তুলে ধরলে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী সংসদকে জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট এ বিষয়ে নিজেই রুলিং দেবেন। এজন্য স্পিকার আইন-কানুন বিশ্লেষণ করছেন।
অন্যদিকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে গতকাল আনুষ্ঠানিক আবেদন পেশ করা হয়েছে। শপথ ভঙ্গ, সংবিধান লঙ্ঘন, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়েছে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে। বিচারপতি শামসুদ্দিনকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলেও আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের পক্ষে অ্যাডভোকেট মো. মোজাম্মেল হক এ আবেদন করেন। বঙ্গভবনে এ আবেদন পেশ করা হয়েছে।
এদিকে স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিনের মন্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বিচারপতি মানিক সম্পর্কে সরকারি দলের সিনিয়র সদস্যদের প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অপসারণের আলটিমেটাম নিয়ে আদালত অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। সিনিয়র ্আইনজীবীরা বলেছেন, একজন বিচারকের দায় গোটা জুডিশিয়ারি বহন করতে পারে না। সংসদ ও বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে বলেও তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
গতকাল জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে রাশেদ খান মেনন স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিনের অবমাননাকর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার এমপিদের আলোচনার বিষয়টি ডেপুটি স্পিকারকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি (ডেপুটি স্পিকার) বলেছিলেন, এ বিষয়ে জানাবেন। জাতি আপনার রুলিং-এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সবাই আপনার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে।’
এরপর দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এটি রুলিং-এর বিষয় নয়। এটি রেজুলেশনের (সিদ্ধান্ত) বিষয়। আমরা রেজুলেশন হিসেবে এটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে চাই। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। রাষ্ট্রপতিই পারেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।
সুরঞ্জিতের পর আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ বলেন, আজকের পত্রিকায় যেভাবে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, তিনি (সামসুদ্দীন চৌধুরী) সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি যে আপত্তিকর ভাষায় কথা বলেছেন, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেব। সেটি পুরো সংসদের সিদ্ধান্ত। আমাদের সিদ্ধান্ত যাবে। স্পিকার তাতে মতামত দেবেন। তারপর সেটা প্রস্তাব আকারে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। এ সময় সব সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানান।
এ পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী আবারও বলেন, ‘সকল বিষয় নিয়ে স্পিকার সংসদে বক্তব্য দেবেন। আজকে দেবেন না। দু’একদিন অপেক্ষা করতে হবে। তিনি সংবিধান ও আইন-কানুন দেখছেন।
আদালত অঙ্গনে তোলপাড় : এদিকে বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ, জাতীয় সংসদে এমপিদের দেয়া বক্তব্য ও মন্তব্যই ছিল গতকাল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। দেশের প্রায় সব মিডিয়াতে বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল আদালতেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এদিকে বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ গতকাল বসেনি। বেঞ্চের জুনিয়র বিচারপতির অসুস্থতার কারণে আদালতে না আসায় বেঞ্চের বিচার কার্যক্রম মুলতবি রাখা হয়। জুনিয়র বিচারপতি সুস্থ হয়ে আদালতে ফিরে না আসা পর্যন্ত সিনিয়র বিচারক বিচারপতি সামসুদ্দিন একক বেঞ্চে দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করবেন বলে বেঞ্চের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিচারপতি মানিকের অপসারণের জন্য সংসদ সদস্যদের দেয়া তিন দিনের আল্টিমেটাম সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবীরা বলেন, একজন বিচারকের দায় গোটা বিচার বিভাগ নিতে পারে না। একজনের কারণে গোটা বিচার বিভাগকে দায়ী করা ঠিকও নয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি মানিককে অপসারণ করা হবে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির। তবে জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগের মুখোমুখি অবস্থান গণতন্ত্রকে বিপন্ন করবে।
গতকাল আদালতপাড়ায় আইনজীবীরা এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। দলমত নির্বিশেষে নবীন-প্রবীণ সব আইনজীবীই সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। সংবিধান প্রণেতা ও প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদ হচ্ছে সুপিরিয়র। জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করে আর সুপ্রিমকোর্ট তা বাস্তবায়ন করে। দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হলে গণতন্ত্র মারাত্মক ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। কাজেই বিচার বিভাগের এমন কোনো আচরণ করা উচিত নয় যাতে জাতীয় সংসদ হেয়প্রতিপন্ন হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংসদ দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার জাতীয় সংসদেও এমন ভাষা প্রয়োগ হওয়া উচিত নয়, যাতে বিচারবিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অপসারণের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের সব আইনজীবীরই উচিত একত্রে বসে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর পক্ষপাতমূলক আচরণ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তার অপসারণের দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একজন আইনজীবীর করা আবেদনের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ থেকেও তার অপসারণ দাবি করা হয়েছে। এটি এখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে। এ বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য করা সঠিক নয়। তবে আমি মনে করি, এ বিষয়ে আমাদের আইনজীবীদের মধ্যেও আলোচনা হওয়া উচিত।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, আমার মনে হচ্ছে জাতীয় সংসদে এমপিরা বিচারবিভাগকে নিয়ে ঢালাও মন্তব্যের চেয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনাই করেছেন বেশি। তারা বিচারপতি শামসুদ্দিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডও তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত বলেও মন্তব্য করেছেন। তার ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে আমি মনে করি, একজনের কারণে গোটা বিচারবিভাগকে কলুষিত করা কিংবা দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। একটিকে অবজ্ঞা বা হেয় করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বর্তমানে হাইকোর্ট ও জাতীয় সংসদের মুখোমুখি অবস্থান গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। বিচারপতি মানিকের অসদাচরণ ও সংবিধান লঙ্ঘনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ড. জহির বলেন, ‘কথায় আছে- সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক বলেছেন—কোর্টের কোনো আদেশ কিংবা কোনো বিচারকের ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করা যাবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে যে মন্তব্য করেছেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
অপসারণ চেয়ে করা আবেদন যা বলা হয়েছে : বিচারপতি মানিকের অপসারণ দাবি করে রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়েছে যে, গত ৩১ মে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী আমাকে অকারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং নিজে নিজে অযথা উত্তেজিত হয়ে আমাকে বানরের সঙ্গে তুলনা করেন, যা আদালত অঙ্গনে নজিরবিহীন।
আবেদনে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক আইনজীবীকে বিভিন্নভাবে অহেতুক গালাগাল এবং লাঞ্ছিত করেছেন বিধায় বর্তমানে একাধিক সত্, ভদ্র, আইনজীবী তার কোর্ট নীরবে বর্জন করে চলেছেন এবং নিজের সম্মান রক্ষার্থে কেউ মুখ খোলেন নাই। এই বিচারপতির আদালত বর্তমানে গুটিকয়েক আইনজীবীর পছন্দের আদালতে পরিণত হয়েছে। তিনি কারণে-অকারণে দেশের বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত রুল জারির মহোত্সব শুরু করেছেন, যা সংবিধান পরিপন্থী। আবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা বিচারপতি শামসুদ্দিনকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলেই মনে করেন।
আবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে ইচ্ছামাফিক আচরণ করেন। তিনি ১১/১২টায় কোর্টে বসেন। এছাড়াও তিনি আইনজীবীদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ, গুটিকয়েক আইনজীবীর মামলায় সহায়ক ভুমিকা রাখা, কারণে- অকারণে উত্তেজিত হয়ে পক্ষপাতিত্ব, বিজ্ঞ আইনজীবীদের ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেন। এগুলো করে তিনি শুধু শপথ ভঙ্গ করেননি, সংবিধানও লঙ্ঘন করেছেন।
আবেদনকারী আরও বলেছেন, আইনের শাসন, সুশাসন, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি কামনা করছি।
আবেদনকারী নিজেকে সরকারসমর্থক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আমি সুপ্রিমকোর্টে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে আইন পেশায় নিয়োজিত আছি। ২০০৭ সালে ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালনের দাবি জানিয়ে আমি একটি রিট আবেদন করে সাফল্য অর্জন করেছি। কর্মজীবনে সুপ্রিমকোর্টে এখনও পর্যন্ত কারও সঙ্গে আমার মনমালিন্য হয়নি।
প্রসঙ্গত, হাইকোর্টকে নিয়ে স্পিকারের দেয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। একই সঙ্গে স্পিকারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আইন পেশা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অপরদিকে বিচারপতি মানিককে মানসিক বিকারগ্রস্ত ও সেডিস্ট বলে উল্লেখ করে তিন দিনের মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করার দাবি জানান।
অন্যদিকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে গতকাল আনুষ্ঠানিক আবেদন পেশ করা হয়েছে। শপথ ভঙ্গ, সংবিধান লঙ্ঘন, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়েছে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে। বিচারপতি শামসুদ্দিনকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলেও আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের পক্ষে অ্যাডভোকেট মো. মোজাম্মেল হক এ আবেদন করেন। বঙ্গভবনে এ আবেদন পেশ করা হয়েছে।
এদিকে স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিনের মন্তব্য এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বিচারপতি মানিক সম্পর্কে সরকারি দলের সিনিয়র সদস্যদের প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অপসারণের আলটিমেটাম নিয়ে আদালত অঙ্গনে তোলপাড় চলছে। সিনিয়র ্আইনজীবীরা বলেছেন, একজন বিচারকের দায় গোটা জুডিশিয়ারি বহন করতে পারে না। সংসদ ও বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে বলেও তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
গতকাল জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে রাশেদ খান মেনন স্পিকার সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিনের অবমাননাকর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার এমপিদের আলোচনার বিষয়টি ডেপুটি স্পিকারকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি (ডেপুটি স্পিকার) বলেছিলেন, এ বিষয়ে জানাবেন। জাতি আপনার রুলিং-এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সবাই আপনার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে।’
এরপর দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এটি রুলিং-এর বিষয় নয়। এটি রেজুলেশনের (সিদ্ধান্ত) বিষয়। আমরা রেজুলেশন হিসেবে এটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে চাই। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। রাষ্ট্রপতিই পারেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।
সুরঞ্জিতের পর আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ বলেন, আজকের পত্রিকায় যেভাবে দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, তিনি (সামসুদ্দীন চৌধুরী) সংসদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি যে আপত্তিকর ভাষায় কথা বলেছেন, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেব। সেটি পুরো সংসদের সিদ্ধান্ত। আমাদের সিদ্ধান্ত যাবে। স্পিকার তাতে মতামত দেবেন। তারপর সেটা প্রস্তাব আকারে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। এ সময় সব সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানান।
এ পর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী আবারও বলেন, ‘সকল বিষয় নিয়ে স্পিকার সংসদে বক্তব্য দেবেন। আজকে দেবেন না। দু’একদিন অপেক্ষা করতে হবে। তিনি সংবিধান ও আইন-কানুন দেখছেন।
আদালত অঙ্গনে তোলপাড় : এদিকে বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ, জাতীয় সংসদে এমপিদের দেয়া বক্তব্য ও মন্তব্যই ছিল গতকাল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। দেশের প্রায় সব মিডিয়াতে বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল আদালতেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এদিকে বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ গতকাল বসেনি। বেঞ্চের জুনিয়র বিচারপতির অসুস্থতার কারণে আদালতে না আসায় বেঞ্চের বিচার কার্যক্রম মুলতবি রাখা হয়। জুনিয়র বিচারপতি সুস্থ হয়ে আদালতে ফিরে না আসা পর্যন্ত সিনিয়র বিচারক বিচারপতি সামসুদ্দিন একক বেঞ্চে দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করবেন বলে বেঞ্চের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিচারপতি মানিকের অপসারণের জন্য সংসদ সদস্যদের দেয়া তিন দিনের আল্টিমেটাম সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবীরা বলেন, একজন বিচারকের দায় গোটা বিচার বিভাগ নিতে পারে না। একজনের কারণে গোটা বিচার বিভাগকে দায়ী করা ঠিকও নয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি মানিককে অপসারণ করা হবে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির। তবে জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগের মুখোমুখি অবস্থান গণতন্ত্রকে বিপন্ন করবে।
গতকাল আদালতপাড়ায় আইনজীবীরা এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। দলমত নির্বিশেষে নবীন-প্রবীণ সব আইনজীবীই সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। সংবিধান প্রণেতা ও প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদ হচ্ছে সুপিরিয়র। জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করে আর সুপ্রিমকোর্ট তা বাস্তবায়ন করে। দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হলে গণতন্ত্র মারাত্মক ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। কাজেই বিচার বিভাগের এমন কোনো আচরণ করা উচিত নয় যাতে জাতীয় সংসদ হেয়প্রতিপন্ন হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংসদ দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার জাতীয় সংসদেও এমন ভাষা প্রয়োগ হওয়া উচিত নয়, যাতে বিচারবিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অপসারণের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের সব আইনজীবীরই উচিত একত্রে বসে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর পক্ষপাতমূলক আচরণ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণ ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তার অপসারণের দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একজন আইনজীবীর করা আবেদনের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ থেকেও তার অপসারণ দাবি করা হয়েছে। এটি এখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারে। এ বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য করা সঠিক নয়। তবে আমি মনে করি, এ বিষয়ে আমাদের আইনজীবীদের মধ্যেও আলোচনা হওয়া উচিত।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, আমার মনে হচ্ছে জাতীয় সংসদে এমপিরা বিচারবিভাগকে নিয়ে ঢালাও মন্তব্যের চেয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনাই করেছেন বেশি। তারা বিচারপতি শামসুদ্দিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডও তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত বলেও মন্তব্য করেছেন। তার ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতিই সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে আমি মনে করি, একজনের কারণে গোটা বিচারবিভাগকে কলুষিত করা কিংবা দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। একটিকে অবজ্ঞা বা হেয় করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বর্তমানে হাইকোর্ট ও জাতীয় সংসদের মুখোমুখি অবস্থান গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। বিচারপতি মানিকের অসদাচরণ ও সংবিধান লঙ্ঘনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ড. জহির বলেন, ‘কথায় আছে- সুখে থাকলে ভূতে কিলায়’।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক বলেছেন—কোর্টের কোনো আদেশ কিংবা কোনো বিচারকের ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা করা যাবে না, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে যে মন্তব্য করেছেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।
অপসারণ চেয়ে করা আবেদন যা বলা হয়েছে : বিচারপতি মানিকের অপসারণ দাবি করে রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়েছে যে, গত ৩১ মে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী আমাকে অকারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং নিজে নিজে অযথা উত্তেজিত হয়ে আমাকে বানরের সঙ্গে তুলনা করেন, যা আদালত অঙ্গনে নজিরবিহীন।
আবেদনে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক আইনজীবীকে বিভিন্নভাবে অহেতুক গালাগাল এবং লাঞ্ছিত করেছেন বিধায় বর্তমানে একাধিক সত্, ভদ্র, আইনজীবী তার কোর্ট নীরবে বর্জন করে চলেছেন এবং নিজের সম্মান রক্ষার্থে কেউ মুখ খোলেন নাই। এই বিচারপতির আদালত বর্তমানে গুটিকয়েক আইনজীবীর পছন্দের আদালতে পরিণত হয়েছে। তিনি কারণে-অকারণে দেশের বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত রুল জারির মহোত্সব শুরু করেছেন, যা সংবিধান পরিপন্থী। আবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা বিচারপতি শামসুদ্দিনকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলেই মনে করেন।
আবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে ইচ্ছামাফিক আচরণ করেন। তিনি ১১/১২টায় কোর্টে বসেন। এছাড়াও তিনি আইনজীবীদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ, গুটিকয়েক আইনজীবীর মামলায় সহায়ক ভুমিকা রাখা, কারণে- অকারণে উত্তেজিত হয়ে পক্ষপাতিত্ব, বিজ্ঞ আইনজীবীদের ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেন। এগুলো করে তিনি শুধু শপথ ভঙ্গ করেননি, সংবিধানও লঙ্ঘন করেছেন।
আবেদনকারী আরও বলেছেন, আইনের শাসন, সুশাসন, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি কামনা করছি।
আবেদনকারী নিজেকে সরকারসমর্থক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আমি সুপ্রিমকোর্টে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে আইন পেশায় নিয়োজিত আছি। ২০০৭ সালে ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালনের দাবি জানিয়ে আমি একটি রিট আবেদন করে সাফল্য অর্জন করেছি। কর্মজীবনে সুপ্রিমকোর্টে এখনও পর্যন্ত কারও সঙ্গে আমার মনমালিন্য হয়নি।
প্রসঙ্গত, হাইকোর্টকে নিয়ে স্পিকারের দেয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। একই সঙ্গে স্পিকারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও আইন পেশা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অপরদিকে বিচারপতি মানিককে মানসিক বিকারগ্রস্ত ও সেডিস্ট বলে উল্লেখ করে তিন দিনের মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করার দাবি জানান।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন