বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

বিদ্যুত্ উপদেষ্টার বেসামাল মন্তব্য : আসল দেশদ্রোহী কারা?



বিদ্যুত্ সঙ্কটে যখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, লোকসান সামলাতে না পেরে অসংখ্য শিল্পকারখানায় তালা ঝুলেছে, ক্ষুব্ধ লোকজনের হামলার আশঙ্কায় বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোয় পাহারা বসানো হচ্ছে, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত্ উপদেষ্টার ক্ষিপ্ত মন্তব্য নজর না কেড়ে পারে না। সরকারের সাড়ে তিন বছরেও বিদ্যুত্ সঙ্কট সমাধানে ব্যর্থতার সমালোচনাকারীদের এক হাত নিয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছেন। ক্ষমতাসীনদের দেয়া বিদ্যুত্ উত্পাদনের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার গরমিল নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের তিনি যে ভাষায় আক্রমণ করেছেন তা এক কথায় অশালীন না বলে পারা যায় না। প্রশ্নকর্তাদের ‘হয়তো অজ্ঞ, না হয় জ্ঞানপাপী, না হয় সরকারবিরোধী; তা নাহলে তারা দেশবিরোধী’ বলতে তার বাধেনি। তিনি সাফাই গেয়ে বলেছেন, ‘আমরা গত সাড়ে তিন বছরে বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অনেক কিছু করেছি।’ এই অনেক কিছু করার ফল এখন রাজধানীতেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং, মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলে দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুত্ না থাকা। এরপরও সরকারের বিদ্যুত্ উত্পাদন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না—এটাই বোধ হয় সরকারের সিদ্ধান্ত। তাই যারা মুখ খুলেছেন তাদের ধমক দিয়ে ঠাণ্ডা করতে চেয়েছেন অসীম ক্ষমতাধর বিদ্যুত্ উপদেষ্টা।
আওয়ামী লীগের তথাকথিত মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময়ও বিদ্যুত্ সমস্যা ছিল। তখন চাহিদা আর সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল দুই হাজার মেগাওয়াট। আর বিদ্যুত্ চাহিদা বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এ বাস্তবতায় দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে বিদ্যুত্ খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জোর দিয়ে বলা হয়েছিল, ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুত্ উত্পাদন ৫ হাজার মেগাওয়াট, ২০১৩ সালে ৭ হাজার আর ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। ক্ষমতা গ্রহণের পরও একের পর এক ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং মুক্তির কথা বলা হয়েছিল। প্রথমে ২০১১ এবং পরে ২০১২ সালের মধ্যে দেশ লোডশেডিং মুক্ত হওয়ার কথা এখন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পিডিবির দেয়া তথ্য মতে এখন পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রায় সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট এবং চাহিদার তুলনায় ঘাটতি আড়াই হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। অর্থাত্ সাড়ে তিন বছরে সরকারের ‘সফলতায়’ বিদ্যুতের ঘাটতি বেড়েছে কমপক্ষে ৫০০ মেগাওয়াট। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বিদ্যুত্ উত্পাদন তিন বছর আগের অবস্থায় আছে। তাহলে সরকার করলটা কী?
২০১০ সালে বিদ্যুত্ সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠলে তড়িঘড়ি ডিজেলচালিত কয়েকটি রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক) বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বেশ দ্রুতই এমন চুক্তি করার হিড়িক পড়েছিল। এ ক্ষেত্রে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরাই এগিয়ে থাকেন। প্রচলিত নিয়মরীতি মানার গরজ কেউ দেখায়নি। সংসদে দায়মুক্তি বিল পাস করে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সবকিছুই হালাল করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী তেলনির্ভর বেশি দামের বিদ্যুত্ ভর্তুকি-মূল্যে কিনে সরবরাহ করতে এবং তেল আমদানি বাড়াতে পিডিবির খরচ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে এ পর্যন্ত সরকারের খরচ ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় বিদ্যুত্ পাওয়া যায়নি। কারণ নানা কারণে সব বিদ্যুত্ কেন্দ্র চালু হয়নি। যেগুলো হয়েছে সেগুলোও পূর্ণমাত্রায় উত্পাদনে যেতে পারেনি। ফলে টাকার জোগান দিতে গিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ করে আর্থিক খাতে বিপর্যয় ডেকে এনেও বিদ্যুত্ সঙ্কটের সমাধান হয়নি। বিশাল দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগই জোরালো হয়ে উঠেছে।
এ অবস্থায় রেন্টাল-কুইক রেন্টাল নিয়ে উপদেষ্টার মন্তব্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, তিনি নিজেই বিষয়টিতে পুরোপুরি অজ্ঞ। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি না জেনেই কি তিনি পা বাড়িয়েছিলেন? এখন বিদ্যুত্ সঙ্কটে দেশ ও জনগণকে যে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে, তার দায় তিনি কিভাবে অস্বীকার করবেন? অশালীন মন্তব্য আর ধমক দিয়ে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। এ থেকে রেন্টালের নামে লুটপাটের পেছনে তার ভূমিকা আরও বড় হয়ে ধরা পড়েছে। এখন এটা স্পষ্ট যে রেন্টাল ব্যবস্থাকে দায়মুক্তি দিয়ে দুর্নীতি আর লুটপাটকেই উত্সাহিত করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শুধু খালি করাই হয়নি, ব্যাংক ব্যবস্থাকেও বিপর্যয়ে ফেলা হয়েছে। এসব বিচার করে বলতে হয়, রেন্টাল ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই দেশদ্রোহিতামূলক কাজ হয়েছে। এভাবে টাকা লুট করে আগামী নির্বাচনের তহবিল গঠন ও কিছু লোকের জন্য দেশ-বিদেশে ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এখন পরিস্থিতি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও বিচারের দাবি ওঠাই স্বাভাবিক।
বিদ্যুত্ সমস্যার সমাধানে স্থায়ী উত্পাদন কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নতুন স্থায়ী বিদ্যুেকন্দ্র তৈরি না করে অস্থায়ী ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের পেছনে আসলে বদ-উদ্দেশ্য কাজ করেছে। নানা টালবাহানা করে চুক্তিমত সময়ের চেয়ে বেশি সময় রেখে অতিরিক্ত টাকা লুটে নেয়ার বিষয়টিও এখন সবার জানা। লুটপাট করে পকেট ভারি করার দিন খুব দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে—এটা সবাইকেই বুঝতে হবে। বর্তমান সরকারের আমলে না হলেও ভবিষ্যতে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। রেন্টালের নামে লুটপাটে বিরোধিতাকারীদের দেশদ্রোহী বলার অধিকার কারও আছে কি না সে প্রশ্নও উঠতে বাধ্য। এ নিয়ে ধমকের সুরে কথা বলার শক্তি আসে কোথা থেকে সেটা বের করা দরকার। তবে এখন বিদ্যুত্ সঙ্কট সামাল দেয়ার নামে ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার পেছনেই বা কি স্বার্থ কাজ করছে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। দেশ ও জনগণের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার প্রতিটি ঘটনা থেকেই আসল দেশদ্রোহীর পরিচয় গোপন রাখাটা এখন বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। কথায় বলে সত্যের কল বাতাসে নড়ে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads