বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১২

যেসব কারণে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি অপরিহার্য



যেসব কারণে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি অপরিহার্য


॥ সিরাজুর রহমান ॥

ড্যান মজিনা বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি হরতালকে ঘৃণা করেন। সেটা আমরা জানি, কেননা রাষ্ট্রদূত মজিনা নিজেই বলেছেন সে কথা বাংলাদেশের মিডিয়াকে।
বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নতুন একজন রাষ্ট্রদূতের পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক ছিল না। তিনি বাংলাদেশে এসে সবিস্ময়ে দেখলেন যে প্রায়ই হরতাল হচ্ছে। কী কারণে? কারণ এই যে, বাংলাদেশের মানুষ বিনা বাধায় নিজের ভোট নিজে দিয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী সংসদে সদস্য পাঠাতে আর সরকার গঠন করতে চায়। 
অবাধে ভোট দেয়ার অধিকারের দাবিতে হরতাল করতে হচ্ছে, রাষ্ট্রদূত মজিনার জন্য অবশ্যই সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। ভোটদাতারা নিজের ইচ্ছামতো প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেÑ গণতন্ত্রের সেটাই প্রত্যাশা, সেটাই নিয়ম। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও অন্তত মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। সমস্যা হচ্ছে তাদের কাজে গণতন্ত্রের নাম-গন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না। 
আমি বিলাতে আছি ৫২ বছর ধরে। এ দেশে প্রথম ভোট দিয়েছি ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে। সে নির্বাচনে সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হ্যারোল্ড উইলসন তিন কিংবা চার আসনের গরিষ্ঠতায় বিজয়ী লেবারদলীয় সরকার গঠন করেন। পরবর্তীকালে মনোনয়ন ও প্রচারাভিযান থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত অনেকগুলো নির্বাচনের খবর পরিবেশন করেছি বিবিসির বাংলা শ্রোতাদের জন্য। ভোট গণনার হলে প্রবেশের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গোপনীয়তা ও নিরপেক্ষতার শপথ নিতে হয়েছে। 
প্রায়ই দেখেছি এক প্রার্থী প্রতিপক্ষের নীতি ও কার্যকলাপের তুমুল সমালোচনা করছেন, বলতে গেলে প্রতিপক্ষকে তুলোধুনো করে ছাড়ছেন। হয়তো তার দু’শ কিংবা চার শ’ গজ দূরে অন্য একটি হলে প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থী সমান তীব্রতার সাথেই এ দলকে তুলোধুনো করছেন। সভা শেষে দুই সভার শ্রোতারা হয়তো একই পানশালায় গেলেন, কিছুক্ষণ গল্প-গুজারি করে যার যার গন্তব্যস্থলে চলে গেলেন। কোনো মারামারি, এমনকি তর্কাতর্কিও হলো না।
ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত প্রার্থীরা অনিবার্যভাবেই বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানান, তার সাথে করমর্দন করেন। নির্বাচনী ফলাফল অথবা নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে চ্যালেঞ্জর কথা এ যাবৎ শুনিনি। শুধু একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একটি ভোট কেন্দ্র ঠিক নির্ধারিত সময়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বলে বাইরে সারি দিয়ে দাঁড়ানো কিছু লোক ভোট দিতে পারেননি। সে নিয়ে মিডিয়ায় কিছু সমালোচনা উঠেছিল।
ব্রিটিশ গণতন্ত্রে সিভিল সার্ভিসের (আমলাতন্ত্রের) একটা অমূল্য ট্র্যাডিশন আছে। আমলা বা সরকারি কর্মকর্তারা দলনিরপেক্ষ থাকেন। অনেকেই বলে থাকেন সে জন্যই মন্ত্রীরা অদক্ষ এবং আনাড়ি থাকলেও আমলারা শাসনকাজ মোটামুটি নির্ভরযোগ্যভাবে চালিয়ে যান। তারা কোন দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন কিংবা সমর্থন করেন সেটা জানাও প্রায় অসম্ভব। নির্বাচন পরিচালনা তারা করেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রের বাইরে একজন কিংবা দু’জন নিরস্ত্র পুলিশকে দাঁড়িয়ে থেকে হাতের নখ খুঁটতে কিংবা পায়চারি করতে দেখেছি কখনো-সখনো। কিন্তু, ব্যস! ওই পর্যন্তই।
হরতাল ব্রিটেনে এবং অন্য উন্নত দেশেও হয় বৈকি! ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলনে মহিলারা বহু দিন ধরে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন, পার্লামেন্ট ভবনের বাইরের রেলে নিজেদের শিকলবন্দী করে রেখেছিলেন। শ্রমিক-কর্মচারীরা নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য কখনো-সখনো হরতাল করেন। বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক কারণেও হরতাল হয়। ২০০৩ সালে আমেরিকা ও ব্রিটেন যখন ইরাক আক্রমণের উদ্যোগ নিয়েছিল তখন দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) লোক লন্ডনে প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। কিন্তু অবাধে ভোটদানের কিংবা নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে কোনো হরতাল গত ৫২ বছরে ব্রিটেনে আমি দেখিনি।

পুলিশের আচরণ কেমন হওয়া উচিত
মার্কিন নির্বাচন পরিচালনা ও সেসব নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সাধারণত কোনো প্রশ্ন কিংবা বিতর্ক ওঠে না। একটা ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয় ফোরিডা অঙ্গরাজ্যের অল্প কিছু সংখ্যক ভোটের দ্বারা। ত্রুটিপূর্ণ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে সামান্য কিছু ভোট কোন দিকে গেছে সে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয় সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে, ভোটগুলি দেয়া হয়েছিল রিপাবলিকান পার্টির অনুকূলে এবং তারা জর্জ ডব্লিউ বুশকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। বিতর্কের সেখানেই অবসান হয়। 
ব্রিটেনে এবং সাধারণভাবে ইউরোপীয় দেশগুলোতে হরতাল-ধর্মঘটে পুলিশের ভূমিকা অনুকরণযোগ্য। হরতালগুলো হয় সাধারণত শনি কিংবা রোববার, যাতে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে দেশের অর্থনীতির খুব বেশি ক্ষতি না হয়। সাধারণত মিছিলগুলো হয় শান্তিপূর্ণ, পুলিশ মিছিলের দু’পাশ দিয়ে হেঁটে চলে, যাতে শান্তিভঙ্গ করার দুর্মতি কারো না হয়। একাত্তরে বাংলাদেশীরা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ব্রিটেনে বহু মিছিল করেছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অফিসার আমার কাছেও এসেছিলেন দু’বার; জানতে চেয়েছিলেন আমাদের মিছিলে আনুমানিক কত লোক হবে, তাদের কেউ শান্তিভঙ্গ করতে চাইবে কি না। আমাদের মিছিলগুলো খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল, পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের একটা সদ্ভাব গড়ে ওঠে। 
সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো বর্ণবিদ্বেষী গোষ্ঠী শান্তিভঙ্গের উসকানি দিতে মিছিল ইত্যাদি করেছে। স্বভাবতই বিরুদ্ধ মতাবলম্বীরাও পাল্টা মিছিল করতে চেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ছিল দু’পক্ষকে তফাৎ রেখে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা দূর করা। অস্বাভাবিক রকম অশান্তি সৃষ্টির ভয় না থাকলে কোনো সভা-সমাবেশ কিংবা মিছিলের অনুমতি দিতে পুলিশ অস্বীকার করে না, কেননা জনমত প্রকাশের এসব উপায় নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। 
রাষ্ট্রদূত মজিনা বাংলাদেশে এসে দেখলেন যে অবাধে ভোট দেয়ার দাবিতে হরতাল হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে। ১৯৯১-৯৬ সময়ে আওয়ামী লীগের ১৭৩ দিন হরতাল ও লাগাতার হরতাল তিনি দেখেননি। ২০০৬ সালে লগি-লাঠি-বৈঠার লাগাতার হরতাল, সড়ক-বন্দর অবরোধ, রেললাইন উপড়ে ফেলা, রাষ্ট্রপতিকে গৃহবন্দী করে রাখা, লগি-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রাজপথে এক ডজনেরও বেশি মানুষ হত্যা করাÑ এসব কথা বোধহয় স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রিফিংয়েও তাকে বলে দেয়া হয়নি। বিচিত্র নয় যে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির অধীনে নির্বাচনপদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপির নেতৃত্বে সব বিরোধী দল ও গোষ্ঠী হরতাল করছে, মিছিল করছে।
রাষ্ট্রদূত মজিনা যেসব মিছিল দেখছেন সেগুলোতে অশান্তি হয়েছে পুলিশ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকার করে সেসব মিছিলে বাধা দিচ্ছে বলেই। শুধু তাই নয়, শাসক দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুনখারাবি চালাচ্ছে। শান্তি রক্ষা এবং মিছিলকারীদের সংরক্ষণ দেয়ার পরিবর্তে পুলিশ সংরক্ষণ দিচ্ছে শাসক দলের ভাড়াটে গুণ্ডা ও ক্যাডারদের। 

গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে অস্বীকার
বিরোধী দলগুলোর এসব হরতাল-মিছিলেরও প্রয়োজন হচ্ছে সরকার ও শাসক দলের গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের প্রতিবাদে। সব গণতান্ত্রিক দেশেই সভা-সমাবেশ করা, সরকারের নীতি ও কাজের সমালোচনা করার অধিকার নাগরিকদের থাকে। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। এটা আওয়ামী লীগের পুরাতন ঐতিহ্য। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও বিরোধী বিএনপিকে পল্টনে কিংবা মুক্তাঙ্গনে সভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি, বিএনপির মিছিলে বহু হামলা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. এইচ বি এম ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডারদের একটা দল বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চালায়। চারজন মিছিলকারী তাতে মারা গেছে। সব মিডিয়ায় আলোকচিত্র সহকারে সে ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে মামলা তুলে নিয়েছে, নাটোরের বিএনপি নেতা গামার এবং লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের সবাইকে মুক্তি দিয়েছে। 
বর্তমানেও সভা-সমাবেশ করার ঐতিহ্যিক স্থানগুলো বিরোধী দলগুলোর জন্য নিষিদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। দু-একটি সভার অনুমতি দেয়া হচ্ছে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। সভা-সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়া হলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান কার্যালয় কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেও পুলিশ সন্তুষ্ট হচ্ছে না, কাঁটাতারের বাইরে ডজন ডজন পুলিশ দাঁড়িয়ে সে কার্যালয় ঘিরে রাখছে। নেতাকর্মীদের নিজেদের কার্যালয়ের বাইরে থেকে ভেতরে এবং ভেতর থেকে বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে বিএনপি একটি বৈধ ও আইনসম্মত রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশে এখন সামরিক কিংবা জরুরি আইন চালু নেই।
তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না সরকার ও শাসক দল। সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের ধরপাকড়ের যে প্রক্রিয়া তাদের গদিতে আসার সময় থেকে শুরু হয়েছিল সেটা আরো বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ ঘুরে এসে ব্রিটেনে প্রবাসী অনেক বাংলাদেশী আমাকে বলেছেন, গ্রামাঞ্চলে গ্রেফতার আর ধর্ষণের একটা মহাযজ্ঞ চলছে। গ্রেফতারের ভয়ে পুরুষেরা রাতের বেলা নিজ বাড়িতে থাকছেন না, মহিলারা কেমন আতঙ্কে আছেন কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হবে না। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সেসব খবরের কিছু কিছু বিরোধী দলগুলোর সমর্থক মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও গ্রামাঞ্চলের খবর অজানাই থেকে যায়। প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, এসব অপকর্ম ঘটাচ্ছে শাসক দলের ক্যাডার ও ভাড়াটে গুণ্ডারা। দলীয়কৃত পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে এজাহার নিতে অস্বীকার করে, নয়তো উল্টো বাদির ওপরই জোরজুলুম শুরু করে। 
অপেক্ষাকৃত খ্যাত ও পরিচিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রাখা হয় সাজানো দুষ্কৃতির অভিযোগে। একাত্তরে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় কিছু লোক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ করেছিলÑ সে অভিযোগের বিচারের ছলে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি ভাবধারার রাজনীতিকদের গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে। ‘ইসলামি সন্ত্রাস’ দলনের অছিলায় সরকারের বিরোধী টুপি-দাড়ি পরা এবং মসজিদগামীদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে। বর্তমান সরকার একটা কথা সুবিধাজনকভাবে ভুলে যায়। সবচেয়ে জঘন্য যুদ্ধাপরাধী বলে শনাক্ত করা ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে মুক্তি দিয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন মুজিব।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয় গত বছর থেকে। জামায়াতে ইসলামীসহ ছোট-বড় আরো ক’টি গণতন্ত্রমনা দল সমান্তরালভাবে সে আন্দোলনে সহযোগিতা করে। চলতি বছরে এ রকম ১৭টি দল প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে যোগ দিয়ে ১৮ দলের একটি জোট গঠন করেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা দলও বাইরে থেকে বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে।

ইলিয়াস আলীদের গুম হওয়ার পেছনে 
বর্তমানপর্যায়ের আন্দোলনের সাফল্যদৃষ্টে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে বলেই মনে হয়। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বর্তমান সরকারের শুরুর দিন থেকে ১৯৭২-৭৫ সালের রক্ষীবাহিনীর অনুকরণে সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূলপর্যায়ের কর্মীদের হত্যা শুরু করে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ অথবা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে এযাবৎ তারা তিন শ’রও বেশি কর্মীকে হত্যা করেছে। প্রথমে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো এবং আরো পরে অন্যান্য দেশের সরকারও এসব বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার দাবি জানালে তথাকথিত ক্রসফায়ার হত্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু নতুন একটা নারকীয় পদ্ধতি এখন অবলম্বন করা হচ্ছে। 
দু’বছর আগে রাজধানীর মগবাজার এলাকার বিএনপিদলীয় কাউন্সিলর চৌধুরী আলম উধাও হয়ে যান। আজ অবধি তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ধলেশ্বরী এবং শাখা-প্রশাখাসহ বুড়িগঙ্গা নদীতে হাত-পা বাঁধা, গলাকাটা ও গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যাচ্ছে। মিডিয়ায়ও কিছু কিছু গুম হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ শুরু হয়। একাত্তরে রাজাকার আর আলবদররা এভাবেই চোখ এবং হাত-পা বেঁধে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যেত। স্বাধীনতার পরে বহু নদী ও জলাভূমিতে অনেকের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। লোকমুখে আরো বহু লোকের গুম হওয়ার খবর প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র বাসে চড়ে কুষ্টিয়া যাচ্ছিলেন। সাভারে র‌্যাবের বেশ ক’জন ইউনিফর্ম পরা সদস্য র‌্যাবের চিহ্নিত যানবাহনে করে এসে সে বাস থামায় এবং আলোচ্য দু’জন ছাত্রকে নামিয়ে নেয়। অন্য যাত্রীরা বাধা দিলে তারা বলে যে তারা নিরাপত্তারক্ষী র‌্যাব বাহিনীর সদস্য এবং সুনির্দিষ্ট তদন্তের জন্য তারা সাময়িকভাবে সে দু’জন ছাত্রকে গ্রেফতার করছে। সে দু’জন ছাত্রের সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। প্রথমে কিছুকাল নীরব থাকার পর র‌্যাব বলেছে, তারা এ সম্বন্ধে কিছুই জানে না।
এপ্রিল মাসে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতি ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়। রাতের বেলা কয়েকজন লোক ঢাকার বনানীতে তার গাড়ি থামিয়ে তাকে ও তার গাড়ির ড্রাইভারকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের কাছে পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলে ধস্তাধস্তি তদন্ত করতে গিয়েছিলেন; কিন্তু ছিনতাইকারীরা নিজেদের র‌্যাবের লোক বলে পরিচয় দেয় এবং সাব-ইন্সপেক্টরকে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। কাছে অবস্থিত একজন ডাব বিক্রেতাও সাংবাদিকদের বলেছে যে ছিনতাইকারীরা র‌্যাবের ইউনিফর্ম পরা ছিল এবং তারা র‌্যাবের যানবাহনে এসেছিল। এই দুই ব্যক্তি এখন কোথায় কী অবস্থায় আছেন জানা যায়নি।
ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার বিশেষ কিছু তাৎপর্য আছে। তিনি বিএনপির সাংগঠনিক কাজে সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছেন। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটে তিনি এতই সফল হয়েছিলেন যে এরপর আওয়ামী লীগ সেখানে আসন পাবে না বলে বলাবলি হচ্ছিল। তা ছাড়া মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ তৈরির প্রকল্পের বিরুদ্ধে তিনি বৃহত্তর সিলেটে এবং তার বাইরেও জনমত গঠন করেন এবং লাখো লোকের একটা প্রতিবাদ মিছিলও তিনি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, হাসিনার আশ্বাস মূল্যহীন
প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের সদস্যরা প্রথমে দাবি করেন, ইলিয়াস আলীকে মুক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা তারা করছেন। কিন্তু দু-চার দিন পরই মন্ত্রীদের বচন-বাচন পরস্পরবিরোধী ও সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ইঙ্গিত করেন ইলিয়াস আলী সরকারকে বিব্রত করার জন্য খালেদা জিয়ার নির্দেশে আত্মগোপন করে আছেন। আওয়ামী লীগের দুর্মুখ যুগ্ম সম্পাদক হানিফসহ আরো কেউ কেউ তার পুনরাবৃত্তি করেন। র‌্যাব গাজীপুর এলাকায় একটা বাড়িতে অনর্থক হানা দিয়ে এবং ইলিয়াস আলীর বাড়িতে গোপনে সিসিটিভি বসানোর চেষ্টা করে নাটক সৃষ্টি করে। 
ইলিয়াসের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করলে হাসিনা তাকে আশ্বাস দেন যে তার স্বামীকে উদ্ধারের সব চেষ্টা তিনি করবেন। একই সময়ে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে বিধবা বলে উল্লেখ করেন। পুলিশ তদন্তে অগ্রগতি দেখাতে পারেনি বলে হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার দেয়া হয় র‌্যাবকে। কিন্তু র‌্যাব এখন সাফ বলে দিয়েছে যে তারা এখনো কোনো ‘কু’ আবিষ্কার করতে পারেনি।
ইলিয়াস আলীকে গুম করার ঘটনা ঘিরে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। সেই সাথে দেশের সাধারণ মানুষও ক্রোধে ফেটে পড়েÑ যখন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম সম্পাদক রিজভী এবং এ দলের স্ট্যান্ডিং কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা সাজানো হয় এই বলে যে তারা সচিবালয়ে ককটেল বোমা নিক্ষেপ এবং তেজগাঁওয়ে একটা গাড়ি ভাঙচুর করার ঘটনায় ‘হুকুমের আসামি’। একবার নিম্ন আদালতে এবং একবার হাইকোর্টে জামিন দিতে অস্বীকার করে তাদের কাশিমপুর জেলে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সাথে রাখা হয়। 
অবশেষে হাইকোর্ট ৭ জুন আটক নেতাদের জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু তাদের মুক্তি দিতে ৯ দিন দেরি করা হয়েছে। তা ছাড়া জেলগেটে চারজন নেতাকে আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। সবাই সন্দেহ করছেন ১১ জুন বিরোধী ১৮ দলের জোট যে মহাসমাবেশ ডেকেছিল সেটা সফল করার লক্ষ্যে এই নেতারা যাতে কোনো সাংগঠনিক কাজ করতে না পারেন সেটা ছিল সরকারের একটা মতলব। আরো কারো কারো মতে বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বন্দী রেখে আওয়ামী লীগের অধীনে সাজানো নির্বাচন করে আবারো ক্ষমতা পাওয়াই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মতলব। 
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করেন। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল বেআইনি ঘোষণা করা হয়, সরকারের মালিকানাধীন দু’খানি বাংলা এবং দু’খানি ইংরেজি দৈনিক ছাড়া অন্য সব পত্রিকা ও সাময়িকী বন্ধ করে দেয়া হয়। আমি বিবিসি থেকে পত্রপত্রিকা বন্ধ করার সমালোচনা করেছিলাম। সে বছরের জুন মাসে জ্যামাইকা থেকে দেশে ফেরার পথে লন্ডন বিমানবন্দরে মুজিব ভাই ফিট স্ট্রিটের বহু সাংবাদিকের সামনে আমাকে তিরস্কার করেছিলেন, বলেছিলেন যে নিউজপ্রিন্টের ব্ল্যাকমার্কেটিং বন্ধ করার জন্যই তিনি পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন।
মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা অন্য কৌশল অবলম্বন করেছেন। মুখে তিনি বলে বেড়াচ্ছেন যে মিডিয়াকে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এক লাখ পাউন্ডের বিজ্ঞাপন দিয়ে সেটা বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছেন। তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কথায় কথায় দাবি করেন, তার আগে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর কখনো এত ভালো ছিল না। শেখ হাসিনাও তেমনি দাবি করছেন যে তার আগে মিডিয়া কখনো এমন স্বাধীন ছিল না। বাংলাদেশের যেকোনো সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করুন, তারা বলবেন সম্পূর্ণ উল্টো কথা। 

মিডিয়ার বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ
বর্তমান সরকার মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের আমলে ৪০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর আক্রমণে ১৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ৬২১ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়, তাদের মধ্যে আহত হয়েছেন ৪২৩ জন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৬০ জন সাংবাদিকের ওপর পুলিশের হামলা হয়, ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। শাসক দলের কর্মীরা সাংবাদিকদের নির্যাতন করছে বলে প্রায় দিনই পত্রপত্রিকায় খবর বেরোয়।
২০১১ সালে ঢাকার একটি দৈনিকের সাংবাদিক ফরহাদ তার নয়াপল্টনের বাসায় খুন হন। অনেক পরে পুলিশ দাবি করে তাকে খুন করেছে ছিনতাইকারীরা। সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানীকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তার মৃত্যু হয়। বরিশালের মুলাদী প্রেস কাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ীকে দিবালোকে হত্যা করা হয়েছে।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি এবং তার স্বামী মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার গভীর রাতে নিজেদের শয়নকক্ষে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। তাদের ল্যাপটপ কম্পিউটার ছাড়া বাসা থেকে আর কিছু খোয়া যায়নি। জানা যায়, জ্বালানি খাতে ২০ হাজার কোটি (২০০ বিলিয়ন) টাকার দুর্নীতি সম্বন্ধে তারা বহু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। আগেই বলেছি সরকার, পুলিশ ও র‌্যাব এই দু’জন সাংবাদিকের খুনিদের গ্রেফতারের চেষ্টা না করে দায়িত্ব একে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। এ দিকে দেশব্যাপী জোর গুজব, এই দুর্নীতির সাথে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা জড়িত এবং হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মিডিয়া নির্যাতনের আরো অজস্র ঘটনা ঘটেছে গত ৪১-৪২ মাসে। 
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপর সরকারের রোষানল সংবাদের স্বাধীনতা হত্যার আরো কিছু প্রমাণ দেয়। সরকারের সমালোচনা করায় চ্যানেল ওয়ান টেলিভিশন চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়ার মহাসমাবেশের বক্তৃতা সরাসরি প্রচার করার সময় একুশে টেলিভিশনসহ তিনটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার মাঝপথে বন্ধ করে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল একটি চ্যানেলের টকশোতে নিজের মতামত ব্যক্ত করায় হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মানিক তাকে নিজের এজলাসে তলব করে কয়েক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখেন।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সবগুলো সংগঠন এখন ঐক্যবদ্ধভাবে রুনি ও সাগরসহ এযাবৎ নিহত সাংবাদিকদের হত্যার বিচার দাবি করছেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রায়ই আন্দোলন করছেন।
মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিকদের হত্যা-নির্যাতন করা হচ্ছে এ কারণে যে বর্তমান সরকার স্থায়ীভাবে গদি দখল করে রাখতে চায়। সে কথা তারা প্রায়ই ঘোষণা করছে। যুগ্ম সম্পাদক হানিফসহ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা পরিষ্কার বলেছেন, বাকশাল পদ্ধতির শাসন চালু করাই তাদের উদ্দেশ্য। আওয়ামী লীগ জানে যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা কিছুতেই জয়ী হবে না। 

বাকশালের হাতছানি
বিএনপি এবং বর্তমানে আরো ১৭টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। আপনাদের অবশ্যই মনে আছে, এ পদ্ধতি চালু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সে বছর আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী একযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি চালু করার দাবিতে আন্দোলন করছিল। তারা অনেকগুলো হরতাল ডাকে, দেশের অর্থনীতির প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে এবং সেসব হরতালে অশান্তির ফলে অনেকগুলো প্রাণহানিও হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের (১৯৯৬) নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী বর্জন করে। তাদের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে দেশে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী দিয়ে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি চালু করে এবং সে পদ্ধতির অধীনে সে বছরেরই জুন মাসে আবার যে নির্বাচন হয় তাতে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। 
বাংলাদেশে বিচার বিভাগের যে দলীয়করণ হয়েছে খুব কম লোকই সেটা অস্বীকার করবেন। সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর দেশের প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীটি অবৈধ ঘোষণা করেন। তার রায়ের প্রকাশিত সারাংশে আরো বলা হয়, দেশ ও জাতির স্বার্থে আগামী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতিতে অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। বছর পেরিয়ে গেলেও সে রায়ের পূর্ণ বিবরণ আজ অবধি প্রকাশ করা হয়নি এবং সে প্রধান বিচারপতি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তার রায় দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে দেয়া হয়। সরকার তারপর ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সরকারের পরিচালনাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং গণতন্ত্রকামী ছোট-বড় অন্য দল সেটা মেনে নিতে পারেনি অনেক কারণে। প্রথমত, সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই বলে যাচ্ছেন অন্তত ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা গদি ছাড়তে চান না। তার পরও যে তারা আরো কত দিন গদি দখল করে রাখতে চাইবেন কে জানে? এটাকে কিছুতেই গণতন্ত্র বলা যাবে না। সাদা কথায় সেটা স্বৈরতন্ত্র। সেটা দেশের মানুষের গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তারা সংসদীয় গণতন্ত্রের দাবিতে অসীম ত্যাগ স্বীকার করে ১৯৭১ সালে দেশটাকে স্বাধীন করেছিল। এই যেখানে অবস্থা সেখানে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, নিরপেক্ষ নির্বাচন নয়, বরং সাধু ও অসাধু উপায়ে নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করাই সরকারের পরিকল্পনা। 
সে প্রস্তুতি তারা সরকার গঠনের প্রথম দিন থেকেই নিয়েছে। খুবই নগ্ন এবং সংবিধানবহির্ভূতভাবে তারা আমলাতন্ত্র, পুলিশ ইত্যাদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং বিচার বিভাগের দলীয়করণ করেছে। সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বাহিনীগুলোও দলীয়করণ করা হয়েছে। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছিল ৩২ জন সাবেক ছাত্রলীগ সদস্যকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স বা এনএসআইতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ডবল ও ট্রিপল পদোন্নতি দিয়ে এবং বহু জ্যেষ্ঠতা ডিঙিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে পরিচিত অফিসারদের উঁচু পদে নিয়োগ করা হয়েছে। সাড়ে ছয় শ’ সিনিয়র আমলাকে ওএসডি করে সেসব পদে আওয়ামী লীগপন্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিগত সাড়ে তিন বছরে দেশের মানুষ সরকারের আমলাতন্ত্রের কাছ থেকে সুবিচার পায়নি। 

দলীয়কৃত পুলিশ ও নার্সিসাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে। থানার পুলিশ আওয়ামী লীগের গুণ্ডা ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে অস্বীকার করে বলে অজস্র অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে, অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আছে। প্রতিদিনই পত্রিকায় খুনখারাবির খবর বেরোচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই তার কোনো সুরাহা করতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে টেলিভিশন সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি ও সাগর নিজেদের শোবার ঘরে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। তখন জানা গিয়েছিল যে জ্বালানি খাতে ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে তারা বহু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। তারপর প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সে দায়িত্ব নেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত পুলিশ ও র‌্যাব নাকি কোনো ‘কুও’ খুঁজে পায়নি। 
বাংলাদেশে এক লাখ ৪২ হাজার পুলিশ আছে। তাদের ব্যস্ত রাখা হচ্ছে সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করার কাজে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন পুলিশে পুরস্কৃত হওয়ার এবং পদোন্নতি পাওয়ার সহজ উপায়। গত বছরের ৬ জুলাই সংসদ চত্বরে পুলিশের ডেপুটি কমিশনার হারুন স্বয়ং বিরোধী দলের সংসদীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে তার শরীরের একাধিক হাড় ভেঙে দিয়েছিলেন। হারুনকে এখন পদোন্নতি দিয়ে একটি জেলার পুলিশ সুপার করা হয়েছে। গত ২২ মে পত্রপত্রিকার একটা শিরোনাম ছিলো : নোয়াখালীতে শান্তিপূর্ণ হরতাল, ৫৬ জন গ্রেফতার। ২৩ মের একটি শিরোনাম : জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে বিএনপির ৩০ জন নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
২৯ মের পত্রিকাগুলোর প্রধান খবর ছিল দিনদুপুরে ঢাকার জেলা জজের আদালত চত্বর থেকে কয়েকজন পুলিশ বাবা-মায়ের সামনে থেকে এক তরুণীকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। সাংবাদিক ও আইনজীবীরা বাধা দিতে গেলে পুলিশ তাদের মারধর করে। একই দিনের আরেকটি শিরোনাম : হাজতখানায় আসামি পিটিয়ে আহত করল পুলিশ।
প্রাচীন গ্রিক রূপকথার নার্সিসাস নিজের সৌন্দর্যে এতই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে সেটাই তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন একই কমপ্লেক্সে ভুগছেন। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন যে তার আমলে আইনশৃঙ্খলা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। অন্য দিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সে দিন পুলিশের কাছ থেকে সাংবাদিকদের দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্য দিকে সাহারা খাতুন এখন ধুয়া ধরেছেন যে তার আমলে পুলিশবাহিনীর অনেক উন্নতি হয়েছে।

সাজানো নির্বাচনের কলকাঠি
সরকারের চোখে উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। সরকার হুকুম দিলে, এমনকি না দিলেও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পিটিয়ে লাশ করতে, তাদের গ্রেফতার করতে এবং সাজানো মামলায় জেলে বন্দী করে রাখতে পুলিশ দ্বিধা করছে না। গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গদলগুলোর বিরুদ্ধে সাড়ে ছয় হাজার মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় বিএনপির এক লাখ ৫৬ হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থককে আসামি করা হয়েছে। বিনিময়ে কিন্তু পুলিশ চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি করে, এমনকি ধর্ষণ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।
স্বাভাবিক অবস্থায় এ রকম পরিস্থিতিতে নাগরিকেরা আদালতে বিচারপ্রার্থী হতে পারতেন। বাংলাদেশে বর্তমানে সে সুযোগ নেই। এ সরকারের আমলে হাইকোর্টেও নতুন ৫৯ জন বিচারপতি ও ছয়জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে যাদের প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের প্রবল সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন। তাদের একজন গত বছর লন্ডনে এসে বাংলা টেলি-চ্যানেলে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার এবং বিএনপির নেত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিলেন। 
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার ওয়াইল্ড ওয়েস্টে কথায় কথায় ফাঁসির দণ্ড দানের কারণে কয়েকজন বিচারপতি হ্যাঙ্গিং জাজ বলে খ্যাত হয়েছিলেন। তারও আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্যারিসে পাবলিক প্রসিকিউটর ম্যাক্সিমিলিয়েন রোবসপিয়ের স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বহু লোককে খুঁজে বের করে গিলোটিনে পাঠিয়েছিলেন। অদৃষ্টের পরিহাস, তার মাথাও কাটা গিয়েছিল গিলোটিনে। শুনেছি আড্ডা-মজলিসে বাংলাদেশের কোনো কোনো বিচারপতিকে রোবসপিয়েরের সাথে তুলনা করা হয়।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মে মাসের শেষার্ধে বলেছেন, সরকার কাজ করতে পারছে না দুর্নীতির জন্য। তিনি আরো বলেন, দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে পুলিশ বাহিনীতে এবং বিচার বিভাগে। সরিষার মধ্যেই যখন এত ভূত তখন মানুষের দুর্ভোগের কথা সহজেই কল্পনা করা যায়। এ হচ্ছে আজকের বাংলাদেশের একটা খণ্ডচিত্র। 
বাংলাদেশে আগামী বছরের শেষে নির্বাচন দিতে হবে। 
শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। ২০০১ সালে হাসিনার সৃষ্ট নজিরই তার প্রধান কারণ। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে হাসিনা পরের নির্বাচনেও বিজয় সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেন। আমলাতন্ত্রে বদবদল করে তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত সব দায়িত্বে আওয়ামী লীগ সমর্থক আমলাদের নিয়োগ করেন। তারপর হাসিনা নির্বাচন বিজয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন। কিন্তু নির্বাচনের তিন মাস আগে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেন। তারা গোড়াতেই মাত্র ১২ জন শীর্ষ আমলাকে বদলি করেন। আওয়ামী লীগ মহলে রব ওঠে ‘গেল, গেল’ পড়ে গেল। শেখ হাসিনা এই বদলিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন এবং দেখা গেল, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির ওপর হাসিনার আর আস্থা রইল না। তিনি বুঝে গেলেন তার ডেকে আনা এ পদ্ধতি তার নির্বাচনী বিজয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। সে জন্যই তিনি তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি তুলে দিয়ে নিজের ব্যবস্থাপনায় নিজের নীলনকশা অনুযায়ী নির্বাচন করতে চান।
এই যেখানে অবস্থা সেখানে হরতাল-আন্দোলন ছাড়া গণতন্ত্রকামী দলগুলোকে কী বিকল্প কর্মপন্থার পরামর্শ দিতে পারেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এবং তার ওপরওয়ালারা? ড্যান মজিনার একজন পূর্বসূরি হ্যারি কে টমাস আর ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ২০০৬-০৭ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে অত্যধিক আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তার ফলে বাংলাদেশ পেয়েছিল ফখরুদ্দীন আহমদের বর্ণচোরা সামরিক শাসন, মাইনাস টু ও মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা, একটা মাস্টারপ্ল্যান নির্বাচন এবং বর্তমান মহাসঙ্কট। বাংলাদেশের যারা সত্যিকারের বন্ধু তাদের উচিত হবে আধা খ্যাঁচড়া অতি উৎসাহী কল্যাণ প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকা। 
(নিউ ইয়র্কে আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা সম্মেলনে পঠিত। জুন ২০১২)
serajurrahman34@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads