দেশজুড়ে অজ্ঞাত লাশের ছড়াছড়ি। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ। রাস্তার পাশে, বিলে-ঝিলে, রেললাইনে অহরহ পড়ে থাকতে দেখা যায় মানুষের মৃতদেহ। খুন করে বস্তাবন্দি করে ডাস্টবিন, ঝিল, হাওর, জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গুমের চেষ্টা করছে দুর্বৃত্তরা। এদের অনেকের পরিচয়ও মেলে না। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ টুকরো করার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও ঘটছে। অধিকাংশ ঘটনারই কোনো কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। গ্রেফতার হচ্ছে না খুনিরা। এ ধরনের পরিচয় না মেলা লাশের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
পুলিশ সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজারেরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডের তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কূটনীতিকও। এ সময় সারাদেশে ৯২৯টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক ও পারিবারিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও পূর্বশত্রুতার জেরে ঘটছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। হত্যার পর আলামত সংগ্রহ করেও অনেক ক্ষেত্রে খুনিদের গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খুনিদের শনাক্ত করতে না পারা এবং ক্লু উদ্ঘাটন না হওয়ার কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ঊঠছে। মামলা হলেও দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত শেষে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হওয়ার পর মামলাটি হিমাগারে চলে যায়। এতে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় খুনিরা উত্সাহিত হচ্ছে। এ কারণে অপেশাদার
খুনিরাও খুনখারাবি ঘটাচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের মে পর্যন্ত গত ৫ মাসে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডে ঘটেছে ১ হাজার ৬৯৭টি। চলতি মাসের ২৫ জুন পর্যন্ত ৩৭০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ সময় রাজধানীতে ঘটেছে ১২৫টি হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩০৪টি, ফেব্রুুয়ারিতে ৩২০টি, মার্চে ৩২৪টি, এপ্রিলে ৩৬৩টি এবং মে মাসে ৩৮৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। জুন
মাস শেষ হওয়ার এখনও ৫ দিন বাকি থাকায় এ মাসের মোট খুনের সঠিক পরিসংখ্যান এখনও তৈরি করেনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৫ জুন পর্যন্ত ৩৭০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে এ মাসে খুনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। চলতি বছরের রাজধানীতে জানুয়ারিতে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২৩, এপ্রিলে ১৯, মে মাসে ২৮টি খুন ও চলতি মাসের গতকাল পর্যন্ত ১৮-১৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
এ ব্যাপারে র্যাবের গোয়েন্দা উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, আমাদের দেশে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বড় বড় কথা বলেন; মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করেন। সন্ত্রাসীদের মারলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, এ কথাও বলেন তারা। এখন তো হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না? তিনি বলেন, সন্ত্রসীরা এদেশের কিছু অতিপণ্ডিত ব্যক্তিদের কারণে প্রশ্রয় পাচ্ছে। এতে দেশে হত্যাকাণ্ডও বাড়ছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এখন বিভিন্ন স্থান থেকেই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। এতেই মনে হচ্ছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তিনি বলেন, লাশ উদ্ধার হলেও খুনিরা চিহ্নিত হয় না। এতে অপরাধীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি এক ধরনের আস্থা জন্মেছে যে, হত্যার পর লাশ নদী-নালায় ফেলে দিলেই বেওয়াররিশ হিসেবে উদ্ধার করে পুলিশ দাফন করবে। আর এমনই হচ্ছে। এতে অপরাধীরাও ক্রমে উত্সাহিত হচ্ছে। এমনকি নদী, খাল-বিল থেকে লাশ উদ্ধারের পর এলাকা নির্ধারণ নিয়েও পুলিশ রশি টানাটানি করে। অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, দেখা গেছে এসব মামলার তদন্তও বেশিদূর এগোয় না। আবার খুব সহজেই আদালত চার্জশিটও দিয়ে দেয়।
মানবাধিকার নেত্রী ও হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, বেওয়ারিশ লাশ যেভাবে বাড়ছে, তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। এত বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার কথা নয়। সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে পরিকল্পিত হত্যার শিকার অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে। এসব হত্যার কোনো ক্লু উদ্ঘাটিত হচ্ছে না।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসের তুলনায় চলতি বছরের সাড়ে ৫ মাসে বেওয়ারশি লাশসহ হত্যাকাণ্ড কম হয়েছে। গত বছর জুন পর্যন্ত রাজধানীতে ১৩৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্যে গত ৫ মার্চ বিকালে সূত্রাপুর এলাকা থেকে মাথাবিহীন অজ্ঞাত যুবকের (২২) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ ফেব্রুয়ারি কাফরুলের কচুক্ষেত এলাকায় নিখোঁজ স্কুলছাত্র শহিদুজ্জামান বিজয়ের (৮) লাশ উদ্ধার করা হয় রিজার্ভ ট্যাঙ্ক থেকে। ৯ মার্চ যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞাত (৩৫) এক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যার পর খণ্ডিত লাশ এবং সোয়ারী ঘাট থেকে অজ্ঞাত (৫০) এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৭ জুন মিরপুরে অজ্ঞাত তরুণীর (৩০) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, ১৭ জুন নিখোঁজ হওয়ার এক মাস পর যাত্রাবাড়ীতে এক ভাগাড় থেকে কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০ জুন শেরেবাংলা নগর এলাকার ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের পাশ থেকে অজ্ঞাত (৪০) পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৩ জুন শ্যামপুর এলাকা থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় মো. কাজল হোসেন (২২) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪ জানুয়ারি হাজারীবাগের একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত (১৩) এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৪ জুন খিলগাঁওয়ের নবীনবাগ ঝিল থেকে অজ্ঞাত (৪৫) এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৫ মে দক্ষিণখান কাঁচাবাজারের পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে অজ্ঞাত কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে গত ৫ জুন রাত ৮টার দিকে সেগাুনবাগিচার তোপখানা রোডে ২৭/১৩/১৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় তিন যুবক ঢুকে মায়ের সামনে মেয়ে নিশাত বানুকে নৃশংসভাবে খুন করে। এ ঘটনায় আহত হন মা খালেদা বানু। হত্যাকাণ্ডের ৩৬ ঘণ্টা পর পুলিশ নিশাত বানুর লাশ এবং আহত বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে। হত্যাকাণ্ডের পর দুর্বৃত্তরা বাসার আসবাবপত্র ভাংচুর করে এবং সিন্দুক ভেঙে নগদ ৪০ হাজার টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ বাড়ির মূল্যবান দলিল লুট করে নিয়ে যায়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা ডিবি তদন্ত কররছে, কিন্তু ২১ দিন পার হলেও হত্যার ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি। আইনের আওতায় আনা হয়নি খুনিদের। এ ঘটনায় নিহতের ভাড়াটিয়া একটি হোটেল মালিক ও তার ভাইকে গ্রেফতার করলেও রহস্য উন্মোচন হয়নি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার ৫৮/এ/২ নম্বর ভবনের এ-৪ ফ্ল্যাটে খুন হন সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী সাংবাদিক মেহেরুন রুনি। পরদিন সকালে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। ওই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের গ্রেফতারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। পরে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার এ ঘটনার তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য’ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান। কিন্তু তাদের সব কথাই শেষ পর্যন্ত বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। গত ৫ মার্চ রাতে গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ২২/বি নম্বর বাড়িতে বসবাস করত সৌদি দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালাফ আল-আলী। ওই রাতে বাসার ২০ গজ দূরে তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় ওই রাতেই খালাফ মারা যান। হত্যাকাণ্ডের পর মামলাটি ডিবি তদন্ত শুরু করে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪ মাস পার হতে চলল, এখনও এ হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। হত্যার সঙ্গে জড়িতদেরও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকপুত্র সাহেদ-উদ-দৌলার (৪২) লাশ সেগুনবাগিচার চট্টলা আবাসিক হোটেলের ১৫/২ নম্বর কক্ষ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন নিহতের বড় ভাই আরিফ-উদ-দৌলা রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গত ১৪ এপ্রিল গুলশান দুই নম্বর সেকশনের ১০১ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলার সি-৫ নম্বর ফ্লাটে থাকতেন ফাহিমা সুলতানা (৪০)। সেখানে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় আহত হন গৃহপরিচারিকা বীনা। তিনি বর্তমানে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। গত ২২ এপ্রিল সুরক্ষিত এলাকা জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টলে অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই তরুণীকে নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে খুন করে লাশ বাথরুমে ফেলে রাখা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ২ মাস পার হয়ে গেলেও কোনো ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ।
এছাড়া গত ২ জুন হাতিরপুর নাহার প্লাজার কাছ থেকে রুমি নামে এক তরুণীর ২৮ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে। পরে লাশ গুম করার জন্য ধারালো অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে ভবনের ছাদ থেকে নিচে ফেলা হয়। এ ঘটনার মূল হোতা সাইদুর রহমান বাচ্চুকে গ্রেফতার করা হয়। সে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। গত ২৯ এপ্রিল বাড্ডায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক নজরুল ইসলাম। গত ২০ মে যাত্রাবাড়ীতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন পুলিশের সোর্স আলমগীর হোসেন। গত ১৬ জুন রাতে ভগ্নিপতির বাসা থেকে নিজ বাসায় যাওয়ার পথে মিরপুরে বখাটেরা তুলে নিয়ে খুন করে পপি (১৬) নামের এক কিশোরীকে। পরদিন সকালে পুলিশ বাসা থেকে ওই তরুণীর লাশ উদ্ধার করে।
গত ১৫ জুন রাতে যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা উপজেলার কাশিপুর প্রতিনিধি জামালউদ্দিনকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। রাত ১১টার দিকে কাশিপুর বাজারের পাশে একদল সন্ত্রাসী তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে হত্যা করে। চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর অন্যতম আসামি উকিল ভারতে গ্রেফতার হয়। শার্শা থানার ওসি একেএম ফারুক জানান, সাংবাদিক জামাল উদ্দিনকে হত্যার পর পরই ঘাতকরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এ কারণে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পালিয়ে যাওয়া ঘাতকদের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ২ হাজারেরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডের তালিকায় রয়েছেন সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কূটনীতিকও। এ সময় সারাদেশে ৯২৯টি বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক ও পারিবারিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, জমি দখল ও পূর্বশত্রুতার জেরে ঘটছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। হত্যার পর আলামত সংগ্রহ করেও অনেক ক্ষেত্রে খুনিদের গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খুনিদের শনাক্ত করতে না পারা এবং ক্লু উদ্ঘাটন না হওয়ার কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ঊঠছে। মামলা হলেও দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত শেষে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হওয়ার পর মামলাটি হিমাগারে চলে যায়। এতে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ায় খুনিরা উত্সাহিত হচ্ছে। এ কারণে অপেশাদার
খুনিরাও খুনখারাবি ঘটাচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, চলতি বছরের মে পর্যন্ত গত ৫ মাসে সারাদেশে হত্যাকাণ্ডে ঘটেছে ১ হাজার ৬৯৭টি। চলতি মাসের ২৫ জুন পর্যন্ত ৩৭০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ সময় রাজধানীতে ঘটেছে ১২৫টি হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩০৪টি, ফেব্রুুয়ারিতে ৩২০টি, মার্চে ৩২৪টি, এপ্রিলে ৩৬৩টি এবং মে মাসে ৩৮৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। জুন
মাস শেষ হওয়ার এখনও ৫ দিন বাকি থাকায় এ মাসের মোট খুনের সঠিক পরিসংখ্যান এখনও তৈরি করেনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৫ জুন পর্যন্ত ৩৭০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে এ মাসে খুনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। চলতি বছরের রাজধানীতে জানুয়ারিতে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২৩, এপ্রিলে ১৯, মে মাসে ২৮টি খুন ও চলতি মাসের গতকাল পর্যন্ত ১৮-১৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
এ ব্যাপারে র্যাবের গোয়েন্দা উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, আমাদের দেশে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বড় বড় কথা বলেন; মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করেন। সন্ত্রাসীদের মারলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, এ কথাও বলেন তারা। এখন তো হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না? তিনি বলেন, সন্ত্রসীরা এদেশের কিছু অতিপণ্ডিত ব্যক্তিদের কারণে প্রশ্রয় পাচ্ছে। এতে দেশে হত্যাকাণ্ডও বাড়ছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এখন বিভিন্ন স্থান থেকেই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে। এতেই মনে হচ্ছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তিনি বলেন, লাশ উদ্ধার হলেও খুনিরা চিহ্নিত হয় না। এতে অপরাধীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি এক ধরনের আস্থা জন্মেছে যে, হত্যার পর লাশ নদী-নালায় ফেলে দিলেই বেওয়াররিশ হিসেবে উদ্ধার করে পুলিশ দাফন করবে। আর এমনই হচ্ছে। এতে অপরাধীরাও ক্রমে উত্সাহিত হচ্ছে। এমনকি নদী, খাল-বিল থেকে লাশ উদ্ধারের পর এলাকা নির্ধারণ নিয়েও পুলিশ রশি টানাটানি করে। অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, দেখা গেছে এসব মামলার তদন্তও বেশিদূর এগোয় না। আবার খুব সহজেই আদালত চার্জশিটও দিয়ে দেয়।
মানবাধিকার নেত্রী ও হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, বেওয়ারিশ লাশ যেভাবে বাড়ছে, তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। এত বেওয়ারিশ লাশ হওয়ার কথা নয়। সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে পরিকল্পিত হত্যার শিকার অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে। এসব হত্যার কোনো ক্লু উদ্ঘাটিত হচ্ছে না।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসের তুলনায় চলতি বছরের সাড়ে ৫ মাসে বেওয়ারশি লাশসহ হত্যাকাণ্ড কম হয়েছে। গত বছর জুন পর্যন্ত রাজধানীতে ১৩৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডের মধ্যে গত ৫ মার্চ বিকালে সূত্রাপুর এলাকা থেকে মাথাবিহীন অজ্ঞাত যুবকের (২২) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৭ ফেব্রুয়ারি কাফরুলের কচুক্ষেত এলাকায় নিখোঁজ স্কুলছাত্র শহিদুজ্জামান বিজয়ের (৮) লাশ উদ্ধার করা হয় রিজার্ভ ট্যাঙ্ক থেকে। ৯ মার্চ যাত্রাবাড়ীতে অজ্ঞাত (৩৫) এক ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যার পর খণ্ডিত লাশ এবং সোয়ারী ঘাট থেকে অজ্ঞাত (৫০) এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৭ জুন মিরপুরে অজ্ঞাত তরুণীর (৩০) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ, ১৭ জুন নিখোঁজ হওয়ার এক মাস পর যাত্রাবাড়ীতে এক ভাগাড় থেকে কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০ জুন শেরেবাংলা নগর এলাকার ঢাকা মহিলা পলিটেকনিকের পাশ থেকে অজ্ঞাত (৪০) পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৩ জুন শ্যামপুর এলাকা থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় মো. কাজল হোসেন (২২) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৪ জানুয়ারি হাজারীবাগের একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত (১৩) এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৪ জুন খিলগাঁওয়ের নবীনবাগ ঝিল থেকে অজ্ঞাত (৪৫) এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৫ মে দক্ষিণখান কাঁচাবাজারের পাশে একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে অজ্ঞাত কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে গত ৫ জুন রাত ৮টার দিকে সেগাুনবাগিচার তোপখানা রোডে ২৭/১৩/১৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় তিন যুবক ঢুকে মায়ের সামনে মেয়ে নিশাত বানুকে নৃশংসভাবে খুন করে। এ ঘটনায় আহত হন মা খালেদা বানু। হত্যাকাণ্ডের ৩৬ ঘণ্টা পর পুলিশ নিশাত বানুর লাশ এবং আহত বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে। হত্যাকাণ্ডের পর দুর্বৃত্তরা বাসার আসবাবপত্র ভাংচুর করে এবং সিন্দুক ভেঙে নগদ ৪০ হাজার টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ বাড়ির মূল্যবান দলিল লুট করে নিয়ে যায়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা ডিবি তদন্ত কররছে, কিন্তু ২১ দিন পার হলেও হত্যার ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি। আইনের আওতায় আনা হয়নি খুনিদের। এ ঘটনায় নিহতের ভাড়াটিয়া একটি হোটেল মালিক ও তার ভাইকে গ্রেফতার করলেও রহস্য উন্মোচন হয়নি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার ৫৮/এ/২ নম্বর ভবনের এ-৪ ফ্ল্যাটে খুন হন সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ও তার স্ত্রী সাংবাদিক মেহেরুন রুনি। পরদিন সকালে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। ওই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুনিদের গ্রেফতারে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। পরে আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার এ ঘটনার তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য’ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান। কিন্তু তাদের সব কথাই শেষ পর্যন্ত বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। গত ৫ মার্চ রাতে গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ২২/বি নম্বর বাড়িতে বসবাস করত সৌদি দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালাফ আল-আলী। ওই রাতে বাসার ২০ গজ দূরে তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় ওই রাতেই খালাফ মারা যান। হত্যাকাণ্ডের পর মামলাটি ডিবি তদন্ত শুরু করে। হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪ মাস পার হতে চলল, এখনও এ হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। হত্যার সঙ্গে জড়িতদেরও শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকপুত্র সাহেদ-উদ-দৌলার (৪২) লাশ সেগুনবাগিচার চট্টলা আবাসিক হোটেলের ১৫/২ নম্বর কক্ষ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন নিহতের বড় ভাই আরিফ-উদ-দৌলা রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গত ১৪ এপ্রিল গুলশান দুই নম্বর সেকশনের ১০১ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলার সি-৫ নম্বর ফ্লাটে থাকতেন ফাহিমা সুলতানা (৪০)। সেখানে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় আহত হন গৃহপরিচারিকা বীনা। তিনি বর্তমানে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। গত ২২ এপ্রিল সুরক্ষিত এলাকা জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টলে অজ্ঞাত এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই তরুণীকে নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে খুন করে লাশ বাথরুমে ফেলে রাখা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ২ মাস পার হয়ে গেলেও কোনো ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ।
এছাড়া গত ২ জুন হাতিরপুর নাহার প্লাজার কাছ থেকে রুমি নামে এক তরুণীর ২৮ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে। পরে লাশ গুম করার জন্য ধারালো অস্ত্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে ভবনের ছাদ থেকে নিচে ফেলা হয়। এ ঘটনার মূল হোতা সাইদুর রহমান বাচ্চুকে গ্রেফতার করা হয়। সে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। গত ২৯ এপ্রিল বাড্ডায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক নজরুল ইসলাম। গত ২০ মে যাত্রাবাড়ীতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন পুলিশের সোর্স আলমগীর হোসেন। গত ১৬ জুন রাতে ভগ্নিপতির বাসা থেকে নিজ বাসায় যাওয়ার পথে মিরপুরে বখাটেরা তুলে নিয়ে খুন করে পপি (১৬) নামের এক কিশোরীকে। পরদিন সকালে পুলিশ বাসা থেকে ওই তরুণীর লাশ উদ্ধার করে।
গত ১৫ জুন রাতে যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা উপজেলার কাশিপুর প্রতিনিধি জামালউদ্দিনকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। রাত ১১টার দিকে কাশিপুর বাজারের পাশে একদল সন্ত্রাসী তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে হত্যা করে। চোরাচালানিদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের দু’দিন পর অন্যতম আসামি উকিল ভারতে গ্রেফতার হয়। শার্শা থানার ওসি একেএম ফারুক জানান, সাংবাদিক জামাল উদ্দিনকে হত্যার পর পরই ঘাতকরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এ কারণে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পালিয়ে যাওয়া ঘাতকদের খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা চলছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন