বর্তমান সরকারের পৌনে ৪ বছরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় ধ্বংসের মুখে পড়েছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প ও গবাদিপশুর উন্নয়ন। মত্স্য খাতেও চলছে চরম নৈরাজ্য। মন্ত্রণালয়ের উন্নতি করতে ব্যর্থ হলেও নিজের সম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন মত্স ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মন্ত্রী হওয়ার পর এরই মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন তুরাগ থানাধীন তাফালিয়া এলাকায় তৈরি করেছেন ৭ তলা বাড়ি। গাজীপুরে ছোট স্ত্রীর নামে দখল করে নিয়েছেন ৭১ শতাংশ জমি। ঢাকার মিরপুরে গার্মেন্ট, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও নিজ এলাকার শত শত বিঘা জমি ক্রয়সহ প্রভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন মন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যরা। মন্ত্রী হিসেবে নিজেকে সফল দাবি করে মন্ত্রী বলেছেন, তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না। তার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগও সত্য নয়। আর বাড়ি তৈরি করেছেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, আবদুল লতিফ বিশ্বাস মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, মত্স্য অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি এবং মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দফতরে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর অধীনস্থ বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সর্বাধিক।
আমার দেশ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মন্ত্রী হওয়ার শুরু থেকেই ঘুষ-দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস। মন্ত্রী হওয়ার ১০ মাসের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কাছে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের তত্কালীন মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। ওই চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলম খান অভিযোগ করেছিলেন, মন্ত্রীর ঘুষের দাবি না মেটানোর কারণে পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিটি কাজে বাধার সৃষ্টি ও তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার এক মাসের মাথায় দুই লাখ টাকা ঘুষ চান মন্ত্রী। ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রাণিসম্পদ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দফতরের সব ফাইল ও কাজ আটকে দিয়েছেন। ঘুষ না দেয়ায় মহাপরিচালকের ঝুলে থাকা পদোন্নতিও পাননি। ওই চিঠিতে সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগ তোলেন তিনি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এইচটি ইমামের কাছে অভিযোগ করার পর মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও চাকরি হারাতে হয়েছিল প্রাণী বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা ড. জাহাঙ্গীরকে। বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে ড. জাহাঙ্গীর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টে রায় তার পক্ষে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। আপিল বিভাগও সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন। ড. জাহাঙ্গীর আলম খান আদালতের রায় পেয়েও দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর অধীনে চাকরি করবেন না ঘোষণা দিয়ে নিজের পেনশন চেয়ে আবেদন করেন। একইভাবে মন্ত্রীর দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আরেক মহাপরিচালক হাবীবুর রহমান।
মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বড় একটি অভিযোগ, মত্স্য অধিদফতরের ট্রলার লাইসেন্স বিতরণে অনিয়ম। নিজস্ব জেটি ও হিমাগার আছে, এমনসব প্রতিষ্ঠানকে ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স না দিয়ে মোটা অংকের ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে কোনো অবকাঠামো নেই, এমন প্রতিষ্ঠানকে ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়র নামে লাইসেন্স গ্রহণ করে ওই লাইসেন্স কোটি টাকায় অপর ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞতা ও অবকাঠামো সুবিধাসম্পন্ন অনেক প্রতিষ্ঠানকে ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ফিশিং ট্রলারের ব্যবসায়ী বিজমেকার্স ফ্রিজিং কমপ্লেক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রয়েল ফিশিং কোম্পানির মালিক নাসির উদ্দিন এ ফেরদৌস নামে একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও জোট সরকারের আমলে বঞ্চিত হওয়ার পরও তাকে ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। অথচ মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস তার অনিয়ম-দুর্নীতিতে সঙ্গ দেয়ায় ৯ জনকে ডিঙিয়ে ১০ম ব্যক্তিকে মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস মন্ত্রী হওয়ার পর দুর্নীতি আর লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো। মন্ত্রীর অনুমোদন ও কমিশন ছাড়া পিয়ন থেকে শুরু করে মহাপরিচালক পর্যন্ত কোনো পদোন্নতি, বদলি বা নিয়োগ কিছুই হয় না। সবই হয় তার অনুমোদনে। ফলে অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও অসাধু কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে সুবিধা দিয়ে অধিদফতরের লোভনীয় পদগুলোতে বসে যাচ্ছে। তাদের অদক্ষতা, অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ে দিন পার করছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। মাঠপর্যায়ে তদারকি ও রোগ প্রতিকার করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের পোল্ট্রি শিল্প যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, ওই মুহূর্তে এটিকে টিকিয়ে রাখার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বিশাল অংকের কমিশনের বিনিময়ে ভারত থেকে মুরগি আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং শিগগিরই ডিম আমদানিরও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক আশরাফ আলী ও মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেয়া অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন, সাবেক প্রকল্প পরিচালক কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস, অধিদফতরের কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজ, কামরুল ইসলাম, আশীষ কুমার পাল, বাসন্তী রাণী সাহা ও সাবেক পরিচালক ডা. সাব্বিরসহ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা একচ্ছত্রভাবে অধিদফতরের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন। মন্ত্রী হওয়ার শুরু থেকেই প্রাণিসম্পদের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও আনুকূল্য দিয়ে আসছেন আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তারা পুরো অধিদফতরে রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। অধিদফতরের এমন কোনো প্রকল্প নেই যেখানে অনিয়ম হয়নি। সরকারি কেনাকাটায়ও চলেছে পুকুরচুরি। প্রাণিসম্পদ ও এলআরআই মহাখালীতে এলটিএম-এর মাধ্যমে ক্রয় দেখানো মালামালের মূল্য এক হাজার শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতাধীন পুরাতন জরাজীর্ণ ভবন মেরামত ও সংস্কারের ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকার কাজ ভাগাভাগি করে নেয়া হয়েছিল। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুসারে এসব কাজে ওপেন টেন্ডার চাওয়ার নিয়ম থাকলেও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে গোপনে লিমিটেড টেন্ডার মেথডে (এলটিএম) ৪৭টি কাজ ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল। মন্ত্রী ও প্রকল্প সমন্বয়কারীর পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্যই এমনটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির স্প্রে কার্যক্রম কর্মসূচির আওতায় প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ হাজার ৫০০ স্প্রে মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। প্রতিটি স্প্রে মেশিনের দাম ১৮৪০ টাকা ধরা হলেও সরবরাহ করা মেশিনগুলোর দাম ছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে। সরবরাহ করা মেশিনগুলোর ওজনও কম ছিল। এই প্রকল্পে পুকুরচুরি হলেও মন্ত্রীর আনুকূল্য থাকায় সংশ্লিষ্ট দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মো. আব্দুল জব্বার অভিযোগ করেন, এল আর আই মহাখালীর অ্যানথ্রাক্স শাখার মালামাল ক্রয়ের জন্য গত জুনে এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে ৩০ লাখ টাকার গ্লিসারিণসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় ও ৭০ লাখ টাকা ডায়াল ক্রয়ের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। গুদামে ৩ কোটি টাকার ডায়াল পড়ে থাকার পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা লাভবান হওয়ার জন্য ওইসব কার্যাদেশ দিয়ে ভুয়া বিল তৈরির মাধ্যমে পুরো ৭০ লাখ টাকা আত্মসাত্ করেছে।
মহাখালীর টিকা উত্পাদন প্রযুক্তি আধুনিকায়ন ও গবেষণাগার সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ফ্রিজ ড্রাইয়ার মেশিন ক্রয়ের জন্য গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। সেখানে অংশ নেয়া ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য দেখিয়ে প্রকল্প পরিচালকের ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছিল। প্রকল্প পরিচালক ডা. মোস্তাফিজুর রহমানের ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাস কনসোর্টিয়াম যে হাইড্রক্স জেল সরবরাহ করেছিল সেগুলো এতই নিম্নমানের ছিল, তা দিয়ে কোনো ভ্যাকসিন উত্পাদন করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ওই প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে সরবরাহ করা পণ্যের সাকুল্যে মূল্য ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। শুধু একটি ক্রয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকারও বেশি। সরকারি আর্থিক ক্ষতির ওই ফাইলটি তদন্তের জন্য উত্থাপন করা হলে মন্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘদিন আটকে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকেও বিশাল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য হয় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর নামে। সম্প্রতি মেসার্স আলম ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছে, এলটিএমের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার মালামাল ক্রয় দেখিয়ে সমুদয় অর্থ আত্মসাত্ করা হয়েছে। এরআগে সংসদীয় কমিটি চিড়িয়াখানায় নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় ডেপুটি কিউরেটর ডা. শহীদুল্লাহ ও প্রকৌশলী মতিউর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই মন্ত্রী ও তার এপিএসের সখ্য থাকায় সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়াও চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণী সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিশাল দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও সর্বশেষ এলটিএমের মাধ্যমে কেনাকাটায় আরও ৪ কোটি টাকা আত্মসাত্ করা হয়েছে বলে প্রাণিসম্পদের কয়েকজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার কারণে প্রাণিসম্পদে অনিয়ম-দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারের পরিকল্পনা বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও ছয় মাস চাকরির মেয়াদ থাকবে এমন কর্মকর্তারাই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালককে উপসচিব/উপ-প্রধান পদমর্যাদার (পঞ্চম গ্রেড) এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অন্তত তিন বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১৭টি প্রকল্প ও কর্মসূচির মধ্যে অন্তত ১৫টিতেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে অনিয়ম করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ষষ্ঠ গ্রেডের উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের আগেই চাকরির মেয়াদ শেষ হবে এমন কর্মকর্তাকেও পরিচালক করা হয়েছে বর্তমান মন্ত্রীর আমলেই। অথচ অধিদফতরে একাধিক প্রকল্প পরিচালনায় দক্ষ এবং পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা রয়েছেন ১৯২ জন।
অভিযোগ আছে, ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও পঞ্চম গ্রেডের পদ দখল করেছেন হ্যাচারি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ডা. সরদার আবুল বাশার, মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ডা. মুনজুর কাদির, পোলট্রি খামার মেরামত প্রকল্পের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম মোল্লা, কৃত্রিম প্রজনন ও ভ্রুণ স্থানান্তর প্রকল্পের পরিচালক ডা. বেলাল, ব্লার্ড ফ্লু প্রকল্পের পরিচালক ডা. নজরুল ইসলাম, ২২ জেলায় ক্ষুদ্র দুগ্ধ ও পোলট্রি খামারিদের সহায়তা প্রকল্পের পরিচালক মাহাবুবুল আলম ফারুক ও স্প্রে প্রকল্পের পরিচালক ডা. প্রণব কুমার। এরআগে মাত্র দুই মাস চাকরির মেয়াদ থাকা অবস্থায় পরিচালক হয়েছিলেন ডা. আবদুল কুদ্দুস। গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি তিন বছর মেয়াদি জরাজীর্ণ ভবন মেরামত প্রকল্পের পরিচালক করা হয়। এই প্রকল্পে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। দুই বছর চাকরির মেয়াদ থাকা কালে ডা. জগলুলকে পাঁচ বছর মেয়াদি টিকা প্রদান প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছিল ২০০৯ সালের আগস্টে। এক বছর চাকরির মেয়াদ থাকাকালে ডা. আবুল কালামকে ২০১০ সালের জুলাইয়ে দেয়া হয় তিন বছর মেয়াদি এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা কমবেটিং প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব।
মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এই অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বড় ধরনের তদবিরের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তদবির ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষ ও যোগ্যরা বাদ পড়ে যান।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক নাজিমউদ্দীন স্বাক্ষরিত গত বছর দেয়া এক চিঠিতে দেখা গেছে, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১৪টি প্রকল্পের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। প্রকল্পগুলো হলো হ্যাচারি উন্নয়ন প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. সরদার আবুল বাসার), প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও জোরদারকরণ প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক বাকী বিল্লাহ), মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প (পরিচালক ডা. মঞ্জুর কাদের), পোলট্রি খামার মেরামত প্রকল্প (পরিচালক ডা. আইনুল হক মোল্লা), কৃত্রিম প্রজনন ও ভ্রূণ স্থানান্তর প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. আফজাল হোসেন), বার্ড ফ্লু নিরাময় প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. নজরুল ইসলাম), স্প্রে প্রকল্প (সাবেক প্রকল্প পরিচালক ডা. বিনয় কুমার নাগ), জরাজীর্ণ ভবন মেরামত প্রকল্প (পরিচালক মোস্তাফা কামাল বাচ্চু), টিকা প্রদান প্রকল্প (পরিচালক ডা. জগলুল) এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রকল্প (পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ), উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায় (পরিচালক এ কে এম ওমর ফারুক), আইলা কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রকল্প (পরিচালক ডা. মো. আলমগীর হোসেন), হাঁস উন্নয়ন প্রকল্প, ক্ষুদ্র দুগ্ধ ও পোলট্রি উন্নয়ন প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. হজরত আলী) এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল উন্নয়ন, টিকা উত্পাদন ও প্রযুক্তি উন্নয়ন প্রকল্প।
এছাড়াও দুদকের উপ-পরিচালক তাহসীনুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ২০০৯ সাল থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর অধীন দফতরগুলোর সব ক্রয় ও ব্যয়ের হিসাব তলব করা হয়েছে। কিন্তু অধিদফতর থেকে ওইসব তথ্য দুদকে সরবরাহ করা হয়নি। মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার জন্যই ওইসব কাগজপত্র দেয়া হচ্ছে বলে অধিদফতরের কিছু ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন।
আবদুল লতিফ বিশ্বাসের ছোট স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের দিনই তার বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটের দিন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী রফিক উল্লাহ খন্দকার তার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে মন্ত্রীপত্নী প্রকাশ্যে ভোট কারচুপি করছেন উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ব্যবস্থা না নেয়ায় রফিক উল্লাহ খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বয়কট করেন এবং পুনঃনির্বাচনের দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলন করে একই রকম অভিযোগ তুলেছিলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী রফিকুল আলমও। ওই ঘটনায় বেলকুচি ও সিরাজগঞ্জের সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আশানুর বিশ্বাস বলেন, নির্বাচন পণ্ড করতে বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থী পরিকল্পিতভাবে নিজের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
মন্ত্রী আবদুুল লতিফ বিশ্বাস গাজীপুর সদরের মারিয়ালী এলাকায় ৭১ শতাংশ জমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মারিয়ালি মৌজার এস এ ২৪ আর এস ৪৪ খতিয়ানে সিএস ১০ দাগের ওই জমির দখল নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বিরোধ চলছে। মন্ত্রী সেখানে তার ছোট স্ত্রী আশানূর বিশ্বাসের নামে নূর নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্ট করার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা আবদুুল হাই অভিযোগ করে বলেন, তাদের কেনা ও ৯০ বছর ধরে মালিকানা পরম্পরায় ওই জমি মন্ত্রী দখল করে নিয়েছেন। আকদুুল হাই জানান, ওই জমিতে গাজীপুর বণিক সমিতির নামে সাড়ে ৫ শতাংশ, হাজী আবুল হাশেমের ২২ শতাংশ, আবদুুল হাইয়ের সাড়ে ১০ শতাংশ, ফরিদা ইয়াসমিন কেয়ার সোয়া ৪ শতাংশ, নাজমা বেগমের সোয়া ৪ শতাংশ, আবদুুল মান্নানের ৩ শতাংশ ও মহিউদ্দিনের ৪ শতাংশ জমি রয়েছে।
বিরোধ ও মামলা থাকা ওই জমি আবদুল লতিফ বিশ্বাসের স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস জনৈক আবদুল মতিন মাস্টারের কাছ থেকে কম দামে ১৫ শতাংশ ক্রয় করেন। ১৫ শতাংশ কিনেই তিনি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পুরো ৭১ শতাংশ জমিতে সীমানা প্রাচীর তৈরি করে দখল করে নিতে চাইছেন। জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার মহিউদ্দিন, আবদুল হাই ও ফরিদা ইয়াসমিন কেয়া অভিযোগ করেন, তাদের জমিতে স্থানীয় পৌরসভা থেকে প্ল্যান করা হয়েছে। তহশিল অফিসেও অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রীর ছোট স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস সেখানে প্ল্যান পাসের অনুমোদন চাইলে পৌরসভা থেকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। বরং তিনি যে ৭১ শতাংশ জমিতে সীমানা প্রাচীর দিয়েছেন, পৌরসভা থেকে সেটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী ও তার স্ত্রী কর্তৃক ওই জমি দখলের কারণ সম্পর্কে জমির মালিকরা অভিযোগ করেন, ১০ দাগের কিছু জমি নিয়ে জনৈক আবদুল মতিন মাস্টারের সঙ্গে বিরোধ ছিল। বিরোধপূর্ণ জমির ১৫ কাঠা ক্রয় করে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আশানুর বিশ্বাস এখন পুরো জমিই দখল করে নিয়েছেন।
ফরিদা ইয়াসমিন কেয়া জানান, তিনি একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। নিজের ও পরিবারের জমানো সমুদয় সম্পদ বিক্রি করে তিনি সোয়া ৪ শতাংশ জমি কিনেছেন। আর সেই জমি মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস ও তার স্ত্রী দখল করে নেয়ায় এখন তিনি পথে বসার মতো অবস্থা। কারও কাছে বিচারও চাইতে পারেন না। তাদের জমি থেকে গাছপালা ও ফসল কেটে নেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গ্রুপ মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করছে। ফলে তারা একরকম নিরুপায় অবস্থায় আছেন।
মারিয়ালিতে জমি দখলের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি গতকাল আমার দেশকে বলেন, ওই জমির সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। জমিটি তিনি দখল করেননি। কেউ যদি তার নামে কোনো তথ্য দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা সঠিক নয়।
কিন্তু গাজীপুর সদর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আবদুল করিম গত সন্ধ্যায় আমার দেশকে বলেন, মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের সঙ্গে ওই জমি নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের দীর্ঘদিন থেকেই বিরোধ চলছে। মন্ত্রীর লোকজন ওই জমিতে স্থাপনা তৈরির জন্য ছাড়পত্র চেয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না পাওয়ায় ছাড়পত্র দেননি। এছাড়া আবদুল হাই, মহিউদ্দিন ও ফরিদা ইয়াসমিন কেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে মন্ত্রীর বিরোধ রয়েছে। তাদের কাগজপত্র যাচাই শেষে ওই জমি থেকে মন্ত্রীর লোকজনের করা সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলারও একটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
লতিফ বিশ্বাস মন্ত্রী হওয়ার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে তুরাগ থানার তাফালিয়া এলাকায় একটি ৭ তলা বাড়ি তৈরি করেছেন। সম্প্রতি ওই বাড়িতে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, সেখানে মন্ত্রী ও মন্ত্রীর জামাতার নামে প্রায় ১০ কাঠা জমি রয়েছে। যার একটি অংশে ৭ তলা বাড়ি তৈরির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ওই ভবনের জন্য রড-সিমেন্ট, ইট-বালু সরবরাহ করা ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মন্ত্রী হওয়ার প্রায় এক বছর পর মন্ত্রী বাড়ির কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে ৭ তলা বাড়ির কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন টাইলস ও রঙের কাজ চলছে। ওই ভবনে কাজ করা শাহিন নামে এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, মন্ত্রী নিজে, মন্ত্রীর ছোট স্ত্রী, মেয়ের জামাই সাজেদুল ও এপিএস হিলটন কাজের তদারকি করেন।
তাফালিয়া ও উলুদাহ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ওই এলাকায় এখন প্রতিকাঠা জমির দাম ৫০ লাখ টাকারও বেশি। সেখানে মন্ত্রী কত টাকায় ওই জমি কিনেছেন—বিষয়টি তাদের সঠিক জানা নেই। তাছাড়া ৭ তলা যে ভবন তৈরি করেছেন, সেই ভবন তৈরিতেও মন্ত্রীর খরচ হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।
বেলকুচি এলাকার বাসিন্দারা জানান, আবদুল লতিফ বিশ্বাসের দুই স্ত্রী ও ৮ সন্তান। দু’দফায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ১৯৮৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। মহাজোট সরকার গঠন করার পর মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লতিফ বিশ্বাসকে।
মন্ত্রণালয়ের মতো বেলকুচিতেও মন্ত্রীর নির্দেশ এবং তার পছন্দের লোক ছাড়া কোনো উন্নয়ন কাজ হয় না। পৌরসভা ও স্থানীয় অফিসগুলোর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ত্রীপুত্র টুকু বিশ্বাস। বর্তমানে নির্মাণাধীন উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনও নির্মিত হচ্ছে টুকু বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে।
লতিফ বিশ্বাস মন্ত্রী হওয়ার পর বেলকুচির প্রত্যন্ত এলাকা শাহপুরে আঞ্চলিক হাঁসের খামার প্রতিষ্ঠার জন্য বেশকিছু জমি ক্রয় করেন পরিবারের লোকজনের নামে। প্রতিবিঘা এক থেকে দেড় লাখ টাকা দরে কেনা ওই জমি বিঘাপ্রতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দাম দিয়ে অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। জেলা পর্যায়ের অজপাড়াগাঁয়ে নির্ধারণ করা প্রকল্পটির জমি নিয়ে এলাকার মানুষ ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে মন্ত্রীর ইচ্ছায় সেখানে তার স্ত্রীর কেনা ও বায়না করা জমিতেই হচ্ছে হাঁসের খামার।
বেলকুচি এলাকার বাসিন্দারা জানান, আবদুল লতিফ বিশ্বাস অত্যন্ত চালাক মানুষ। তিনি কোনো কাজে তার সংশ্লিষ্টতা ও প্রমাণ রাখেন না। এমনকি কোনো সুপারিশেও সই করেন না। সবই করেন অন্যের মাধ্যমে। ফলে কোনো দুর্নীতিতেই তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া বেশ কঠিন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেলকুচিতে মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাসের দুই স্ত্রী থাকেন দুই বাড়িতে। মন্ত্রী হওয়ার পর বিপুল টাকা ব্যয়ে মেঘুলা গ্রামের পৈতৃক বাড়ি সংস্কার করে দিয়েছেন। সেখানে থাকেন তার বড় স্ত্রী। বেলকুচিতে অবস্থানকালে বেলকুচি শহরে মন্ত্রী ওই বাড়িতেই থাকেন। গত দু’বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ে ওই বাড়ির পুকুরপাড় পাকাকরণসহ বাড়িটিতে আমূল সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়াও সোহাগপুর ও বেলকুচির চরসহ বিভিন্ন স্থানে মন্ত্রী নিজ নামে ও তার পরিবারের নামে দু’শতাধিক বিঘারও বেশি জমি ক্রয় করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এছাড়াও তার ছোট স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকশ’ ভরি স্বর্ণালঙ্কার কিনেছেন এবং উপঢৌকন হিসেবেও অনেক গহনা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিজের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি বলেন, তার মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতরগুলো ভালোভাবেই চলছে। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের ক’জনকে এরই মধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ও আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রী হওয়ার পর তাফালিয়া এলাকায় ৭ তলা বাড়ি তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাড়িটি তিনি ব্যাংক এশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি করছেন। এখনও বাড়ির কাজ সম্পন্ন হয়নি। সেখানে ৩ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা ভবন করেছেন তিনি। আর ওই জমি মন্ত্রী হওয়ার আগেই কিনেছেন বলে জানিয়েছেন আবদুল লতিফ বিশ্বাস। এলাকায় আঞ্চলিক হাঁসের খামার ও বেলকুচিতে জমিজমা ক্রয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অধিদফতরের নিয়ম অনুযায়ী অবহেলিত এলাকার উন্নয়নের জন্য হাঁসের খামার করা হচ্ছে। তাছাড়া এলাকায় উন্নয়নের কারণে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বিরোধীপক্ষ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে পারে।
কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করে ভারত থেকে মুরগি ও ডিম আমদানির অনুমোদন দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, সামনে রোজা। এসময় ডিম ও মুরগির চাহিদা বেড়ে যাবে। তাই তারা মুরগি এবং ডিম আমদানির অনুমোদন দিচ্ছেন। রোজার পর আমদানি বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, আবদুল লতিফ বিশ্বাস মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, মত্স্য অধিদফতর, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন, মেরিন ফিশারিজ একাডেমি এবং মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দফতরে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর অধীনস্থ বিভাগগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সর্বাধিক।
আমার দেশ’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মন্ত্রী হওয়ার শুরু থেকেই ঘুষ-দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস। মন্ত্রী হওয়ার ১০ মাসের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কাছে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের তত্কালীন মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। ওই চিঠিতে জাহাঙ্গীর আলম খান অভিযোগ করেছিলেন, মন্ত্রীর ঘুষের দাবি না মেটানোর কারণে পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিটি কাজে বাধার সৃষ্টি ও তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার এক মাসের মাথায় দুই লাখ টাকা ঘুষ চান মন্ত্রী। ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রাণিসম্পদ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দফতরের সব ফাইল ও কাজ আটকে দিয়েছেন। ঘুষ না দেয়ায় মহাপরিচালকের ঝুলে থাকা পদোন্নতিও পাননি। ওই চিঠিতে সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগ তোলেন তিনি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এইচটি ইমামের কাছে অভিযোগ করার পর মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও চাকরি হারাতে হয়েছিল প্রাণী বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা ড. জাহাঙ্গীরকে। বরখাস্তের আদেশের বিরুদ্ধে ড. জাহাঙ্গীর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টে রায় তার পক্ষে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। আপিল বিভাগও সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন। ড. জাহাঙ্গীর আলম খান আদালতের রায় পেয়েও দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর অধীনে চাকরি করবেন না ঘোষণা দিয়ে নিজের পেনশন চেয়ে আবেদন করেন। একইভাবে মন্ত্রীর দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আরেক মহাপরিচালক হাবীবুর রহমান।
মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বড় একটি অভিযোগ, মত্স্য অধিদফতরের ট্রলার লাইসেন্স বিতরণে অনিয়ম। নিজস্ব জেটি ও হিমাগার আছে, এমনসব প্রতিষ্ঠানকে ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স না দিয়ে মোটা অংকের ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে কোনো অবকাঠামো নেই, এমন প্রতিষ্ঠানকে ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। মন্ত্রীর নিকটাত্মীয়র নামে লাইসেন্স গ্রহণ করে ওই লাইসেন্স কোটি টাকায় অপর ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞতা ও অবকাঠামো সুবিধাসম্পন্ন অনেক প্রতিষ্ঠানকে ফিশিং ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ফিশিং ট্রলারের ব্যবসায়ী বিজমেকার্স ফ্রিজিং কমপ্লেক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রয়েল ফিশিং কোম্পানির মালিক নাসির উদ্দিন এ ফেরদৌস নামে একজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও জোট সরকারের আমলে বঞ্চিত হওয়ার পরও তাকে ট্রলারের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। অথচ মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস তার অনিয়ম-দুর্নীতিতে সঙ্গ দেয়ায় ৯ জনকে ডিঙিয়ে ১০ম ব্যক্তিকে মত্স্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আব্দুল লতিফ বিশ্বাস মন্ত্রী হওয়ার পর দুর্নীতি আর লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো। মন্ত্রীর অনুমোদন ও কমিশন ছাড়া পিয়ন থেকে শুরু করে মহাপরিচালক পর্যন্ত কোনো পদোন্নতি, বদলি বা নিয়োগ কিছুই হয় না। সবই হয় তার অনুমোদনে। ফলে অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও অসাধু কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে সুবিধা দিয়ে অধিদফতরের লোভনীয় পদগুলোতে বসে যাচ্ছে। তাদের অদক্ষতা, অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ে দিন পার করছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। মাঠপর্যায়ে তদারকি ও রোগ প্রতিকার করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের পোল্ট্রি শিল্প যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, ওই মুহূর্তে এটিকে টিকিয়ে রাখার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বিশাল অংকের কমিশনের বিনিময়ে ভারত থেকে মুরগি আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং শিগগিরই ডিম আমদানিরও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক আশরাফ আলী ও মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেয়া অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. মোসাদ্দেক হোসেন, সাবেক প্রকল্প পরিচালক কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস, অধিদফতরের কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজ, কামরুল ইসলাম, আশীষ কুমার পাল, বাসন্তী রাণী সাহা ও সাবেক পরিচালক ডা. সাব্বিরসহ কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা একচ্ছত্রভাবে অধিদফতরের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন। মন্ত্রী হওয়ার শুরু থেকেই প্রাণিসম্পদের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও আনুকূল্য দিয়ে আসছেন আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। তারা পুরো অধিদফতরে রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। অধিদফতরের এমন কোনো প্রকল্প নেই যেখানে অনিয়ম হয়নি। সরকারি কেনাকাটায়ও চলেছে পুকুরচুরি। প্রাণিসম্পদ ও এলআরআই মহাখালীতে এলটিএম-এর মাধ্যমে ক্রয় দেখানো মালামালের মূল্য এক হাজার শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতাধীন পুরাতন জরাজীর্ণ ভবন মেরামত ও সংস্কারের ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকার কাজ ভাগাভাগি করে নেয়া হয়েছিল। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুসারে এসব কাজে ওপেন টেন্ডার চাওয়ার নিয়ম থাকলেও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে গোপনে লিমিটেড টেন্ডার মেথডে (এলটিএম) ৪৭টি কাজ ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল। মন্ত্রী ও প্রকল্প সমন্বয়কারীর পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্যই এমনটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির স্প্রে কার্যক্রম কর্মসূচির আওতায় প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে ৭ হাজার ৫০০ স্প্রে মেশিন ক্রয় করা হয়েছে। প্রতিটি স্প্রে মেশিনের দাম ১৮৪০ টাকা ধরা হলেও সরবরাহ করা মেশিনগুলোর দাম ছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে। সরবরাহ করা মেশিনগুলোর ওজনও কম ছিল। এই প্রকল্পে পুকুরচুরি হলেও মন্ত্রীর আনুকূল্য থাকায় সংশ্লিষ্ট দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মো. আব্দুল জব্বার অভিযোগ করেন, এল আর আই মহাখালীর অ্যানথ্রাক্স শাখার মালামাল ক্রয়ের জন্য গত জুনে এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে ৩০ লাখ টাকার গ্লিসারিণসহ অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় ও ৭০ লাখ টাকা ডায়াল ক্রয়ের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। গুদামে ৩ কোটি টাকার ডায়াল পড়ে থাকার পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা লাভবান হওয়ার জন্য ওইসব কার্যাদেশ দিয়ে ভুয়া বিল তৈরির মাধ্যমে পুরো ৭০ লাখ টাকা আত্মসাত্ করেছে।
মহাখালীর টিকা উত্পাদন প্রযুক্তি আধুনিকায়ন ও গবেষণাগার সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ফ্রিজ ড্রাইয়ার মেশিন ক্রয়ের জন্য গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ৩ কোটি ৯২ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। সেখানে অংশ নেয়া ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য দেখিয়ে প্রকল্প পরিচালকের ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছিল। প্রকল্প পরিচালক ডা. মোস্তাফিজুর রহমানের ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান মেসার্স মাস কনসোর্টিয়াম যে হাইড্রক্স জেল সরবরাহ করেছিল সেগুলো এতই নিম্নমানের ছিল, তা দিয়ে কোনো ভ্যাকসিন উত্পাদন করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ওই প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে সরবরাহ করা পণ্যের সাকুল্যে মূল্য ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। শুধু একটি ক্রয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকারও বেশি। সরকারি আর্থিক ক্ষতির ওই ফাইলটি তদন্তের জন্য উত্থাপন করা হলে মন্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘদিন আটকে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকেও বিশাল অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য হয় প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর নামে। সম্প্রতি মেসার্স আলম ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছে, এলটিএমের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার মালামাল ক্রয় দেখিয়ে সমুদয় অর্থ আত্মসাত্ করা হয়েছে। এরআগে সংসদীয় কমিটি চিড়িয়াখানায় নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় ডেপুটি কিউরেটর ডা. শহীদুল্লাহ ও প্রকৌশলী মতিউর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই মন্ত্রী ও তার এপিএসের সখ্য থাকায় সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়াও চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণী সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিশাল দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও সর্বশেষ এলটিএমের মাধ্যমে কেনাকাটায় আরও ৪ কোটি টাকা আত্মসাত্ করা হয়েছে বলে প্রাণিসম্পদের কয়েকজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার কারণে প্রাণিসম্পদে অনিয়ম-দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে। সরকারের পরিকল্পনা বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও ছয় মাস চাকরির মেয়াদ থাকবে এমন কর্মকর্তারাই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালককে উপসচিব/উপ-প্রধান পদমর্যাদার (পঞ্চম গ্রেড) এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অন্তত তিন বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১৭টি প্রকল্প ও কর্মসূচির মধ্যে অন্তত ১৫টিতেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে অনিয়ম করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ষষ্ঠ গ্রেডের উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের আগেই চাকরির মেয়াদ শেষ হবে এমন কর্মকর্তাকেও পরিচালক করা হয়েছে বর্তমান মন্ত্রীর আমলেই। অথচ অধিদফতরে একাধিক প্রকল্প পরিচালনায় দক্ষ এবং পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তা রয়েছেন ১৯২ জন।
অভিযোগ আছে, ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও পঞ্চম গ্রেডের পদ দখল করেছেন হ্যাচারি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ডা. সরদার আবুল বাশার, মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ডা. মুনজুর কাদির, পোলট্রি খামার মেরামত প্রকল্পের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম মোল্লা, কৃত্রিম প্রজনন ও ভ্রুণ স্থানান্তর প্রকল্পের পরিচালক ডা. বেলাল, ব্লার্ড ফ্লু প্রকল্পের পরিচালক ডা. নজরুল ইসলাম, ২২ জেলায় ক্ষুদ্র দুগ্ধ ও পোলট্রি খামারিদের সহায়তা প্রকল্পের পরিচালক মাহাবুবুল আলম ফারুক ও স্প্রে প্রকল্পের পরিচালক ডা. প্রণব কুমার। এরআগে মাত্র দুই মাস চাকরির মেয়াদ থাকা অবস্থায় পরিচালক হয়েছিলেন ডা. আবদুল কুদ্দুস। গত বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি তিন বছর মেয়াদি জরাজীর্ণ ভবন মেরামত প্রকল্পের পরিচালক করা হয়। এই প্রকল্পে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। দুই বছর চাকরির মেয়াদ থাকা কালে ডা. জগলুলকে পাঁচ বছর মেয়াদি টিকা প্রদান প্রকল্পের পরিচালক করা হয়েছিল ২০০৯ সালের আগস্টে। এক বছর চাকরির মেয়াদ থাকাকালে ডা. আবুল কালামকে ২০১০ সালের জুলাইয়ে দেয়া হয় তিন বছর মেয়াদি এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা কমবেটিং প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব।
মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এই অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বড় ধরনের তদবিরের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। তদবির ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষ ও যোগ্যরা বাদ পড়ে যান।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক নাজিমউদ্দীন স্বাক্ষরিত গত বছর দেয়া এক চিঠিতে দেখা গেছে, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১৪টি প্রকল্পের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। প্রকল্পগুলো হলো হ্যাচারি উন্নয়ন প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. সরদার আবুল বাসার), প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও জোরদারকরণ প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক বাকী বিল্লাহ), মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প (পরিচালক ডা. মঞ্জুর কাদের), পোলট্রি খামার মেরামত প্রকল্প (পরিচালক ডা. আইনুল হক মোল্লা), কৃত্রিম প্রজনন ও ভ্রূণ স্থানান্তর প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. আফজাল হোসেন), বার্ড ফ্লু নিরাময় প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. নজরুল ইসলাম), স্প্রে প্রকল্প (সাবেক প্রকল্প পরিচালক ডা. বিনয় কুমার নাগ), জরাজীর্ণ ভবন মেরামত প্রকল্প (পরিচালক মোস্তাফা কামাল বাচ্চু), টিকা প্রদান প্রকল্প (পরিচালক ডা. জগলুল) এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রকল্প (পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ), উপজেলা প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায় (পরিচালক এ কে এম ওমর ফারুক), আইলা কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রকল্প (পরিচালক ডা. মো. আলমগীর হোসেন), হাঁস উন্নয়ন প্রকল্প, ক্ষুদ্র দুগ্ধ ও পোলট্রি উন্নয়ন প্রকল্প (প্রকল্প পরিচালক ডা. হজরত আলী) এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল উন্নয়ন, টিকা উত্পাদন ও প্রযুক্তি উন্নয়ন প্রকল্প।
এছাড়াও দুদকের উপ-পরিচালক তাহসীনুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ২০০৯ সাল থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও এর অধীন দফতরগুলোর সব ক্রয় ও ব্যয়ের হিসাব তলব করা হয়েছে। কিন্তু অধিদফতর থেকে ওইসব তথ্য দুদকে সরবরাহ করা হয়নি। মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার জন্যই ওইসব কাগজপত্র দেয়া হচ্ছে বলে অধিদফতরের কিছু ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন।
আবদুল লতিফ বিশ্বাসের ছোট স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের দিনই তার বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটের দিন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী রফিক উল্লাহ খন্দকার তার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে মন্ত্রীপত্নী প্রকাশ্যে ভোট কারচুপি করছেন উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ব্যবস্থা না নেয়ায় রফিক উল্লাহ খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বয়কট করেন এবং পুনঃনির্বাচনের দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলন করে একই রকম অভিযোগ তুলেছিলেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী রফিকুল আলমও। ওই ঘটনায় বেলকুচি ও সিরাজগঞ্জের সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আশানুর বিশ্বাস বলেন, নির্বাচন পণ্ড করতে বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থী পরিকল্পিতভাবে নিজের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
মন্ত্রী আবদুুল লতিফ বিশ্বাস গাজীপুর সদরের মারিয়ালী এলাকায় ৭১ শতাংশ জমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মারিয়ালি মৌজার এস এ ২৪ আর এস ৪৪ খতিয়ানে সিএস ১০ দাগের ওই জমির দখল নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বিরোধ চলছে। মন্ত্রী সেখানে তার ছোট স্ত্রী আশানূর বিশ্বাসের নামে নূর নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্ট করার চেষ্টা করছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা আবদুুল হাই অভিযোগ করে বলেন, তাদের কেনা ও ৯০ বছর ধরে মালিকানা পরম্পরায় ওই জমি মন্ত্রী দখল করে নিয়েছেন। আকদুুল হাই জানান, ওই জমিতে গাজীপুর বণিক সমিতির নামে সাড়ে ৫ শতাংশ, হাজী আবুল হাশেমের ২২ শতাংশ, আবদুুল হাইয়ের সাড়ে ১০ শতাংশ, ফরিদা ইয়াসমিন কেয়ার সোয়া ৪ শতাংশ, নাজমা বেগমের সোয়া ৪ শতাংশ, আবদুুল মান্নানের ৩ শতাংশ ও মহিউদ্দিনের ৪ শতাংশ জমি রয়েছে।
বিরোধ ও মামলা থাকা ওই জমি আবদুল লতিফ বিশ্বাসের স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস জনৈক আবদুল মতিন মাস্টারের কাছ থেকে কম দামে ১৫ শতাংশ ক্রয় করেন। ১৫ শতাংশ কিনেই তিনি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পুরো ৭১ শতাংশ জমিতে সীমানা প্রাচীর তৈরি করে দখল করে নিতে চাইছেন। জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার মহিউদ্দিন, আবদুল হাই ও ফরিদা ইয়াসমিন কেয়া অভিযোগ করেন, তাদের জমিতে স্থানীয় পৌরসভা থেকে প্ল্যান করা হয়েছে। তহশিল অফিসেও অভিযোগ রয়েছে। মন্ত্রীর ছোট স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস সেখানে প্ল্যান পাসের অনুমোদন চাইলে পৌরসভা থেকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। বরং তিনি যে ৭১ শতাংশ জমিতে সীমানা প্রাচীর দিয়েছেন, পৌরসভা থেকে সেটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী ও তার স্ত্রী কর্তৃক ওই জমি দখলের কারণ সম্পর্কে জমির মালিকরা অভিযোগ করেন, ১০ দাগের কিছু জমি নিয়ে জনৈক আবদুল মতিন মাস্টারের সঙ্গে বিরোধ ছিল। বিরোধপূর্ণ জমির ১৫ কাঠা ক্রয় করে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আশানুর বিশ্বাস এখন পুরো জমিই দখল করে নিয়েছেন।
ফরিদা ইয়াসমিন কেয়া জানান, তিনি একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। নিজের ও পরিবারের জমানো সমুদয় সম্পদ বিক্রি করে তিনি সোয়া ৪ শতাংশ জমি কিনেছেন। আর সেই জমি মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাস ও তার স্ত্রী দখল করে নেয়ায় এখন তিনি পথে বসার মতো অবস্থা। কারও কাছে বিচারও চাইতে পারেন না। তাদের জমি থেকে গাছপালা ও ফসল কেটে নেয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গ্রুপ মন্ত্রীর পক্ষে কাজ করছে। ফলে তারা একরকম নিরুপায় অবস্থায় আছেন।
মারিয়ালিতে জমি দখলের অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি গতকাল আমার দেশকে বলেন, ওই জমির সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। জমিটি তিনি দখল করেননি। কেউ যদি তার নামে কোনো তথ্য দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা সঠিক নয়।
কিন্তু গাজীপুর সদর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আবদুল করিম গত সন্ধ্যায় আমার দেশকে বলেন, মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের সঙ্গে ওই জমি নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তিদের দীর্ঘদিন থেকেই বিরোধ চলছে। মন্ত্রীর লোকজন ওই জমিতে স্থাপনা তৈরির জন্য ছাড়পত্র চেয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না পাওয়ায় ছাড়পত্র দেননি। এছাড়া আবদুল হাই, মহিউদ্দিন ও ফরিদা ইয়াসমিন কেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে মন্ত্রীর বিরোধ রয়েছে। তাদের কাগজপত্র যাচাই শেষে ওই জমি থেকে মন্ত্রীর লোকজনের করা সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলারও একটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
লতিফ বিশ্বাস মন্ত্রী হওয়ার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে তুরাগ থানার তাফালিয়া এলাকায় একটি ৭ তলা বাড়ি তৈরি করেছেন। সম্প্রতি ওই বাড়িতে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, সেখানে মন্ত্রী ও মন্ত্রীর জামাতার নামে প্রায় ১০ কাঠা জমি রয়েছে। যার একটি অংশে ৭ তলা বাড়ি তৈরির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ওই ভবনের জন্য রড-সিমেন্ট, ইট-বালু সরবরাহ করা ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, মন্ত্রী হওয়ার প্রায় এক বছর পর মন্ত্রী বাড়ির কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে ৭ তলা বাড়ির কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন টাইলস ও রঙের কাজ চলছে। ওই ভবনে কাজ করা শাহিন নামে এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, মন্ত্রী নিজে, মন্ত্রীর ছোট স্ত্রী, মেয়ের জামাই সাজেদুল ও এপিএস হিলটন কাজের তদারকি করেন।
তাফালিয়া ও উলুদাহ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ওই এলাকায় এখন প্রতিকাঠা জমির দাম ৫০ লাখ টাকারও বেশি। সেখানে মন্ত্রী কত টাকায় ওই জমি কিনেছেন—বিষয়টি তাদের সঠিক জানা নেই। তাছাড়া ৭ তলা যে ভবন তৈরি করেছেন, সেই ভবন তৈরিতেও মন্ত্রীর খরচ হয়েছে কয়েক কোটি টাকা।
বেলকুচি এলাকার বাসিন্দারা জানান, আবদুল লতিফ বিশ্বাসের দুই স্ত্রী ও ৮ সন্তান। দু’দফায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ১৯৮৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। মহাজোট সরকার গঠন করার পর মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লতিফ বিশ্বাসকে।
মন্ত্রণালয়ের মতো বেলকুচিতেও মন্ত্রীর নির্দেশ এবং তার পছন্দের লোক ছাড়া কোনো উন্নয়ন কাজ হয় না। পৌরসভা ও স্থানীয় অফিসগুলোর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ত্রীপুত্র টুকু বিশ্বাস। বর্তমানে নির্মাণাধীন উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনও নির্মিত হচ্ছে টুকু বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে।
লতিফ বিশ্বাস মন্ত্রী হওয়ার পর বেলকুচির প্রত্যন্ত এলাকা শাহপুরে আঞ্চলিক হাঁসের খামার প্রতিষ্ঠার জন্য বেশকিছু জমি ক্রয় করেন পরিবারের লোকজনের নামে। প্রতিবিঘা এক থেকে দেড় লাখ টাকা দরে কেনা ওই জমি বিঘাপ্রতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দাম দিয়ে অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। জেলা পর্যায়ের অজপাড়াগাঁয়ে নির্ধারণ করা প্রকল্পটির জমি নিয়ে এলাকার মানুষ ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে মন্ত্রীর ইচ্ছায় সেখানে তার স্ত্রীর কেনা ও বায়না করা জমিতেই হচ্ছে হাঁসের খামার।
বেলকুচি এলাকার বাসিন্দারা জানান, আবদুল লতিফ বিশ্বাস অত্যন্ত চালাক মানুষ। তিনি কোনো কাজে তার সংশ্লিষ্টতা ও প্রমাণ রাখেন না। এমনকি কোনো সুপারিশেও সই করেন না। সবই করেন অন্যের মাধ্যমে। ফলে কোনো দুর্নীতিতেই তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া বেশ কঠিন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেলকুচিতে মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাসের দুই স্ত্রী থাকেন দুই বাড়িতে। মন্ত্রী হওয়ার পর বিপুল টাকা ব্যয়ে মেঘুলা গ্রামের পৈতৃক বাড়ি সংস্কার করে দিয়েছেন। সেখানে থাকেন তার বড় স্ত্রী। বেলকুচিতে অবস্থানকালে বেলকুচি শহরে মন্ত্রী ওই বাড়িতেই থাকেন। গত দু’বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ে ওই বাড়ির পুকুরপাড় পাকাকরণসহ বাড়িটিতে আমূল সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়াও সোহাগপুর ও বেলকুচির চরসহ বিভিন্ন স্থানে মন্ত্রী নিজ নামে ও তার পরিবারের নামে দু’শতাধিক বিঘারও বেশি জমি ক্রয় করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এছাড়াও তার ছোট স্ত্রী আশানুর বিশ্বাস সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকশ’ ভরি স্বর্ণালঙ্কার কিনেছেন এবং উপঢৌকন হিসেবেও অনেক গহনা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিজের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। তিনি বলেন, তার মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতরগুলো ভালোভাবেই চলছে। যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের ক’জনকে এরই মধ্যে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ও আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রী হওয়ার পর তাফালিয়া এলাকায় ৭ তলা বাড়ি তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাড়িটি তিনি ব্যাংক এশিয়া থেকে ঋণ নিয়ে তৈরি করছেন। এখনও বাড়ির কাজ সম্পন্ন হয়নি। সেখানে ৩ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা ভবন করেছেন তিনি। আর ওই জমি মন্ত্রী হওয়ার আগেই কিনেছেন বলে জানিয়েছেন আবদুল লতিফ বিশ্বাস। এলাকায় আঞ্চলিক হাঁসের খামার ও বেলকুচিতে জমিজমা ক্রয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অধিদফতরের নিয়ম অনুযায়ী অবহেলিত এলাকার উন্নয়নের জন্য হাঁসের খামার করা হচ্ছে। তাছাড়া এলাকায় উন্নয়নের কারণে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বিরোধীপক্ষ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে পারে।
কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি অস্বীকার করে ভারত থেকে মুরগি ও ডিম আমদানির অনুমোদন দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, সামনে রোজা। এসময় ডিম ও মুরগির চাহিদা বেড়ে যাবে। তাই তারা মুরগি এবং ডিম আমদানির অনুমোদন দিচ্ছেন। রোজার পর আমদানি বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন