রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

রাজনৈতিক সার্কাস বাজেট ও অন্যান্য বিষয়


কাকে আমরা ‘রাজনৈতিক সার্কাস’ বলবো? ক্ষমতার জন্য লম্ফ-জম্প, ডিগবাজিকে? নাকি, ক্ষমতার জন্য সত্য বাদ দিয়ে মিথ্যা বলাকে? প্রভুদের পদলেহনকে? কাকে বলবো ‘রাজনৈতিক সার্কাস’, তা ভেবেই ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হচ্ছে। যদি বলা হয়, আমার দেশের নদীর পানি উজান থেকে বন্ধ করা হলে, আমাদের কোন ক্ষতি হবে না? তাহলে এ কথাকে মিথ্যা বলা হলে তো কম বলা হয়। সার্কাস বলবো? বলা যায়। কারণ, একদা স্বৈরাচার এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক সার্কাস বেশ জমিয়ে তুলেছিল হাসপাতাল, কারাগার করে করে নানা মামলা বাঁচিয়েও ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে। সে দলেরই একজন স্বৈরাচারের আমলের পররাষ্ট্র আর এখন পানি বিষয়ক মন্ত্রী। বিরাট বড় লম্ফই বটেÑপররাষ্ট্র থেকে পানি। পত্রিকায় পাতায় প্রকাশিত তার বক্তব্য পড়লে বড়ই পুলক অনুভব হয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যা না করেও বলা যায়, এ জাতীয় কথা শুনলে আর সার্কাসে যাওয়ার দরকার কি!
আদর্শহীন রাজনীতির গর্ভজাতরা সর্বদাই নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ ও গোষ্ঠী স্বার্থ হাতানোর তালে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতার জন্যই তারা রাজনীতি করে। আদর্শের জন্য নয়। অতএব এদের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। কারণ সদ্য অতীতে এরাই, ক্ষমতা ধরে রাখার শেষ চেষ্টায় এবং আবারও ক্ষমতায় আসার কল্পস্বপ্নে  কোলাকুলি ও ক্ষমতা ভাগাভাগির মজাদার দৃশ্যচিত্র উপহার দিয়েছে।  ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণশত্রু নামে নিন্দিত পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি ফাঁক-তালে দুই হালি মন্ত্রিত্ব হাসিল করেছে। এর বিরুদ্ধে দেশের মানুষ  কফ-থু-থু আর ঘৃণার বন্যায় এবং ঝাড়–র পিটুনিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রতিবাদের সামনের কাতারে ছিলেন বাংলাদেশের সংগ্রামী নারী সমাজ। কেন তারা বেশি সোচ্চার, তার কারণ বিশ্ব বেহায়ার চরিত্রের  মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে। বাংলাদেশের আশি দশকের এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রজন্ম প্রবল ঘৃণা ও লজ্জায় এইসব রাজনৈতিক সার্কাস হজম করছেন। নূর হোসেন, সেলিম-দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়া, দীপালি সাহাসহ শত-সহ¯্র শহিদের আত্মাও এসব নিকৃষ্ট আচরণে ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী রাজনৈতিক ডাকাতদের সঙ্গে মিত্রতা-সখ্যতার পরিণাম আসলেই কি লাভজনক হবে? এতে কি সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্ত ও পরিবেশ সৃষ্টি হবে? নাকি একদল দালাল, চাটুকার ও বশংবদকে নিয়ে ক্ষমতার ইঁদুর দৌড়ই দীর্ঘায়িত হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর অল্প অল্প পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেস ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে যে, সকলের অংশ গ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা এবং বৈধতা পাবে না। ইতিহাসের অদ্ভুত রহস্য এটাই, যে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়াকে, সেই এরশাদই আবার ক্ষমতার অংশীদার এবং বেগম খালেদা জিয়াকে আন্দোলন করে যেতে হচ্ছে। অতীতে ক্ষমতায় এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সংসদে ছিল। এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের লোকজন মন্ত্রিত্বে। পতিত স্বৈরাচার-ভোট ডাকাত-বিশ্ব বেহায়ার সঙ্গে ক্ষমতার বাটোয়ারার খাতিরে কোলাকুলি করার পরিণাম অতীতে খুব ভালো হয় নি। ‘জাতীয় বেঈমান’ নামে একটি শব্দ তখন বাতাসে ভেসেছিল। বর্তমান মৈত্রীর ফলও যে শুভময় হবে না, সেটাও বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে। দেশের মানুষের ঘৃণা ও থু-থু সে কথা প্রমাণ করেছে। আর মার্কিন কংগ্রেস ও ইউরোপিয় পার্লামেন্ট স্পষ্ট ভাষায় যা বলেছে, তার সরল অর্থ হলো, বাংলাদেশের একাধিক বারের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানের বিরোধী দলনেত্রীকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে, সেটা দেশে বা বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে না। বৈধতা পাবে না। এবং আরেকটি পাতানো খেলা হিসাবেই ইতিহাসের পাতায় কলঙ্ক-কালিমার অক্ষরে লিপিবদ্ধ হবে। এবং পরিণামে এইসব প্রহসন ও পাতানো খেলার নায়ক-নায়িকারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন ইতিহাসের নিয়মেই। স্বৈরাচারের রাজনৈতিক সার্কাস নিজেকে ভাঁড়ে পরিণত করেছে বটে; সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকের শরীরেও লেপন করে দিয়েছে কদর্য-কালিমা। যারা ইতিহাস সচেতন, গণতন্ত্র সচেতন এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, তারা জানেন, ইতিহাস ও জনতার বিরুদ্ধে গিয়ে পাতানো বা প্রহসনের কোনও নির্বাচন ইতিহাস গ্রহণ করে না। মানুষ মেনে নেয় না। গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা পায় না। এই ঐতিহাসিক প্রজ্ঞার কোন চিহ্ন  স্বৈরশাসনের ইতিহাসে থাকে না। গণমানুষের ভোটের অধিকার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীনরা কথায় ও আচরণে রাজনৈতিক সার্কাস দেখাতে পারঙ্গম।

উল্লেখ করা দরকার,  দেশের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ ১/১১-এর প্রতিক্রিয়ায় একটি অনির্বাচিত-সেনা শাসিত সরকার থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এটা ছিলো গণতান্ত্রিক মানুষের উদার রাজনৈতিক মনোভাবের পরিচয়। গণমানুষের এই উদার মনোভাবের ফসল সামরিক-স্বৈরতন্ত্রের বিদায়। কিন্তু তারা বিদায় নিলেও আজকে যে শাসনকে রেখে গিয়েছে, সেখানে গণতন্ত্রের অবক্ষয় স্পষ্ট। সেই শাসনের সূত্রে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে অবক্ষয় আরো প্রকট। এখন পর্যন্ত দেশে-বিদেশে শাসনের বৈধতার সঙ্কট প্রশ্নবিদ্ধ। এমন কি, সাবেক প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরী ‘এ সরকারের বাজেট বৈধতা পাবে না’ মর্মে যে উক্তি করেছেন, সেটা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। কারণ সরকারের রাজনৈতিক দিকের মতো অর্থনৈতিক দিকও যদি বৈধতার সঙ্কটে নিপতিত হয়, তাহলে দেশে ও বিদেশে বিরাট সমস্যা তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান বিশ্ব বিশ্বায়নের যুগের বাজার অর্থনীতিভিত্তিক বিশ্ব। এ বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে নানা দেশের কোম্পানি, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈধতা না থাকলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি রুদ্ধ হবে। বিদেশী বিনিয়োগ নিরাপত্তহীন হয়ে যাবে। দেশীয় পুঁজি ও ব্যবসা ক্ষেত্রেও আসবে স্থবিরতা। অর্থনৈতিক সমিতি ও সিপিডি-এর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার মর্মবাণীই হচ্ছে সমঝোতা, শৃঙ্খলা, ঐক্য ও সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধিদের শাসন। কারণ, স্বৈর বা  সেনা শাসকদের চেয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশ ও জনগণের মঙ্গল বয়ে আনবে এটা মনে করা হলেও বাস্তবে অনেক সময় ঘটে তার উল্টো। কারণ একটি অনির্বাচিত সেনাশাসক যতটা না স্বৈরাচারী ভূমিকা পালন করতে পারে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর হয় একটি নির্বাচিত স্বৈরশাসক। যে কারণেই গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিকতার কথা বলেন। বহুমত ও বহুত্ববাদের কথা বলেন। সকলের অংশগ্রহণ ও ঐকমত্যের কথা বলেন এবং রাজনৈতিক সার্কাসের বদলে রাজনৈতিক স্বচ্ছতার কথা জোর দিয়ে বলেন।  একদলীয় স্বৈরশাসনকে নিন্দা করেন। এভাবেই গণতান্ত্রিক মানুষ সাদরে গ্রহণ করেন গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক শাসনের পক্ষ। এ কারণেই স্বৈরতান্ত্রিকতার স্মৃতিবাহী এরশাদের রাজনৈতিক নাটক জনঘৃণার কারণ। রাজনৈতিক সার্কাস বিপদের বার্তাবহ।
বাজেটের প্রাক্কালে রাজনৈতিক সার্কাস নয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রয়োজন প্রাজ্ঞতা। বাজার ও বাজেটের প্রেক্ষপটে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এবার একই সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে পবিত্র রমজান। সাধারণত বাজেট ও রমজানেরর উপলক্ষে অসৎ ও অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে দ্রব্যমূল্যেও আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এবার বাজেটের আগুন আর রমজানের বাজার দরের বৃদ্ধি আগুনের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে আবহাওয়ার গনগনে গরম আগুন। শাসনে-প্রশাসনে-সমাজে-অর্থনীতিতে-আবহাওয়া ও বাতাসে আগুনের হল্কায় মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। এমন সময় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার বদলে রাজনৈতিক সার্কাস দেখানো হলো সেটা নিতান্তই দুঃখজনক। অমরা কারও বিরুদ্ধে বলতে চাই না। নিজেদের ন্যায্য পানির হিস্যা চাই। পানি না দেয়া হলে আমরা লাভবান হবো বা আমাদের কোনও ক্ষতি বা অসুবিধা হবে নাÑএটাও মানতে চাই না। নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলার সততার মাধ্যমেই রাজনৈতিক র্স্কাাসের আমূল উৎপাটন সম্ভব। একই সঙ্গে সকলের অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা সম্ভব। দেশের শাসন-প্রশাসন-অর্থনীতি যদি বৈধতার সম্মুখীন হয়, তাহলে দেশে যেমন সমস্যা, বিদেশী বিনিয়োগেও তেমনি সমস্যার সৃষ্টি হবে। বিশ্বায়নের বাজার অর্থনীতির যুগে এতোসব সমস্যা নিয়ে চলা আসলেই মুস্কিল। অতএব যত তাড়াতাড়ি সমস্যাগুলোর সমাধান কল্পে গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেয়া যায়, ততই মঙ্গল।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads