বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০১৪

রাজনীতির আসল রূপ


রাজনীতি এখন যতই রক্তাক্ত ও ভয়াবহ হচ্ছে এবং সমাজজীবন যতই বিপদ সঙ্কুল হচ্ছে, ততই নানা উপাদেয় আলোচনার সূত্রপাত হচ্ছে। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, ক্ষতিকর ফরমালিন ও রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্কের নানা কথা। খাদ্যের পচনরোধে অপব্যবহৃত-ক্ষতিকর ফরমালিন এখন রাজনীতির দরবারেও আলোচিত হচ্ছে। অর্থাৎ কাঁচাবাজার থেকে ফরমালিন এসে পৌঁছেছে রাজনীতির মহাহাটে। কথাটা এখন খোদ রাজনীতিবিদরাই বলছেন। বর্ষীয়ান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনও বলেছেন। এমনকি, ফরমালিন ও রাজনীতি নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীও মুখ খুলেছেন। বিশিষ্ট সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিষাক্ত ফরমালিন দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে,  ‘বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ফরমালিন দূর করতে হবে। খাবারে ফরমালিন দিয়ে পচা ও নষ্ট জিনিসকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, আমাদের রাজনীতিতেও সেভাবে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে।’  অন্যদিকে, ‘সরকারকে পচতে সময় দিয়েছি’, খালেদা জিয়ার এমন বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেখ হাসিনা জাপান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আহূত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপিই পচে গেছে। এখন ফরমালিন দিয়ে আমরাই বিএনপিকে তাজা রাখছি।’ কাগজে আরও দেখলাম, শিশুদের ফরমালিনের কবল থেকে বাঁচাতে মানববন্ধন হয়েছে। মনে হচ্ছে, ফরমালিনই এখন দেশের শীর্ষ আলোচ্য বিষয়। রেলের দুর্নীতির সময়, দুর্নীতির বদলে যেমন ‘কালো বিড়াল’ নিয়ে মুখরোচক আলাপ-আলোচনা শুরু হয়, এখনও আসল সমস্যার বাইরে ফরমালিন নিয়ে কথা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতির আসল বা প্রকৃত রূপের ছটার পেছনের যে ফরমালিনের হাত আছে, সেটাও এই সুযোগে জানা গেল। তার মানে, ফরমালিন সরিয়ে ফেলা হলে রাজনীতির প্রকৃত রূপটি কেমন হবে, সেটাও বোঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। এমনই রাজনীতির হাত ধরে বাংলাদেশ এখন চলেছে প্রকৃত গণতন্ত্রের অধীনে আইনের শাসনের প্রত্যাশায়। সঙ্গে নিয়ে চলেছে স্বৈরতান্ত্রিক-গডফাদার সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির রূপ দেখা যাচ্ছে ফেনীতে, নারায়ণগঞ্জে এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের জনগণের প্রায়-সকলেই জানেন যে, খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের ব্যাপক উপদ্রব চলছে। মাছে-মাংসে-ফলে-মূলে-শাক-সবজিতে ফরমালিন ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য ফরমালিন শনাক্ত করার পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের কাছে প্রচার করা হচ্ছে এবং মাঝে মাঝেই ফরমালিনবিরোধী অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিতে ফরমালিনের বিষয়টি সদ্য উত্থাপিত হয়েছে। ফলে সেটি শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধের বিষয়টি এখনও ব্যাপকতা পায়নি। খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন যেমন শরীর-স্বাস্থ্যের বারোটা বাজাচ্ছে, রাজনীতির ফরমালিনও সমাজ আর রাজনীতির বিরাট ক্ষতি করবে, এতে সন্দেহের কোনও কারণ নেই। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, বাজারে ফরমালিনবিরোধী অভিযান যতটা সরব, রাজনীতিতে ততটা নয়।
১/১১-এর সময় থেকেই রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসীমুক্ত করার কথা শোনা যায়। পেশীশক্তি, কালো টাকার কবল থেকে রাজনীতিকে বাঁচাতে ডাক দেয়া হয়। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করতেও কথা বলেন অনেকেই। এখন ফরমালিনমুক্ত করার কথাও শোনা যাচ্ছে। এতে যদি রাজনীতির গুণগত মান বৃদ্ধি পায়, তবে তো ভালোই। রাজনীতির পাশাপাশি নেতাদেরও ফরমালিনের আওতা থেকে বের করতে হবে। পচা মাছে যেমন ফরমালিন দিলেও স্বাস্থ্যকর হয় না, দূষিত নেতারাও ফরমালিন দিয়ে পাপ ঢাকতে পারবেন না। বরং ফরমালিনযুক্ত খাদ্যের মতোই ফরমালিনযুক্ত রাজনীতি ও নেতৃত্ব সমাজের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাজার ও রাজনীতির যৌথ বিপদ মানুষ ও সমাজের জন্য বড়ই ভয়ের বিষয়। মানুষকে বাজারে যেতেই হবে; রাজনীতিতেও সংশ্লিষ্ট থাকতেই হবে। আর সেখানেই যদি ওঁৎ পেতে থাকে ফরমারিনের প্রলেপ দেয়া ভেজাল, পচা, বাসি মাল, তাহলে তো সবার নাভিশ্বাস।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, একদা সুখাদ্যের জন্য বাংলা বিখ্যাত ছিল। বিদেশীরা বলতেন, স্বর্গের মতো দেশ। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরুর কথাও আছে। অতীত ও ইতিহাসে ভেজাল ও পচা মালের বিবরণ বলতে গেলে নেই। অন্যদিকে, অতীতের ইতিহাসে রাজনীতি ও নেতৃবৃন্দ মানুষ ও সমাজের জন্য আদর্শস্বরূপ ছিলেন। তাদের ত্যাগ, পরহিত, কৃচ্ছ্রতা ছিল প্রবাদপ্রতীম। তাদের প্রতি রাজনৈতিক কারণে কিছু সমালোচনা ছিল বটে; কিন্তু এমন কোনও দুর্গন্ধ ও পচনশীলতা তাদের ছিল না যে, আতর বা ফরমালিন ব্যবহার করে তারা নিজেকে রক্ষা করতেন। এখন ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরে যেসব নেতার কথা শোনা যাচ্ছে এবং যেরূপ রাজনীতি দেখা যাচ্ছে, সেটাকে কি বলা যায়? শেকড় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত রাজনীতি ও নেতৃত্বের দুর্গন্ধ ও পচনশীলতার কার্যকারণগত সম্পর্কও মানুষের অজানা নেই। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, বাজারে বা রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান সমস্যা ও বিপদ নিয়ে এন্তার লেখালেখি, আলাপ-আলোচনা হলেও কর্তৃপক্ষ পারস্পরিক দোষারোপের কাজেই ব্যস্ত। অপরের দিকে দোষ ঠেলে দেয়াই যেন সমস্যার সমাধান! সম্মিলিতভাবে সমস্যা ও বিপদ মোকাবিলার কথা কেউ বলছেন না। ঐক্যে যে লাভ, সেটাই মনে হয় অনেকে বিশ্বাসই করেন না। অথচ বারবার বলা হচ্ছে ঐক্য ও সমঝোতার কথা। সেটা গণতন্ত্র বাঁচানো, বিনিয়োগ বাড়ানো, দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে বা বাজার ও রাজনীতি থেকে ফরমালিন হটাতেও সত্য। এ সত্যটিই এখন বিস্মৃত হয়েছে। বরং মিথ্যাকে ফরমালিন দিয়ে সত্যের মাথায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পচা মাছ, পচা রাজনীতি, পচা নেতা, পচা কথা (মিথ্যা) ইত্যাদি যদি ফরমালিনের জোরে জনতা ও সমাজের মাথায় চেপে বসে, তাহলে খাঁটি ও আসলের উপায় কি? রূপকথায় সিন্দাবাদেও কাঁধে চেপেছিল দৈত্য। সে আর নামতে চায়নি। আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে ফরমালিন মাখানো ভেজাল, পচা, দুর্গন্ধযুক্ত মালামাল। দৈত্য সিন্দাবাদকে বিব্রত করেছিল, জীবনের হানি করেনি। আজকের ফরমালিনযুক্ত মালামাল শুধু বিব্রতই করছে না, জীবন বিপন্ন করার মতো স্বাস্থ্যগত, সমাজগত, আইন-শৃঙ্খলাগত-রাজনৈতিক কারণও ঘটাচ্ছে। সর্বত্র বিরাজমান ও ফরমালিনে চুবানো এই আধুনিক-বীভৎস দৈত্যকুলের কবল থেকে মানুষ ও সমাজের মুক্তির উপায় কি? যারা ফরমালিনের কারবার করেন সমাজে ও রাজনীতিতে, কিংবা যারা বিজ্ঞানের গবেষণায় ফরমালিন নিয়ে চর্চা করেন, তারা হয়ত উত্তরটি জানাতে পারেন।
খাদ্যদ্রব্যের মতোই রাজনীতি, সমাজ, সংসার, অর্থনীতি পচে গেলে বা দূষিত হয়ে গেলে, সেটাকে ফরমালিন দিয়ে আপাতত ঢেকে রাখা যায়। কিন্তু এই আড়াল করার মাধ্যমে কাজের কাজ কিছুই হয় না। পচাকে তাজা বানানো তো যায়-ই না। ফরমালিন হলো প্রবঞ্চনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। প্রহসনের আধুনিক উপায়। এসব বৈজ্ঞানিক বা আধুনিক উপায় প্রয়োগ করে সাময়িক লাভ কিছু হলেও হতে পারে, কিংবা আপাতত পচা গোপন করা যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হতে পারে না। এক-দুইবার ব্যবহারের পর কোনো খাবারে ফরমালিন আছে বা নেই, সেটা যেমন মানুষ টের পায়, রাজনীতিতেও কে ফরমালিন-মাখানো সেটাও স্বল্পসময়ে টের পেয়ে যায়। আদর্শ ও পচার মধ্যকার পার্থক্য মানুষ নিজস্ব বিবেক, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। মানুষের এই উপলব্ধি বড়ই কঠিন। প্রকৃত উপলব্ধি ফিরে পেলে মানুষ কথিত ভেজাল বস্তুকে প্রত্যাখ্যান করতে মোটেও কসুর করে না। একজন বা কয়েকজনকে কয়েক দিনের জন্য ধোঁকা দেয়া যায়। কিন্তু ব্যাপক জনতাকে সারা জীবনের জন্য ধোঁকা দেয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা এবং সভ্যতার নিয়ম।
আমরা অবশ্যই আশা করি, মানুষের প্রকৃত বোধোদয় একদিন হবেই। বাজার ও রাজনীতি থেকে মানুষই নিজ সচেতনতায় ফরমালিন বা ভেজালকে উচ্ছেদ করবেই। উচ্চ আদর্শ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি উন্নত বিষয়ই মানুষের কাক্সিক্ষত হবে। ভেজাল বা ফরমালিন নয়। গায়ের জোরে, ফরমালিনের প্রহসনের জোরে, বিদেশী প্রভুর জোরে ভেজাল ও পচা বস্তু বা মালকে বাজারে যেমন চালানো যায় না, সমাজে ও রাজনীতিতেও চালানো যায় না। সমাজ ও রাজনীতি শেষ পর্যন্ত শুদ্ধতার প্রতিই নিজের আনুগত্য প্রকাশ করে। এভাবেই প্রতিষ্ঠা পায় মানুষের আকাক্সক্ষা ও অধিকার। বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রামের ঐতিহ্যে ভেজাল ও পচা অতিক্রম করে বিশুদ্ধতার প্রতিই নিজের সমর্থন ও আস্থা জ্ঞাপন করবে। বাজার ও রাজনীতির পচনশীলতা আর ফরমালিন-প্রবণতার সঙ্কুল সময়ে দাঁড়িয়েও আমরা মানুষের শুদ্ধতম অভিযাত্রার প্রতিই তাকিয়ে থাকতে আশাবাদী হই। কেননা, গণমানুষের প্রবল শক্তিই সকল বিরূপতা ও অব্যবস্থাকে পরাজিত করার সামর্থ্য রাখে। যারা গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করেন এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখেন, তারা মুক্তির পথ হিসেবে গণশক্তির উত্থানই কামনা করবেন ফরমালিন, পচা বা গডফাদার বা স্বৈরাচারের বিকাশ কামনা করবেন না। কিংবা চলমান গুম, খুনসহ আইন-শৃঙ্খলা ও শাসনের অবক্ষয় কখনওই চাইবেন না। কোনও সুস্থ, গণতান্ত্রিক, বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষই নেতিবাচক বা ক্ষতিকর কিছু চাইতে পারেন না। আমরাও বাজারে বা রাজনীতিতে ফরমালিন চাই না এবং ফরমালিনওয়ালাদেরকেও না। আমরা চাই শুভবোধ সম্পন্ন বাজার ও রাজনীতি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads