বুধবার, ২৫ জুন, ২০১৪

গুম খুন অপহরণ অতঃপর নারায়ণগঞ্জ


জেলার নাম নারায়ণগঞ্জ। এখনও পত্রিকার হেডলাইন। অপরাধ সংঘটনের মাত্রায় শঙ্কিত, বিহ্বলিত, বিচলিত হয়ে ব্যঙ্গ করে পরিণামদর্শী সমাজবিজ্ঞানী ও চিন্তকদের কেউ কেউ স্থানটির নাম দিয়েছেন গুমগঞ্জ। কেউ কেউ বলছেন, মৃত্যু উপত্যকা। আমি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত ঘটনার ইতিবৃত্ত বিশ্লেষণ করে এই অকুস্থলের নামের তাল লয় ঠিক রেখে নামকরণ করতে চাই গুমায়ণগঞ্জ। আয়রন হলো বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত পরমাণু। আজকাল সরকার যেভাবে গুম, খুন অপহরণকে গতিশীল ও সর্বব্যাপী রূপ দিয়েছে সম্ভবত তারই ভয়ঙ্কর ও পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে আমাদের এককালের প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জে। সঙ্গত কারণেই আমরা এখন নারায়ণগঞ্জকে গুমায়ণগঞ্জ বলতে পারি। নারায়ণগঞ্জ যেন আজকে সন্ত্রাসকেই ভয়ঙ্কররূপে শিল্পায়িত করেছে। এই শিল্প আসলে মজ্জাগত ও জন্মগতভাবে স্বতন্ত্র কোনো শিল্প নয়। অন্য কোনো হিটলারী অথবা মুসোলিনীয় শিল্পের বাইপ্রোডাক্ট মাত্র। এই শিল্পের কলাকুশলী বা শিল্পী এককভাবে কোনো ব্যক্তি নয়। বরং ভিন্নমত ও পথকে তা যতই কল্যাণময় ও নান্দনিক হোক না কেন তাকে সর্বাংশে নির্মূল করার দার্শনিকতত্ত্ব যাদের কাছ থেকে এসেছে তারাই এর মূল কলাকুশলী এবং প্রকৃত কৃতিত্বের দাবিদার। এটি আওয়ামী দর্শন ও বাকশালী শিল্প। এই দর্শন ও শিল্পের অনুসারী হতে পারে রাজনীতিক, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, কবি-সাহিত্যিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ীসহ সমাজের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। এরা সবাই একদেশদর্শী ও দুই কান কাটা। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে সহ্য করে না এরা। যাপিত জীবনে এরা স্বার্থান্বেষী, অবিশ্বাসী, মিথ্যেবাদী, স্বেচ্ছাচারী ও ধর্মবিরোধী। কখনো কখনো এরা নিজের ছায়াকেও অবিশ্বাস করে, সংঘর্ষে লিপ্ত হয় নিজেরই বিরুদ্ধে। স্বার্থই যেখানে মুখ্য মনুষ্যত্ব সেখানে সুদূর পরাহত। তার সপ্রমাণচিত্র আমরা দেখতে পাই নারায়ণগঞ্জে। এই শিল্প-দর্শনের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের নিষ্ঠুর ও নৃশংস অনুসারী শামীম ওসমান যিনি বর্তমান ভোটারবিহীন নির্বাচনের ভোটহীন এমপি। নূর হোসেন তার শিষ্য বৈ কিছু নয়। সামান্য ট্রাকের হেলপার থেকে নূর হোসেনর যে অভূতপূর্ব উন্নতি, বিত্ত-বৈভব তা কেবল এই শামীম ওসমানের কল্যাণেই। যখন লিখছি তখন পত্রিকার শিরোনাম এরশাদ শিকদারের চেয়েও ভয়ানক এই নূর হোসেন। এমন একজন লোক নারায়ণগঞ্জে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি! ভাবতেই সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। যুবলীগের মিল্কির কথা কে না জানে? প্রকাশ্য দিবালোকের মতো বৈদ্যুতিক আলোতে জনসমক্ষে নিজেরই রাজনৈতিক সহকর্মীকে ফিল্মি স্টাইলে গুলী করে হত্যা করার মতো দৃষ্টতা আর কে দেখাতে পারে? সেটারও কোনো বিচার হয়নি, ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে মিল্কিকে, যাতে থলের বিড়াল বেরিয়ে না আসে। অবশ্যই এর সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে। মিল্কি যদি সেদিন শপিংমলের সিসি ক্যামেরায় ধৃত না হতো তাহলে এই মিল্কির জীবন হতো সোনায় সোহাগা, কপাল পুড়তো জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের। এই মিল্কি নূর হোসেনরা সরকার তথা আওয়ামী লীগের লোক। এরা সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে জনগণের সম্পদ তছরুপ করে। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। হাট, ঘাট, স্টেশন, টার্মিনাল, জলমহাল, বালুমহাল, ফুটপাত, খাস জমি দখলে নেয়। রাষ্ট্রকে করে ভিখারী। জনগণকে করে জিম্মি। রাষ্ট্র ও জনগণের টাকায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ভাড়া খাটায়। প্রয়োজনে নিজের ছায়াকেও স্বার্থের কারণে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। আর এ ধ্বংসযজ্ঞে যে বা যারা টিকে যায় এদের প্রভুরা বা প্রকৃত শিল্পী-কলাকুশলীরা তাদেরকেই বুকে তুলে নেয়। নাকে মুখে চুমু খায় আর বলে অপহরণকারী আর অপহৃত, গুমকারী, আর গুমকৃত, হত্যাকারী আর হত দুজনই আমার। অতএব কিসের বিচার? বিচারে কেবল ক্ষতি আর ক্ষতি। বরং এদের মধ্যে যে টিকে আছে তাকে রক্ষা করো, সেই আমাদের শিল্প-দর্শনের পকৃত উত্তরাধিকারী, প্রকৃত আওয়ামী বা বাকশালী চেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রকৃত বাঙালি। এ শুধু অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে টিকে থাকা এক বিজয়ী সাহসী বীরই নয়, ভিন্নমত দলনে, দমনে ও নির্র্মূলেও অথিশয় পারঙ্গম। শামীম ওসমান আর নূর হোসেনরা তাদেরই অন্যতম।
দুই মাঝি, দুই ছেলেসহ মোট এগার প্রাণের বিনিময়ে কিছু দিনের জন্য হলেও আজকে নূর হোসেনের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী মুক্ত হয়েছে প্রিয় নারায়ণগঞ্জের মাটি। শেখ হাসিনার শাসনামলে এটাও নারায়ণগঞ্জেবাসীর কম পাওয়া নয়। তবে নারায়ণগঞ্জবাসীর হৃদয়ের পাতা পড়ে বলে দেয়া যায় তারা নূর হোসেন আর শামীম ওসমানমুক্ত নারায়ণগঞ্জ চায়। যেটি বোধকরি নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভিও চায়। ত্বকী মঞ্চের সকল নেতা-কর্মীরও সম্ভবত একই দাবি। কিন্তু সাধু সাবধান! আগেই বলেছি এই দর্শনের মূলনীতিই হলোÑ নিজেরা নিজেরা মারামারি করো, ঝগড়া ফাসাদ করো কিন্তু দুনিয়া থেকে বিয়োগ হয়ে গেলে দল থেকেও বিয়োগ। যে থাকলো তাকে দাও অবারিত সুযোগ, তার সকল কর্মে অপকর্মে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার পাশেই থাকবে। ঐ নপুংষক আহত পরাজিতের কাছ থেকে তো কিছু আশা করা যায় না। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরাজিতকেও কেন্দ্র থেকে শক্তি সাহস আর ক্ষমতা দিয়ে সহায়তা করা হয়। এভাবেই দলের পোষণে তোষণে একেকজন নূর হোসেন আর শামীম ওসমানের জন্ম হয়। তাই আইভি আপাকে বলি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন ঠিক আছে, কিন্তু কেন্দ্র থেকে দলচ্যুত হবেন না। পানি দিয়ে হাওয়া দিয়ে কেন্দ্রের সাথে সংযোগটা ঠিক রাখবেন, মূল্যবান জীবনটা আগে রক্ষা করবেন। নইলে আপনার জন্য শোকসভা হবে আর জামায়াত-শিবিরের গোষ্ঠী নির্মূল হবে। প্রকৃত অপরাধীরা আপনার নামে মিলাদ মাহফিল করবে আর দলে জায়গা পাকাপোক্ত করবে। দলের যে দর্শন তাতেও আইভির জন্য কান্নার কোনো অর্থ নেই বরং জামায়াত-শিবির নিধনের এটাই মোক্ষম সুযোগ। আপনি হারিয়ে গেলেন দলও আপনার শূন্যতায় জামায়াত বিএনপির ঘাড়ে দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে আপনার জীবন সংহারকারীর গাড়িতেই প্রয়োজনে জাতীয় পতাকা তুলে দেবে। এটা আমরা কস্মিনকালেও প্রত্যাশা করি না।
এই নারায়ণগঞ্জে কিশোর ত্বকী হারিয়ে গেলো। আর পাওয়া গেলো না, পরে পাওয়া গেলো ওর লাশ। কিছু দিন আগে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবাদী নেত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীর অপহরণ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখন সেটা নিয়ে তেমন কোনো সাড়া শব্দ নেই। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। নিশ্চিত বৈধব্য থেকে বেঁচে সরকারের হাইপ্রোফাইল নেতাদের তিনি বরং ধন্যবাদই দিয়েছেন। কে বা কারা অপহরণের সাথে যুক্ত তা আর হয়তো কোনদিন জানা যাবে না। কারণ হয়তো শাসিয়ে দেয়া হয়েছেÑ এ পর্বে মুক্তি মিললেও ফের কথা বললে স্বামীসহ জীবনটাই হারাতে হবে। কারণ রিজওয়ানও জানে যারা জড়িত তাদের বিচার কোনো কালেও হবে না।
এরই ধারাবাহিকতায় বড় ঘটনাটা ঘটে গেলো ২৭ এপ্রিল বেলা ১২.৩০টার পর, যখন নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম নূর হোসেনের করা মালায় নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিয়ে জামিন নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন। পথে মৃত্যুফাঁদ পেতে বসেছিল আমাদের জীবন রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাব। নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন মায়ার জামাতা র‌্যাব ১১-এর সিও লে. কর্নেল তরেক মুহাম্মদ সাঈদ, সাথে ছিলেন মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার রানা। এরা তিনজনসহ গুম বাহিনীতে আরো ২২ জন বিভিন্ন পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমস্য জড়িত ছিল বলে জানা যায়। নূর হোসেন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল তার ভাড়ায় খাটা র‌্যাবের সদস্যরা কিভাবে নজরুলকে হত্যার দায়িত্ব পালন করে সেটা দেখার জন্য। বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে ১ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পশ্চিম পাড়া এলাকার রাস্তা নির্মাণকালে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের ফুপাতো ভাই মোবারক হোসেনের সাথে নজরুলের তর্ক হয়। উভয়ের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। ঐ সময় মোবারক নূর হোসেনকে ফোন করে বলেÑ তুমি আওয়ামী লীগের নেতা থাকতে আমি নজরুলের হাতে লাঞ্ছিত হলাম। এ নিয়ে তুমি একটা কিছু করবা। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে বারোটি মাইক্রেবাসযোগে নূর হোসেনের নূর বাহিনীর সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলীবর্ষণ করতে থাকে। পরদিন নজরুল ইসলামকে প্রধান আসামী করে মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে এই নূর হোসেনই উল্টো মামলা দায়ের করে।
এই মামলার পর নজরুল ইসলাম জীবন রক্ষার্থে ঢাকায় চলে যায় এবং হাজিরা দিতে ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে আসে। তিন বন্ধু তাজুল, স্বপন, লিটন ও ড্রাইভার জাহাঙ্গীরসহ র‌্যাবের হাতে অপহৃত হয়। অপহরণের কর্মকা- দেখে ফেলার অপরাধে এডভোকেট চন্দন সরকার ও তার ড্রাইভার ইব্রাহিমকেও যুগপৎ র‌্যাব অপহরণ করে। পরে তাদের নৃশসভাবে হত্যা করে শীতলক্ষ্যার কালো পানিতে সমাধিস্থ করবার প্রাক্কালে তাদেরকে বহনকারী নৌকার দুই মাঝিও এই পর্বের চাক্ষুস সাক্ষী আরো দুই জেলেকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ১১ জনের হত্যাকা-ের নেতৃত্ব দেন মন্ত্রী জামাতা লে. কর্নেল তারেক মুহাম্মদ সাঈদ। ভেবেছিলেন-কর্তার হুকুমে কত গুম, খুন করলাম নিজের জন্য না হয় একটু ঝুঁকিই নিলাম, আর একেবারে নিজের জন্যও তো নয় ছোটকর্তাদের হুকুমে .....! মাঝখানে ছয় কোটি টাকা! হুকুম তামিলও হলো, নগদ নারায়ণও মিলল। কিন্তু বেচারা শীতলক্ষ্যা বুঝল না, উগড়ে দিল এক এক করে সাতটি লাশ, চারদিন পর ৩০ এপ্রিল ছয়টি পরদিন ১ মে আরো একটি। শুরু হয় গুমগঞ্জে গুম কাহিনীর পরবর্তী নাটকের মঞ্চায়ন। যার শেষটা দর্শকশ্রোতা ঘুমিয়ে যাবার কারণে হয়তো আর জানা যাবে না। কেননা ইতোমধ্যেই আসামী গ্রেফতার নিয়ে আসল কলাকুশলী বা প্রভুদের শুরু হয়েছে টালবাহানা। কারণ এ আসামী অতি সাধারণ কোন আসামী নয়, ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত আন্তর্জাতিক ফেরারি আসামী যাকে আওয়ামী লীগ অবমুক্ত করে এনে থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির আসনটিকে অলঙ্কৃত করেছে। এসব নূর হোসেনদের অবর্তমানে আওয়ামী লীগের ঐসব বাকশালী কলা কুশলীদের ক্ষতি হবে যারা জনগণের বুকের উপর জোর করে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। তবে জনগণের লাভ হবে অশেষ।
যদিও অপহরণের পরই ফতুল্লা থানায় পাঁচজনকে আসামী করে মামলা হয়। আসামীরা যথাক্রমে নাসিকের চার নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নূর হোসেন, থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন, নজরুলের চাচা শ^শুর হাসমত আলী হাসু, নূর হোসেনের সহযোগী ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে গ্রেফতার করা তো দূরে থাক উল্টো অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধেই ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও নানামুখী হয়রানি অব্যাহত রাখে এবং আসামীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এতে অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না যে এই অপহরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে। সরকারের নির্লিপ্ততাই শুধু নয় বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ও আন্দোলন সংগ্রাম প্রতিহত করতে গিয়ে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকে গুম, খুন ও অপহরণের এজেন্সি দিয়ে মাঠে নামিয়ে এদেরকে এ ধরনের অপকর্মে রীতিমত অভ্যস্ত করে তুলেছে। সুতরাং এর দায় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার নয় বরং পুরো দায়দায়িত্বই নীতি ও দর্শনগতভাবে সরকারের উপরই বর্তায়। রাষ্ট্র শুধু ভূখ-ের নাম নয় এর অপরিহার্য উপাদান জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই রাষ্ট্র গঠন করেছিল। রাষ্ট্র গঠনের এই উদ্দেশ্যটা শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল নাগরিকই কম-বেশি অবহিত। সেই রাষ্ট্রই আজ তার সন্তানতুল্য নাগরিকদের জীবন সংহারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভূখন্ড আর জনগোষ্ঠী কোনটাই আজ আর নিরাপদ নয়। সীমান্তে পার্শ্ববর্তী দেশ কর্তৃক জমি খাল জলাশয় দখল, কাঁটা তারে ঝুলে থাকে যারা নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র গঠন করেছিল তাদের সম্ভ্রম। এটাকে আর যাই হোক স্বাধীনতা বলা যায় না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা যখন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই বিঘিœত হতে থাকে তখন শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন রাষ্ট্রের মালিককে অপহরণ করে, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে শুধু তাই নয় নিহত মালিকের প্রাণহীন দেহটিকে সরকারি টাকায় কেনা ডালের বস্তায় ভরে চাকরের বেডিংবাধা রশি দিয়ে সেই বস্তার মুখ বেঁধে পেট ফেঁড়ে শীতলক্ষ্যায় স্বাধীনতার জলাঞ্জলি দেয়, তখন আমাদের নির্বাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। তখন জনপ্রিয় সেই স্লোগানের সাথে আমাদেরও গলা মেলাতে ইচ্ছে করে-“এ রাষ্ট্র ভেঙ্গে ফেল, জনগণের রাষ্ট্র গড়।” অবস্থার ভয়াবহতা এখানেই শেষ নয়-অবশেষে যখন স্বাধীন বাংলাদেশ পচে ফুলে শীতলক্ষ্যায় ভেসে উঠেছে, চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেছে, আঙুল উঠছে সরকারি দল আর সরকারি বাহিনীর দিকে, ঠুঁটোজগন্নাথ বিচার বিভাগও বিবেকের দায়বোধে উজ্জীবিত হয়। ঘটনার ১৫ দিন পরে হলেও একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১১ মে তারিখে মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলমের বেঞ্চ তিন মহারথিকে গ্রেফতারের আদেশ জারি করেন। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন-যারা রিট আবেদনটি করেছে তারা নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে চায়। এর আগে তো কোন কোন মন্ত্রী বলেই বসলেন এটি বিএনপি-জামায়াতের কাজ। তাও আবার সচরাচর যেভাবে সরকারের ভুঁইফোড় অর্বাচিন কিছু মন্ত্রী উল্টা পাল্টা নানান কথার খই ফুটায়, ছোট মুখে বড় কথা বলে তারা নয়, মোটামুটি যাদের গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক অতীত আছে তারাই যখন এ ধরনের ঘটনায় পূর্বাপর না জেনেই কোন প্রকার তদন্ত ব্যতিরেকেই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায় তখন প্রকৃত অপরাধীরা মুক্তির উল্লাসে ঘোমটা তালে নাচে। আর সরকার তথা প্রভুরা তখন আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাকার মদমত্ততায় ডুগডুগি বাজায়। এটাই এই দার্শনিক তত্ত্বের অনুসারীদের নেশা পেশা এবং রাজনৈতিক অভিলাষ। নারায়ণগঞ্জ মূল কোন রোগ নয়, মূল কোন রোগের উপসর্গও নয়। বরং জনগণ ইতোপূর্বে আন্দোলনে যে হালকা মাত্রার অনুপযোগী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছে তারই বিরূপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মাত্র। জনমনে গভীর ভীতি সৃষ্টি করাই এর উদ্দেশ্য। যাতে এদেশে আর কোন আন্দোলন হতে না পারে, আর কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ দানা না বাঁধে। অবাক হই দেশের সুশীল আর ভাড়া খাটা বুদ্ধিজীবীদের আচরণগত পরিবর্তন দেখে, তারা বোধ হয় এখন একটু নড়েচড়ে বসেছে-তাদের মুখে ‘সমাজ অতিমাত্রায় অসভ্য হয়ে পড়ছে, বাঁচতে হলে রাস্তায় নামতে হবে, এভাবে চলতে পারে না, গুম হত্যার জন্য অসুস্থ রাজনীতিই মূল কারণ’ এ ধরনের দুই একটা কথার উচ্চারণ অনেক তাৎপর্যবহ হয়ে উঠেছে। এর কারণ হতে পারে দুটি-এক. ৬ কোটির একআনাও বোধহয় এদের কারো ভাগ্যে জোটেনি। লে. কর্নেল তারেক সাঈদরা খুবই স্বার্থপর আর নূর হোসেনও যাচ্ছেতাই বোকা! যারা এত সাধনা করে শেখ হাসিনার সরকারকে জলপট্টি দিয়ে এখনও পর্যন্ত জীবিত রেখেছে, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার থেকেও যাদের একাউন্টে নগদ নারায়ণ জমা হয়, দাদাদের কৃপা যাদের মাথার উপরে সব সময় ছায়ার মত লেগে থাকে, তাদেরকে কোন অংশ না দিয়ে এত বড় কা-! তাই এরা হয়তো সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এহেন কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সাময়িকের জন্য কিছু বাক্য ব্যয় করছে মাত্র। আশা করা যায়, দেবতামতে ফুল দিয়ে সরকার বাহাদুর  এদেরকে তুষ্ট ও শান্ত করতে পারেন। দুই. অথবা এদের আশঙ্কা- এভাবে রিজওয়ানা হাসানের স্বামী, নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের নেতার ছেলে ত্বকী, এ্যাড. চন্দন সরকার ও নজরুলরা গায়েব হতে থাকলে এসব ফ্রাঙ্কেনস্টাইল আমাদেরকেও প্রয়োজনে গায়েব করে হজম করে ফেলতে পারে। কেননা এই বাংলাদেশে এর পূর্বেও বহু মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আওয়ামী ক্যাডারদের হাতে অপহৃত, গুম ও খুন হয়েছে। কখনও এরা মুখ খুলেনি, দাঁড়ায়নি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের পক্ষে। কারণটা বোধ হয় সবারই জানা আছে যারা গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, পুলিশ র‌্যাব বিজিবির গুলীতে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে তারা কেউই মানুষ ছিল না তারা কেবলই বিএনপি বা জামায়াত। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার ব্যস্ত রাজপথ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিএনপির জনপ্রিয় নেতা সিলেটে সুরঞ্জিত বাবুর অবিকল্প রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইলিয়াস আলী গুম হন, এর আগে ঢাকা সিটির ওয়ার্ড বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম গুম হন। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এদের স্বজনদের চোখের জলও বোধহয় বাংলাদেশের নদীগুলোর মতোই শুকিয়ে গেছে। আজও তাদেরকে জীবিত বা মৃত উদ্ধার করা যায়নি বা হয়নি। তখন কিন্তু এই সুশীলরা মুখে তালা মেরে বসেছিল। বললে যদি প্রভু নারাজ হয়। হাই প্রোফাইল গুমের কথা ছেড়েই দিলাম তাদের গুম হয়তো বৃহৎ কাউকে খুশি করা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষেতে খামারে যেসব মানুষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারালো। কই তখন তো কেউ দুটো কথা খরচ করল না। আমার পয়সায় কেনা গুলি আমার বুকই বিদ্ধ করে, ঝাঁঝরা করে। ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন মেধাবী ছাত্র মুকাদ্দাস ও ওয়ালীউল্লাহ ঢাকা-কুষ্টিয়া ফেরার পথে নবীনগর পৌঁছালে হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে র‌্যাবের হাতে গুম হন। তাদের উদ্ধারের জন্য তাদের স্বজনরা সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির কাছে দিনের পর দিন ধরনা দেয়। তাদের বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তাল আন্দোলন গড়ে তোলে। ঢাকায় মানববন্ধন করে তাদের সন্ধান প্রত্যাশীরা। সরকার কোন কিছুতেই কান দেয় না, কারণ তারা যে রাজনৈতিক জিঘাংসার শিকার, এটা আজ আর রাখঢাকের কোন বিষয় নয়। সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুরে প্রতিদিনই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বেছে বেছে সেখানকার গণমানুষদের অতিপ্রিয়, সমাজসেবী, জনদরদী তরুণ-যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ নির্বিশেষে হয় গুম করছে; না হয় খুন করছে। এই সবের বিরুদ্ধে দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, এনজিও ও মানবাধিকার কর্মীদের তো কোন প্রকার বাদ-প্রতিবাদ করতে দেখি না। তাহলে কি বুঝবো সবই মেকি, সবই ছলনা, মানবাধিকারের মোড়কে কেবল পয়সা কামানোর ধান্দা। আমাদের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান দিব্যি কাব্যিক মানুষ, তার কোন নর্তন-কুর্দনে কারও তেমন কিছু আসে-যায় বলে আমার মনে হয় না। সুশোভিত মুখে তিনি তা দিতে দিতে মানবাধিকারের ফুটো ফানুস হরদম আকাশে ওড়ান। তাতে পৃথিবীর বাসিন্দাদের খুব একটা লাভ হয় না। কারণ এসব গুম খুন হচ্ছে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সবই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্দয়ভাবে বাকশালী কায়দায় উচ্ছেদ করবার অভিপ্রায়। ২০০৮ থেকে অদ্যাবধি ২০১৪ পর্যন্ত সরকার কিছু পুলিশ র‌্যাব ও বিজিবি কর্মকর্তার হাতকে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের কাজে ব্যবহার করে পরিপক্ব করে তুলেছে তার মাশুল বাংলাদেশের জনগণকে বহুকাল দিতে হতে পারে। যেভাবে সরকার এদেরকে মানুষ হত্যার অবারিত লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে, তারই একটা ভুল ব্যবহার করে ফেলেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতি দক্ষ ও অনুগত সদস্য লে. কর্নেল তারেক মুহাম্মদ সাঈদ ও তার সাথীরা। এতক্ষণে আমাদের পরজীবী সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের মুখে বাক ফুটেছে। তাদের আচরণ বড়ই রহস্যময়, ভাব দেখে মনে হয় দুধ-কলা দিয়ে তারা সাপ পুষেছে। গুম করতে হয়Ñ বিএনপি জামায়াত আছে না? ওদের দিয়ে তোমাদের চিরদিনের ক্ষুধা মিটিয়ে ফেল। ওরা পাকিস্তানের দালাল বাঙালিপনার শত্রু। এই মুখে ফেনা তোলা বোল মানুষ আর গ্রহণ করতে চায় না শাহরিয়ার কবিরদের মন খারাপ। নারায়ণগঞ্জের এতবড় হৃদয়বিদারক ঘটনার পরও এর মধ্যে জামায়াত নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছেন তিনি। বলছেন, জামায়াত যেন সরকারের বিরুদ্ধে কোন জনমত গড়ে তুলতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। এই পরান্নভোজীরা যদি প্রকৃত অর্থেই অন্যায়কে অন্যায় বলতো, দলান্ধতা, পার্শ¦দেশপ্রেমিকতা ও স্বার্থপরতা ছেড়ে মনুষ্যত্বের চর্চা করতো তাহলে বোধকরি দেশ এই ভয়াবহ গুমরাজ্যে পরিণত হতো না। আওয়ামী লীগের জঠরে যুগে যুগে জন্ম হতো না জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান, ডা. ইকবাল, মিল্কি ও নূর হোসেনদের। অবশেষে প্রার্থনা করি, নিরাপদ হোক প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ, স্বাধীনতার মৌ মৌ গন্ধে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিক এদেশের মানুষ। নিপাত যাক হিটলারী ও মুসোলিনীয় তাবৎ দর্শন। নারায়ণগঞ্জের পুনরাবৃত্তি আর কোথাও না ঘটুক। এর জন্য প্রয়োজন দুর্বার গণআন্দোলন ও সঠিক নেতৃত্ব। প্রতীক্ষায় রইলাম।
মো. রফিকুল ইসলাম 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads