শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০১৪

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি


সরকারের পক্ষ থেকে আশার কথা শুনিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালানো হলেও বাস্তবে দেশের অপরাধ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দৈনিক সংগ্রামের এক বিশেষ রিপোর্টে জানা গেছে, দেশজুড়ে অপরাধ বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধগুলো অনেক আগেই মানুষের জন্য ‘ডাল-ভাতে’ পরিণত হয়েছে। মানুষ আতংকিত হচ্ছে আসলে গুম ও খুনের মতো রক্ত হিম করে দেয়া অপরাধের কারণে। দৈনিক সংগ্রামের এই রিপোর্টে তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, চলতি বছর ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ১৬৯ দিনে খুনের শিকার হয়ে সারাদেশে মারা গেছে এক হাজার ৭৫৬ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন খুন হয়েছে ১১ জন। উদ্বেগের অন্য এক কারণ হলো, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের যখন জোর তৎপরতা চালানোর কথা তখনও খুনের মতো ভয়ংকর অপরাধ দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে। জুনের ১৮ তারিখ পর্যন্ত পরিসংখ্যানের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে পূর্ববর্তী মাস মে’র তুলনায় চারজন বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। রিপোর্টে অন্য একটি আশংকাজনক তথ্যেরও উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে এতে জানানো হয়েছে, গুম আর খুনের ঘটনা বেড়ে চলেছে আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে যেখানে চার হাজার ৯৯ জন মানুষ খুনের শিকার হয়েছিল, ২০১৩ সালে সেখানে চার হাজার ৩৯৩ জনকে খুন করা হয়েছে। অপরাধ কেন বেড়ে চলেছে তার কিছু কারণও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান কারণ হিসেবে তথ্যাভিজ্ঞরা সরকারের ব্যর্থতার কথা জানিয়েছেন। দলীয় লোকজনকে চাকরি দিয়ে র‌্যাব ও পুলিশের জনবল বাড়ানো হলেও আাইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীগুলো মারাত্মক ব্যর্থতা দেখিয়েছে বলেই অপরাধও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রয়েছে র‌্যাব ও পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করার কর্মকান্ড। আাইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার আসল কাজ ফেলে এসব বাহিনী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে আর এর ফলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। র‌্যাব ও পুলিশকে তারা গণনায়ই আনছে না। একই কারণে বেআইনী অস্ত্রের ব্যবহারও আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পাশাপাশি তথ্যাভিজ্ঞদের অভিমতের উল্লেখ করে দৈনিক সংগ্রামের আলোচ্য রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করার পরিবর্তে র‌্যাব ও পুলিশকে স্বাধীনভাবে তাদের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হলে এবং প্রতিটি অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ এমনিতেই কমে আসবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, খুন ও গুমসহ সামগ্রিক অপরাধ পরিস্থিতি সম্পর্কিত দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টটি যে কোনো মূল্যায়নে অত্যন্ত ভীতিকর। রিপোর্টে বলা হয়েছে বলে শুধু নয়, আসলেও আজকাল এমন কোনোদিনের কথা বলা যাবে না, যেদিন দেশের কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো মানুষকে খুনের শিকার না হতে হচ্ছে। সরকারের হিংসার টার্গেট হয়ে গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মিরা। তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র সাদা পোশাকধারীরা। স্বজনদের পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীরাও একবাক্যে জানাচ্ছেন, সাদা পোশাকধারীরা র‌্যাব ও পুলিশের সদস্য। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা তো ইতিহাসই সৃষ্টি করেছে! বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অনেক উপলক্ষেই সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। বাস্তবেও পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছে যে, এই অভিযোগকে পাশ কাটানোর উপায় নেই। কারণ, দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্দোলনে তৎপর বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মিরাই গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন। এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে পেশাদার খুনী-সন্ত্রাসীরা। জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ থেকে চাঁদাবাজি পর্যন্ত নানা কারণে ও অজুহাতে তারা হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের লোকজনকে তো বটেই, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যদেরকেও তাদের সঙ্গে অংশ নিতে বা গোপনে তাদের সাহায্য করতে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে জানাজানি হওয়ার পরও কেউ ধরা পড়ছে না। বিচার কিংবা শাস্তি দূরে থাকুক, সরকারের লোকজন উল্টো তাদের সীমান্ত পার করে দিচ্ছে। সরকারের আশ্রয়েও অনেক অপরাধী দেশের ভেতরে বসবাস করছে। অন্যদিকে সমাজে এসব নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়ায় ভীতি-আতংক ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, জনগণকে যাদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা সে পুলিশ ও র‌্যাবের বিরুদ্ধেই গুম ও গুপ্তহত্যার অনস্বীকার্য অভিযোগ উঠেছে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যে, নিরীহ মানুষেরাও আজকাল শংকাহীনভাবে বাড়ির বাইরে যেতে পারছেন না।
দেশের ভেতরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেবল নয়, বিদেশেও এমনকি সরকারি পর্যায়েও এসব হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটতে এবং হত্যার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। যেমন গত সোমবার এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা কথায় কথায় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে থাকেন তারাও সরকার সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে এখনো কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পুলিশের আ্ইজি বরং দৈনিক সংগ্রামের প্রশ্নের জবাবেও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি সম্পর্কে যথারীতি কলেরগানের ভাঙা রেকর্ডই বাজিয়েছেন। বলেছেন, পরিস্থিতি নাকি স্বাভাবিক রয়েছে! আমরা মনে করি,এমন বাস্তবতার প্রতি এমন উপেক্ষার দৃষ্টি কোনও ভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং সময় থাকতে সরকারের এমনভাবে তৎপর হওয়া উচিত যাতে আর একজন মানুষকেও হত্যার শিকার না হতে হয়। যাতে অপরাধীরা গ্রেফতার হয় এবং কঠোর শাস্তি পায়। যাতে র‌্যাব ও পুলিশ তাদের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেতে পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads