মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০১৪

যাত্রাপালার রঙ্গমঞ্চ ও গানম্যান ভরসা


শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। সম্ভবত তিনি বাংলাদেশে আর একটি রেকর্ড তৈরী করে ফেলেছেন। এর আগে বৃহত্তম মানব পতাকা আর লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে গিনেজ বুকে নাম উঠিয়েছেন এমন লাফালাফি আমরা অনেক শুনেছি। ঐ দুই কারণে গিনেজ বুকে নাম উঠলে সাধারণ মানুষের কী উপকার হয় সে বিষয়ে কারও কোনো ধারণা নেই। তাতে বেঘোরে প্রতিদিন যে মানুষেরা প্রাণ হারাচ্ছে, দেশব্যাপী যে খুনোখুনি, লুণ্ঠন, অরাজকতার ক্ষেত্রে কী হেরফের হয় কেউ জানে না। কিন্তু ঠাটা ঢেঁকির বাদ্য বাজতেই থাকে। ঐ দুই কারণে সত্যি সত্যি গিনেজ বুকে বাংলাদেশের নাম উঠেছে কিনা, পরে সেখবর আর কেউ রাখেননি। কিন্তু সম্প্রতি জাতীয় সংসদে মুজিব-হাসিনার প্রশস্তিমূলক সঙ্গীত গেয়ে সরকার আর একটি রেকর্ড স্থাপন করেছে। জানিনা, এ জন্য গিনেজ বুকে সরকারের নাম উঠবে কিনা। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ সংসদে যখন এই গান গেয়েছেন, তখন গোটা সংসদ টেবিল চাপড়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
গুগলে সার্স দিয়ে দেখা গেলো, পৃথিবীর পার্লামেন্টের ইতিহাসে জাতীয় সংসদে গান গেয়ে বিনোদনের ঘটনা কেবল একবার ঘটেছে। আর সেটা হয়েছিলো নিউজিল্যা-ে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্ট সমকামীদের বিয়ের প্রস্তাব অনুমোদন করে। তখন সংসদে এই প্রস্তাবের সমর্থকরা প্রেম সঙ্গীত গেয়ে আইন পাসে অভিনন্দন জানায়। সংসদে গান গাওয়ার ওটি প্রথম রেকর্ড। তার আগে বা পরে আর কোথায়ও এমন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু গত ১৯জুন বাংলাদেশের অনির্বাচিত সংসদে তেমনি আর এক ঘটনা ঘটলো। এটি বাজেট অধিবেশন। সে অধিবেশনে জনগণের ভাগ্য নির্ধারণমূলক বাজেট নিয়েই আলোচনা হবার কথা। মমতাজ বেগম সেই বাজেট আলোচনায় অংশ নিচ্ছিলেন। কিন্তু বাজেটের উপর কোনো কথা না বলে তিনি হারমোনিয়াম-তবলা ছাড়াই খালি গলায় শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে গান শুরু করে দেন। গানটি ছিলো ‘যতোদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী বহমান, ততোদিন রবে কীর্তি তোমার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ তিনি বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন ঐ গানের প্যারোডি দিয়ে। তা ছিলো ‘হায়রে বাঙালী, ওরে বাঙালী, তোরা বুঝবিরে একদিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তোদের মাঝে থাকবে না যেদিন। শেখ হাসিনার জন্য আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তা নাহলে ওসব কথা বলাই যেতো না।’ এসময় সংসদ নেতা শেখ হাসিনা হাসতে থাকেন। অন্য এমপি’রা টেবিল চাপড়ে মমতাজকে অভিনন্দন জানান।
আজকাল সংসদের এমনই চিত্র। নবম বাজেট অধিবেশনেও মমতাজ একইভাবে গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। আওয়ামী ঘরানারই এক সাংবাদিক এই ঘটনায় বিস্ময় বোধ করে অন্য একটি সংবাদপত্রে ‘মাননীয় স্পীকার পয়েন্ট অফ অর্ডার/ মমতাজের গান ও তেল ঘি বাটারে ভাসছে সংসদ’ শিরোনামে একটি ‘পর্যবেক্ষণ’ লিখেছেন। আর তিনি তাতে অনেক দুঃখ করেছেন। বলেছেন, জাতীয় সংসদ তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। এখানে জ্ঞান, বিদ্যা ও বুদ্ধির আলোকচ্ছটা একসময় যা ছিলো এখন তার কিছুই নেই। সংসদে বিরোধী দল বলতেও কিছু নেই। স্পীকারও তার বিদ্যা ও ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটাতে পারছেন না। অধিবেশন যা নিয়েই হোক না কেনো সবারই প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা ও সরকার দলের নেতা-নেত্রীদের গুণকীর্তন আর অশালীন ভাষায় বিএনপি নেতাদের গালিগালাজ করা। তিনি দুঃখ করে বলেছেন, মমতাজের গানের সময় ‘একজন বিরোধী দলের সদস্যও দাঁড়িয়ে বললেন না, মাননীয় স্পীকার সংসদের রীতিনীতি, কার্যপ্রণালী বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এই গান এক্সপাঞ্জ করুন। এমনকি এখনও এই সংসদে অনেক দেশবরেণ্য পার্লামেন্টারিয়ান রয়েছেন। তবু কেউ অপত্তি করেননি সংসদকে এমন করে তামাশা বানানোর প্রক্রিয়া দেখে।’
কার্যত সংসদকে যাত্রাপালার আসর বানানো যেতে পারে, একথা কেউ কল্পনাও করেনি। ঐ সহযোগী সাংবাদিক যেমন বলেছেন, জনগণের অর্থ ব্যয় করে এমন কা- হতাশাজনক ও অনভিপ্রেত। তেমনিভাবে গত ২২জুন এক জনসভায় কৃষক-শ্রমিক-জনতা পার্টির নেতা বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমও একই অভিযোগ করে বলেছেন, ‘জনগণের রক্ত পানি করা পয়সা খরচ করে বর্তমান সংসদ মমতাজের গানের রঙ্গমঞ্চে পরিণত করা হয়েছে। যে সংসদে মানুষের কথা বলার কথা, সে সংসদ এখন নেতা-নেত্রীদের গুণকীর্তন করে সংগীত পরিবেশন করা হচ্ছে। এ সংসদের গঠন প্রক্রিয়া যেমন হাস্যকর ও ঠাট্টা-মশকরামূলক, তেমনি এখানে যা কিছু ঘটছে, তা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ সংসদের প্রকৃত পক্ষে সংসদীয় কোনো চরিত্রও নেই, দায়ও নেই। আওয়ামী লীগের ২৩৪ সদস্য থাকলেও প্রতিনিয়ত এখানে কোরামের সঙ্কট আছে। কেউই সংসদকে গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে না। কার্যত যেনো এটি যাত্রাপালার রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে।
সেটাই হওয়ার কথা। যে সংসদে ১৫৪ জন অনির্বাচিত, যে সংসদ নির্বাচন জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত, যে ভোটাভুটিতে জনগণ অংশগ্রহণ করেনি, তেমন সংসদে এমন ঘটনাই তো ঘটার কথা। প্রকৃত দায়িত্ব পালনে এদের অবকাশ কোথায়?
দেশে হানাহানি, খুনোখুনি, আওয়ামী নেতাকর্মীদের পরস্পরকে খুন করা এখন দৈনন্দিন ব্যপারে পরিণত হয়েছে। সাধারণভাবে অন্যত্র যারা খুন হচ্ছে, তারাও হচ্ছে আওয়ামী নেতাদের দ্বারাই। কিংবা তাদের বিভিন্ন ভাড়াটে বাহিনীর দ্বারা। নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারে যারা খুন করেছে বা করিয়েছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগার। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামকে যারা খুন করেছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সদস্য। এমনকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি এনামুল হক শামীমকে যারা ধানম-িতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে, এখন পত্র-পত্রিকাগুলোর অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এরাও সব আওয়ামী লীগার। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখন আফ্রিকান মাগুরে পরিণত হয়েছে। এরা যা পায়, তাই খায়। যখন খাওয়ার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না, তখন নিজেরা নিজেদের খায়। এরা এখন পরস্পরকে খাচ্ছে। স্বার্থের দ্বন্দ্বই এসব হত্যাযজ্ঞ ও হত্যাচেষ্টার কারণ। পল্লবীর কালসী বস্তিতে এক পরিবারের যে নয় জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে তার পেছনেও রয়েছে এক আওয়ামী এমপি। সন্দেহের সকল আঙ্গুল তার দিকেই।
এক্ষেত্রেও চরম দলীয়করণকৃত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্ভবত কিছুই করার নেই। গত ২১জুন এক সহযোগী ‘রাজনীতিকদের সাবধানে চলার পরামর্শ!’ শিরোনামে এক খবর দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপর হামলা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বর্তমান অবস্থায় রাজনীতিকদের সতর্ক থাকা এবং একা না চলার পরামর্শ দিচ্ছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি লাইসেন্স করা অস্ত্র সব সময় সঙ্গে রাখতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা একটি রিপোর্ট তৈরী করছে, যা শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। তাদের সুপারিশে থাকছে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাবধানে চলার পরামর্শ। একা বের না হওয়াই ভালো। চলাফেরার সময় বিশ্বস্ত কাউকে সঙ্গে রাখতে হবে। যাদের লাইসেন্স করা অস্ত্র আছে, তাদের তা সার্বক্ষণিক সঙ্গে রাখতে হবে। পাশাপাশি অস্ত্রটি সচল আছে কিনা তাও পরীক্ষা করে নিতে হবে। দলীয় বিরোধ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে পারে এমন কিছু আঁচ করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে থানার ওসি, ডিসি বা পুলিশ সুপারদের অবহিত করতে হবে।
এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পুলিশের উপর আর নির্ভর করার মানেই হয় না। বরং প্রত্যেক ব্যক্তিকেই যার যার নিরাপত্তার জন্য এখন থেকে অস্ত্রের মালিক হতে হবে। নিরাপত্তা সংস্থার পরামর্শমতে সঙ্গে থাকতে হবে বিশ্বস্ত সঙ্গী। তাদের তো আর পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকলে চলবে না। নেতার নিরাপত্তার জন্য তাদেরও অস্ত্রের প্রয়োজন হবে। ফলে ঐ নিরাপত্তা রক্ষীদেরও অস্ত্রের লাইসেন্স দিতে হবে। এমনিতেই প্রতিদিন, জানা যায়, শত শত অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এসব অস্ত্র খুন, ডাকাতি, রাহাজানিতে ব্যবহার হচ্ছে। সেভেন মার্ডারের প্রধান আসামী নূর হোসেনের ছিলো ১২টি অস্ত্রের লাইসেন্স। একরাম হত্যার সময় আমরা দেখলাম, প্রতিপক্ষের এক আওয়ামী নেতা নিজেই পাঁচটি অস্ত্র এনে খুনিদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। অস্ত্র এখন এমনই মুড়িমুড়কি। নতুন যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে আরও হাজারে হাজারে অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে যাবে। আওয়ামী নেতারা পরস্পর খুনোখুনিতে লিপ্ত। ফলে উভয় গ্রুপই ‘আত্মরক্ষার জন্য’ অস্ত্রের লাইসেন্স চাইবে। উভয় পক্ষের হাতে অস্ত্র থাকার ফলে খুনোখুনি কমার বদলে তা আরও বাড়বে। এবং সমাজে হানাহানি চূড়ান্ত রূপ নেবে। ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ আরও শতগুণে বিস্তৃত হবে। সাধারণ মানুষের জীবন আরও অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
তার নমুনাও তো দেখা যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বের হওয়া যায় না। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়া যায় না। ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো যায় না। মেয়েরা রাস্তায় বের হলেই বিপদ। অস্ত্রধারীরা গুলি করে ছিনিয়ে নিয়ে যায় টাকা। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণ না পেলে খুন করে লাশ এখানে সেখানে ফেলে দেয়। দেশের এই চরম অরাজক অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের সম্ভবত গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads