বুধবার, ১৮ জুন, ২০১৪

ওরা মানুষ নয় বিহারি


মিরপুরের কালশীর বিহারিপল্লীতে এখনো শোকের মাতম থামেনি। মানবিক বিপর্যয়ের এ বধ্যভূমি এখনো অনেকের দৃষ্টির আড়ালে। অবাঙালি হত্যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও বাঙালিত্বের অহমধারীরা বুঝতেই চাচ্ছেন নাÑ আমাদের ভাবমর্যাদা কতটুকু ভূলুণ্ঠিত হলো। শাসকদের কাছে এটা যেন সামান্য ক্ষতি। তার ওপর ওরা মানুষ নয়, বিহারি। পল্লীটা তাদের। অধিকন্তু এলাকাটা বিএনপি সমর্থিতদের আখড়া, কিন্তু এমপি সরকারদলীয়। বিহারিরা মানুষ কি না, তাদের গায়ের রক্ত বাঙালির মতো লাল কি না, তাদের অনুভূতি-অনুভব আমাদের মতো কি না কেউ সেই প্রশ্ন তুলছেন না।
মধ্য শাবানের রাতে এই নারকীয় ঘটনাটি ঘটিয়ে শবেবরাতের আতশবাজির রঙ ছড়িয়ে দেয়া হলো। অদূরে পিশাচের হাসি হাসল স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তার পেটোয়া বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ১০টি প্রাণ কেড়ে নেয়া থেকে এই অসহায় বনি আদমদের রক্ষায় ন্যূনতম কর্তব্যকর্মটিও পালন করতে পারল না। তালাবদ্ধ ঘরে পুড়ে মরল অবুঝ তিন শিশু। ১০ জনের ৯ জনই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেল। এর পরও মাস্তান চক্রের খুনের নেশা মিটল না।
ঘটনার দিন স্থানীয় সংসদ সদস্য কতটা প্রকৃতিস্থ ছিলেন তা জানি না, তবে শুনেছিÑ সে এলাকায় তার ইশারা ছাড়া মশাও ওড়ে না, গাছের পাতাও নড়ে না, মদ্যপদের খদ্দেরও জোটে না। অবশ্য অনেক দেরিতে সংসদ সদস্য সমবেদনা জানাতে গেলেন। প্রশ্নটা বড় হয়ে এলো, তাৎক্ষণিক গেলেন না কেন? ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে কটা টাকা গুঁজে দিয়ে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করে উল্টো ক্ষোভের মুখে পড়লেন। এমপির মুখের ওপর সেই গুঁজে দেয়া টাকা ছুড়ে মেরে হত্যার জন্য তাকেই দায়ী করলেন নিহত-আহতদের স্বজনেরা। এই তিরস্কারের অর্থ হয়তো এমপি বোঝেনই না।
হত্যা, খুন, গুম ও অপহরণের এই দেশে কুর্মিটোলার কালশী জনপদও এখন মৃত্যু উপত্যকা। একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটে চলছে। একটা ঘটনার রক্ত শুকাবার আগেই ঘটে চলছে আরেকটি নারকীয় ঘটনা। ফেনী ও নারায়ণগঞ্জের রক্তের দাগ মোছার আগেই কালশীতে রক্ত ঝরল। এখানে-ওখানে মানুষের লাশ পড়ে থাকছে জমিনের পর। মানুষের এত অপমান, এত অবহেলা বিধাতা আর কত দিন সহ্য করবেন একমাত্র তিনিই জানেন।
এক পরিবারেরই সাতজনের মৃত্যুর ঘটনা শোকে পাথর করে দিলো সবাইকে। সবাই বলল বিহারি মরেছে। আদতে ১০ জন মানুষ নিহত হয়েছে, সেটি কেন আমরা বিবেচনায় নিলাম না! জীবিতদের অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। স্বজনহারা এক অসহায় নারী আহাজারি করে জানান দিলেন, ‘আমাদের শরীরে যে রক্ত আপনাদের শরীরেও তো সেই রক্ত!পুলিশ তাতেও কান দিলো না, পাকিস্তানি বলে ব্যঙ্গ করল। এক দিকে পোড়া ও রক্তাক্ত লাশ, সামনে পুড়ে যাওয়া ঘর ও ভাঙা দোকানপাট। অন্য দিকে স্থানীয় কিছু বাঙালির অজানা রাজনৈতিক বিদ্বেষ এবং পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও গুলির শব্দ, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো না। এর পরও কালশীর মাটি ও মানুষ শিথিল মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে প্রতিবাদ করল, প্রতিহত করল আরো সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি। কিন্তু শাসকশ্রেণীর কোনো বোধোদয় নেই। কোনো মানবাধিকার কর্মী দৌড়ে গেল না। আমরা সবাই বিবেক বিক্রি করে বসে থাকলাম। মানুষের প্রতি মানুষের এমন অবহেলায় হয়তো খোদার আরশ কেঁপেছে, মন গলেনি আমাদের শাসকদের। তথাকথিত সুশীলদের।
একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, এই মানবসন্তানেরা আগুনে পুড়ে মারা গেছে নিজ ঘরে, বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়া অবস্থায়। এই নারী ও শিশুরা কেউই কোনো ঘটনায় জড়িত ছিল না। বহিরাগত যুবকেরা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলো। মিডিয়ার ভাষ্য, পুলিশি পাহারায় এমন অমানবিক ঘটনা ঘটল। শত শত প্রতিবেশী তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হলো। কী মর্মান্তিক দৃশ্য! দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ঘরটায় বাইরে থেকে তালা দেয়া। পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলির মুখে কারো সাধ্য ছিল না কাছে ঘেঁষার। তাই ভাগ্যহতদের আর্তনাদে সাড়া মিলল না। কালশীর বিহারি ক্যাম্পের সবারই অভিযোগ, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দুবছর আগে রাজধানীর আমিন বাজারের কেবলার চরে নিহত ছয় ছাত্রের দুজনকে ডাকাতির হুজুগ তুলে হত্যা করা হয়েছিল পুলিশের উপস্থিতিতেই। সেটাও ছিল এ রকমই এক শবেবরাতের রাতে। মানবতা, জীবন ও বিপন্নের পক্ষে পুলিশও দাঁড়াল না কেন, এ এক বিরাট জিজ্ঞাসা। আশ্রিতদের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ কোথাও করা হয় না।
আরো একটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পুড়ে যাওয়া দুটি ঘরই মূল সড়কের পাশে, গলি কিংবা উপগলি নয়? তা হলে আগুন নেভাতে যাওয়া সম্ভব হয়নি কেন? তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন, যারা চেয়েছিল পুরো পল্লীটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাক, তারা কারা! দোকানপাটে লুটপাট-ভাঙচুর করা হলো কেন? কারা তা করল? পড়শির ঘরপোড়া আগুনে আলু পুড়ে খাওয়ার লোকগুলো কোত্থেকে এলো। পুলিশই বা কী ভূমিকা পালন করল। তাদের গুলি-টিয়ার গ্যাস আর ধরপাকড়ে কেবল বিহারিরাই ধরা পড়ল, হামলাকারী বহিরাগতদের কাউকে তারা আটকাতে পারল না কেন? এখানে পুলিশ কার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। নির্দেশদাতাই বা কে? বিপর্যস্ত বিহারি পল্লীবাসী মাস্তানদের আক্রমণ রুখে দাঁড়িয়েছিল ইটপাটকেল হাতে, পুলিশ তাদের ঠেকাল, মাস্তানদের নয় কেন?
স্থানীয়দের বক্তব্য একেবারে সোজাসাপটা, ঘটনার শুরু পটকা বা আতশবাজি নিয়ে নয়। তিন দিন আগেই ঘটনার সূত্রপাত। কালশী ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে নতুন রাস্তা করতে গিয়ে অনেকে উচ্ছেদ হয়। তাদের ঠাঁই দেয়া হয় একটু দূরের পাকা বস্তিতে। সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। দিন তিনেক আগে এলাকার এমপি ইলিয়াস মোল্লা কালশীতে গিয়ে বললেন, ওই বস্তিতে বিদ্যুৎ দিতে হবে। কিন্তু কালশীবাসীর ভয় ছিল তাদের ৪১২ পরিবারের জন্য একটি মাত্র ট্রান্সফরমার। এটিতে তাদের চাহিদার চাপই সহ্য করতে পারে না। নতুন সংযোগের এত চাপ একটি ট্রান্সফরমার নিতে পারবে না। তাই এরা এমপিকে বলেছিল, ট্রান্সফরমার ঠিক রাখার দায়িত্ব এমপি নিলে তারা নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ নিতে দেবেন, নয়তো নয়। তাদের অনুযোগ ছিল, ওয়াসা তাদের পানি দেয় না, তিতাস তাদের গ্যাস দেয় না। এমপি কোনো ভূমিকা নেয় না। এই বিদ্যুৎটুকুই এরা সরকারের কাছ থেকে পান। সেটুকু এরা হারাতে চান না। এ নিয়েই বাদ-বিবাদের শুরু। এই নিয়ে হয়তো কিছু মন্দ কথাও শুনতে হয় এমপিকে। এতেই মোল্লা পরিবারের আঁতে ঘা লাগে, অহম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাই প্রতিশোধ! কালশীবাসীর অভিযোগ, এমপির লোকজন এ জন্যই আতশবাজির ইস্যু খাড়া করে তাদের ওপর হামলা চালায়। বিহারিদের মুখপাত্র বলেই দিলেন, ক্যাম্প থেকে আটকে পড়া বিহারিদের উচ্ছেদের জন্য এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ঘটনা আজই প্রথম নয়। আগেও এ ধরনের ঘটনা ছোট ছোটভাবে ঘটেছে। এর বাইরেও বিএনপির ভোটের অনুযোগ, অন্য দিকে জমির প্লট প্রত্যাশী, বিদ্যুতের ঝগড়া ও বিতণ্ডা, বস্তি উচ্ছেদের অভিযোগ তো রয়েছেই। আসল সত্য ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য সব বক্তব্য খতিয়ে দেখা দরকার। সব অভিযোগ বিবেচনায় নেয়া উচিত।
গণভবন থেকে কালশী অনেক দূরে নয়। পল্লবী পার হলেই কালশী, কুর্মিটোলা। এক দিকে বনানী-গুলশান-সেনানিবাস। আশপাশে জলাভূমি ভরাট করে নতুন ভবন-আবাসন তৈরি হচ্ছে। ফাইওভার হওয়ার পর এলাকাটা আরো জমে উঠছে। চার দিকে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। বিহারিদের বেমানানবস্তিটি ঠিক মাঝখানে। স্থানীয় মাস্তানদের চোখে কলঙ্ক তিলকউচ্ছেদ করে দিতে পারলে মোটা অঙ্কের বখরা মিলবে। এ বখরাদাতারাই নাটের গুরু।
কারো কারো কাছে এই জঞ্জালসরাবার দায়ও রয়েছে। তার সাথে আছে মাস্তান চক্রের বখরা আদায়ের তোড়জোড়। শাসকদের নির্লিপ্ত ভাব ও দুঃশাসনের নৈঃশব্দের মাঝে বিহারিদের কান্না তো কোলাহল মাত্র। এক সময় সব মিলিয়ে যাবে। ইথারে ভাসবে মৃত আত্মাগুলোর মৃত্যুকালীন কষ্টমাখা দীর্ঘশ্বাস। স্বজনহারারা আরশের প্রভুর কাছে হয়তো মিনতি জানাবেনÑ অবশিষ্ট প্রাণগুলো বাঁচাবার। ক্ষমতার পাশা খেলায় বিহারিরা বিহারিই থেকে যাবেনÑ মানুষ হতে পারবেন না। কারণ একটি মহল চায় না তারা মানুষ হিসেবে বাঁচুক। মানবিক মর্যাদা পাক। মানবাধিকার উপভোগ করুক।

বিহারি কারা এ নিয়ে অনেক ভ্রান্তি-বিভ্রান্তি রয়েছে। উর্দুভাষী মাত্রই বিহারি নয়। বিহার ছাড়াও ৪৭-এ দেশ বিভাগের সময় ভারত থেকে প্রচুর মুসলমান এসেছে। আবার প্রচুর হিন্দুও ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এটি ৭১-এর শরণার্থীর মতো বিষয় নয়। ৪৭-এর আশ্রয় পাওয়ার বিষয়টি স্থায়ী নিষ্পত্তির ব্যাপার ছিল। অংশত হয়েছিলও তাই। একাত্তর সালে বিহারি নামে উর্দুভাষীরা আবার পাকিস্তানি হতে গিয়ে নির্যাতন-নিপীড়ন মাথায় তুলে নিয়েছে। উর্দুভাষী মাত্র বিহারি আখ্যায়িত করার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক। নোংরা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কিছু উর্দুভাষী যেমন বাড়াবাড়ি করেছে, তেমনি তাদের ওপরও বাড়াবাড়ির শেষ নেই। আজো সেই দুর্বিষহ জীবন তাদের তাড়িয়ে ফিরছে।
মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির আগে ও পরে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশসহ হিন্দুস্থান চিহ্নিত এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলমান পাকিস্তানের উভয় অংশে স্থায়ীভাবে বসবাসের লক্ষ্যে চলে আসে। বলা চলে এরা অভিবাসী জনগোষ্ঠী। ওই সময় বিশেষত বিহারে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে বিহার, উড়িষ্যা ও পশ্চিবঙ্গ থেকে বিপুলসংখ্যক মুসিলম অভিবাসী পূর্ববাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তাদের সবাইকে সাধারণভাবে বিহারি বলা হলেও সবাই বিহারি নয়। পাকিস্তান সরকার এই অভিবাসী জনগোষ্ঠীকে মোহাজিরহিসেবে পূর্ববাংলার বিভিন্ন এলাকায় পুনর্বাসিত করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বেশির ভাগ উর্দুভাষী পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। স্বাধীনতার পর তাদের একটি বিরাট অংশ পাকিস্তানে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের পাকিস্তান যাওয়া জটিল হয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশ একটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে উদ্বাস্তুবিষয়ক যেসব সমস্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশে আটকে পড়া উর্দুভাষীরা অন্যতম।
বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশকালে ১০ লাখেরও বেশি অবাঙালি যারা উর্দু, হিন্দি, উড়িয়াসহ নানা ভাষাভাষী লোক ছিল। বাংলাদেশ এদের জাতীয় পরিচয় বেছে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সে সময় বাংলাদেশে সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে ইচ্ছুক প্রায় ছয় লাখ অবাঙালিকে এ দেশের নাগরিত্ব দেয়া হয়। কিন্তু প্রায় পাঁচ লাখ অবাঙালি পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রসে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে। প্রাথমিকভাবে পাকিস্তান মাত্র এক লাখের কিছু বেশি অবাঙালিকে সে দেশে প্রত্যাবাসন করাতে সম্মত হয়, তারা পাকিস্তানে প্রত্যাবাসিতও হয়েছে। অনেকে আবার প্রত্যাবাসিত হতে না পেরে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায় এবং কেউ গোপনে বাংলাদেশ ত্যাগ করে, কেউ বা দেশের ভেতর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা কমবেশি ৮১টি ক্যাম্পে প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার আটকে পড়া অবাঙালি বসবাস করছে বলে একটি সাধারণ বক্তব্য দেয়া হয়। কালশী পল্লীর ৪২০ পরিবার তারই অংশ।

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads