সোমবার, ২৩ জুন, ২০১৪

সাত খুন ও ফেনীর ঘটনার পর কালশীর হত্যাযজ্ঞ


নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার, ফেনীর একরাম হত্যা, লক্ষ্মীপুরের লাশের মেলা, কালশীর গণহত্যা, দেশব্যাপী গুম, খুন এবং সর্বশেষ ১৯ জুন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীমকে গুলি করে হত্যার চেষ্টাÑ এর সব ক্ষেত্রেই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের গডফাদাররা জড়িত বলেই জনগণ মনে করে; কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, হত্যাকারীদের ধরার জন্য নয়, রক্ষার জন্যই ক্ষমতাসীন মহল ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার সাথে পরোক্ষভাবে হলেও জড়িত আওয়ামী লীগের মনোনীত বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার এমপি শামীম ওসমান। এ মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ছিলেন তার একেবারে ডান হাত। হত্যাকাণ্ডের পরও নূর হোসেন শামীম ওসমানের আশপাশেই ছিলেন। র‌্যাবের ভাড়াটে হত্যাকারীরা নূর হোসেনের সাথে, নূর হোসেনের হয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে হত্যা করে লাশের পেট চিরে ইট বেঁধে শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। দক্ষ হাতের কাজ। তারা ভেবেছিল, এ লাশ আর কোনো দিন ভেসে উঠবে না; মানুষ কোনো দিনই জানতে পারবে না এদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।
সরকারের গুম-খুন পরিকল্পনা র‌্যাবকে দিয়ে কার্যকর করানোর ফলে এ বাহিনী নৈতিকভাবে চূড়ান্ত রকম বিপথগামী হয়ে পড়েছে। এখানে র‌্যাব-১১-এর কমান্ডিং অফিসার লে. ক. তারেক সাঈদ মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জামাতা। এ ছাড়া তার ছেলে দীপু চৌধুরীর নামও সন্ত্রাসী হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত। তদন্তে সাক্ষীরা বলেছেন, এ দীপু চৌধুরীর মাধ্যমে র‌্যাবের লে. ক. তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানাকে উৎকোচের টাকা দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো টাকা দেয়া হয়েছে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। এসব অভিযোগ ওঠার পরও দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি, ওই সব অ্যাকাউন্টে কিভাবে বিপুল অর্থ ট্রান্সফার হয়েছে। এক সময় ছোট একটি খবর বেরিয়েছিল, তাদের অ্যাকাউন্টগুলোতে ২৭ এপ্রিল ওই হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে; কিন্তু সেই অস্বাভাবিক লেনদেন কত ও কী পরিমাণ, কোথা থেকে কোথায় এসেছে বা গেছে, তার কিছুই জানা যায়নি।
ওই সেভেন মার্ডারের পর সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন তাদের গ্রেফতারের জোর দাবি উঠল চার দিক থেকে। কিন্তু মনে হতে থাকল, সরকার যেন তাদের রক্ষাই করতে চাচ্ছে। তখন উচ্চতর আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হলো, ‘ওই তিন কর্মকর্তাকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক। যদি অন্য কোনো অভিযোগে গ্রেফতার করা না যায়, তাহলে ৫৪ ধারায় হলেও তাদের যেন গ্রেফতার করা হয়।সে অনুযায়ী পুলিশ তাদের কয়েক দিন পর গ্রেফতার করল। এতে একেবারেই ক্ষেপে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বললেন, ‘আমরা তো তদন্ত করছিলামই। তাহলে আদালত কেন অমন আদেশ দেবেন? কথায় কথায় রিট, কথায় কথায় গ্রেফতার; এতে তদন্তকাজ বিঘিœত হয়। আদালতই যদি সব করে তাহলে আমাদের আর কী করার আছে?’ এর বিরুদ্ধে একজন আইনজীবী আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেছিলেন। আদালত সে মামলা খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু আদালতের কোনো নির্দেশ অমান্য করেননি, সে কারণে তার বক্তব্যে আদালত অবমাননা হয়নি। আমরা স্মরণ করতে পারি, কত তুচ্ছ কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। এমনকি পুলিশ কনস্টেবল সালাম দেয়নি বলে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে আইজিপিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আদালতের বর্তমান রায়ের পর আমরা বোধ করি, এখন অনেক বিষয়েই অনেক কথা বলতে পারব।
নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন শামীম ওসমান। পালিয়ে যাওয়ার পথে নূর হোসেনের সাথে শামীমের টেলিফোন সংলাপের অডিও রেকর্ড পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। শামীম তা অস্বীকার করেননি। এতে দেখা যায়, নূর হোসেন কিভাবে পালিয়ে যাবেন, কোথায় গিয়ে কার সাথে যোগাযোগ করবেন, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন শামীম ওসমান। এখন কলকাতার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ জিজ্ঞাসাবাদে নূর হোসেন বলেছেন, তার কাছে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে যা প্রকাশ করলে সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে। এ ছাড়া পুলিশের রিমান্ডে মেজর আরিফ, লে. কমান্ডার রানা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ এবং র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াও এর সাথে জড়িত আছেন বলে জানান। তারা বলেছেন, এসব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তারা সাত খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এদের সংশ্লিষ্টতার তালিকায় শামীম ওসমানও রয়েছেন।
কিন্তু আজ পর্যন্ত শামীম ওসমানকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। বরং জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বুলন্দ আওয়াজ দিয়েছেন যে, শামীম ওসমান পরিবারের যেকোনো প্রয়োজনে বা বিপদে আপদে তিনি ওই পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন। তিনি এ-ও বলেছেন, ‘যারা রাজনীতি করেন বাংলাদেশে তাদের মধ্যে এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের সম্পর্কে ছোটখাটো অভিযোগ নেই।অর্থাৎ রাজনীতি করলে দুর্নীতি বা সন্ত্রাস করা স্বাভাবিক। এতে কি সরকার প্রধানের অনুমোদন পাওয়া গেল না?
এমনিতেই বাংলাদেশ এখন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের এক বধ্যভূমি। তার সাথে যুক্ত হয়েছে র‌্যাব-পুলিশ। সেটি যেন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। মানুষ দেখছে, র‌্যাবকে দিয়ে খুন করানো যায়। জমি দখল করানো যায়। প্রতিপক্ষকে ধরিয়ে এনে শায়েস্তা করিয়ে দেয়া যায়। তার ওপর শীর্ষ নেতৃত্ব যদি এমন লাইসেন্স দিয়ে বসেন তাহলে তো কথাই নেই। এখন খুনের উৎসবে মত্ত ক্ষমতাসীন দল ও এসব বাহিনী।
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা নিয়ে যখন দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে, সে সময়ই গত ১৭ মে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হককে গুলি করে, কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে ফেনী শহরেই প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় আশপাশে পুলিশ মোতায়েন ছিল। আক্রান্তরা তাদের সাহায্যও চেয়েছিলেন। পুলিশ বলেছিল, এটা তাদের এলাকা নয়। অতএব, তাদের কিছুই করার নেই। এই বলে পুলিশ স্থান ত্যাগ করে।
এর প্রতিবাদে বারবার ফেনী ও ফুলগাজীতে হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন এবং আদালতে খুনের দায় ও পরিকল্পনায় বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। ফেনী থেকে গডফাদার হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারী চলে আসার পর দৃশ্যপটে এসেছেন নতুন গডফাদার নিজাম হাজারী। একরামের সাথে তার স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল। কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ ছিল তুঙ্গে। এ কথা ফেনীতে সবাই জানে। একরামের প্রধান ঘাতক নিজাম হাজারীর ভাগিনা। যে বোনের ছেলে ওই ঘাতক তিনিও একজন আওয়ামী লীগ নেত্রী। ফুলগাজীর মানুষেরা অবিরাম নিজাম হাজারীর ফাঁসি দাবি করে আসছেন; কিন্তু এই এমপিকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি। এ ক্ষেত্রেও খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অভিযুক্তকে সরকার প্রশ্রয়ই দিয়ে যাচ্ছে।
গড়ে প্রতিদিনই সারা দেশে ১৫-২০টি লাশ পড়ছে। কাউকে কাউকে শনাক্ত করা গেছে। কেউ কেউ শনাক্তও হননি। অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে তাদের লাশ দাফন করা হয়েছে। ওইসব পরিবার কোনো দিন জানতেও পারবে না দেশে তাদের কোথায়, কোন প্রান্তে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে দাফন করা হলো তাদের আপনজনকে। এ দিকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক বিএনপি নেতাকে র‌্যাব তুলে নিয়ে গিয়ে সারা রাত নির্যাতন চালায়। এতে তার মৃত্যু ঘটেছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিল নিহতের পরিবার। আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ওই র‌্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। পরদিনই সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রত্যাহার করে র‌্যাব সদস্যদের বাঁচাতে নতুন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে নতুন আদেশ জারি করা হলো। হত্যার বিচারের আশা এভাবেই অবিরাম পদদলিত হচ্ছে।
এর মধ্যে হয়তো আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর পল্লবীর কালশীতে। শবেবরাতের রাতে আতশবাজি ঘিরে সেখানকার বিহারি বস্তিবাসীদের সাথে ঝগড়া বাধে আওয়ামী এমপি ইলিয়াস মোল্লার লোকদের। এ নিয়ে ১৪ জুন ভোরে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি ইলিয়াস মোল্লার নির্দেশেই তার লোকেরা ভোরে ওই বস্তিতে হামলা চালায়। সে হামলায় একটি ঘরে নারী-শিশুসহ ৯ জনকে আটক করে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে পুলিশ তাদেরকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। তারপর ব্যাটারা অনেক বেড়ে গেছেবলে বাইরে থেকে কেউ হুকুম করে আগুন লাগিয়ে দেয়। দাউ দাউ জ্বলে ওঠে বস্তির ঘর। এ আগুন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, ওই ঘরে আটকে পড়া শিশু-নারীসহ অন্যদের রক্ষার জন্য যখন বস্তির অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ তাদের ওপর অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তাতে আরো একজন মারা যান। আহত হন বহু মানুষ। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। সারা দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। সেখানেও স্লোগান ছিল, ‘ইলিয়াস মোল্লার ফাঁসি চাই। যেসব মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সংগঠন তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কথা বলেছে, তাদেরও বক্তব্য একটাই, ইলিয়াস মোল্লাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে; কিন্তু তাকে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কোনো দিন করবে বলেও মনে হয় না।
এখন মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত। সেখানে যারা কথা বলতে আসেন, তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী ঘরানার। ফলে তারা সরকারের এসব হত্যাকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড কৌশলে এড়িয়ে যান; কিন্তু তার বাইরে যারা আছেন, তারা সরব হয়ে উঠেছেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এ নিষ্ঠুর গণহত্যার বিচার দাবি করছেন। সংবাদপত্রে লেখালেখি করছেন। সারা দেশে এখন প্রতিবাদের ঝড়। এ ঝড়ের কবল থেকে কেবল দুর্বৃত্ত, ক্যাডার আর পুলিশ দিয়ে আত্মরক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না। 

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads