সোমবার, ২ জুন, ২০১৪

রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবটাই বড় বাধা


দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে আটকে গেছে আওয়ামী লীগ। জনসম্পৃক্ত কোনো কর্মসূচি নেই। নেতাকর্মীরা যার যার আখের গোছাতে ব্যস্ত। দলের কোনো স্তরেই চেইন অব কমান্ড নেই। তাই কেউ কারও কথা শোনেন না। কেন্দ্রে শীর্ষ নেতারা মন্ত্রিত্ব ও সরকারের বিভিন্ন পদ নিয়ে ব্যস্ত। যারা সরকারি পদ পাননি তারা দলের জন্য সময় দেন না। এ অবস্থা যে শুধু কেন্দ্রে তা নয়, তৃণমূল পর্যায়েও। আর এ সুযোগে বেপরোয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি হচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে বাড়ছে খুনোখুনি। গত ৫ মাসে খুন হয়েছেন ৪১ জন। এরা সবাই আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। খুনও হয়েছেন একই দলের নেতাকর্মীদের হাতে। খুনোখুনি, টেন্ডারবাজি, দখল এবং অপহরণে জড়িয়ে কার্যত সারা দেশে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা।
সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোন্দল এবং হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ক্ষমতায় গেলে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে অনেক অন্যায় সুবিধা বা ফায়দা পাওয়া যায়। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায়। তবে এ ফায়দার পরিমাণটা সীমিত। এ জন্য প্রবল প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার ফলে খুন আর অপহরণের ঘটনা বাড়ছে। তা ছাড়া খুনখারাবি করে পার পাওয়া যায়Ñ এটা এখন আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর মামলা হলেও শাস্তি হয় না। খুনের মামলা প্রত্যাহার করা যায়। সে কারণে অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে। সরকারি দলের মধ্যে অপরাধীরা শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্রমশ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।
গত ৩১ মে দৈনিক যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত নিয়ন্ত্রণহীন আওয়ামী লীগশীর্ষক প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এমন। রিপোর্টের পরবর্তী অংশে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির নানা উদাহরণের প্রতিফলন রয়েছে। রিপোর্টটির বিস্তারিতে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই। তবে সারা দেশের সাম্প্রতিক ও নিকট-অতীতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে রিপোর্টের বক্তব্যেরই জোরালো সমর্থন মেলে।
প্রশ্ন হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগের মতো জনসংশ্লিষ্ট একটি দলকে আজ কেন এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো? এর সহজ জবাব হচ্ছেÑ একটি রাজনৈতিক দল যখন সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির সড়ক থেকে ছিটকে অসুস্থ রাজনীতির কবলে পড়ে, তখনই এমন একটি পরিস্থিতিতে পড়তে বাধ্য হয়। আমাদের নানা বিতর্কে বিতর্কিত বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ আজ অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কবলে পড়ে একটি নিয়ন্ত্রণহীন রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে, এর অসুস্থ রাজনীতির পথ ধরে চলে দলটির কপালে বাড়ছে শুধু কলঙ্কতিলকের সংখ্যা। তবুও থামছে না অসুস্থ রাজনীতির অনুশীলন। এর ফলে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়ে উঠছে অসহিষ্ণু, অস্থিতিশীল। এর ফলে রাজনীতি হারাচ্ছে সুষ্ঠুতা। এ পরিস্থিতিদৃষ্টেই হয়তো গণফোরাম সভাপতি ও বিশিষ্ট সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন এখন খাবারে ফরমালিন দিয়ে যেভাবে পচা বা নষ্ট জিনিসকে উপস্থাপন করা হয়, বাংলাদেশে রাজনীতিতেও সেভাবে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে। তাই রাজনীতি থেকে ফরমালিন দূর করতে হবে। জনগণ জাগলেই রাজনীতি ফরমালিনযুক্ত হবে। সব সমস্যার সমাধান হবে। তার এই রূপক বক্তব্যের সারকথা হচ্ছেÑ আমাদের রাজনীতিতে আজ সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছে অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তাই তার বক্তব্যের নিহিতার্থ হচ্ছে, রাজনীতিতে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে; তবেই যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে নিয়ন্ত্রণহীনতার অবসান ঘটে। প্রত্যেক নেতাকর্মীর কাজের দায়ভার দলের নেতৃত্ব নিতে পারবে। মূল দলের ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের দখলবাজি, চাঁদা বাজি টেন্ডারবাজি, হামলাবাজিসহ দলীয় কোন্দলবাজির অবসান ঘটবে। দেশ থেকে, দলের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক খুন, গুম, অপহরণসহ রাজনৈতিক ব্লেম গেমের অবসান ঘটবে, ফিরে আসবে সুস্থ রাজনীতি।
সে অবস্থায় পৌঁছতে হলে আমাদের সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিষয়টিকে সম্যক উপলব্ধি করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনসাইকোপিডিয়া অব পলিটিক্যাল সায়েন্সসেই পলিটিক্যাল কালচারকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে : রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে অর্থবহ ও নিয়মনীতিতে আবদ্ধ করে যেসব মনোভাব (attitudes), বিশ্বাস (beliefs) ও অনুভূতি (sentiments) এবং যেসব অনুমিত সিদ্ধান্ত ও বিধিবিধান রাজনৈতিক ব্যবস্থার আচরণকে শাসনের আওতায় আনে তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা পলিটিক্যাল কালচার। রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য উল্লিখিত এই মনোভাব, বিশ্বাস ও অনুভূতি যেমন আমরা লালন করি না, তেমনি আমাদের রাজনৈতিক আচরণকে শাসন করার মতো নেই কোনো অনুমিত সিদ্ধান্ত ও বিধিবিধানও। এর অভাবেই আমরা সুষ্ঠু রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারছি না। সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই বলে আমরা সুষ্ঠু নাগরিক সংস্কৃতি তথা সিভিক কালচারও গড়ে তুলতে পারছি না। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের ব্যক্তিগত জীবনাচারের সম্মিলিত ইতিহাস থেকে গড়ে ওঠে একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনীতিবিদদের সচেতন ভূমিকাই কেবল পারে একটি জাতির জন্য গর্ব করার মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিশ্চিত করতে। আর এখানেই আমাদের ঘাটতি সীমাহীন, ক্ষমাহীন।
রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন, ১৯৬৩ সালের দিকে দুই আমেরিকান ব্যক্তিত্বÑ গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড ও সিডনি ভার্বা তিনটি বিশুদ্ধ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চিহ্নিত করেন, যেগুলো একসাথে মিলে সম্মিলিতভাবে সৃষ্টি করতে পারে একটি সিভিক কালচার বা নাগরিক সংস্কৃতি। এরা উভয়েই রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই তিনটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল পাবলিকগভর্নমেন্টেরমধ্যে একটা যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা।
এই খাঁটি তিনটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রথমটি হচ্ছে : deferance; অর্থাৎ অন্যের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করা, সম্মান প্রদর্শন করা, অন্যের মতামত গ্রাহ্য করা এবং অন্যের মতামত মেনে নেয়ার সংস্কৃতি। দ্বিতীয় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নাম : Consensusএর অর্থ ঐকমত্য পোষণ, মতামতের ঐক্য গড়ে তোলা। এই সংস্কৃতির নিহিতার্থ হচ্ছে, সরকার ও জনগণের মধ্যে একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলে জনক্ষোভ প্রশমন করা। জনগণ যেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে নানাভাগে বিভক্ত, তাই এই ঐকমত্য গড়ে তোলার অপর অর্থ কার্যত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। এর ফলে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা নিশ্চিত হয়, রাজনৈতিক হানাহানির অবসান ঘটে, অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। সব রাজনৈতিক দল সব রাজনৈতিক বিষয়ে একমত হবে, এমনটি নাও হতে পারে। তার পরও সুষ্ঠু রাজনৈতিক সুষ্ঠুতার জন্য ন্যূনতম একটি সাধারণ ঐকমত্য এখানে অপরিহার্য। ক্ষমতাসীন দলকে সর্বাধিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শন করে সেই ন্যূনতম সাধারণ ঐকমত্যে আবদ্ধ করতে হবে গোটা জাতিকে। ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধরনের সাধারণ ঐকমত্যের বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে : এরা জাতি হিসেবে কিভাবে শাসিত হবে সে ব্যাপারে ঐকমত্য, কল্যাণরাষ্ট্র হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য; কে হবেন রাষ্ট্রপ্রধান, কে হবেন সরকারপ্রধান, কী হবে তাদের ক্ষমতা, কে পরিচালনা করবে জাতীয় নির্বাচনÑ ইত্যাদি বিষয়ে ঐকমত্য। অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও এ ধরনের ন্যূনতম সাধারণ ঐকমত্য লক্ষ করা যায়। আমাদের মধ্যে এ ধরনের ঐকমত্যের বড় অভাব বলেই পদে পদে আমাদের বিপত্তি।
তৃতীয় রাজনৈতিক কালচারটি হচ্ছেÑ homogeneity অর্থাৎ সবাই সমশ্রেণীভুক্ত। আইনের চোখে রাষ্ট্রের সেবা পেতে সব নাগরিক সমান। সবাই সমসুযোগের অধিকারী।
এখানে যে তিন ধরনের মুখ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করা হলো, তা একটি দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। এর প্রথমটি হচ্ছে deferanceঅপরের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করা বা অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তা মেনে নেয়া কিংবা অন্যের মতামতকে গ্রাহ্য করার সংস্কৃতির নামই ডেফারেন্স। এই সংস্কৃতির সূত্র ধরেই আসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি। কিন্তু এ ডেফারেন্স নামের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবেই আমরা অন্যের মতামতকে গ্রাহ্য করতে পারি না, অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারি না, নিজের মতামতের ওপর অন্যের মতামতকে স্থান দেয়ার মতো উদার মনোভাব প্রদর্শন করতে পারি না সর্বোপরি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিতে পারি না। ফলে ভিন্নমত প্রকাশের অবাধ সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে নেই। উল্টো আছে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর চড়াও হওয়া ও তাদের ওপর দলন-মথন চালানোর অপসংস্কৃতি।
সম্প্রতি বিএনপি নেতা তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে তার একটি মূল্যায়নের কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যেখানে ব্যর্থ, জিয়া সেখানে সফল। একজন রাজনীতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ হয়েছেন, জিয়া সফল হয়েছেন। একজন রাজনীতিবিদ সম্পর্কে কারো এ ধরনের মূল্যায়ন থাকতেই পারে। হতে পারে সে মূল্যায়ন ভুল কিংবা সঠিক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণেই সে ভুল-শুদ্ধ বের করে আনা যেতে পারে। একজন বললেই বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ রাজনীতিবিদ কিংবা সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে সাধারণ্যে মূল্যায়িত হবেন, বঙ্গবন্ধু ছোট কিংবা বড় হয়ে যাবেন, তা কিন্তু নয়। বাস্তবে দেখা গেছে, যে রাজনীতিবিদ যত বড় মাপের রাজনীতিবিদ হয়েছেন, তার জীবনে রাজনীতিচর্চায় তিনি তত বড় মাপের ভুল কিংবা সঠিক কাজটি করেছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের বেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিজ্ঞানী নিউটনকেও তার কক্ষ থেকে একটা বাচ্চা ও একটি বড় ইঁদুর বের করতে একটি ছোট ও একটি বড় গর্ত করতে আমরা দেখেছি। কিন্তু যখন বড় ও ছোট দুটি ইঁদুরই বেরিয়ে গেল ওই একটি বড় গর্ত দিয়ে, তখন তিনি বুঝতে পারলেন ছোট গর্ত করাটা ছিল তার ভুল। অস্বীকার করার উপায় নেই, একদলীয় বাকশাল কায়েম করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রয়াস ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় ধরনের একটি ভুল পদক্ষেপ। আওয়ামী লীগের নেতারা তা মুখে স্বীকার না করলেও কাজের মধ্য দিয়েই সে কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন। একদলীয় বাকশাল কায়েমের দর্শন থেকে দলটিকে ইউটার্ন দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের রাজনীতি চর্চায় ফিরে আসতে হয়েছে। বললে ভুল হবে না, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর বাকশালী কর্মসূচি থু থু দিয়ে মুছে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্রচর্চার বলয়ে। একজন রাজনীতিবিদের জীবনে ভুলভ্রান্তি থাকতেই পারে। কারো মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্যর্থ কিংবা সফল বিবেচিত হতেই পারেন। তেমনি মূল্যায়িত হতে পারেন রাজনীতিবিদ জিয়া। বাস্তবে এমনটিই চলে আসতে আমরা দেখেছি। এ দুজনের পক্ষে-বিপক্ষে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা আছে। কিন্তু যেই তারেক জিয়া বললেন, ‘শেখ মুজিব যেখানে ব্যর্থ, জিয়া সেখানে সফলকিংবা বঙ্গবন্ধু ব্যর্থ রাজনীতিবিদ আর জিয়া সফল রাজনীতিবিদ’, ঠিক তখনই তাকে কথ্য-অকথ্য ভাষায় আক্রমণের শিকার হতে হলোÑ এ ধরনের আচরণের স্থান নেই সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। উল্লিখিত ডেফারেন্সনামের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবেই এমনটি ঘটতে দেখলাম তারেক জিয়ার মন্তব্যের ব্যাপারে সরকারি দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়ায়।
মতিয়া চৌধুরী তারেক জিয়ার এ বক্তব্যের সমালোচনা করে তারেক জিয়াকে ছাগলঅভিহিত করে বলেছেন, ‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়।তাকে তিনি পিগমিবলেও উল্লেখ করেন। তিনি এও বলতে ভোলেননি, তারেক জিয়া টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাস করেছেন। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কুলাঙ্গার তারেক বিদেশে বসে পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশনে আবোলতাবোল বলছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।তিনি তারেক রহমানকে উন্মাদ ও বদ্ধপাগল  বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাকে বিদেশ থেকে ধরে এনে রাজপথে বিচার করা হোক। নয়তো তার কথায় আরো অনেকে এভাবে পাগলামি করবে।আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফও তারেক জিয়াকে গণ্ডমূর্খ উল্লেখ করে একই ধরনের মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। এমন কথাও পত্রিাকান্তরে জানা গেছে, সরকার নাকি ভাবছে তারেক জিয়ার বক্তব্য বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হবে। এগুলোকে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা ডেফারেন্সের আওতায় ফেলা যায় না। তারেক জিয়ার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর কোনো রাজনৈতিক সাফল্য থাকলে তা তুলে ধরে তার বক্তব্যের জবাব দেয়া যেত। তখন দেশের মানুষ বোঝার সুযোগ পেত, তারেক জিয়া ঠিক বলেছেন, না ভুল বলেছেন। তা না করে যা চলেছে তা কার্যত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিরই চর্চা।
দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের অপসংস্কৃতির আঁচড় পড়েছে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপরও। কারও সমালোচনা দুদকের পছন্দ হয় না। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দুদক প্রধান সাহাবুদ্দিন বলেছেন ‘সম্প্রতি আমাদের ওপর একটি ওয়াচডগ ভর করছে। সেটা টিআইবি। আমাদের কোনো কাজ তাদের পছন্দ নয়। আমাদের গঠনমূলক সমালোচনা না করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সমালোচনা করে টিআইবি। সময় হলে টিআইবির মুখোশ উন্মোচন করা হবে। বিদেশ থেকে টিআইবি টাকা এনে গবেষণায় কতটা খরচ করছে, তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। বিদেশ থেকে টাকা এনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি অপপ্রচার চালাচ্ছে।টিআইবি অবশ্য দুদক কমিশনারকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছে, ‘সময় হলে কেন, এখনই মুখোশ উন্মোচন করুন।
আমরা প্রায়ই দেখি, টিআইবি দেশের ভেতরে সরকারের বিভিন্ন খাত ও রাজনীতিবিদদের নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এরই অংশ হিসেবে দুদক সম্পর্কিত বিষয়-আশয় সম্পর্কে অনেক অপ্রিয় সত্যেরও উল্লেখ থাকে। এসব অপ্রিয় সত্য দুদক কর্মকর্তাদের ক্ষোভ সৃষ্টি করে থাকতে পারে, যার ফলে দুদক কমিশনার এ ধরনের অসহিষ্ণুতার চর্চা করে থাকতে পারেন। তবে দুদক কমিশনারের রাজনীতিবিদদের মতো অসহিষ্ণু বক্তব্য দেয়ার সুযোগ হতো না যদি দেশে সুষ্ঠু রাজনীতিক সংস্কৃতির অস্তিত্ব থাকত। টিআইবির অনেক প্রতিবেদনেই দুদক প্রশ্নে অনেক অপ্রিয় সত্যই মাঝে মধ্যে বেরিয়ে আসে। যেমন সম্প্রতি দুদক জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল : বাস্তবায়ন ও অগ্রগতিশীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি বলেছে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদক মামলা করছে ও মামলা প্রত্যাহার করছে।দুদকের উচিত ছিল টিআইবির এ অভিযোগ কতটুকু সত্য তা খতিয়ে দেখা এবং তেমনটি ঘটে থাকলে তা থেকে দুদককে উত্তরণের পথ খোঁজা। আবারো বলছি, দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হলে এমনটি ঘটার সুযোগ থাকত না।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দ্বিতীয় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নাম কনসেনশাস। সবার মতামতের মধ্যে একটা সাধারণ ঐকমত্য গড়ে তোলা হচ্ছে এ্ কনসাসের তাগিদ। এ সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা ষোলআনা। আমরা কেউই কারো মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারি না সবাই চাই তালগাছটা হবে আমার। ফলে ঐকমত্য নির্বাসিত, মতানৈক্য সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা যদিও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, তাও একটি দলের রাজনৈতিক অপকৌশলের অংশ হিসেবে জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভর করে সংবিধান থেকে তা বিদায় করে দেয়া হলো। ফলে এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রশ্নে দেশে সৃষ্টি করা হলো এক বড়মাপের রাজনৈতিক সঙ্কট। এর জের বা পরিণাম জাতি এখন বয়ে বেড়াচ্ছে। এর পথ ধরেই জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বীবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বিতর্কিত এক সরকার, বিতর্কিত একটি পার্লামেন্ট যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনেই এমপি হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কেউ কেউ তাদের অভিহিত করছেন অটো এমপি বলে।
অনেকের অভিমত এসব এমপিরা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ইতিহাসে কীভাবে চিহ্নিত হবেন, তা এখন বলা মুশকিল। এদের কেউ কেউ আবার মন্ত্রীও আছেন। শোনা যায়, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাও এদের দেখে লজ্জা পান। আর এ নির্বাচনের মাধ্যমে এমন এক অদ্ভুত বিরোধী দল তৈরি করা হলো, যারা সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। বিদেশীরাও এ বিরোধী দলকে বিরোধী দল ভাবতে পারছেন না। এমনকি সরকারি দলের লোকেরাও। বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুরুতেই এর বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছিলেন। কয়দিন আগে মন্ত্রী শাহজাহান খান একটি টকশোতে মুখফসকে খালেদা জিয়াকে বিরোধী দলের নেতা বলে উল্লেখ করলেন। বিদ্যমান এ প্রেক্ষাপটে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ এবং সেই সাথে ভারত ছাড়া সারা দুনিয়ার দেশগুলোর তাগিদ অবিলম্বে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হোক। এর জন্য জাতীয় ঐকমত্যের তথা কনসাসের ভিত্তিতে একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক এবং অবিলম্বে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের আয়োজন করা হোক। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে মাধ্যমে দ্রুত দেশে প্রতিষ্ঠা পাক একটি বতির্কহীন জনগণের সরকার ও একটি বিতর্কহীন পার্লামেন্ট। কিন্তু বিতর্কিত সরকার এখন ব্যস্ত দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনপীড়রে মাধ্যমে। অস্তিত্বহীন করে আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা। এর পর আবারো ৫ জানুয়ারিমার্কা একটি একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতার গদি আরো পাঁচ বছর সম্প্রসারিত করে নেয়া। এর কারণেই আজ শহীদ জিয়ার শাহাদত দিবসে বিএনপিকে কাঙালিভোজের আয়োজনেও বাধা দেয় হয়। রাজধানীতে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের দলগুলোকে কোনো সমাবেশ করতে দেয়া হয় না। বিরোধী মত-পথের মানুষকে দমনপীড়নের সে আরেক নতুন অধ্যায়। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় থামতে হচ্ছে এখানেই। তবে শেষ করার আগে আবারো বলছি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাতির জীবনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তার অবসান হবে না, যতক্ষণ না দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন আরেকটি নির্বাচিত সরকার গঠন করা হয়। যে সরকারকে জনগণ বলবে এ সরকার আমাদের সরকার। আর সরকার সম্পর্কে থাকবে না বিতর্কের কোনো অবকাশ।

গোলাপ মুনীর


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads