সোমবার, ১৬ জুন, ২০১৪

অপরাজনীতির আঘাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে


অপরাজনীতি কী সবকিছু গিলে খাবে? সমাজ, মানুষ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- সবকিছুই অপরাজনীতির দৌরাত্ম্যে এখন বিপর্যয়ের মুখে। একদিকে রাজধানীর বিহারি ক্যাম্পে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা, অপরদিকে মাদরাসার বেতন বন্ধ করে শিক্ষকদের ভাতে মারার আয়োজন আমাদের রাজনীতির কুৎসিত চেহারাকেই উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ক্ষমতাদর্পী শাসকদলের নেতারা কী ইতিহাস থেকে কোনো পাঠই নেবেন না?
৬৪ বছরের পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগরদাঁড়ি আমিনিয়া কামিল মাদরাসা। দক্ষিণ খুলনার সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা চলতি মাস থেকে বিনা কারণে বন্ধ করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই আদেশের বিপক্ষে মাদরাসা থেকে একটি রিট আবেদন দাখিল করা হলে আদালত বেতন বন্ধের কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, শুধু রাজনৈতিক কারণেই এই মাদরাসাটির বেতন বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এই মাদরাসা কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। স্থানীয় সূত্র জানায়, বেতন বন্ধের মূল কারণ শাসকদলের সেই ক্ষোভ। আগরদাঁড়ি মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে। এই মাদরাসাটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন ভারতের বশিরহাটের আল্লামা রুহুল আমিন। শিক্ষা-সংস্কৃতির মানে দক্ষিণ খুলনার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই মাদরাসাটি। ক্লাস ওয়ান থেকে এমএ (কামিল) পর্যন্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে এই মাদরাসায়। ছাত্রদের অনেকে মাদরাসার হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করছেন। পরীক্ষার ফলও অনেক ভালো। তারপরও সঙ্গত কোনো কারণ ছাড়াই এই মাদরাসাটির বেতন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুস সালাম কাসেমি একটি জাতীয় দৈনিককে জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) তাদের একটি নোটিশ দেয়। ১ জুনের মধ্যে ওই নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। না হলে বেতন বন্ধ করে দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কি কারণে বেতন বন্ধ করা হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। প্রিন্সিপাল জানান, যদি কারণই না জানি তাহলে জবাব দেব কী? এরই মধ্যে চলতি মাস থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয় বেতন।
শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক কর্মকা-ের পক্ষে থাকার কথা সরকার ও প্রশাসনের। জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার সময় রাজনীতিবিদরা তেমন অঙ্গীকারই ব্যক্ত করে থাকেন। আজকাল অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে জয়লাভের জন্য জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয় না। যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি আসনে জনগণের ভোট ছাড়াই এমপি নির্বাচিত হয়ে গেছেন শাসকদলের নেতা-নেত্রীরা। কোনো কোনো কেন্দ্রে একজন ভোটারও ভোট দিতে যাননি। যেমন আলোচ্য মাদরাসার ভোট কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এই ঘটনাকে উক্ত মাদরাসার অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন শাসকদল। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভোট কী মাদরাসা শিক্ষকরা দেবেন, নাকি ভোট দেবেন বৈধ ভোটাররা? নাকি শাসকদল আশা করেছিল, ভোটার না এলেও মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ভোটের বাক্স ব্যালট দিয়ে ভর্তি করে দেবে? অবশ্য এমন ভুতুড়ে ভোটারের খবরও পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে। নৈতিকতাবর্জিত কর্মকা-ে জড়িত না হওয়াই যদি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপরাধ হয়ে থাকে, তা হলে শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী হবো কেমন করে? এমন চিত্র থেকে উপলব্ধি করা যায়, ভোটের সময় এবং অন্যান্য সময় শিক্ষার বিকাশ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার ব্যাপারে আমাদের রাজনীতিবিদরা যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে থাকেন, তা বাস্তবায়নের কাজকে তারা তেমন জরুরি বলে বিবেচনা করেন না। শিক্ষার বিকাশকে দেশের জন্য জরুরি বলে বিবেচনা করলে ৬৪ বছরের পুরনো একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন বন্ধ করা হয় কোন কা-জ্ঞানে? এমন কর্মকা- থেকে প্রশ্ন জাগে, যে কোনোভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই কি আমাদের রাজনীতিবিদদের মূল লক্ষ্য? নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে কি দেশ, সমাজ ও শিক্ষার স্বার্থ গৌণ হয়ে পড়ে? এমন রাজনীতি তো দেশের জনগণ চায় না। ক্ষমতাসীনরাও এমন রাজনীতির পক্ষে কথা বলেন না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আচরণ উচ্চারিত কথামালার বিপক্ষেই যায়। জাতীয় স্বার্থেই গরমিলের এমন রাজনীতির অবসান প্রয়োজন। কিন্তু বিষয়টি যাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন তারা উপলব্ধি করবেন কী?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads