মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০১৪

সরকারে নানামাত্রিক অস্থিরতা


ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে নানা মাত্রায় অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বিরোধী রাজনীতিহীন এক পরিবেশ সৃষ্টি করতে গিয়ে সারা দেশে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ আর হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে দলের নেতাকর্মীরা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা করছিলেন। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ছয় মাসের মধ্যে সরকার অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা গর্বভরে বলেন পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, বেসামরিক আমলাতন্ত্রের এমন জোরালো সমর্থন আগের কোনো সরকার পায়নি; কিন্তু সরকার বলতে যদি আমরা একটি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা বুঝি তাহলে বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের ব্যাবস্থাপনা এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সেকুলার রাজনীতির ঘোর সমর্থক বিদায়ী জার্মান রাষ্ট্রদূত এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে বলেছেন, দেশের বেশ কিছু এলাকায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। অর্থাৎ এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ক্ষমতাসীন দলের গডফাদারদের হাতে। প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। এ অবস্থার অবসানের চেয়ে আগামী দিনগুলোতে যে তা ভয়ঙ্কর রূপ নেবে জাপান সফর শেষে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর থেকে তা স্পষ্ট। 

প্রধানমন্ত্রী এই সংবাদ সম্মেলনে যথেষ্ট হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করলেও তিনি আগামী দিনের রাজনীতি ও তার সরকারের কৌশল নিয়ে যে ছিটেফোঁটা আভাস-ইঙ্গিত দিয়েছেন তা থেকে অনুমান করা যায়, সামনের দিনগুলো আরো রক্তাক্ত হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতাসীন দলে যে অস্থিরতা আছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও তা ফুটে উঠেছে। বিরোধী দলের রাজনীতি, মধ্যবর্তী নির্বাচন, দুর্নীতির প্রসঙ্গ, বিচার বিভাগের অবস্থান, ভারতের সাথে সম্পর্ক এসব বিষয় নিয়ে তার বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে যেমন স্পষ্ট ছিল না তেমনি তার অতিসাহসী অবস্থান সঙ্কট আরো নানা মাত্রা পেতে পারে। পরিস্থিতি আরো লেজেগোবরে হয়ে পড়তে পারে। তার বক্তব্যের মধ্যে আত্মবিশ্বাস নয় বরং একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

 প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি ৪০ শতাংশ ভোট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তার এই বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা যে নেই তা নিজেই আবার প্রমাণ করেছেন। নির্বাচনের পর অর্থমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেছিলেন, এই নির্বাচন হলো নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। নির্বাচনে তারা সত্যিকারের ম্যান্ডেট পাননি। একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন,  মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা আছে কি না। তিনি সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেছেন, তারা (সাংবাদিকেরা) নির্বাচন চান কি না। তারা চাইলে নির্বাচন দিতে তার কোনো সমস্যা নেই। অর্থাৎ তিনি নৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর এই জবাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হতাশ হবেন। এরপর তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিএনপিকে ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এমন অবস্থায় এনেছেন যে দলটির বাঁচামরার ক্ষমতা এখন তার নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের পরিণাম নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। আর যদি তিনি এর অর্থ বুঝিয়ে থাকেন বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে, দলটিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, তাহলে ক্ষমতাসীনদের উচিত দলটিকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেয়া; কিন্তু আমরা দেখছি বিএনপিকে সভা সমাবেশ এমনকি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে খাবার বিতরণের মতো কর্মসূচি পালন করতে, দেয়া হচ্ছে না। বিএনপির যদি জনসম্পৃক্ত করার কোনো ক্ষমতাই না থাকে তাহলে কেন এই দলটির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়া হচ্ছে। কার্যত এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বিএনপিকে যে ফরমালিন দিয়ে বেঁচে থাকার মতো একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে চান সেই আকাক্সা প্রকাশ করেছেন। অবশ্য বিএনপির দুর্বল রাজনীতিও এই আকাক্সা সৃষ্টির মানসিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। কারণ শেখ হাসিনা ভালো করে জানেন বিএনপির কোন নেতা কোন লক্ষ্য নিয়ে দলের মধ্যে সক্রিয় রয়েছেন। বিএনপির কোন কোন নেতা কিভাবে ক্ষমতাসীনদের সামনে হাঁটুগেড়ে সম্পদ বাঁচানোর মুচলেকা দিয়ে রাজনীতিতে টিকে আছেন তা দেখে তিনি হয়তো মুচকি হাসেন; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই ফরমালিন রাজনীতির তত্ত্ব নিয়ে এখন তিনি  নিজেই সমালোচনার মুখে পড়েছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সমাজের সর্বত্র এখন ফরমালিন দিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি সরকারের বিশেষ দূত ও অনুগত বিরোধী দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ফরমালিন নিয়ে যারা আলোচনা করেন তাদের লজ্জা নেই বলে মন্তব্য করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী এই সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের সম্মাননা দেয়া ক্রেস্টে দুর্নীতির বিষয়ে যেভাবে সাফাই গেয়েছেন তাতে দলের দুর্নীতিবাজেরা হয়তো আরো উৎসাহিত হবে। এমনিতে সরকারি ব্যাংক থেকে একের পর এক টাকা লোপাটের যেসব চিত্র পাওয়া যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর নতুন যারা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন তারা টাকা বানানোর ফন্দিফিকির নির্ভয়ে করতে পারবেন। তবে প্রধানমন্ত্রীকে এ জন্য ধন্যবাদ দিতে হবে দলের মন্ত্রী বা নেতাকর্মীদের দায়দায়িত্ব নিতে তিনি কখনোই পিছপা হন না। যেমন নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীতে তার দলের নেতাকর্মী হত্যার সাথে জড়িতদের পক্ষে তিনি অবস্থান নিয়েছেন। গডফাদার হিসেবে পরিচিতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা তিনি নেননি। বরং বিএনপি আমলে কোনো বিচার হতো না এখন বিচার হচ্ছে বলে ন্যায়বিচারের দাবি করেছেন। এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি আবার বিচার বিভাগের কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং কনটেম্প বা আদালত অবমাননা হলেও পরোয়া করেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তার এই বক্তব্য থেকে ন্যায়বিচার কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সীমা কতটুকু পর্যন্ত মেনে নেয়া হবে সে ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিচার বিভাগের নজরে বিষয়টি এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের ব্যাপারে বিচার বিভাগের অবস্থান জানতে আমাদের আরো হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আইনমন্ত্রীও বিচার বিভাগের সীমা নিয়ে কথা বলেছেন। এসব বক্তব্য থেকে দেশের মানুষ ন্যায়বিচার এবং সরকার ও বিচার বিভাগের সম্পর্কে ধারণা পাবে। 

জাপান সফরের এ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কেমন ছিল গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছে; কিন্তু বিজেপি সরকারের সাথে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক কেমন হবে তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়নি। বরং দুপক্ষের মধ্যে যে একটা দূরত্ব আছে তা ভালোভাবেই বোঝা গেছে। কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ককে পারিবারিক সর্ম্পক হিসেবে দেখা হতো। আগের মতো ভারতের সাথে বিশেষ কোনো সম্পর্কের ইঙ্গিত তিনি দেননি। প্রধানমন্ত্রী জাপান সফরের কারণে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সব নেতা উপস্থিত থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি ভারত থেকে ফিরে আসার পর থেকে আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এই সঙ্কট যে পুশইন বা পুশব্যাকের চেয়েও  ভয়াবহ রূপ নেবে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আসামের বিজেপি নেতারা খুবই তৎপর হয়ে উঠেছেন। একই সময়ে আমরা দেখছি মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। একজন বিজিবির সদস্যকে মিয়ানমার ভূখণ্ডে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশও করেছিল মিয়ানমার। সাংবাদিকেরা প্রধানমন্ত্রীকে সুনির্দিষ্টভাবে এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করলেও আগামী দিনে প্রতিবেশী দুই দেশের সাথে এসব কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করা হবে তা এখন দেখার বিষয়। 

তবে এই সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী যে কতটা সাহসী তা তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আর জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের টেলিফোন সত্ত্বেও কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। দণ্ড দেয়ার পর আইন পরিবর্তন করে কাদের মোল্লার এই ফাঁসি নিয়ে দেশ-বিদেশে এখনো বিতর্ক আছে। খোদ আইনমন্ত্রী বলেছেন, আমাকে সারা পৃথিবীতে ব্যাখা দিতে হচ্ছে কাদের মোল্লার ব্যাপারে। ইসলামপন্থী একটি দলের নেতার মৃত্যুদণ্ডে ব্যথিত হয়ে কেরি, বান কি মুনেরা ফোন করেননি বরং বিচার নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তারা ফোন করেছিলেন আইনমন্ত্রীর কথায় তা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক মহল এ বিচারপ্রক্রিয়ার ব্যাপারে আরো আগ্রহী হবে। বিদেশীরাও প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হবে। কারণ আলোচনার বিষয়বস্তু যে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?

প্রধানমন্ত্রীর এ সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট হয়েছে সরকার এখন আরো বেশি কঠোর অবস্থানে যাবে। বিরোধী রাজনীতি আরো বেশি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী যে সাহসী অবস্থান নিয়েছেন সেখান থেকে আর সরে আসতে পারবেন না। বিরোধী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকার আরো বেশি জটিলতার মধ্যে পড়তে পারে। এ সংবাদ সম্মেলনের দুই দিন পর আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন। বেঁচে থাকলে তাকে আসামি করা হতো বলে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য আবারো বিএনপির সাথে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করবে। এই বিতর্কে ক্ষমতাসীনেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এর আগে শেখ মুজিব হত্যার জন্য জিয়াকে দায়ী করা হয়নি। আওয়ামী লীগের এ ব্যাপারে অবস্থান ছিল মুজিব হত্যায় জিয়া ছিল সুবিধাভোগী। এখন সে অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইছে আওয়ামী লীগ।

কিছু দিন ধরে তারেক রহমান লন্ডনে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে হয়তো এমন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে; কিন্তু এসব বিতর্কে ইতিহাসের অনেক অনুচ্চারিত শব্দ বেরিয়ে আসতে পারে। যেমন এসেছে তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদের বইয়ে। ফলে এসব বিতর্কে আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হবে না। বরং এসব বক্তব্যের মাধ্যমে তারেকের আক্রমণাত্মক বক্তব্যে সরকারে আরেক ধরনের অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। 


 আলফাজ আনাম

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads