রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪

সুইস ব্যাংকে টাকা এবং অর্থনীতিতে অ্যাসেট বাবল


সম্প্রতি প্রায় সব কটি জাতীয় দৈনিকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা জমানোর হিড়িক নিয়ে উদ্বেগজনক খবর প্রকাশ হতে দেখা গেছে। এসব খবরের সারমর্ম হচ্ছে সারা দুনিয়া থেকে যখন সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে মোট জমা অর্থের পরিমাণ কমেছে, তখন বাংলাদেশ থেকে তা বেড়েছে। সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের অর্থ রাখার পরিমাণ এক বছরে বেড়েছে ৬২ শতাংশ। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকসম্প্রতি ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৩শীর্ষক যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে এই তথ্য পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদন মতে, ২০১৩ সালে আগের বছরের তুলনায় সুইস ব্যাংকে ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশের জমানো অর্থের পরিমাণ যেখানে বেড়েছে ৪৫ শতাংশ, সেখানে আমাদের জমানো অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৬২ শতাংশ।

উল্লিখিত প্রতিবেদন মতে, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে বাংলাদেশীদের সুইস ব্যাংকে জমানো টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, সুইস ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন দেশের নাগরিক তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় গোপন রেখে অর্থ জমা রাখতে পারে। এখন কোনো বাংলাদেশী যদি তার নাগরিকত্ব গোপন রেখে কোনো সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে থাকেন, তবে সে হিসাব এই প্রতিবেদনে আসেনি। তবে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর। কারণ, বাংলাদেশে যারা অবৈধভাবে কালো টাকা কামান, তাদের জন্য নামে-বেনামে অর্থ জমা রাখার নিরাপদ স্থান হলো সুইস ব্যাংক। সুইস ব্যাংকগুলো বিদেশীদের অবৈধ অর্থ এভাবে জমা রাখার সুযোগ দিয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াকেই অগ্রাধিকার দেয়। নীতি-নৈতিকতা তাদের কাছে কোনো বিবেচ্য নয়। সুখের কথা, এখন সুইস ব্যাংকে জমানো টাকার প্রতিবেদন প্রকাশ হয় বলেই আজ আমরা জানতে পারছি, কী বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে। আগে সে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকেজমা টাকার কোনো প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হতো না। কোন দেশের কে কত টাকা সুইস ব্যাংক জমা রাখল, তা কাউকে জানতে দেয়া হতো না, বিষয়টি পুরোপুরি গোপন রাখা হতো। এমনকি আমানতকারীর নাম-ঠিকানাও গোপন রাখা হতো। একটি কোড নাম্বারের ভিত্তিতে অর্থ জমা রাখা হতো। যেমনটি রাখা হতো বাংলাদেশের বেয়ারার সার্টিফিকেট অব ডিপোজিটের (বিসিডি) মাধ্যমে। এর আওতায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে নাম-ঠিকানা ছাড়া টাকা রাখা যেত। ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন চালু হওয়ার পর এ সুযোগ তুলে নেয়া হয়। এখন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে কালো টাকা জমা রাখার সুযোগ নেই। সে কারণে দেশের কালো টাকার মালিকদের নজর সুইস ব্যাংকগুলোর দিকে। নিশ্চিতভাবে এরা কালো টাকা পাচার করে নিয়ে জমা রাখছে সুইস ব্যাংকে।

কিছু দিন আগে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণার পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ‘দেশে কালো টাকার অস্তিত্ব রয়েছে। এবং এর পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।পাঁচ বছর আগে পরিচালিত একটি সমীক্ষার সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির ৪০-৮০ শতাংশই কালো টাকার অর্থনীতি।আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নয়া সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশের অঘোষিত কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ৮০ শতাংশের চেয়েও বেশি হতে পারে। অর্থাঙ্কে যার পরিমাণ ১১ হাজার কোটি ডলারেরও ওপর। তিনি বলেন, অর্থনীতির একটা বড় অংশই যখন চলে যায় অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে, তখন তা অর্থনীতিতে সৃষ্টি করে এক ধরনের অ্যাসেট বাবল। আর তা সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবেই। সে যাই হোক, বাংলাদেশের ব্যাংকে কালো টাকা জমানোর সুযোগ না থাকলেও আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ফ্যাট, জমি ও ট্রেজারি বন্ড কেনায় ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই তিন খাতে মাত্র ৩৪০ কোটি কালো টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। আর এ থেকে সরকার ট্যাক্স পেয়েছে মাত্র ৩৪ কোটি টাকা। তাহলে উল্লিখিত ১১ হাজার কোটি ডলারের কালো টাকার অবশিষ্ট বিরাট অংশ গেল কোথায়? নিশ্চয়ই এর একটা অংশ গিয়েছে সুইস ব্যাংকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার একটা বড় অংশ দেশ থেকে পাচার হয়ে সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করা হচ্ছে। কালো টাকার মালিকেরা তাদের টাকা দেশের ব্যাংকে রাখতে চায় না। কিছু দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও আমলারা হুন্ডি ও চোরাচালানের মাধ্যমে এবং ব্যবসায়ীরা রফতানি মূল্য দেশে না এনে, আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করছেন। ওই টাকায় এরা বিদেশে সম্পদ কিনছেন কিংবা জমা রাখছেন ব্যাংকে। 

আমরা জানি, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশের কেউ দেশ থেকে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারেন না কিংবা বিদেশে নিয়ে কোনো ব্যাংকে জমা রাখতেও পারেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সুইস ব্যাংকে বা অন্য কোনো বিদেশী ব্যাংকের টাকা জমা করার অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংক দেয়নি। এর পরও হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গিয়ে সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে। কোনো বাংলাদেশীই সরকারকে এই টাকা জমা রাখার বিষয়টি অবহিত করেননি। অতএব সহজেই ধরে নেয়া যায়, সুইস ব্যাংকে জমা পুরো টাকাই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। এখানে, টাকা পাচারের ঘটনা ঘটে চলেছে। তা সুস্পষ্ট। গত বছরের শেষ দিকে খাদ্য আমদানি ও মূল্যধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক নয়। এক দিকে সরকার জোরগলায় প্রচার করছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপর দিকে খাদ্য আমদানি বাড়বে কোন যুক্তিতে? আমরা দেখেছি, গত বছর বিনিয়োগ একেবারে শূন্যের কোঠায় গিয়ে নামে। অথচ এর পরও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়ে যায় কী করে? আসলে এখানে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে ওভার ইনভয়েসিং। এই ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে নিশ্চিতভাবে টাকা পাচার করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া এসব অর্থ উন্নত দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জমা হয়েছে। ট্যাক্সেস হেভেন বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে এই অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ধরনের একটি দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ডের দীর্র্ঘ দিন ধরে পরিচিতি রয়েছে।

দুর্নীতিবাজেরা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন, এই অবৈধ অর্থসম্পদ বিদেশের ব্যাংকে জমা হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীনদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় পরিচিত হচ্ছেন একেকজন দুর্নীতির গডফাদার, সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে। এরা ক্ষমতা হারালে বিদেশে বিলাসী জীবন যাপন করেন। এরা ক্ষমতায় থাকার সময় পরিচিত হন বাজিকর হিসেবে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ হেন অপরাধ নেই যা এরা করেন না। এদের লক্ষ্য একটাই, ক্ষমতা আর অর্থ। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিতে একের পর এক ব্যাংকগুলো ফতুর হচ্ছে। 

সুইস ব্যাংকে অর্থপাচারের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদেরা পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্তের দাবি তুলেছেন। এরা বলছেন দেশে একের পর এক ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারি, সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় উদ্যোক্তারা আস্থা হারিয়ে দেশের অর্থ বাইরে পাচার করছেন। কেউ কেউ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বৈধ বা অবৈধ পথে দেশের বাইরে পাচার করছেন। অর্থনীতিবিদদের তাগিদ, অবিলম্বে এ প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে এই অর্থপাচারকারীদের চিহ্নিত করে সুইস ব্যাংকে তাদের জমানো টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতিকে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় আনার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ দরকার।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই বিদেশে অর্থপাচারের প্রবণতা বন্ধ করতে হলে দেশে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা দরকার। প্রতিষ্ঠা করতে হবে জনগণের সরকার। ভোটারবিহীন জনবিচ্ছিন্ন সরকার দিয়ে তা কখনোই সম্ভব নয়। সব দলের অংশ নেয়ার মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনপ্রক্রিয়ার আওতায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করেই তা সম্ভব। এই উপলব্ধি নিয়ে সরকারকে ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনসূত্রে গঠিত সরকার নিয়ে পাঁচ বছর দেশ চালানোর একগুঁয়েমি বন্ধ করে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন ছাড়া এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। ব্রিটিশ আইনজীবী যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র বন্দী বুলেট নিশানায়। সরকারকে এ সত্যটি মেনে নেয়ার মধ্যে বর্তমান অচলাবস্থার সমাধান নিহিত; অন্য কিছুতে নয়। দুর্নীতি ও অর্থপাচার সমস্যার সমাধানও নিহিত একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই। এ সত্য যেন আমরা ভুলে না যাই।

সবশেষে বলব, সুইস ব্যাংক থেকে বাংলাদেশীদের টাকা জমানোর যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে দেখা গেছে ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ তিন হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এই অর্থ আমাদের আগামী অর্থবছরের ঘাটতি অর্থায়নের জন্য যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, এর অর্থ এর প্রায় ৬ ভাগের ১ ভাগ। বললে ভুল হবে না, আমাদের জানার বাইরে বাংলাদেশীদের যে পরিমাণ কালো টাকা বিদেশের কোনো ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে, তা এর সাথে যোগ হলে নিশ্চিতভাবে তা লক্ষিত মোট বিদেশী ঋণের অর্থাঙ্ককে ছাড়িয়ে যাবে। উল্লেখ্য, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে নিট বিদেশী ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। আসলে সুইস ব্যাংকে যে টাকা জমা হচ্ছে, তা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিদেশে পাচার করা মোট টাকার একটি ুদ্রতম অংশ মাত্র। দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের অর্জিত আরো বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সুইস ব্যাংক ছাড়াও পাচার হয়েছে এবং হচ্ছে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো অনেক দেশেই। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব টাকা পাচারের ব্যাপারে অনেকটা নীরব ভূমিকাই পালন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ভূমিকা গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাংক এ ব্যাপারে সব সময়ই যেন গা বাঁচিয়ে কথা বলে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা এভাবে বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিতে কার্যত সৃষ্টি করা হচ্ছে এক ধরনের সম্পদশূন্যতা বা অ্যাসেট বাবল। এই অ্যাসেট বাবল নিয়ে কোনো দেশ সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। কারণ, এ অবস্থায় সুষ্ঠু বাজেট পরিকল্পনা সম্ভব হয় না। সম্ভব নয় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। 

গোলাপ মুনীর


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads