সোমবার, ৯ জুন, ২০১৪

পথভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতি


যেন ছায়াছবির মতো ঘটনা। হত্যাকা-ের পর একটু গা ঢাকা দেয়া, এরপর পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে রেলস্টেশনে গমন। হত্যাকা-ের ৪ দিন পর সিলেট থেকে পালিয়ে যেতে মামলার এজাহারভুক্ত আসামী সৌমেন দে উপস্থিত হয়েছিল রেলস্টেশনে। তবে রাতের উপবন ট্রেনে তার আর ঢাকা যাওয়া হয়নি। মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি দল স্টেশন এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। আবু সিনা ছাত্রাবাসের ১০০৩ নম্বর কক্ষের টর্চার সেলে ছাত্রদল নেতা তাওহিদুল ইসলাম নির্মম নির্যাতনে নিহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দে। গত রোববার বিকালে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে সৌমেন দে জানায়, সে ছাড়াও কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই এবং রাফি, ফাহিম, জুবায়ের, শরিফ, অনন্ত, হাফিজ, পাঠান ও রিপন এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। সৌমেন আরো জানায়, রাজনৈতিক কারণেই তারা তাওহিদকে নির্যাতন করে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে সহপাঠীকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হবে, এ কেমন রাজনীতি? আসলে এমন কর্মকা-কে রাজনীতি বললে রাজনীতির অবমাননা করা হয়। রাজনীতি না বলে একে বরং সন্ত্রাস বলাই সমীচীন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্ররা সন্ত্রাসের এই পাঠ কোথা থেকে নিল, কীভাবে নিল? এরা তো রাস্তাঘাটের টোকাই কিংবা বেকার যুবক ছিল না। রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার পর মেধাবী এই ছাত্ররা এমন নিষ্ঠুর সন্ত্রাসী হয়ে উঠলো কেমন করে? তাহলে আমাদের রাজনীতি কি চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে? কোনো সমাজ দূষিত হয়ে পড়লে কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান দূষিত হয়ে পড়লে সেখানে বিকাশ ও প্রগতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এমন অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন আমাদের সম্মানিত স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। সম্মানিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে গিয়ে প্রধান অতিথি হিসাবে প্রগতির সপক্ষে মূল্যবান বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। তাওহিদ হত্যাকা-ের পর সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে মন্ত্রী মহোদয়কে সফরসূচি বাতিল করতে হয়। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতি থেকে প্রধান এই রাজনীতিকের মনে কোনো বোধোদয় ঘটেছে কি না তা আমরা জানতে পারিনি।
আমাদের মেধাবী সন্তানদের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে রাজনীতির নামে তারা কেন নিহত হবে, কিংবা হত্যাকা-ে যুক্ত হয়ে কেন তারা পালিয়ে বেড়াবে অথবা মৃত্যুদ-ে দ-িত হবে? শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র পরিবেশে এমন হলাহল কিভাবে যুক্ত হলো? রাজনীতির মূলে তো অনভিজ্ঞ তরুণরা থাকে না, মূলে থাকেন অভিজ্ঞ ও পাকা রাজনীতিবিদরা। তারা ছাত্রদের রাজনীতির এ কেমন পাঠ দিচ্ছেন? রাজনীতির নামে ছাত্রদের তারা কি কাজে ব্যবহার করছেন, তা তো তাদের না জানার কথা নয়। রাজনীতির সাথে যুক্ত ছাত্র-যুবকরা কি কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে সে খবর রাখা তো তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পত্র-পত্রিকায় ছাত্র-যুবকদের বিভিন্ন অপকর্মের খবর মুদ্রিত হলেও তা নিয়ে রাজনীতিবিদরা তেমন মাথা ঘামান না। সংশোধন কিংবা শাস্তির ব্যবস্থাও নেন না। কিন্তু যখন বড় কোনো ঘটনা ঘটে এবং মিডিয়ায় ফলাও করে সে সংবাদ ছাপা হয়, তখন যেন কিছুটা টনক নড়ে রাজনীতিবিদদের। এ সময় রাজনীতিবিদরা কিছু সুন্দর কথা বলার চেষ্টা করেন এবং কিছু বহিষ্কারের তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তারপর অবস্থা আবার পূর্বের জায়গায় চলে যায়। ফলে রাজনীতিবিদদের ঘটনাকেন্দ্রিক সাময়িক তৎপরতাকে জনগণের কাছে অনেকটা প্রহসনের মতোই মনে হয়। প্রহসনের এমন পরিবেশ তো জনগণের কাম্য নয়। আলোকিত ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার যে প্রত্যয় রাজনীতিবিদরা ঘোষণা করেন, তার সমর্থনেই তো নাগরিকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষাঙ্গনে পাঠান। আর সন্তানরাও মেধা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই তো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু ভর্তির পর জ্ঞানচর্চার শুভ চেতনার সাথে যখন রাজনীতি যুক্ত হয়ে যায়, তারপর থেকেই লক্ষ্য করা যায় অধঃপতন ও বিকৃতির নানা চিত্র। এর দায় থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা মুক্তি পেতে পারেন না। ছাত্রদের মনন বিনষ্ট হলে, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ নষ্ট হলে জাতির কতোটা ক্ষতি হয়, তার গভীরতা আমাদের রাজনীতিবিদদের উপলব্ধি করতে হবে। তবে উপলব্ধির জন্য নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কতোটা বর্তমান আছে সেই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads