বুধবার, ৪ জুন, ২০১৪

ওঝা মরে সাপের বিষে


ফেনী ও নারায়ণগঞ্জের নারকীয় ঘটনার পরপরই প্রথম মনে পড়ল ধর্মের কল বোধকরি বাতাসে নড়তে শুরু করেছে। এরপর মনে হলো, ক্ষমতার মানুষ বাড়াবাড়ির প্রান্ত ছুঁয়ে গেলে তখন ঔদ্ধত্য দমনের ক্ষমতা মানুষের থাকে না। তখনই একের পর এক সতর্কতামূলক খোদায়ি ফয়সালা আসতে শুরু করে, এতেও সতর্ক না হলে শাসকেরা নিয়ন্ত্রণ হারায়। শক্তির ভরকেন্দ্রগুলো হলুদ কার্ড দেখাতে শুরু করে। বর্তমান পরিস্থিতির ওপর যাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ রয়েছে, এরা এ বক্তব্য মিলিয়ে দেখতে পারেন। কথায় আছে ওঝা মরে সর্পদংশনে। সহজ বাংলায়, যারা সাপের খেলা দেখায়, সাপের বিষ নামায়, শেষ পর্যন্ত সেই সাপুড়ে সাপের বিষেই মারা যায়। এই প্রবাদটি কতটুকু সত্য, এর ওপর কোনো প্রামাণ্য জরিপ নেই। তবে মানুষের অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। সব ধরনের প্রবাদ-প্রবচন মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ। অভিজ্ঞতালব্ধ প্রবাদ-প্রবচনের জন্য খনারকোনো জুড়ি নেই। খনা এক বাঙালি নারী। জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে তার পারদর্শিতা কিংবদন্তিতুল্য। তার স্বামীর নাম মিহির। কৃষি, শস্য, আবহাওয়া, বৃক্ষ, গৃহ ও জ্যোতিষ বিষয়ে তার অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী ও বক্তব্য রয়েছে। ছড়ার আকারে তার বক্তব্যগুলো খনার বচননামে খ্যাত। তার কোনো বচনই ফেলনা নয়। আজ অবধি তার বক্তব্য খণ্ডন করা সম্ভব হয়নি।
এই বিদুষী নারীর আবির্ভাবকাল ৮০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে। তার নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার বারাসতের দেউলি গ্রামে। খনার স্বামী মিহির ছিলেন বিক্রমাদিত্যের সভাসদ। খনার ভবিষ্যদ্বাণী ও বচনগুলো চ্যালেঞ্জ করে বিজ্ঞানও কোনো ভিন্নমত দেয়নি। তাই এই তল্লাটে উদ্ভব হওয়া কিংবা প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনগুলো মানুষের দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়েছে।
প্রসঙ্গটা টানলাম দুটো কারণে। প্রথমত, সাপুড়ে যে সাপের বিষে মারা যায় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রমাণিত সত্য। দ্বিতীয়ত, আমরা দীর্ঘ দিন ধরে দেখে আসছি খুনি নিজেও একসময় খুনের শিকার হচ্ছেন। এক গডফাদার মারা যাচ্ছেন অন্য গডফাদারের হাতে। সন্ত্রাসের ওস্তাদ মারা যাচ্ছে তারই সাগরেদের হাতে। যদিও গডফাদারহিসেবে ব্যবহৃত শব্দটি আমাদের মতে রাজনৈতিকভাবে উত্থিত সন্ত্রাসীদের নামের সাথে সঠিকভাবে যায় না। কারণ অক্সফোর্ড ডিকশনারি গডফাদার শব্দটির অর্থ করেছে এ ভেরি পাওয়ারফুল ম্যান ইন অ্যা ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন। স্পেশিয়ালি দ্য মাফিয়া। জানা মতে, যাদের গডফাদার বলা হচ্ছে এদের কেউ ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনের সদস্য নন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তাদের আলাদা বিচরণক্ষেত্র ও জগৎ থাকতে পারে; কিন্তু এরা রাজনীতির সৃষ্টি। দলকানা ক্ষমতার রাজনীতির উদর থেকে এদের জন্ম। ক্ষমতার বলয়ে এদের বেড়ে ওঠা ও বসবাস। ক্ষমতা ব্যবহার করে এরা রাষ্ট্রশক্তির আনুকূল্য আদায় করেন। ক্ষমতার কারণেই এরা পুলিশ, প্রশাসন, বিচার সব কিছু উপেক্ষা করেই রাজনৈতিক ক্ষমতা উপভোগ করেন। রাষ্ট্রশক্তিকে এরা নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করেন। তাই ক্ষমতার রাজনীতির বরপুত্র খ্যাত গোলন্দাজ, তাহের, হাজারী, একরাম, বদি এবং ওসমানদের মতো মানুষকে গডফাদার বলা হবে কেন? এরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আইনপ্রণেতা ও জনগণের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার। এরা সবাই বৈধ রাজনৈতিক দলের সদস্য। স্থানীয় কিংবা আঞ্চলিক নেতাও। তাদেরকে গডফাদার বলা হলে শব্দটির প্রতি সুবিচার করা হয় না। এরা গডফাদার হলে তাদের যারা সৃষ্টি করেছেন, কিংবা সৃষ্টিকারী ও নেতৃত্বদানকারী দলের নেতানেত্রী ও নীতিনির্ধারকদের কী বলা হবে?
এবার আসা যাক প্রতিষ্ঠিত বচনটি সম্পর্কে। আপনারা চোখ বন্ধ করে যার যার অভিজ্ঞতার ঝুড়িটি হাতিয়ে দেখুন। দেখবেন, মানুষকে অপমান করে কোনো ক্ষমতাধর মানুষ যত বড়ই হোক তিনি নিরাপদ থাকতে পারেননি। কোনো না কোনো সময় তিনি নিজেই অপমানিত হয়েছেন। মানুষকে অসম্মান করে সেই মানুষ নিজের সম্মান রক্ষা করেছেন তার কোনো নজির নেই। হত্যাকারী হয় হত্যার শিকার হয়েছেন, অপঘাতে মরেছেন, নয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধের শিকার হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে নীতিকথাটি হচ্ছে, মানুষ সৃষ্টির সেরা, আল্লাহ মানুষকে শুধু সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বই দেননি, পরস্পরকে পরস্পরের জন্য মর্যাদাবান, আমানতদার ও জিম্মাদার করে দিয়েছেন। তাই মানুষকে মানুষ অপমান করুক, বিনাবিচারে হত্যা করুক, বিনাদোষে লাঞ্ছিত করুক, অসম্মান করুক এটা বিধাতা চাননি। এ জন্যই বলা হয়, খুনি নিজেই বিধাতার কোনো অদৃশ্য ইশারায় খুনের আলামত রেখে যায়। একসময় নিজেও অন্য কোনো খুনি, সন্ত্রাসী কিংবা দাগী অপরাধীর হাতে প্রাণ হারায়।
ফেনী এখন খুনি সৃষ্টির প্রজননকেন্দ্র কি না ভেবে দেখা দরকার। যারা একরাম খুনের কিলিং মিশনে যোগ দিলো তাদের বয়স, চেহারা ও সামাজিক অবস্থান বলে না এই তরুণেরা এতটা নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর কাজে জড়িত হতে পারে। জীবন ও ক্যারিয়ারের অর্থ বুঝবার আগেই এসব টগবগে তারুণ্যে ভরা যুবক, কিশোরদের যারা খুনি সাজিয়ে দিলো তারা ক্ষমা পাবেন কেন? একরাম হয়তো অসুরে পরিণত হয়েছিল; কিন্তু তাকে যারা অসুর বানাল সেসব রাক্ষসরাজদের এই সমাজে ভালো মানুষ সাজার সুযোগ থাকবে কেন?
টিট ফর ট্যাটবাক্যটির মাজেজা সব সময় সমান অর্থ বহন করে না। ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়; কিন্তু তা হয়তো সব সময় হয় না। তার পরও যেমন কর্ম তেমন ফল ভোগ না করে উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে দুটো রূপক ঘটনা উপস্থাপন করতে চাই। ক. আমাদের পড়শি রাগের মাথায় বুড়ো বাবাকে লগিজাতীয় বাঁশ দিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। বাবা রক্তাক্ত মাথায় হাত রেখে বিড় বিড় করে কী যেন বললেন কেউ শুনল না। পরে জেনেছিলাম তিনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, তুই আমার মাথায় আঘাত করতে পারলি! এটা কোনো ধরনের বদদোয়া বা অভিশাপ কি না জানি না, তবে বাপ-বেটা এই ঘটনার পরও একসাথে বাস করে কিছু দিন জীবন অতিবাহিত করেছেন। এক সময় বাবা মারা যান। তত দিনে সন্তানও বাবা হয়ে বুড়োর অবস্থায় পৌঁছে যায়। খোদার কী কুদরত! একদিন বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে তার একমাত্র সন্তানটি তার মাথায় সজোরে একটি আঘাত করে দৌড়ে পালাল না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এটাই বোধ করি কর্মফল এবং পাপের কিছু প্রায়শ্চিত্ত। বাকিটা হয়তো আদালতে আখেরাতের জন্য তোলা রয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনাটি শোনা গল্প। বুড়ি শাশুড়ির পিঠ চুলকাচ্ছিল। বউমাকে ডেকে একটু চুলকিয়ে দিতে অনুরোধ করলেন। বউ বারকয়েক হাত দিয়ে চুলকিয়ে পা দিয়ে চুলকাবার চেষ্টা করল। শাশুড়ি টের পেয়ে গেলেন। অনেকটা অসহায়ভাবে বললেন মা রে, তুই যে পা দিয়ে চুলকাচ্ছিস তা আমি বুঝতে পারছি। দে, পা দিয়েই দে, ভালোই তো লাগছে। তোর দোষ কী, আমিও আমার শাশুড়িকে এমনটিই করেছিলাম।
আমরা ছয় দশক পার করে আরেকটা দশকেরও কবছর পার করে দিয়েছি। বজ্জাত, খুনি, বদমায়েশ, দাম্ভিক, ক্ষমতাদর্পী ও অপব্যবহারকারী, সন্ত্রাসী, মানুষের হক নষ্টকারী, দাগী অপরাধী, রাজনৈতিক টাউট কাউকে সময়ের নির্মমতা ও প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে রেহাই পেতে দেখিনি। বিশেষত নিরীহ নিরপরাধ মানুষের ওপর জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়ে কোনো মানুষ রেহাই পায়নি। কোনো মানুষের ওপর অপর কোনো মানুষের লাঞ্ছনা-অপমানের প্রতিশোধ কিংবা প্রায়শ্চিত্ত খোদ বিধাতাই অংশত দুনিয়াতে পাইয়ে দেন। অবশিষ্টটা রাখেন শেষ বিচারদিনের জন্য।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের শীর্ষপর্যায়ের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও তার পরিণতিগুলো কি আমাদের দৃষ্টি খুলে দেয় না! ইতিহাসের নানা বাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কি শিক্ষণীয় হয়ে ওঠে না! কে না জানেন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটায় বিশ্বস্ত ও কাছের লোকজন। ধারে-কাছের লোকেরাই হত্যাকারী সেজে যায়। অথচ এদের সৃষ্টি হয় হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের হাত ধরেই। যেমনি সাপুড়ে মারা যায় সাপের বিষে। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads