মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০১৪

সুষমা স্বরাজের সফর ও বাংলাদেশের প্রত্যাশা


প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির নেতৃত্বে ভারতের ক্ষমতায় নবাগত বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আজ বাংলাদেশ সফরে আসছেন। নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে শুধু নয়, বিজেপির ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ অন্যকিছু বিশেষ কারণেও সুষমা স্বরাজের এই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সচেতন সকল মহলে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। সফরের সম্ভাব্য ফলাফল এবং বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিগত কয়েক দিনে সেমিনার পর্যন্ত আয়োজিত হয়েছে। এরকম একটি সেমিনারে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, সুষমা স্বরাজের এই সফরকালে আগামী পাঁচ বছরে দু’দেশের সম্পর্ক কেমন হবে তার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, সেমিনারে এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কূটনীতিক ও রাজনীতিকসহ বিশিষ্টজনেরা এমনভাবে বলেছেন ও মন্তব্য করেছেন যা শুনে মনে হয়েছে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই চালকের আসনে থাকবেন। অর্থাৎ ভারতের ইচ্ছা ও পরিকল্পনাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। অন্যদিকে একই সফরকে কেন্দ্র করে গতকাল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা ও দাবি আদায়ের বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। রিপোর্টে যে বিশিষ্টজনদের উদ্ধৃত করা হয়েছে তারা একদেশদর্শী বা ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত নন। তারা বরং দু’দেশের মধ্যে সমতাভিত্তিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মূলকথা হলো, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে সামনে রেখে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সর্বতোভাবে তাদের দাবি করেছে, আরও আদায়ে সচেষ্ট ছিল। এর ফলে বাংলাদেশ শুধু শোষিত ও বঞ্চিতই হয়নি, দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিতর্ক বেড়েছে। বড় কথা, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে একই সঙ্গে ভীতি ও অবিশ্বাস দৃঢ়মূল হয়েছে। রিপোর্টে বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কংগ্রেস সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে কংগ্রেস সরকারের ভূমিকার উল্লেখ করা হয়েছে। দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়েছে, কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের বিরুদ্ধে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্টজনদের উদ্ধৃত করে রিপোর্টে আশা করা হয়েছে, নিজেরা যেহেতু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজয়ী বিজেপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিশ্চয়ই নির্বাচনসহ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারে আন্তরিকতার প্রমাণ রাখবেন।
দৈনিক সংগ্রামের ওই রিপোর্টে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা নিয়েও বিস্তারিত বলা হয়েছে। কেন বাংলাদেশীদের মধ্যে ভারতের প্রতি ভীতি ও সন্দেহ সে বিষয়েও বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান ও ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে রিপোর্টটিতে। আমরাও মনে করি, এসবের কোনো একটির প্রশ্নেই ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ নেই। ভারতের প্রতি জনগণের এই মনোভাব মোটেও নতুন নয়। এর কারণও কেবল তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে ড. মনমোহন সিং-এর সুকৌশলে পিছিয়ে যাওয়া নয়। আসল কারণ ভারতের বাংলাদেশনীতিÑ যার মধ্যে অনেক খুঁজেও আন্তরিকতার উপাদান খুব বেশি পাওয়া যাবে না। বাণিজ্যের বিপুল ঘাটতি থেকে সীমান্ত সমস্যা এবং অভিন্ন নদ-নদীর পানির হিস্যা পর্যন্ত এমন কোনো বিষয়েরই উল্লেখ করা যাবে না, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেছে। প্রাসঙ্গিক সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবেই এসেছে তিস্তা চুক্তি এবং ওই চুক্তি স্বাক্ষর করা না করা নিয়ে তদানীন্তন ভারত সরকারের অতিনাটকীয় কর্মকা-। মনমোহন সিং কেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চুক্তির ব্যাপারে ‘অন্ধকারে’ রেখেছিলেন এবং শ্রীমতি মমতাই বা কেন একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে বেঁকে বসেছিলেন এসবের কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও বুঝতে বাকি নেই। কারণ, চুক্তি করার সত্যি সদিচ্ছা থাকলে পানির পরিমাণ নিয়ে খুব বেশি এদিক-সেদিক করার দরকার পড়তো না। শতাংশের হিসাবও সহজেই মানিয়ে নেয়া যেতো। তাছাড়া চুক্তি মানা-না মানার ব্যাপারে সুবিচার বাংলাদেশ পায়নি। এ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বা গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মতো কোনো চুক্তির উল্লেখ নিশ্চয়ই করার দরকার পড়ে না। সুতরাং মমতার জন্য চুক্তি হয়নি কথাটা হজম করানো যায় না। এ প্রসঙ্গে বড় কথা হলো, তিস্তা চুক্তির সানাই বাজিয়ে ড. মনমোহন সিং কিন্তু যা যা নেয়ার কথা ছিল তার সবই কড়ায়-গ-ায় বুঝে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বিশেষ করে কংগ্রেস সরকারের নীতি ও মনোভাব সম্পর্কে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানেই গভীর প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে সুষমা স্বরাজের আসন্ন সফরকে কেন্দ্র করে। কারণ, ভারতের অকংগ্রেসী সরকারের কাছ থেকে সবসময় বিভিন্ন চুক্তি ও সম্পর্কের ব্যাপারে আন্তরিক বিবেচনা পেয়েছে। আমরা আশা করতে চাই, বাংলাদেশের ব্যাপারে নীতি নির্ধারণ করার এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ও বিজেপি সরকারও যুক্তি, সুবিচার ও জনমতের বিষয়টিকে প্রাধান্যে রাখবে এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানোর সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এর ফলে দু’ দেশের মধ্যকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও সহজ হবে বলে আমরা মনে করি। দু’দেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ ভারতের পক্ষ থেকে বাধাগ্রস্ত হওয়া, দু’দেশের বাণিজ্যের আকাশচুম্বী ভারসাম্যহীনতা, সীমান্ত, সীমান্ত হত্যা ও ছিটমহল সমস্যা, তিন বিঘা করিডোর স্থায়ী লিজ না পাওয়া, দেয়া, নেয়া বিনিময় ইত্যাদি ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু অসাম্য ইত্যাদি সমস্যা বাংলাদেশের মানুষকে খুব বেশি পীড়া দিচ্ছে। পুরনো এসব সমস্যার সমাধান হলে যে আস্থা ও ভীতিমুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি হবে তা ভারতের কিছু নতুন দাবি-দাওয়া পূরণেও সহায়ক হবে। আমরা ভারতের নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাই এবং আশা করি তার উদ্যোগে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads