রবিবার, ১৫ জুন, ২০১৪

রমজান ও নৈতিকতা


নৈতিক শিক্ষার ডাক দিয়ে কদিন বাদেই আসছে পবিত্র মাহে রমজান। রমজান যখন আসছে, তখন আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে নৈতিক শক্তি প্রদর্শন খুবই জরুরি। মানুষ বাঁচাতে, মানুষের জীবন ও সম্পদ বাঁচাতে সমাজে ও রাজনীতিতে নৈতিক বলে এগিয়ে আসার প্রেরণাও এখন খুবই জরুরি একটি বিষয়। অনৈতিক জবরদখল এখন সর্বত্র। শীর্ষ থেকে শিকড় পর্যন্ত। ছলে-বলে দখল করার মচ্ছব চলছে সব খানে। কেউ একবার চেপে বসতে পারলেই হলো, নড়ার নাম নেই। মানুষ চায় কিনা, সে প্রশ্ন না শোনেই চলছে দখলের দাপট। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল যখন স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনা হয়, তখন নদী দখল, বন দখল, ভূমি দখল, বাজার দখল, কিংবা বাড়ি-ঘর দখল কোনও বিরাট বিষয় না। নৈতিক মান উচ্চ হলে, এসব দখল-সংস্কৃতি চলতে পারতো বলে মনে হয় না।
সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে নৈতিকতা লোপ পাওয়া সর্বত্র নৈতিকতাহীন মানুষের ছড়াছড়ি। নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে করা যায় না, এমন কাজও করছে মানুষ। মিডিয়ায় সেসব খবর শোনে যতই শিহরিত হই না কেন, জঘন্য ও বীভৎস কাজের বহর করছে না। কমছে না মানুষের নৈতিক মান বৃদ্ধির অভাবে। খাবারে যে বিষ ও ফরমালিন দেয়া হচ্ছে, তার পেছনে ব্যবসায়ীর নৈতিকতার অধঃপতন দায়ী। ইয়াবা, ফেনসিডিল যারা এনে তরুণ সমাজ ধ্বংস করছে, তাদের অনৈতিক মানসিকতা এজন্য দায়ী। যারা বাজারে সিন্ডিকেট করে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে, বেশি দাম নিচ্ছে ও ভেজাল পণ্য গছিয়ে দিচ্ছে, তাদের নৈতিক অবস্থান কোথায়? যারা মানুষের দাবি ও অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা শুনছে না, মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাসকে হনন করছে, তাদের নৈতিক অবস্থানও নিম্নতম। বাংলাদেশে এখন সত্যি সত্যিই নিম্নতম নৈতিকতার প্লাবন চলছে।
পবিত্র রমজান নৈতিকতার শিক্ষক। ইসলাম নৈতিকতার দীক্ষক। এ রমজানে ইসলামের চিরায়ত আদর্শে এদেশের মানুষকে শ্বাশত নৈতিক উন্নত জীবনের পথে ডাক দিতে হবে। যদিও বৃহত্তর মুসলমানের দেশে সর্বত্র এ ডাক ধ্বনিত হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। ধর্মবিদ্রোহী ও ইসলাম-বিদ্বেষীদের কারণে। যারা জেনে বা না জেনে ইসলামের বিরোধিতা করছেÑ তারা মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতির বিরাট ক্ষতি করছে। কারণ ইসলাম হলো মানুষ ও মানবতার রক্ষাকবচ। বিভিন্ন মানব রচিত মতবাদ অতীতে এবং আজকেও মানুষকে নানা রঙিন স্বপ্ন দেখালেও শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছে। মানুষকে শোষণ করেছে। মানুষের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা লুণ্ঠন করেছে। শুধু নেতৃবৃন্দ নিজেদের আখের গোছাতে পেরেছে। সাবেক কমিউনিস্ট আমলে অকাতরে মানুষ মরেছে আর নেতৃবৃন্দ কলাগাছ/বটগাছ হয়ে গেছে। এখনও তা-ই হচ্ছে। পুঁজিবাদ সবাইকে বস্তুতান্ত্রিক জগতের লোভ ও লালসায় মদমত্ত করলেও মানুষ কিন্তু ভালো নেই। অথচ পুঁজিপতিরা ঠিকই ভালো আছে। আমাদের দেশে পোশাক শিল্প ধসে হাজার মানুষ আহত-নিহত হলেও মালিকের শাস্তি হয়েছে খুব কমই। দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের দিকে তাকানো যায় না। মধ্যবিত্তই চরম কষ্টে আছে। আর উচ্চবিত্তের আচরণ থেকে জৌলুস ছিটকে বের হচ্ছে। তারা এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানরা যে জীবন-যাপন করে এবং যে পোশাক ব্যবহার করে, সেটা বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক মান অনুয়ায়ী অকল্পনীয়। অনৈতিক জীবন-দর্শনের জন্যই তারা এমনটি করতে পারছে। এদের সামনেও রমজান আসবে, ইফতার আসবে, নানা ইবাদত আসবে। এসবের সঙ্গে তাদের মধ্যে নৈতিকতা আসলেই সব দিক থেকে মঙ্গল।
নৈতিকতা বেশি জরুরি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের জন্য। মাছের মাথায় পচন ধরলে যেমন মাছটি আর খাওয়া যায় না, ফেলে দিতে হয়। সমাজের তেমনিভাবে মাথায় পচন ধরলে বিরাট বিপদ। রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনিক কর্তা নষ্ট হলে, পচে গেলে, নৈতিকতা হারালে সমাজের বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা। আমাদের একজন নেতাকে যখন আমেরিকা সারা জীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে, তখন আমাদের নেতৃত্বের নৈতিক মানটি কেমন নিম্ন, তা স্পষ্ট দেখা যায়। এজন্য অন্য নেতৃত্বের মধ্যে লজ্জা-শরম দেখা গেছে এমন মনে হয় না। এই যে অন্যায় ও দুর্নীতির কারণে নেতৃবৃন্দ স্ত্রী-কন্যা-পুত্রসহ জেল খেটেছেন, তাতে কি তাদের নৈতিক মান কিছু বৃদ্ধি পেয়েছে? নাকি দাঁত কেলিয়ে তারা আবার সদম্ভে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? জনগণ এসব বেহায়াপনা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছে। শুধু বিরক্ত হলেও বিপদের কিছু ছিল না। জনগণের একটি অংশ আবার এসব তথাকথিত নেতাকেই পূজা করছে। তাদেরকেই অনুসরণ করছে। এভাবেই তৈরি হচ্ছে নানা গডফাদার ও সন্ত্রাসীÑ যাদের নৈতিকতা বলতে কিছুই নেই। অর্থাৎ খারাপ শীর্ষ থেকে আরও খারাপ উদাহরণ তৈরি হচ্ছে এবং সেসব তৃণমূল ও শিকড় পর্যায়ে ছড়িয়ে গিছে পুরো সমাজ ও মানুষের নৈতিকতার বারোটা বাজাচ্ছে।
পবিত্র রমজানের এই আবাহনের কালে আমরা কামনা করি, মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। দায়িত্বশীলরা নিজেদের আত্মসমালোচনা করুন। সঠিকভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব আইন ও নৈতিক দিক থেকে পালন করছেন কিনা, সেটা ভেবে দেখুন। নিজেকে কু-উদাহরণে পরিণত করে শত শত, হাজার হাজার মানুষকে কুপথে যেতে প্ররোচিত করবেন না। পবিত্র কোরআনে একটি সতর্ক বাণী রয়েছে, ‘প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হবে।’ এই হুঁশিয়ারি যেন আমরা কেউই বিস্মৃত না হই।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিবেচনায় আমরা আবারও নৈতিক মান বিকাশের তাগিদ দিয়ে এ কথাটিই বলতে চাই যে, অনৈতিক পথে মহৎ বা বড় কিছু করা সম্ভব নয়। অনৈতিক ও অবৈধ ভিত্তির উপর দাঁড়ানো বিশাল অট্টালিকাও এক সময় বালির বাঁধের মতো ধুলায় মিশে যাবে। ব্যক্তি বা রাজনীতি, কিছুই অনৈতিকতার মাধ্যমে টিকে থাকতে পারবে না। এ সত্যটিই পবিত্র রমজানের প্রাক্কালে সবার মনে রাখা আবশ্যক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads