শুক্রবার, ২০ জুন, ২০১৪

র‌্যাব বিতর্ক


র‌্যাব নিয়ে একটি বিতর্ক জমে উঠেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাম্প্রতিক আলোচনা অনুষ্ঠান তথা টকশো থেকে এমনই মনে হয়। যদিও কদিনের মধ্যে তা হারিয়েও যাবে। অন্য কোনো ঘটনা এসে নতুন করে ভিড় করবে নিঃসন্দেহে। তা ছাড়া নিন্দুকেরা বলছে, কোনো ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়ায় নাকি বর্তমান সরকারের তুলনা নেই! অধিকন্তু সময়ও একটিমাত্র ঘটনার জন্য থেমে যাবে না। সময়ের এই বিতর্ককে কেউ কেউ কূটতর্কও বলছেন, কারো কাছে কুতর্ক। তেমন বলতে যেমন কোনো বাধা নেই, যেমন আপত্তি থাকার কথা নয় র‌্যাব নিয়ে কথা বলতে, তা র‌্যাবের সংস্কার নিয়েও হতে পারে, আবার র‌্যাবের আদৌ দরকার আছে কি না তা নিয়েও। মনে রাখতে হবে, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ ধরনের আলোচনা প্রতিষ্ঠানটির স্থায়িত্ব বা উন্নয়নের জন্য সহায়ক হতে পারে। তা ছাড়া দেশের সাধারণ নাগরিক এসব বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতেই পারেন, বরং না করতে দেয়াই অস্বাভাবিক এ নিয়ে নাক সিটকানোরও কারণ দেখি না। জাতীয় প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বিষয়ে যত্রতত্র আলোচনা হয়তো যথাসমীচীন নয়, কিন্তু র‌্যাব তেমন কোনো কিছু নয়। টকশোতে কোনো কোনো ব্যক্তি র‌্যাবকে বিজিবি বা পুলিশের সাথেও তুলনা করার প্রয়াস পেয়েছেন, যা বালকসুলভ বলেই মনে হয়। বিজিবি একটি আধা-সামরিক বাহিনী। পুলিশ একটি পূর্ণাঙ্গ বেসামরিক বাহিনী। র‌্যাব হচ্ছে পুলিশকে সহায়তা করার জন্য পুলিশের ভেতরের একটি ক্ষুদ্র শাখা। সুতরাং এ ধরনের তুলনার ভিত খুবই দুর্বল।

বর্তমান বিতর্কে র‌্যাবের কার্যক্রম ছাড়াও র‌্যাব বন্ধ করে দেয়ারও বিতর্ক অব্যাহত আছে। পাশাপাশি এর সংস্কার নিয়েও কথা হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপিপ্রধানের এমন বক্তব্যের পর বিতর্ক যেন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পরই যেন এই তর্কটার সৃষ্টি এবং ঘটনাটি বিতর্কে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। নারায়ণগঞ্জে কী ঘটেছে তা সবারই জানা এবং সে নিয়ে আলোচনা এই নিবন্ধের মূল উপজীব্য নয়। বরং এটা বলা যায়, নারায়ণগঞ্জ মানুষের চোখ-মুখ খুলে দিয়েছে যেন।

র‌্যাব গঠিত হয়েছিল সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কাজের কথা বলে যা দৈনন্দিন পুলিশের কাজের চেয়ে ভিন্ন। সে কারণেই ১৯৭৮ সালের পুলিশ ব্যাটালিয়ন আইন সংশোধন করা হয়। স্পিরিট এমনই ছিল যে, পুলিশের রিকুইজিশনে পুলিশকেই বাড়তি শক্তি জোগাবে অর্থাৎ পুলিশেরই বাড়তি শক্তি। এতে প্রতীয়মান হয়, পুলিশ কিংবা সিভিল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণসাপেক্ষে র‌্যাব তার দায়িত্ব পালন করবে; কিন্তু র‌্যাব শুরু থেকেই কারো নিয়ন্ত্রণে থাকেনি, বরং দিন দিন অনেক শক্তি আর ক্ষমতার আধার হয়ে উঠেছে সমস্যা এখানেই। এমনো প্রশ্ন উঠেছে, র‌্যাব কে নিয়ন্ত্রণ করে! আগস্ট ২৯, ২০১২ নয়া দিগন্তে একটি উপসম্পাদকীয়ের নাম ছিল, সরকার না একটি বাহিনী কে বড়! তারই কয়েক মাস আগে একই কাগজে ছাপা হয়েছিল, র‌্যাব যে কথা বলা হয়নি; যেখানে র‌্যাবের সাফল্য-বিফলের একটি চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় নিবন্ধে আমরা দেখেছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও মানতে নারাজ র‌্যাব। স্বরাষ্ট্র সচিব একটি বিষয়ে তদন্তের কথা বললে র‌্যাবের মিডিয়া থেকে জানানো হয়, মন্ত্রণালয় কী বলছে সেটা তাদের দেখার ব্যাপার নয়। এই উদাহরণটি এ জন্যই দেয়া যে, র‌্যাব তাহলে কার নিয়ন্ত্রণে!

 র‌্যাবের শুরুটাই হয়েছিল অনৈতিকভাবে। একজন মানুষের জীবনহানির আইনানুগ বিধানে আমরা কী দেখি জেলা দায়রা জজের মতো বয়স্ক-বিচক্ষণ-অভিজ্ঞ ব্যক্তি দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফাঁসির আদেশ দিতে পারেন। এর বিরুদ্ধে আবার আপিল, রিভিউ এসব করা যায়। কিছু না করা হলেও উচ্চ আদালত ডেথ রেফারেন্সে দেখেন যে, আদেশটি সঠিক হয়েছে কি না। সারা পৃথিবীতে এটিই স্বীকৃত পন্থা। সংবিধান-গণতন্ত্র আর ক্রসফায়ার একসাথে চলার কোনো নৈতিক ভিত্তি মেলে না। পৃথিবীর কোথাও কিংবা কোনো দেশের সংবিধানে বিনাবিচারে মানুষ মারার অনুমতি নেই। হ্যাঁ, কোথাও কোথাও জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে বিশেষ বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয় যুদ্ধকালে দেখিবামাত্রগুলিও চলতে পারে। রাষ্ট্রের অতি এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জীবনরক্ষায়ও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি আছে; কিন্তু র‌্যাব তেমন কোনো বাহিনী নয়, তার গঠনও সে উদ্দেশ্যে নয়; কিন্তু শুরুতেই র‌্যাব সেই কাজটি সম্পন্ন করেছে এবং বিনাবাধায়।

এলিট বাহিনীকে তাদের ব্যবহারকারীরা এলিট থাকতে দেয়নি। র‌্যাবও সেভাবে থাকেনি। সরকার একটি অপকর্ম করিয়ে নিলে নিজেরাও কয়েকটি করে চলেছে। তখন সরকারের পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব হয়নি এভাবেই বিপত্তির যাত্রা। র‌্যাব যদি একটি এলিট ফোর্স হয়, তবে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, মসজিদের ইমাম ঠিক আর ১০ জনের মতো নয় বলেই একজন ইমামকে খারাপ কাজ করতে দেখলে নানা কথা আসবে, অনেকে তার পেছনে নামাজও পড়তে চাইবে না। র‌্যাবের ক্ষেত্রেও তেমন ঘটেছে এলিট ফোর্স তার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। 

র‌্যাব কেনো কাউকে মানছে না? একটা কারণ এই যে, তাকে মানুষ মারার ক্ষমতা দেয়া আছে। যেকোনো কাউকে এমন ভয় দেখিয়ে কুপোকাত করা সম্ভব (এমনো অভিযোগ শোনা যায়, ক্রসে দেয়ার আগে সমুদয় টাকা-পয়সা বাগিয়ে নেয়া হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে। হয়তো সেটা নাও হতে পারে)। দুঃখজনক সত্য, র‌্যাবের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোয় যথেষ্ট আমল দেয়া হয়নি। ক্রসফায়ারের বিষয়টিও যথেষ্ট ক্ষতিয়ে দেখা হয়নি যে, কাকে মারা হলো, বরং র‌্যাবকে সব সময়ই একটা প্রচ্ছন্ন সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা দেখা গেছে। ক্রসফায়ারের পরপর বানানো গল্প সরকার বরাবরই সহজে গলাধঃকরণ করেছে। একটি উর্দিপরা বাহিনীর দিনের পর দিন এই মিথ্যা রচনা একটি জাতির জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে তারই খানিকটা মানুষ এখন প্রত্যক্ষ করছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগে হয়তো তাদের দিয়েই নামকাওয়াস্তে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত শেষে কাউকে কাউকে নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো ছাড়া বিশেষ শাস্তি দেখা যায়নি। অধিকন্তু ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো সেভাবে তদন্ত করে দেখা হয়নি। এ ছাড়া র‌্যাবের ওপর কোনো বিশেষ গোয়েন্দাগিরির খবর পাওয়া যায় না।

র‌্যাব নিয়ন্ত্রণহীন তথা বেপরোয়া হয়ে পড়ার আরো একটি বড় কারণ আছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর কী ঘটল! সামরিক বাহিনীর অফিসার বলে কেউই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়নি। বরং উচ্চ আদালতের আদেশের পর তাদের গ্রেফতারে যে কালহরণের নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে, তাতে মনে হতেই পারে যে, সামরিক বাহিনীর অফিসারেরা অন্যায় করলেও পার পেতে পারে। অতীতেও দেখা গেছে, সামরিক বাহিনীর অফিসারেরা সিভিল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ মানতে চায় না, তা আইনটি যেভাবেই থাকুক না কেন। অপারেশন কিন হার্ট কিংবা নিকট অতীতের জরুরি আইনের সময়েও এটি লক্ষ করা গেছে। দুটি সামরিক শাসনের কথা না হয় বাদই দেয়া হলো। একজন কর্নেলকে অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক পদে পদায়ন করলে এই অবস্থা গোচরীভূত হয় না। কিন্তু সামরিক বাহিনীর একটি গ্রুপকে কোথাও নিয়োগ করা হলে সিভিল প্রশাসনের কর্তৃত্ব মানানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ভাবতেই হবে, সামরিক বাহিনীর এই সংখ্যাধিক্য র‌্যাবে থাকবে কিনা। সিভিল প্রশাসনে কাজ করলে যদি গর্হিত অপরাধের বিচার করা না যায়, তবে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। কেবল নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরিয়ে দেয়াই এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তাদের বাহিনী কী ব্যবস্থা নেয় তা আবার সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাজ করবে সিভিল প্রশাসনে, সুযোগ-সুবিধা নেবে এখানে, অপরাধ করবে সিভিল প্রশাসনে; কিন্তু অপরাধের জন্য ন্যূনতম শাস্তি দেয়া যাবে না এটা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। মনে রাখা জরুরি যে, সামরিক বাহিনীর কর্মীরা নিজেদের বাহিনীতে থাকতে যতটা নিয়ন্ত্রিত থাকে, বাইরে এসে ঠিক সেভাবে থাকে না। জাতি বিভিন্ন সময়ে তেমনি দেখেছে। কেউ কেউ এমনো বলে, সামরিক বাহিনীর অফিসারদের র‌্যাব-বিজিবিতে দেয়াই ঠিক না এসব জায়গায় নাকি চরিত্র ঠিক রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, র‌্যাবে এমন অধিকসংখ্যক সামরিক বাহিনীর আগমন পুলিশকে মনোক্ষুণœ করে তাদের দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহিত করে কি না ভেবে দেখতে হবে। আমার মনে হয়, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কখনোই এসব নিয়ে এক মিনিট সময় ব্যয় করেননি। 

র‌্যাব থাকবে কী থাকবে না; তা নিয়ে আমজনতা যত যা-ই বলুক, এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তই হচ্ছে মূল কথা। আমাদের সরকারগুলো যেহেতু এই বাহিনীকে তাদের দায়িত্বের বাইরে নানা কুকাজেও ব্যবহার করে, তখন কোনো সরকারই এই বাহিনী তুলে দেবে এমন মনে করার কারণ নেই। তা ছাড়া মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলা ভালো চিকিৎসা নয়।

র‌্যাবের নানা ভালো কাজ আছে; কিন্তু তা এখন ম্লান প্রায় ওই মসজিদের ইমামের মতোই; মাত্র একটি কাজেই তার দীর্ঘ দিনের যাবতীয় সুনাম ধুলায় লুটতে পারে। বরিশালের লিমন একজন মাত্র নয়। যার সন্তান র‌্যাবের হাতে জীবন দিয়েছে, ঠিক তাকেই র‌্যাবের কথা জিজ্ঞেস করতে হবে। এখন আবার র‌্যাব পরিচয়ে উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগ যত্রতত্র দেখা যায় র‌্যাব ঠিক অস্বীকারও করে না, আবার স্বীকারও করে না সেই ক্রসফায়ারের মিথ্যা গল্প বরং প্রাধান্য পায়। একটি এলিট বাহিনীর ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেললে সেটি বন্ধ করে দেয়াই যুক্তিযুক্ত; কারণ বাহিনী তার এলিটত্ব হারিয়েছে। প্রয়োজনে আবার নতুন কোনো বাহিনী হতেই পারে। র‌্যাব যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছে, বন্ধ করার আগে সেগুলো কে করবে, অবশ্যই ভাবতে হবে। যদিও একটি বাহিনী বিলোপ করার চেয়ে তার সংস্কারই আগে আসে। এখন সময় এসেছে র‌্যাবে তিন বাহিনীর সংখ্যা কমানো, নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় কৌশল ব্যবহার, বিশেষ কাজ ছাড়া ব্যবহার না করা, ক্রসফায়ারের মতো কাজ বন্ধ করা, অভিযোগুলোর দ্রুত ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত এবং জবাবদিহিতার মধ্য নিয়ে আসা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করা নয়তো বাঘের মতো এক দিন তার সওয়ারেরই ঘাড় মটকে দেবে। র‌্যাব যেন ভাবতে পারে, তারাই সবকিছু নয় তাদের সবকিছুই মনিটর করা হচ্ছে। সরকার ও আমাদের তিন বাহিনী নারায়ণগঞ্জ থেকে কী শিক্ষা নেয় তা দেখার অপেক্ষায়। এসব দুর্বৃত্তের দায় জাতির গর্ব তিন বাহিনীও যেমন নিতে পারে না, সরকারইবা কেন নেবে!


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads