রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

অন্যায় জুলুম অবিচার ও লোভ-লালসার বিরুদ্ধে রমযানের আহ্বান


অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও লোভ-লালসাসহ সব পাপকাজ থেকে বিরত থাকার এক মহান শিক্ষা দেয় মাহে রমযান। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমান রমযান মাসে সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ্ র নৈকট্য লাভের জন্য আত্মার পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণে নিয়োজিত হয়। সারা দিন সব ধরনের পানাহার থেকে মুক্ত হয়ে মোমিন মুসলমানরা আল্লাহ্ র সন্তুষ্টি অর্জন করেন। অন্যায়, জুলুম, অবিচার এবং লোভ লালসাসহ সব ধরনের পাপকাজ থেকে বিরত থাকার এক মহান শিক্ষা দেয় মাহে রমযান। এ শিক্ষাকে বুকে ধারণ করে নিজেদের পবিত্র মানুষ গড়ে তুলতে হবে। অনাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি পরিহার করে সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকা প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
রমযানের এ চিরায়ত আহ্বান বাংলাদেশে কতটুকু প্রতিপালিত হচ্ছে, বুকে হাত দিয়ে সবাইকে সে আত্ম-জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হওয়া দরকার। অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও লোভ-লালসা এখানে সাপের মতো লকলকে জিহ্বা দিয়ে সবকিছু চেটে খাচ্ছে। সুইস ব্যাঙ্কে টাকা পাচারের কথা আলোচিত হচ্ছে। গুম-খুন-হামলা-মামলার মতো নির্মম জুলুম নির্যাতনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। মানুষের ছিনিয়ে নেয়া মৌলিক অধিকার, আইনের শাসন আর ভোটের রাজনৈতিক অধিকারের প্রসঙ্গ বার বার ফিরে ফিরে আসছে আলোচনার টেবিলে। অতীতের মতো এ রমযানেও এসব কথা আলোচিত হচ্ছে। অন্যায়, জুলুম, অবিচার ও লোভ-লালসা-লুটপাটের বিরুদ্ধে রমযানের মহান আহ্বান সবাই শুনতে পায় কি-না, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। বিশেষত, যারা কর্তা ব্যক্তি তারা কি সব করছেন, সে তথ্য-প্রমাণ তো চোখের সামনেই রয়েছে।
পরিস্থিতি কেমন নিয়ন্ত্রণহীন, সেটা বিলক্ষণ অনুধাবন করা যায় বাজার-দরের দিকে লক্ষ্য করলে। অর্থাৎ খুন করে বা গুম করে সাত-খুন-মাফের মতো দাম বাড়িয়ে বা ভেজাল দিয়েও বেশ বহাল তবিয়তে থাকা সম্ভব হচ্ছে। মানে হলো, ওপর থেকে নীচে সুবিধা মতো যেমন পারো করতে থাকো। জনগণ আর নীতি-নৈতিকতার দিকে তাকানোর দরকার নেই। সাংবাৎসরিক এহেন অবক্ষয় আদর্শিক রমযানের সময়েও দেখতে পাওয়া যাবে, সেটা ভাবতেও কষ্ট হয়। সরকার যে সারা বছরের মতো পবিত্র মাহে রমযানের উদাসিন থাকবে, সেটা কে জানতো! উদাসিন না হলে ঠিক রমযানের আগে আগে দামের এতো লাভ কেন? বন্যা নেই, খরা নেই, কোনও উপযুক্ত কারণও নেই, তবুও দাম বেড়েছে কেন, তার উত্তরও অজানা। এসব উদাসীনতা ছাড়া আর কি!
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বেগুন, আলু, টমেটোর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কেজি প্রতি প্রায় ২০ থেকে ১০ টাকা। গত দু’দিন আগে বেগুন কেজি প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হতো। আজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে। এছাড়া আলু ও টমেটোর দাম বেড়েছে কেজি প্রতি প্রায় ৫ থেকে ১০ টাকা। তবে বাজারে অন্যান্য কাঁচাপণ্যের দাম প্রায় একই রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারের কাঁচাপণ্য বিক্রেতা রিপন হোসেন বাংলানিউজকে জানান, হঠাৎ করেই গতকাল থেকে  বেগুন, আলু ও টমেটোর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দামের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশী আলু (লাল) কেজি প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ও সাদা ২৪ টাকা, কাকরোল ২৫ থেকে ৩০ টাকা, চিচিঙ্গা ২৫ থেকে ৩০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা, কুমড়া (জালি) ২০ থেকে ২৫ টাকা, কচুর লতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, গাজর ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, শসা ২৫ থেকে ৩০ টাকা, পটল ২৪ থেকে ৩০ টাকা, পেঁপে ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কলমি শাক ৪ টাকা আঁটি, কলা একহালি ২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর ফুলকপি প্রতি পিস ৩০ ও পাতাকপি ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর চাল কেজি প্রতি (২৮ নতুন) ৩৬ থেকে ৩৭, পুরাতন ৪০ থেকে ৪২ টাকা, নাজিরশাল ৪৬ থেকে ৫২ টাকা, মাঝারি (পারিজা, বিআর-২৮) ৩৬ থেকে ৪০ টাকা, মোটা চাল (বিআর-৮ ও ১১) ৩২ থেকে ৩৩ টাকা, গুটি, স্বর্ণা ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সোয়াবিন তেল (খোলা) প্রতি লিটার ৯৮ থেকে ১০৫ টাকা, সরিষার তেল ১৪০ থেকে ১৫০ দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। মশুরের ডাল দেশি (উন্নত) কেজি প্রতি ১০৪ থেকে ১১০ টাকা, মুগ ডাল ১১০ থেকে ১১৫, ইন্ডিয়ান মুশুরের ডাল ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে প্রতিদিনই এভাবে কাঁচাপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারাও খুবই বিরক্ত। মহাখালী কাঁচাবাজার থেকে বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন ওই এলাকার আফজাল হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছেই। বাড়ি থেকে এক হিসাব করে বাজারে আসি। আর বাজারে এসে দেখি পণ্যের দামের চিত্র ভিন্ন। বাজেটের সময় একবার বেড়েছে আর এখন রমযানকে সামনে রেখে প্রতিদিন বাড়ানো হচ্ছে।
সরকারকে এ কারণে উদাসীন বলা হয়েছে জনগণের পক্ষ থেকে এবং যারা মজুদদারি, মুনাফাখোরি করে কৃত্রিম দাম বাড়িয়ে অগাধ কালো টাকার মালিক হয়েছে, সেসব সরকারি-বেসরকারি দুর্নীতিবাজদের নিন্দাও করছে মানুষ। প্রকাশ্যে না পারলেও, গোপনে তো করছেই। বিশেষত কালো টাকার মালিক মজুদদার ও মুনাফাখোররা এক ঘৃণিত শ্রেণী। কিন্তু সরকারের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী কি বলছেন? তার সব কথা নিয়ে আলোচনা করলে ভিমরি খেতে হবে। তার সম্পর্কে প্রায়-সকলেই জানেন। শুধু এটুকুই উল্লেখ করা যথেষ্ট যে, তার উত্থাপিত ও প্রস্তাবিত আর্থিক বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে। তাহলে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে কালো টাকা বানানো আর সেগুলোকে সাদা করার ব্যবস্থা থাকলে কালো টাকার চক্কর কি আদৌ বন্ধ হবে?
অথচ পবিত্র মাহে রমযান সব ধরনের অন্যায়, অপকর্ম, পাপাচার বন্ধ করার মাধ্যমে মানুষকে আত্মশুদ্ধির ডাক দেয়। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরয সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হয়। আয়াতটি হলো- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হলো যেভাবে তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ্ আরো বলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৫)। পবিত্র রমযানের ফযিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসের কিতাবগুলোতে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্য থেকে কিছু হাদিস বর্ণিত হচ্ছে। প্রিয় নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যখন রমযান মাস আসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় ও দোজখের  দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)। অপর হাদিসে হযরত সাহ্ল ইবনে সা’দ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বেহেশতের আটটি দরজা রয়েছে। তারমধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতীত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)।
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রাতে এবাদত করবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত এবাদতে কাটাবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।  (বুখারী, মুসলিম)।
আরো এসেছে, প্রিয় নবী সল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ্  তায়ালা এরশাদ করেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। রোজা (জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচার জন্য) ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেনো লিপ্ত না হয়। কেউ গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্ত্বার কসম যার করতলগত মুহাম্মদের জীবন, আল্লাহ্র নিকট রোজাদারের মুখের গন্ধ কস্তুরির সুঘ্রাণ হতেও উত্তম। রোজাদারের খুশির বিষয় দু’টি। যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (বুখারী)।
অপর একটি হাদিসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোজা ও কোরআন (কেয়ামতের দিন) আল্লাহ্র কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি তাকে (রমযানের) দিনে পানাহার ও প্রবৃত্তি থেকে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং আমার সুপারিশ তার ব্যাপারে কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে (এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে)। বায়হাকী। হাদিস শরীফে আরো এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন রমযানের প্রথম রাত আসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই খোলা হয় না। বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অতপর এর কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে ভালোর অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে মন্দের অন্বেষণকারী! থামো। আল্লাহ্  তায়ালা এ মাসে বহু ব্যক্তিকে দোজখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন রমযান মাস উপস্থিত হতো তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব কয়েদিকে মুক্তি দিতেন এবং প্রত্যেক যাচ্ঞাকারীকে দান করতেন। (বায়হাকী)। আর আমরা বাংলাদেশে কি করছি? উচ্চ থেকে নীচ স্তর পর্যন্ত কি হচ্ছে, সেটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু পরিতাপই এসবের একমাত্র প্রতিষেধক হবে? হা-হুতাশ না করে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো; ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার সততা ও সাহসিকতার মাধ্যমেই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মাথার উপর চেপে থাকা অসৎ ও অযোগ্যদেরকেও এক সময় প্রকৃত সত্য কথাটি জানিয়ে দিয়ে বিদায় করতে হবে। পবিত্র মাহে রমযানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আল্লাহ্  সুবহানাহু তা‘য়ালা  সেই আত্মশুদ্ধি ও সততার পথে আমাদেরকে পরিচালিত করুক। আমিন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads