ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এই সরকার সম্পর্কে কিছু গঠনমূলক সমালোচনা এতদিন ধরে করে আসছে বিভিন্ন বিরোধী দল। ‘দৈনিক সংগ্রাম’ সহ অনেকগুলি দৈনিক ও সাপ্তাহিকও সরকারের কিছু কিছু কার্যক্রমের সমালোচনা করে আসছে। এগুলো সমালোচনার খাতিরেই সমালোচনা ছিল না। এগুলি ছিল গঠনমূলক, যাতে করে সরকার তার ভুল শুধরাতে পারে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বিভিন্ন বিরোধী দল বলুন, আর এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকাই বলুন, এসব সমালোচনাকে সরকার ধৈর্য্যরে সাথে এবং ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। সরকারের ভাবখানা ছিল এই রকম যে, ওরা তো সরকার বিরোধী। ওরা তো এগুলো বলবেই। কিন্তু এখন সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং দু’এক জন মন্ত্রী এমপির মুখ দিয়ে এসব কথা বেরিয়ে আসছে। এখন সরকার কি বলবেন? বিরোধী দলের বক্তব্যকে যেভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয় অথবা কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হয়, এদের বক্তব্যকেও কি সেভাবে মোকাবিলা করা হবে? আসুন জেনে নেই সরকারের দু’জন এমপি সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে কি বলছেন। এই দুই জনের একজন হলেন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং এমপি বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং অপরজন হলেন পুরানা ঢাকার এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম।
গত শনিবার একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ৩ কলামব্যাপী বিস্তৃত সংবাদটির শিরোনাম, “নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় : সুরঞ্জিত / দেশ চালাচ্ছে পুলিশ : হাজী সেলিম”। সংবাদে বলা হয়, শিশু হত্যার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এমন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, কী বীভৎস উপায়ে ও বিকৃত চিন্তায় দেশে শিশুহত্যা হচ্ছে। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাব মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আশা করবে কোথায়! আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, সিলেটে রাজন হত্যার পর আসামি পালিয়ে সৌদী আরবে যায়। দেশ চালাচ্ছে পুলিশ আর পুলিশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। পরে সৌদী আরবে আমাদের যুবকরা তাকে ধরে পুলিশে দিল। শুনলাম তাকে দু’একদিনের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের আসামি নূর হোসেন পালিয়ে গেলেন। আজ পর্যন্ত দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি সরকার। এটা হতে পারে না। এসব হত্যার সঙ্গে যে পুলিশ সদস্য সহযোগিতা করেছেন তারাও সমান অপরাধী। তাদেরও বিচার করতে হবে। গত শুক্রবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে বঙ্গবন্ধু একাডেমি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভাপতির বক্তব্যে হাজী সেলিম এমপি বলেন, দেশ এখন রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে নেই। দেশ চালাচ্ছে পুলিশ বাহিনী।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কড়া সমালোচনা করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, একজন মন্ত্রী সড়ক-মহাসড়কে গিয়ে গলা ফাটিয়ে বেড়ান, মহাসড়ক পরিষ্কার করবেন। কিন্তু এ ঘটনাতো অনেক আগে থেকেই। এতদিন কোথায় ছিলেন? নছিমন, করিমনসহ সব তিন চাক্কাই চলে। প্রতিদিন নিউজ হচ্ছে। আপনি কি দেখেন না? বরং আগের চেয়ে ভাড়া বাড়ছে দ্বিগুণ। আপনি সব সড়ক চার লেন করবেন। কিন্তু চিটাগাং রোডই এখন পর্যন্ত চার লেনের কাজ শেষ করতে পারলেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলাকেও মধ্যম সারিতে নিয়ে আসবেন। পুলিশ নেবেন হাজার হাজার। আর বিচারক নেবেন না। দেশে মামলার জট দিন দিন বাড়ছেই। হবে কী করে। দেশের দেড় লাখ মানুষের জন্য একজন বিচারক। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটি হয় না। আপনাকে পুলিশ ও বিচারক দুটিই নিতে হবে। এ বিষয়গুলোর দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।
একটি জাতীয় দৈনিকের বরাত দিয়ে সুরঞ্জিত সেন বলেন, বৃহস্পতিবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করেছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নিয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রী, এমপি ও সংসদের হুইপ।’ তারা যে অভিযোগটি করেছেন এটা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল দাবি করে স্লোগান দেবেন আর রক্ষকই ভক্ষক হবেন। সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে ক্ষমতাভোগীরা সম্পত্তি নিয়ে যাবেন। এটা আরো বেশি দুঃখজনক। এ অভিযোগ রাষ্ট্র ও সরকারের দিকে যায়। এনিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করবে।
“দুই”
আসল কথা হলো, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে অথবা জোরদার ও সুসংগঠিত অপপ্রচার দিয়ে চিরদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। এক দিন না একদিন সে মিথ্যা এবং অপপ্রচারের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে। সুরঞ্জিত বাবু এবং হাজী সেলিমের কথা থেকে আপনারা দেখতে পারছেন যে, কঠিন সত্য ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতা, বীরত্ব ও অবদানের কারণে এদেশে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। দেশে চলমান অনাচার ও অপশাসন দেখে প্রায়শই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “এজন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম?” গত শুক্রবারেও তিনি এমন আক্ষেপ করেছেন। গত শনিবার এসম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম, ‘পাপ না হলে আত্মহত্যা করতাম’- কাদের সিদ্দিকী। সংবাদে বলা হয়েছে, ‘মাতৃগর্ভে শিশু গুলীবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, মুসলমানদের আত্মহত্যা মহাপাপ। মাগুরার ঘটনায় দেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। শিশুরা নিরাপদ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাগুরায় ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটি দেখে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ বলে আমি তা করিনি। গত শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলীবিদ্ধ শিশু সুরাইয়াকে দেখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। কাদের সিদ্দিকী বলেন, দেশে বিচার হয় মুখ দেখে। ২৮ জুন আমি ফুটপাতে বসেছিলাম। তখন দেখেছি সাধারণ মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়, তারা হানাহানি চায় না। এ সময় দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।’
শ্রদ্ধেয় কাদের সিদ্দিকী, আপনি কেন আত্মহত্যা করতে চাইবেন? আপনি না বঙ্গবীর? দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এখন যারা সেই স্বাধীনতাকে কলুষিত এবং কলঙ্কিত করছে তাদেরকে মোকাবিলা করাও তো হবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে আপনি একটি ভূ-খন্ডের জন্য যুদ্ধ করেছেন। এবং সেটি পেয়েও গেছেন। এখন আপনার চোখের সামনে যা কিছু ঘটে চলেছে একজন নীরব দর্শকের মত সেই সব অপকর্ম এবং বীভৎসতা আপনি কি মেনে নেবেন? এসব অপকর্ম এবং অপশাসনের মোকাবিলা আপনাকে করতে হবে। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধের ময়দানে নামতে হবে। কিন্তু তাই বলে আমরা বলছি না যে আপনি অস্ত্র হাতে মাঠে নামবেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা, আপনি জনগণকে সংগঠিত করুন। যারা আপনার সমমনা তাদেরকেও আপনার সাথে নিন। সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সহিংসতা পরিহার করে রাজপথে নামুন। জনগণকে যদি সাথে নিতে পারেন তাহলে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি, সেগুলো যত বড়ই হোকনা কেন, জনগণের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
“তিন”
বঙ্গবীর, আপনাকে বলেছি, সুরঞ্জিত বাবু আপনাকে বলছি, হাজী সেলিম আপনাকেও বলছি, মানুষের জান মালের আজ নিরাপত্তা কোথায়? রাস্তায় বেরোলে বহাল তবিয়তে ঘরে ফেরা যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। ঘরের ভেতরে থাকলেও ঘাতকরা এসে জান কবচ করে। এমনকি মাতৃগর্ভে অর্থাৎ মায়ের পেটের মধ্যে থাকলেও মায়ের পেট ফুঁড়ে বুলেট এসে গর্ভস্থ সন্তানকে আঘাত করে। তাহলে আমরা নিরাপত্তার জন্য আর কোথায় যাব? একমাত্র ভিন গ্রহ ছাড়া সুনিশ্চিত নিরাপত্তার কোন যায়গা দেখা যাচ্ছে না।
দেশ আজ শিশুহত্যা এবং গণধর্ষণের মত নারকীয় পাপে জর্জরিত। গত কয়েক দিনের কয়েকটি নৃশংসতা এবং বীভৎসতার একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান দিচ্ছি। সিলেটের রাজন এবং খুলনায় রাকিব হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই বরগুনায় রবিউল ইসলাম নামক ১১ বছরের এক শিশুকে চোখ উপড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বুধবার বংশালের নয়াবাজারে বড় বোন আসমা আক্তারকে আপন ছোট ভাই আকবর হোসেন মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। আসমা আক্তারের অপরাধ (?) হলো, সে ছোট ভাইয়ের কাছে পাওনা টাকা চেয়েছিলো। গত বুধবার চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার তারাপুর গ্রামে পিতা এমরান হোসেন এবং মাতা আমেনা বেগম নির্মম প্রহার করে তাদের শিশু সন্তান সুমাইয়াকে হত্যা করেছে। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে একটি লাগেজের মধ্যে ৯ বছরের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটির শরীরে ৫৭টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গত ১৩ই এপ্রিল কবুতর চুরির অপরাধে কিশোর নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরের বড়াইগ্রামে চুরির অভিযোগে দিনমজুর আবু সামা এবং কিশোর শাকিলকে গাছের সাথে বেঁধে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে। ২০ জুলাই সাভারে সাগর হোসেন নামক ১০ বছরের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ২৬ মে রাজধানীর কদমতলীর একটি ডোবা থেকে ১০ বছর বয়সী একটি শিশুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১৩ জুলাই ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়েছে আর একটি শিশু হত্যার ছবি। ১৪ বছর বয়সী নিজাম উদ্দীন নামের এই শিশুকে কবুতর চুরির অভিযোগে তার এক আত্মীয় পিটিয়ে হত্যা করে। এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ এপ্রিল রাজধানীর পল্লবীতে রিজার্ভ ট্যাংকের ভেতরে মেলে চার বছর বয়সী রবিউল ইসলাম নামে এক শিশুর লাশ। ২৬ মে নোয়াখালীতে এক শিশু শিক্ষার্থীকে গলাটিপে ও মুখে বালু গুঁজে খুন করা হয়েছে। ১৬ মে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তিন শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ মে পাবনার চাটমোহরে আয়শা হুমায়রা জিম নামের দুই বছরের এক শিশু কন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। সাভারে ফজলুল হক নামে এক ট্রাক চালক তার ২৫ দিন বয়সী সন্তানকে হাসপাতালের ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে হত্যা করে নিষ্ঠুরতার নতুন নজির স্থাপন করেছে। এরকম আরও বহু শিশু হত্যার খবর সাম্প্রতিক কালে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এই সব খবর কি বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছে? নাকি কলঙ্কিত করছে? এভাবে আর কিছু দিন চললে রুয়ান্ডা বা বুরুন্ডির চেয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোন অংশে উন্নত হবে না। আর দেশের মধ্যে শুরু হবে হত্যা, রাহাজানি ও ধর্ষণের ফ্রি স্টাইল।
গত শনিবার একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ৩ কলামব্যাপী বিস্তৃত সংবাদটির শিরোনাম, “নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় : সুরঞ্জিত / দেশ চালাচ্ছে পুলিশ : হাজী সেলিম”। সংবাদে বলা হয়, শিশু হত্যার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এমন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, কী বীভৎস উপায়ে ও বিকৃত চিন্তায় দেশে শিশুহত্যা হচ্ছে। এতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাব মর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আশা করবে কোথায়! আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, সিলেটে রাজন হত্যার পর আসামি পালিয়ে সৌদী আরবে যায়। দেশ চালাচ্ছে পুলিশ আর পুলিশ নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। পরে সৌদী আরবে আমাদের যুবকরা তাকে ধরে পুলিশে দিল। শুনলাম তাকে দু’একদিনের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের আসামি নূর হোসেন পালিয়ে গেলেন। আজ পর্যন্ত দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি সরকার। এটা হতে পারে না। এসব হত্যার সঙ্গে যে পুলিশ সদস্য সহযোগিতা করেছেন তারাও সমান অপরাধী। তাদেরও বিচার করতে হবে। গত শুক্রবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে বঙ্গবন্ধু একাডেমি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভাপতির বক্তব্যে হাজী সেলিম এমপি বলেন, দেশ এখন রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে নেই। দেশ চালাচ্ছে পুলিশ বাহিনী।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কড়া সমালোচনা করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, একজন মন্ত্রী সড়ক-মহাসড়কে গিয়ে গলা ফাটিয়ে বেড়ান, মহাসড়ক পরিষ্কার করবেন। কিন্তু এ ঘটনাতো অনেক আগে থেকেই। এতদিন কোথায় ছিলেন? নছিমন, করিমনসহ সব তিন চাক্কাই চলে। প্রতিদিন নিউজ হচ্ছে। আপনি কি দেখেন না? বরং আগের চেয়ে ভাড়া বাড়ছে দ্বিগুণ। আপনি সব সড়ক চার লেন করবেন। কিন্তু চিটাগাং রোডই এখন পর্যন্ত চার লেনের কাজ শেষ করতে পারলেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলাকেও মধ্যম সারিতে নিয়ে আসবেন। পুলিশ নেবেন হাজার হাজার। আর বিচারক নেবেন না। দেশে মামলার জট দিন দিন বাড়ছেই। হবে কী করে। দেশের দেড় লাখ মানুষের জন্য একজন বিচারক। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটি হয় না। আপনাকে পুলিশ ও বিচারক দুটিই নিতে হবে। এ বিষয়গুলোর দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।
একটি জাতীয় দৈনিকের বরাত দিয়ে সুরঞ্জিত সেন বলেন, বৃহস্পতিবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করেছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নিয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রী, এমপি ও সংসদের হুইপ।’ তারা যে অভিযোগটি করেছেন এটা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। নিজেকে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল দাবি করে স্লোগান দেবেন আর রক্ষকই ভক্ষক হবেন। সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে ক্ষমতাভোগীরা সম্পত্তি নিয়ে যাবেন। এটা আরো বেশি দুঃখজনক। এ অভিযোগ রাষ্ট্র ও সরকারের দিকে যায়। এনিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করবে।
“দুই”
আসল কথা হলো, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে অথবা জোরদার ও সুসংগঠিত অপপ্রচার দিয়ে চিরদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। এক দিন না একদিন সে মিথ্যা এবং অপপ্রচারের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে। সুরঞ্জিত বাবু এবং হাজী সেলিমের কথা থেকে আপনারা দেখতে পারছেন যে, কঠিন সত্য ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতা, বীরত্ব ও অবদানের কারণে এদেশে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তী। দেশে চলমান অনাচার ও অপশাসন দেখে প্রায়শই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “এজন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম?” গত শুক্রবারেও তিনি এমন আক্ষেপ করেছেন। গত শনিবার এসম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম, ‘পাপ না হলে আত্মহত্যা করতাম’- কাদের সিদ্দিকী। সংবাদে বলা হয়েছে, ‘মাতৃগর্ভে শিশু গুলীবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, মুসলমানদের আত্মহত্যা মহাপাপ। মাগুরার ঘটনায় দেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। শিশুরা নিরাপদ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাগুরায় ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটি দেখে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ বলে আমি তা করিনি। গত শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলীবিদ্ধ শিশু সুরাইয়াকে দেখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। কাদের সিদ্দিকী বলেন, দেশে বিচার হয় মুখ দেখে। ২৮ জুন আমি ফুটপাতে বসেছিলাম। তখন দেখেছি সাধারণ মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়, তারা হানাহানি চায় না। এ সময় দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।’
শ্রদ্ধেয় কাদের সিদ্দিকী, আপনি কেন আত্মহত্যা করতে চাইবেন? আপনি না বঙ্গবীর? দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এখন যারা সেই স্বাধীনতাকে কলুষিত এবং কলঙ্কিত করছে তাদেরকে মোকাবিলা করাও তো হবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে আপনি একটি ভূ-খন্ডের জন্য যুদ্ধ করেছেন। এবং সেটি পেয়েও গেছেন। এখন আপনার চোখের সামনে যা কিছু ঘটে চলেছে একজন নীরব দর্শকের মত সেই সব অপকর্ম এবং বীভৎসতা আপনি কি মেনে নেবেন? এসব অপকর্ম এবং অপশাসনের মোকাবিলা আপনাকে করতে হবে। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধের ময়দানে নামতে হবে। কিন্তু তাই বলে আমরা বলছি না যে আপনি অস্ত্র হাতে মাঠে নামবেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা, আপনি জনগণকে সংগঠিত করুন। যারা আপনার সমমনা তাদেরকেও আপনার সাথে নিন। সাথে নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সহিংসতা পরিহার করে রাজপথে নামুন। জনগণকে যদি সাথে নিতে পারেন তাহলে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি, সেগুলো যত বড়ই হোকনা কেন, জনগণের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।
“তিন”
বঙ্গবীর, আপনাকে বলেছি, সুরঞ্জিত বাবু আপনাকে বলছি, হাজী সেলিম আপনাকেও বলছি, মানুষের জান মালের আজ নিরাপত্তা কোথায়? রাস্তায় বেরোলে বহাল তবিয়তে ঘরে ফেরা যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। ঘরের ভেতরে থাকলেও ঘাতকরা এসে জান কবচ করে। এমনকি মাতৃগর্ভে অর্থাৎ মায়ের পেটের মধ্যে থাকলেও মায়ের পেট ফুঁড়ে বুলেট এসে গর্ভস্থ সন্তানকে আঘাত করে। তাহলে আমরা নিরাপত্তার জন্য আর কোথায় যাব? একমাত্র ভিন গ্রহ ছাড়া সুনিশ্চিত নিরাপত্তার কোন যায়গা দেখা যাচ্ছে না।
দেশ আজ শিশুহত্যা এবং গণধর্ষণের মত নারকীয় পাপে জর্জরিত। গত কয়েক দিনের কয়েকটি নৃশংসতা এবং বীভৎসতার একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান দিচ্ছি। সিলেটের রাজন এবং খুলনায় রাকিব হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই বরগুনায় রবিউল ইসলাম নামক ১১ বছরের এক শিশুকে চোখ উপড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গত বুধবার বংশালের নয়াবাজারে বড় বোন আসমা আক্তারকে আপন ছোট ভাই আকবর হোসেন মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। আসমা আক্তারের অপরাধ (?) হলো, সে ছোট ভাইয়ের কাছে পাওনা টাকা চেয়েছিলো। গত বুধবার চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার তারাপুর গ্রামে পিতা এমরান হোসেন এবং মাতা আমেনা বেগম নির্মম প্রহার করে তাদের শিশু সন্তান সুমাইয়াকে হত্যা করেছে। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে একটি লাগেজের মধ্যে ৯ বছরের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটির শরীরে ৫৭টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গত ১৩ই এপ্রিল কবুতর চুরির অপরাধে কিশোর নাদিমকে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরের বড়াইগ্রামে চুরির অভিযোগে দিনমজুর আবু সামা এবং কিশোর শাকিলকে গাছের সাথে বেঁধে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে। ২০ জুলাই সাভারে সাগর হোসেন নামক ১০ বছরের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ২৬ মে রাজধানীর কদমতলীর একটি ডোবা থেকে ১০ বছর বয়সী একটি শিশুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১৩ জুলাই ফেসবুকে প্রকাশ করা হয়েছে আর একটি শিশু হত্যার ছবি। ১৪ বছর বয়সী নিজাম উদ্দীন নামের এই শিশুকে কবুতর চুরির অভিযোগে তার এক আত্মীয় পিটিয়ে হত্যা করে। এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা থেকে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ এপ্রিল রাজধানীর পল্লবীতে রিজার্ভ ট্যাংকের ভেতরে মেলে চার বছর বয়সী রবিউল ইসলাম নামে এক শিশুর লাশ। ২৬ মে নোয়াখালীতে এক শিশু শিক্ষার্থীকে গলাটিপে ও মুখে বালু গুঁজে খুন করা হয়েছে। ১৬ মে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তিন শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। ১৩ মে পাবনার চাটমোহরে আয়শা হুমায়রা জিম নামের দুই বছরের এক শিশু কন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। সাভারে ফজলুল হক নামে এক ট্রাক চালক তার ২৫ দিন বয়সী সন্তানকে হাসপাতালের ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে হত্যা করে নিষ্ঠুরতার নতুন নজির স্থাপন করেছে। এরকম আরও বহু শিশু হত্যার খবর সাম্প্রতিক কালে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এই সব খবর কি বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছে? নাকি কলঙ্কিত করছে? এভাবে আর কিছু দিন চললে রুয়ান্ডা বা বুরুন্ডির চেয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোন অংশে উন্নত হবে না। আর দেশের মধ্যে শুরু হবে হত্যা, রাহাজানি ও ধর্ষণের ফ্রি স্টাইল।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন