শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০১৫

এপিজে আবদুল কালাম এবং ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব


বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে নিয়ে মাঝখানে ক’দিন বেশ আলোচনা হয়েছে। কারণ ছিল তার মৃত্যু। দিল্লি থেকে প্রথমে বিমানে আসামের রাজধানী গৌহাটি এসে পরে গাড়িতে মেঘালয়ের শিলং শহরে গিয়েছিলেন তিনি একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার জন্য। সব মিলিয়ে ঘণ্টা সাতেকের ভ্রমণ করতে হয়েছিল তাকে। ৮৪ বছর বয়সী একজনের পক্ষে এতটা ধকল সহ্য করা সহজ ব্যাপার নয়। এটাই এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুর আশু কারণ ছিল বলে জানা গেছে। তার এ মৃত্যুকে ঘিরে অবশ্য তেমন আলোচনা হয়নি যতোটা হয়েছে তার জীবন ও কীর্তি তথা অবদানকে নিয়ে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, নিজের দেশ ভারতকে তিনি পারমাণবিক বোমার অধিকারী বানিয়ে গেছেন। মিসাইল নির্মাণের কারণে তার পরিচিতি ছিল ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে। একই কারণে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাকে বিশেষ বক্তার সম্মান দিয়ে আমন্ত্রণ করা হতো। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই ঢাকার একটি কম পরিচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সমাবর্তন বক্তা’ হিসেবে তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। বিষয়টি তখন যথেষ্ট কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের মতো ঐতিহ্যবাহী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে না এসে একটি কম পরিচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য ভারতের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতির ঢাকায় আসাটা সম্মানজনক হয়েছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক তখন কম হয়নি। ‘সমাবর্তন বক্তা’ হিসেবে এপিজে আবদুল কালামকে বেছে নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণত এমন কাউকেই অতিথি হিসেবে আনা হয়, যার কাছ থেকে ছাত্রছাত্রীরা মানব সভ্যতার বিকাশ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের জন্য বিশেষ কিছু শিখতে পারে। অনুপ্রাণিত হতে পারে। সে দিক থেকে এপিজে আবদুল কালামের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন এখনো রয়েছে। এর কারণ, তার ‘সাফল্য’ বা ‘কৃতিত্ব’ বলতে সাধারণত পারমাণবিক বোমা ও মিসাইল বানানোর কথাই উল্লেখ করা হয়। এটা এমন এক বোমা ও মিসাইল, যা দিয়ে একই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে হত্যা করা যায়। ধ্বংস করা যায় সভ্যতাকেও। কখন কোন দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সত্য হলো, ভারত কোনো না কোনো সময় এই বোমা ও মিসাইলের ব্যবহার করবে- এমন চিন্তা থেকেই এ দুটি মারণাস্ত্র বানিয়ে গেছেন এপিজে আবদুল কালাম।
ভারতীয় হিসেবে এই ধ্বংসাত্মক ‘সাফল্য’ দেখানোর বাইরে তিনি মানবতার জন্য এবং সাধারণভাবে ভারতীয়দের জন্য সৃষ্টিশীল বা কল্যাণধর্মী তেমন অবদান রেখেছেন বলে জানা যায় না। তার মৃত্যুর পর ভারতীয় মুসলমানদের কথাও উঠে এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। ভারতে বছরের পর বছর ধরে দাঙ্গায় মুসলমানদের অসহায় মৃত্যু ঘটছে। মুসলমানদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে এপিজে আবদুল কালামকে কখনো সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ও গুজরাট ও মহারাষ্ট্রসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মিথ্যা অভিযোগে দাঙ্গা বাধিয়ে শয়ে শয়ে মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে এপিজে আবদুল কালাম কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। মুসলমান নাম নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি বরং ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জন্য ‘যুক্তি’ দেখানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বকে জোর গলায় বলতে পেরেছে, ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্র যে, এপিজে আবদুল কালামের মতো একজন মুসলমানও সেখানে রাষ্ট্রপতি হতে পারেন! এর ফলে কোনো দেশকেই একথা বিশ্বাস করানো সহজ হয়নি যে, যে দেশে একজন মুসলমান রাষ্ট্রপতি হতে পারেন সে দেশে মুসলমানদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা সম্ভব। হত্যা ও উচ্ছেদ করা হয়েও থাকে। নামে মুসলমান হয়েও এভাবেই ভারতীয় মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতনের ‘ওপেন লাইসেন্স’ দিয়েছিলেন এপিজে আবদুল কালাম। হিন্দুত্ববাদীরাও সে লাইসেন্সের সদ্ব্যবহার করেছে যথেচ্ছভাবেই। এখনো মুসলমানরা সর্বাত্মকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন ভারতে। এজন্যই যতো বড় ‘বিজ্ঞানী’ হোন না কেন, লাখ লাখ মানুষ ও প্রাণীকে হত্যা এবং সম্পদ ও সভ্যতা ধ্বংসের জন্য পারমাণবিক বোমা ও মিসাইল বানিয়ে যিনি ভারতের মতো সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছেন, তেমন একজন ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশের ছাত্র-যুবকদের শিক্ষণীয় কিছু থাকতে পারে কি না- সে প্রশ্ন উঠেছিল গুরুত্বের সঙ্গে। বলা হয়েছে, নীতি-নৈতিকতা, ধর্ম, মানবিকতা বা সভ্যতার উন্নয়নের মতো কোনো বিষয়ে তিনি বাংলাদেশীদের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হতে পারেন না।
এখানে অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। এপিজে আবদুল কালামকে নিয়ে সেবার আলোচনার বিশেষ কারণের সৃষ্টি হয়েছিল একটি খবরের সূত্র ধরে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা গিয়েছিল, ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল যাত্রী হিসেবে বিমানে ওঠার আগে মার্কিন বিমান কোম্পানি কন্টিনেন্টালের লোকজন তার দেহই শুধু তল্লাশি করেনি, তাকে দিয়ে জুতো পর্যন্ত খুলিয়ে ছেড়েছিল। সেটাও আবার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিমান বন্দরে নয়, খোদ ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিরই ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে! বিষয়টি নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টেও অনেক হইচই হয়েছিল। দীর্ঘ তিনমাস পর, সে বছরের ২২ জুলাই মার্কিন কোম্পানিটি নামকা ওয়াস্তে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করে একটি বিবৃতি দেয়া ছাড়া কিছুই করেনি। এ থেকে পরিষ্কার হয়েছিল, বাংলাদেশসহ ক্ষুদ্র ও নিরীহ প্রতিবেশীদের ঘাড়ে সন্ত্রাসের দায় চাপিয়ে ‘ভালো’ সাজতে চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র ভারতকেও সন্ত্রাসী ধরনের রাষ্ট্রই মনে করে। আর সাবেক একজন রাষ্ট্রপতিকেও যেখানে জুতো পর্যন্ত খুলে দেখাতে হয় সেখানে অন্য ভারতীয় মুসলমানরা যে কতভাবে হেনস্থা হয়ে থাকেন- সে সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা চলে! পার্থক্য হলো, এপিজে আবদুল কালাম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বলে তার বিষয়টি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল, অন্যদের সম্পর্কে সাধারণত জানা যায় না।
এপিজে আবদুল কালাম এবং নরেন্দ্রনাথ মোদিকে দিয়ে শুরু করলেও ‘ওপার বাংলা’র কথাও বলা দরকার। শুনলে আমাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সুশীলজনেরা রা-রা করে উঠতে পারেন, কিন্তু ভারত এতটাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র যে, কোলকাতার মুসলিম প্রধান পার্ক সার্কাস এলাকায় মুসলমানরা এখনো জুমার নামাজ পড়তে যান টুপি পকেটে নিয়ে। অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে- যেন কোনো মহাঅপরাধ করতে যাচ্ছেন! কমিউনিস্টদের বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিম বঙ্গে- এদেশের অনেকের অতি প্রিয় ‘ওপার বাংলা’য় মাইকে আযান দেয়া আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নয়াদিল্লির তথা ভারতের রাজধানীর দিকে লক্ষ্য করুন। ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর মতো বিদেশিনী খ্রিস্টান রমণীকেও নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার আগে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডেকে, হাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে এবং ঢাকঢোল বাজিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। মন্দিরে গিয়ে গলায় আঁচল পেচিয়ে হিন্দুদের দেবীকে পেন্নাম করতে হয়। অথচ সোনিয়া গান্ধী হিন্দু নন। এসবই ভারতের রাজনীতিতে অবশ্যপালনীয়- সোনিয়া গান্ধী থেকে নরেন্দ্রনাথ মোদি পর্যন্ত রাজনীতকদের প্রত্যেককে হিন্দু ধর্ম এবং ধর্মের বিধি-বিধান মানতে হয়। নাহলে ভোট পাবেন না তারা। কথাগুলো জানানোর উদ্দেশ্য একথা স্পষ্ট করা যে, যতোই ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ স্লোগান দেয়া হোক না কেন, ভারত এখনো সর্বতোভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র রয়ে গেছে। দেশটিতে মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের বিপদও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০০২ সালের সংঘটিত গুজরাট হত্যাকান্ডের উল্লেখ করা দরকার। গোধরায় একটি ট্রেনে অগ্নি সংযোগের মিথ্যা অভিযোগে দিনের পর দিন ধরে সেবার শত শত মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু বিজেপির নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী মুসলমানদের স্বার্থে কোনো পদক্ষেপ নেননি। শুধু তা-ই নয়, হত্যাকান্ড নিয়ে লোকসভায় বিতর্ক শুরু হওয়ার প্রাক্কালে গোয়ায় অনুষ্ঠিত বিজেপির সম্মেলনে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গুজরাট হত্যাকান্ডের জন্য উল্টো মুসলমানদেরকেই দায়ী করেছিলেন। তার কথাগুলোও ছিল উস্কানিমূলক। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই মুসলমান সেখানেই সন্ত্রাস। তাদের ধর্ম সন্ত্রাস শেখায় এবং পৃথিবীর কোথাও তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে না।’ বাজপেয়ী গুজরাট পরিস্থিতির জন্য তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের এবং গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই বলেও ঘোষণা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বাজপায়ীর বক্তব্য লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি প্রকারান্তরে মুসলিম হত্যাকান্ডে নিজেদের সমর্থন ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছিলেন। তার কথায় ঘাতকদের প্রতিও সমর্থন ও উস্কানি ছিল- যার অর্থ হলো, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় যে কোনোস্থানে হত্যার অভিযান চালানো যেতে পারে! এতে দোষের কিছু নেই এবং এটাই ভারতীয় মুসলমানদের প্রাপ্য!
‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ ধ্বজাধারী ন্যাশনাল কংগ্রেস ও বামপন্থীসহ বিজেপির বিরোধিতাকারী দলগুলোও কখনো মুসলমানদের পক্ষে ভূমিকা পালন করেনি। গুজরাট হত্যাকান্ডের দিনগুলোতে দেখা গেছে, রাজ্যের রাজধানী আহমদাবাদে যাওয়ার কিংবা মুসলমানদের বাঁচানোর লক্ষ্যে কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সোনিয়া গান্ধী শুধু লোকসভার অধিবেশন আহ্বান জানানোর দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। এর ফলেও ঘাতকরা যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। এদেশের কারো কারো ‘কাকাবাবু’ জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাকেও শুধু কোলকাতা আর দিল্লিতেই দৌড়-ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। এভাবেই এক মাসের বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছিলেন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের রাজনৈতিক নেতারা! লোকসভার অধিবেশনে দেয়া ভাষণেও সোনিয়া গান্ধী গুজরাট হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচারের এবং মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তেমন জোরালোভাবে জানাননি। তিনি প্রধানত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদিকে বরখাস্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন- যেন ওই একজনমাত্র ব্যক্তিকে সরানো হলেই মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে! যেন হত্যার অভিযানে বাজপেয়ীসহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ভূমিকা বা অংশগ্রহণই ছিল না!
এখানে কংগ্রেসের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিরোধিতা ও প্রতিবাদের নামে কংগ্রেস তখন যেটুকু করেছিল তার সবই করেছিল নিজের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচিতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কংগ্রেসের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের অন্যান্য রাজ্যে ‘ভোট ব্যাংক’ মুসলমানদের সন্তুষ্ট করা। অর্থাৎ কংগ্রেসের উদ্দেশ্যের মধ্যে মুসলমানদের জানমাল হেফাজতের কোনো উপাদান ছিল না। সবই ছিল নিতান্ত রাজনৈতিক কৌশল। বলা দরকার, কংগ্রেস সবচেয়ে বেশি সময় ভারতের ক্ষমতায় থেকেছে এবং কংগ্রেসের সময়ও মুসলমানরা একইভাবে হত্যা ও দাঙ্গার শিকার হয়েছেন। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ যখন ভেঙে ফেলা হয় তখনও কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নরসীমা রাও। কিন্তু কংগ্রেস সরকার বাবরী মসজিদ ভাঙা যেমন প্রতিহত করেনি তেমনি ব্যবস্থা নেয়নি মুসলমানদের হত্যার অভিযান থামানোর জন্যও। উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং বলেছেন এবং পরবর্তীকালে একথা প্রমাণিতও হয়েছে যে, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানী বাবরী মসজিদ ভাঙার কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকার এই দু’জনসহ কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সত্যিকার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কোনো রাষ্ট্রে এমনটা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটসহ সারা ভারতে মুসলমানদের হত্যাকা- সম্ভব হওয়ার কারণ হচ্ছে, সংবিধানে লেখা থাকলেও এবং প্রকাশ্যে প্রচারণা চালানো হলেও ভারত এখনো উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি, মনোভাব ও কৌশল নিয়েই এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে মুসলমানদের হত্যা করার, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালানোর এবং মুসলমানদের পদানত রাখার ব্যাপারে গোপনে গোপনে সকল দলের মধ্যেই রয়েছে বিচিত্র সমঝোতা। পার্থক্য হলো, বিজেপি যেখানে হিন্দুত্ববাদী পরিচিতিকে প্রকাশ্যে আনে কংগ্রেস সেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ সাইনবোর্ডকে সামনে রাখে।
এখানে কমিউনিস্ট ও বাম নামধারীদের প্রসঙ্গেও বলা দরকার। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান-বিরোধী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে অন্য ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও একবার  পাল্লা দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এমনকি কূটনৈতিক শালীনতা ও শিষ্টাচার পর্যন্ত মানেননি। উদাহরণ দেয়ার জন্য এখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কিছু মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়। ২০০৪ সালের ১৭ আগস্টের বোমাবাজি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত ও চরমভাবে ক্ষুব্ধ, পশ্চিম বঙ্গের এই ‘কমরেড’ মুখ্যমন্ত্রী তখন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ‘সেকে- ফ্রন্ট’ আবিষ্কার করেছিলেন। বোমাবাজির ঠিক পরদিন কোলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন একটা থ্রেট’। এ শুধু কথার কথা ছিল না। কারণ, অত্যন্ত ক্ষোভ ও বিরক্তির সঙ্গে ওই সাক্ষাৎকারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যে একটা ‘থ্রেট’ এবং পাকিস্তান যে বাংলাদেশে তার ‘সেকেন্ড ফ্রন্ট’ খুলেছে- এই কথাটি তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ততোবার’ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ‘যতোবার’ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু ‘আফসোসের’ বিষয়, কেউই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথাকে তেমন ‘পাত্তা’ দেননি। তা সত্ত্বেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার নিজের মনের মতো করে ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন। আনন্দবাজারকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে ‘কমরেড’ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘মৌলবাদীরা’ এমনভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে, যার ফলে ‘ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম’ নাকি একটি ‘জটিল জায়গায়’ চলে গেছে! তিনি আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, কথিত ‘মৌলবাদীদের’ প্রতিফলন নাকি সরকারে এবং সেনাবাহিনীতেও হচ্ছে! এজন্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বাংলাদেশকে একটা ‘থ্রেট’ মনে করেছিলেন। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তিনি যে পাকিস্তানের পাশাপাশি সার্বিকভাবে মুসলমানদেরই টেনে এনেছিলেন সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ ভারতের তো বটেই, পশ্চিম বঙ্গেরও কারো কাছে মুসলমানদের আশা করার বা পাওয়ার কিছু নেই- তা তিনি মুখ্যমন্ত্রী বা রাজনেতিক নেতা, কূটনীতিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বা নোবেল বিজয়ী যা-ই হোন না কেন। এ ব্যাপারে সর্বশেষ ‘খেল’ তো বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও কম দেখাননি। এখনো তার সে ‘খেল’-এর শেষ দেখার জন্য অপেক্ষাই করতে হচ্ছে!
উদ্বেগের কারণ হলো, ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মুসলিমবিরোধী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনেরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে।  এসব সংগঠনের লক্ষ্য ভারতকে সম্পূর্ণরূপে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। তারা ভারতের সেনাবাহিনীতে হিন্দুত্ববাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। পেছনে রয়েছে শিব সেনা, বজরঙ্গ দল, আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা ভিএসপির মতো কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল। পুলিশ অনেক উপলক্ষেই প্রমাণ পেয়েছে, ভারতের সেনাবাহিনী ও হিন্দু সন্ত্রাসীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা মুসলমানদের হত্যাসহ নানা রকমের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কারণ, নির্দেশ ও নিষেধ আসে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কাছ থেকে। সব প্রধানমন্ত্রীর আমলেই ‘র’ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ ভারতের রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, ‘র’ এবং সন্ত্রাসীদের সমন্বিত নেটওয়ার্ক একযোগে কাজ করছে। বাবরী মসজিদ ধ্বংস ও মুসলমান হত্যা, গোধরায় ট্রেনে অগ্নি সংযোগ, গুজরাট গণহত্যা, মালেগাঁওয়ের বোমা বিস্ফোরণ, সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নি সংযোগ এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর সব অপরাধেই রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, ‘র’ এবং সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের সময় তো বটেই, আগে-পরে সকল উপলক্ষেও প্রমাণিত হয়েছে, ভারতীয় মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো দল ভারতে নেই। অদূর ভবিষ্যতেও তেমন কোনো দলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হিসেবে যতো প্রচারণাই চালানো হোক না কেন, ভারত এখনো হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রই রয়ে গেছে। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ভারতের সব রাজনৈতিক নেতাই ভারতীয় হিন্দু হিসেবে তাদের জাতীয় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। যার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে মমতা ব্যানার্জি এবং নরেন্দ্রনাথ মোদীর সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কর্মকান্ড থেকে।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads