জেনারেল মইনউদ্দিন আহমেদের ছদ্মবেশী সামরিক
সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল আওয়ামী
লীগ সরকার। অভিযোগটি আমার নয়,
এটি আমাদের জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন
সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। আরো ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, যখন
এই আঁতাত হয়, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল জলিলই। অর্থাৎ ওই
ক্ষেত্রে তারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সে নির্বাচনে কাকে জয়ী করা হবে, কাকে
হারিয়ে দেয়া হবে, সে ছকও নাকি আগে থেকেই নির্ধারণ করা ছিল। আর সে সময় জেনারেল
মইনের সহযোগী ছিল মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন।
সে নির্বাচন কমিশনেরও কাজ ছিল শুধু একটি ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। কিন্তু আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় এবং জেনারেল মইন মনোনীত ওই নির্বাচন কমিশন সে দিকে মনোযোগ দেয়ার অবকাশ কমই পেয়েছে। দেখা গেল, নির্বাচনের বদলে তাদের প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে দিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি করা, যাতে ওই প্লাটফরমের ওপর দাঁড়িয়ে মইন ক্ষমতা দখল করতে পারেন। শুরুতে শেখ হাসিনা জেনারেল মইনের শাসনের প্রতি এই আশায় দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন যে, মইন যেভাবে পারেন, যেন বিএনপিকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেন। এতে যদি কোনো বাড়াবাড়ি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে আইন প্রণয়ন করে ইনডেমনিটির মাধ্যমে তার দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবে। কী চমৎকার একটি গণতান্ত্রিক দল!
সে সময় সামরিক সরকারের কৃপায় নিয়োজিত এবং এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে ভিন্ন এজেন্ডা দেয় জে. মইনের সামরিক সরকার। সে এজেন্ডা বাস্তবায়নেই কাজ করেছেন তারা। এখন টেলিভিশনের টকশোগুলোতে, গোলটেবিল বৈঠকে তাদের আলোচনায় বড় বড় কথা শুনি, যা রীতিমতো হাস্যকর। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়েও তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোকে টুকরো টুকরো করে দেয়া। তেমনিভাবে, কোনো দলের সম্পাদক বা নির্বাহী সদস্য কে হবেন, না হবেন, কাকে রাখতে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে, সেটাও নির্ধারণ করতে শুরু করে ওই নির্বাচন কমিশন। তবে শেষ পর্যন্ত মইনের অথর্ব সরকার রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। তারা নিরাপদ প্রস্থানের পথ খুঁজতে শুরু করেন। আর সে পথের দিশাই তারা দেখে আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাতের মধ্যে। দুই বছরের দুঃশাসনে তারা বিএনপির ওপর যে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছিল, তাতে বিএনপির সাথে আঁতাতের কোনো সম্ভাবনাই তাদের ছিল না।
২০০৮ সালের নির্বাচনেও ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি হয়েছে। আর তা হয়েছে তালিকা ধরে ধরে বিশেষ দল ও তার সহযোগীদের জেতাতে গিয়ে। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১১০ শতাংশেরও বেশি। মনে হচ্ছিল যেন ভূতে ভোট দিয়ে গেছে। কিন্তু শামসুল হুদা ও তার সহকর্মীরা এ বিষয়ে ছিলেন একেবারে নীরব। বিএনপির প্রার্থীরা যখন ভোটকেন্দ্রের পাশ থেকে ফেলে দেয়া ব্যালট পেপারের মুড়ি উদ্ধার করে আনলেন, যখন বাচ্চাদের কাছেও পাওয়া যেতে থাকল সেসব মুড়ি, তখন ওই বশংবদ নির্বাচন কমিশন নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতে আইন করে দিলো যে, মুড়ি যার কাছে পাওয়া যাবে, তাকেই গ্রেফতার করা হবে। বলিহারি নির্বাচন কমিশন। এখন তাদের বড় বড় কথা বলতে কোনো লজ্জা দেখা যায় না। যা হোক, সেভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও সামরিক শাসকদের মধ্যে আঁতাতের নির্বাচন, যে কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল। ওই নির্বাচনের মাধ্যমেই তখন ক্ষমতাসীন হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর আঁতাতের কথা ফাঁস করে দিয়ে দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান আবদুল জলিল। এ দিকে, সামরিক শাসকদের দেয়া কথা রেখেছেন শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাদের সব পাপের, সব অপরাধের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
সেই নির্বাচনে কারা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হবেন, সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের তাতে কিছু ভূমিকা ছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে গোটা ব্যবস্থাকে ২০১৪ সালে এমন তছনছ করে দেয়া হয় যে, এতে গোটা নির্বাচনব্যবস্থাই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার তার আগের ১৫ বছর ধরে পরীক্ষিত, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারায় ছেদ টেনে দেয়। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিলো। সে ক্ষেত্রে যে যুক্তি দেয়া হয়, তা ছিল খুবই ঠুনকো আর অগ্রহণযোগ্য। কারণ তারা বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থাই ডেকে আনে। কিন্তু ২০০৭ সালের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে আসেনি। অযৌক্তিক দাবি আর হীন উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগই মঈন-ফখর সরকার ডেকে এনেছিল বলে শেখ হাসিনাই দাবি করেছেন। অনর্থক সেই দাবির শরিক হয়েছিলেন একটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক। এখন তার জন্য তিনি প্রতিদিন কাফফারা দিচ্ছেন।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলে আওয়ামী লীগের সমর্থনের লক্ষ্য কারো কাছে অস্পষ্ট ছিল না। আর তা হলো, দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দলকে বাকশালী কায়দায় শেষ করে দিয়ে জাতির ঘাড়ে চেপে বসে জনগণকে শাসন করা। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান যা সংবিধান সংশোধন করে করতে চেয়েছিলেন, তার কন্যার সরকার তা করতে চাইল বল প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু এতে বিপদ সমানই থাকছে কিংবা তা আরো বেশি মারাত্মক হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ ছফাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘সেভেন্টি টুতে ইউনিভার্সিটির কাজে তাঁর লগে একবার দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন ত আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায় কথায় আমি জিগাইলাম, আপনার হাতে ত এখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে? জহরলাল নেহরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশন পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী ইলেকশানে অপজিশন পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সিট পাইব না। আমি একটু আহত হইলাম, কইলাম, আপনে অপজিশনরে একশো সিট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান হইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।’ (উদ্ধৃত, যদ্যপি আমার গুরু)।
দুই.
খুব সঙ্গত কারণেই বলা যায়, আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল আসুক, তা চায়নি। ফলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় একদল মেরুদণ্ডবিহীন ব্যক্তিত্বহীন আত্মমর্যাদাশূন্য লোককে। তাদের নেতা করা হয় একান্ত বশংবদকে। দলীয়করণ করা হয় প্রশাসন-পুলিশ-র্যাবকে। গ্রেফতার করা হয় বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। হামলা-মামলা, হুলিয়া জারি করা হয় হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। সরকার এসব সুবিধা নিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যাতে বিরোধী দল নির্বাচনে আসতেই না পারে। আসেনি বিরোধী দল। এটাই সম্ভবত চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দল। ফলে শেখ হাসিনা এমন সব লোককে জাতীয় সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মনোনয়ন দিলেন, যাদের বেশির ভাগেরই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ারও যোগ্যতা নেই বলে দেশের মানুষের ধারণা। তার ফলে মাস্তান-চোরাচালানি-আদমপাচারকারী ধরনের কিছু লোকও সংসদ সদস্য হয়ে আসেন পার্লামেন্টে। ১৫৩ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। নির্বাচনই হয়নি। তাদের নাম শুধু সংসদ সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আবার এদের মধ্য থেকেই বিতর্কিত কয়েকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী হিসেবে। যা হোক, আপাতত সবচেয়ে সফল কক্সবাজারের এমপি বদি। সরকারি প্রশাসনিক কর্মতর্কাদের কিল-ঘুষি-লাথি মেরে তিনি অনেক ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন। সরকারি কর্মকর্তারা যতই আওয়ামী লীগার হোন না কেন, তারা বদির মতো লোকের লাথি খেতে প্রস্তুত আছেন কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মনে রাখা দরকার, শেখ মুজিবের খুনি মেজর ডালিম বেগম মুজিবকে মা ডাকতেন আর ডালিমের স্ত্রী শেখ রেহানার বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। কিন্তু স্ত্রীর গায়ে যখন হাত পড়ল, তখন ডালিম সেসব কথা মনে রাখতে পারেননি। সর্বশেষ, গত ১২ আগস্ট বদি পিটিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলীকে। ১২ আগস্টই নাটোর-২ আসনের আওয়ামী এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল র্যাবের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন হ্যান্ডকাফ পরানো অপরাধী রেদওয়ান সাব্বিরকে। পরে এমপির সাথে সবার সামনে এসে হ্যান্ডকাফহীন সাব্বির এসে হাজির হন।
এমপি বদি তার অপকর্মের জন্য ‘যথেষ্ট খ্যাতি’ অর্জন করে আওয়ামী শীর্ষস্থানীয়দের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। ইয়াবা চোরাচালানেও তার নাম শীর্ষে। কক্সবাজারের সাম্প্রতিক সমুদ্রপথে আদমপাচারেরও তিনি মহানায়ক বলে অভিযোগ আছে। এখন অনেকেই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। সর্বশেষ খেল দেখিয়েছেন ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬-৩০ মে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অনুষ্ঠিত ফিফার ৬৫তম কংগ্রেসে অংশ নেয়। কংগ্রেসশেষে প্রতিনিধিদলের অন্যরা দেশে ফিরলেও ফেরেননি মোহাম্মদ সেলিম নামের এক ব্যক্তি। তাকে বিয়ানিবাজার স্পোর্টিং কাবের সদস্য পরিচয়ে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যান উপমন্ত্রী। তিনিই ছিলেন তার গ্যারান্টার। তিনি তার যাওয়া-আসা থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব নিয়ে সুইস অ্যাম্বেসিতে চিঠি লেখেন তাকে ভিসা দেয়ার জন্য। ফিরে এসে সশরীরে সুইস অ্যাম্বেসিতে রিপোর্ট করার শর্তে সেলিমকে ভিসা দেয়া হয়েছিল। এখন সন্দেহ করা হচ্ছে, উপমন্ত্রী অর্থের বিনিময়ে ওই আদমকে সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছেন। আর বিয়ানীবাজার স্পোর্টিং কাব নামে কোনো কাবের অস্তিত্বই নাকি নেই।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর কি কোনো জবাব আছে?
পাদটীকা
সত্তরের দশকের একেবারে শেষের দিকে আমার বছর দশেকের জুনিয়র একদল ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। তত দিনে আমার মাস্টার্স শেষ। ছিলাম পরবর্তী পড়াশোনায়। ওদের কেবল ফার্স্ট ইয়ার শুরু। দ্রুতই তারা আমার বন্ধু হয়ে যায়। এরা ক্রিয়েটিভ ধরনের দুষ্টু ছিল। মেয়েরা ছেলেদের এবং ছেলেরা মেয়েদের ভালোবাসতে বাসতে দাগা দিয়ে চলে যায়। এটা আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পড়–য়া আমার তরুণ বন্ধুরা দল বেঁধে আড্ডা দিত। আর দাগা দেয়া মেয়ে দেখলে একযোগে আওয়াজ দিত, ‘বইন তোরা পারস্ও’। ওদের এমন রসিকতায় লাইব্রেরির সামনে বসে হাসতাম। বলতাম, এই, এসব কী করেন। ওরা আমাকে ‘বুইড়্যা’ বলে টিটকারি দিত।
সে নির্বাচন কমিশনেরও কাজ ছিল শুধু একটি ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। কিন্তু আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় এবং জেনারেল মইন মনোনীত ওই নির্বাচন কমিশন সে দিকে মনোযোগ দেয়ার অবকাশ কমই পেয়েছে। দেখা গেল, নির্বাচনের বদলে তাদের প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে দিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি করা, যাতে ওই প্লাটফরমের ওপর দাঁড়িয়ে মইন ক্ষমতা দখল করতে পারেন। শুরুতে শেখ হাসিনা জেনারেল মইনের শাসনের প্রতি এই আশায় দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন যে, মইন যেভাবে পারেন, যেন বিএনপিকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেন। এতে যদি কোনো বাড়াবাড়ি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে আইন প্রণয়ন করে ইনডেমনিটির মাধ্যমে তার দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবে। কী চমৎকার একটি গণতান্ত্রিক দল!
সে সময় সামরিক সরকারের কৃপায় নিয়োজিত এবং এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে ভিন্ন এজেন্ডা দেয় জে. মইনের সামরিক সরকার। সে এজেন্ডা বাস্তবায়নেই কাজ করেছেন তারা। এখন টেলিভিশনের টকশোগুলোতে, গোলটেবিল বৈঠকে তাদের আলোচনায় বড় বড় কথা শুনি, যা রীতিমতো হাস্যকর। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেয়েও তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোকে টুকরো টুকরো করে দেয়া। তেমনিভাবে, কোনো দলের সম্পাদক বা নির্বাহী সদস্য কে হবেন, না হবেন, কাকে রাখতে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে, সেটাও নির্ধারণ করতে শুরু করে ওই নির্বাচন কমিশন। তবে শেষ পর্যন্ত মইনের অথর্ব সরকার রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। তারা নিরাপদ প্রস্থানের পথ খুঁজতে শুরু করেন। আর সে পথের দিশাই তারা দেখে আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাতের মধ্যে। দুই বছরের দুঃশাসনে তারা বিএনপির ওপর যে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছিল, তাতে বিএনপির সাথে আঁতাতের কোনো সম্ভাবনাই তাদের ছিল না।
২০০৮ সালের নির্বাচনেও ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি হয়েছে। আর তা হয়েছে তালিকা ধরে ধরে বিশেষ দল ও তার সহযোগীদের জেতাতে গিয়ে। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১১০ শতাংশেরও বেশি। মনে হচ্ছিল যেন ভূতে ভোট দিয়ে গেছে। কিন্তু শামসুল হুদা ও তার সহকর্মীরা এ বিষয়ে ছিলেন একেবারে নীরব। বিএনপির প্রার্থীরা যখন ভোটকেন্দ্রের পাশ থেকে ফেলে দেয়া ব্যালট পেপারের মুড়ি উদ্ধার করে আনলেন, যখন বাচ্চাদের কাছেও পাওয়া যেতে থাকল সেসব মুড়ি, তখন ওই বশংবদ নির্বাচন কমিশন নিজেদের দুর্নীতি ঢাকতে আইন করে দিলো যে, মুড়ি যার কাছে পাওয়া যাবে, তাকেই গ্রেফতার করা হবে। বলিহারি নির্বাচন কমিশন। এখন তাদের বড় বড় কথা বলতে কোনো লজ্জা দেখা যায় না। যা হোক, সেভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল আওয়ামী লীগ ও সামরিক শাসকদের মধ্যে আঁতাতের নির্বাচন, যে কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিল। ওই নির্বাচনের মাধ্যমেই তখন ক্ষমতাসীন হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আর আঁতাতের কথা ফাঁস করে দিয়ে দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান আবদুল জলিল। এ দিকে, সামরিক শাসকদের দেয়া কথা রেখেছেন শেখ হাসিনা। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তাদের সব পাপের, সব অপরাধের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
সেই নির্বাচনে কারা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হবেন, সেনাবাহিনীর নেতৃস্থানীয়দের তাতে কিছু ভূমিকা ছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে গোটা ব্যবস্থাকে ২০১৪ সালে এমন তছনছ করে দেয়া হয় যে, এতে গোটা নির্বাচনব্যবস্থাই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার তার আগের ১৫ বছর ধরে পরীক্ষিত, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারায় ছেদ টেনে দেয়। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিলো। সে ক্ষেত্রে যে যুক্তি দেয়া হয়, তা ছিল খুবই ঠুনকো আর অগ্রহণযোগ্য। কারণ তারা বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থাই ডেকে আনে। কিন্তু ২০০৭ সালের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারণে আসেনি। অযৌক্তিক দাবি আর হীন উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগই মঈন-ফখর সরকার ডেকে এনেছিল বলে শেখ হাসিনাই দাবি করেছেন। অনর্থক সেই দাবির শরিক হয়েছিলেন একটি ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক। এখন তার জন্য তিনি প্রতিদিন কাফফারা দিচ্ছেন।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলে আওয়ামী লীগের সমর্থনের লক্ষ্য কারো কাছে অস্পষ্ট ছিল না। আর তা হলো, দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দলকে বাকশালী কায়দায় শেষ করে দিয়ে জাতির ঘাড়ে চেপে বসে জনগণকে শাসন করা। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান যা সংবিধান সংশোধন করে করতে চেয়েছিলেন, তার কন্যার সরকার তা করতে চাইল বল প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু এতে বিপদ সমানই থাকছে কিংবা তা আরো বেশি মারাত্মক হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ ছফাকে। তিনি বলেছিলেন, ‘সেভেন্টি টুতে ইউনিভার্সিটির কাজে তাঁর লগে একবার দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন ত আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায় কথায় আমি জিগাইলাম, আপনার হাতে ত এখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে? জহরলাল নেহরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশন পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী ইলেকশানে অপজিশন পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সিট পাইব না। আমি একটু আহত হইলাম, কইলাম, আপনে অপজিশনরে একশো সিট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান হইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।’ (উদ্ধৃত, যদ্যপি আমার গুরু)।
দুই.
খুব সঙ্গত কারণেই বলা যায়, আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী দল আসুক, তা চায়নি। ফলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় একদল মেরুদণ্ডবিহীন ব্যক্তিত্বহীন আত্মমর্যাদাশূন্য লোককে। তাদের নেতা করা হয় একান্ত বশংবদকে। দলীয়করণ করা হয় প্রশাসন-পুলিশ-র্যাবকে। গ্রেফতার করা হয় বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। হামলা-মামলা, হুলিয়া জারি করা হয় হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। সরকার এসব সুবিধা নিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যাতে বিরোধী দল নির্বাচনে আসতেই না পারে। আসেনি বিরোধী দল। এটাই সম্ভবত চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দল। ফলে শেখ হাসিনা এমন সব লোককে জাতীয় সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মনোনয়ন দিলেন, যাদের বেশির ভাগেরই ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ারও যোগ্যতা নেই বলে দেশের মানুষের ধারণা। তার ফলে মাস্তান-চোরাচালানি-আদমপাচারকারী ধরনের কিছু লোকও সংসদ সদস্য হয়ে আসেন পার্লামেন্টে। ১৫৩ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। নির্বাচনই হয়নি। তাদের নাম শুধু সংসদ সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আবার এদের মধ্য থেকেই বিতর্কিত কয়েকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী হিসেবে। যা হোক, আপাতত সবচেয়ে সফল কক্সবাজারের এমপি বদি। সরকারি প্রশাসনিক কর্মতর্কাদের কিল-ঘুষি-লাথি মেরে তিনি অনেক ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন। সরকারি কর্মকর্তারা যতই আওয়ামী লীগার হোন না কেন, তারা বদির মতো লোকের লাথি খেতে প্রস্তুত আছেন কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মনে রাখা দরকার, শেখ মুজিবের খুনি মেজর ডালিম বেগম মুজিবকে মা ডাকতেন আর ডালিমের স্ত্রী শেখ রেহানার বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতেন। কিন্তু স্ত্রীর গায়ে যখন হাত পড়ল, তখন ডালিম সেসব কথা মনে রাখতে পারেননি। সর্বশেষ, গত ১২ আগস্ট বদি পিটিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলীকে। ১২ আগস্টই নাটোর-২ আসনের আওয়ামী এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল র্যাবের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন হ্যান্ডকাফ পরানো অপরাধী রেদওয়ান সাব্বিরকে। পরে এমপির সাথে সবার সামনে এসে হ্যান্ডকাফহীন সাব্বির এসে হাজির হন।
এমপি বদি তার অপকর্মের জন্য ‘যথেষ্ট খ্যাতি’ অর্জন করে আওয়ামী শীর্ষস্থানীয়দের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। ইয়াবা চোরাচালানেও তার নাম শীর্ষে। কক্সবাজারের সাম্প্রতিক সমুদ্রপথে আদমপাচারেরও তিনি মহানায়ক বলে অভিযোগ আছে। এখন অনেকেই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। সর্বশেষ খেল দেখিয়েছেন ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়। তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬-৩০ মে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অনুষ্ঠিত ফিফার ৬৫তম কংগ্রেসে অংশ নেয়। কংগ্রেসশেষে প্রতিনিধিদলের অন্যরা দেশে ফিরলেও ফেরেননি মোহাম্মদ সেলিম নামের এক ব্যক্তি। তাকে বিয়ানিবাজার স্পোর্টিং কাবের সদস্য পরিচয়ে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যান উপমন্ত্রী। তিনিই ছিলেন তার গ্যারান্টার। তিনি তার যাওয়া-আসা থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব নিয়ে সুইস অ্যাম্বেসিতে চিঠি লেখেন তাকে ভিসা দেয়ার জন্য। ফিরে এসে সশরীরে সুইস অ্যাম্বেসিতে রিপোর্ট করার শর্তে সেলিমকে ভিসা দেয়া হয়েছিল। এখন সন্দেহ করা হচ্ছে, উপমন্ত্রী অর্থের বিনিময়ে ওই আদমকে সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছেন। আর বিয়ানীবাজার স্পোর্টিং কাব নামে কোনো কাবের অস্তিত্বই নাকি নেই।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর কি কোনো জবাব আছে?
পাদটীকা
সত্তরের দশকের একেবারে শেষের দিকে আমার বছর দশেকের জুনিয়র একদল ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। তত দিনে আমার মাস্টার্স শেষ। ছিলাম পরবর্তী পড়াশোনায়। ওদের কেবল ফার্স্ট ইয়ার শুরু। দ্রুতই তারা আমার বন্ধু হয়ে যায়। এরা ক্রিয়েটিভ ধরনের দুষ্টু ছিল। মেয়েরা ছেলেদের এবং ছেলেরা মেয়েদের ভালোবাসতে বাসতে দাগা দিয়ে চলে যায়। এটা আদিকাল থেকেই হয়ে আসছে। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পড়–য়া আমার তরুণ বন্ধুরা দল বেঁধে আড্ডা দিত। আর দাগা দেয়া মেয়ে দেখলে একযোগে আওয়াজ দিত, ‘বইন তোরা পারস্ও’। ওদের এমন রসিকতায় লাইব্রেরির সামনে বসে হাসতাম। বলতাম, এই, এসব কী করেন। ওরা আমাকে ‘বুইড়্যা’ বলে টিটকারি দিত।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন