বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৫

এখন প্রয়োজন অঙ্গীকার বাস্তবায়ন


দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভাল নয়, তা জনগণ ভাল করেই উপলব্ধি করছে। পর পর কয়েকটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়েছে, তাতে উপলব্ধি করা যায় যে, আমাদের রাজনীতিও ভাল অবস্থায় নেই। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বর্জন করে দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দুর্বল করার যে কৌশল সরকার গ্রহণ করেছে, তার ফল কিন্তু সরকারি দলের জন্যও ভাল হয়নি। আসলে কোনো সরকার যখন অঙ্গীকার ভঙ্গ করে অনুরাগ ও বিরাগের নীতিতে দেশ শাসন করে, তখন একদিকে নিজদলের নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে, অপরদিকে ভেঙে পড়ে আইনের শাসন। তেমন এক পরিস্থিতিতেই আমরা এখন বসবাস করছি। এমন অবস্থায় দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসন নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে- তা মোটেও সুখকর নয়। তিনদিনের সফর শেষে ২৫ আগস্ট, ঢাকা ত্যাগের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক বৃটিশ প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়েন বলেছেন, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ্য করা যায় না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে কারণে সে কারণে এখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখা জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখন সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে। আইনের শাসন তথা সুশাসনের সংকট নিয়েও উদ্বিগ্ন নাগরিকরা। ‘চ্যালেঞ্জ আইনের শাসনে’ শিরোনামে প্রতিবেদনও মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদেরও প্রশ্ন এখন আইনের শাসন নিয়ে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সরকার পক্ষের লোকজন বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব নিয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহল। একই সঙ্গে উন্নয়ন ও আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। জেলায় জেলায় পুলিশ সুপারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। অন্যায়-অপরাধ করলে ছাড় দেওয়া হবে না দলের কাউকে। বর্তমানে এরই অংশ হিসেবে সারা দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কঠোর মনোভাব নিয়েছে।
সরকার পক্ষের লোকজন বলছেন, সরকার একই সাথে উন্নয়ন ও আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে চায়। এটা খুবই ভাল কথা। অবশ্য কিছুদিন আগে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল- উন্নয়ন আগে, না সুশাসন আগে? জনগণ আসলে উন্নয়ন ও সুশাসন দু’টোই চায় এবং চায় একসাথেই। আর উন্নয়নেরও রয়েছে নানা রূপ। গুটি কয়েকের উন্নয়ন কিংবা দুর্বৃত্তদের উন্নয়ন জনগণের কাম্য নয়। জনগণ চায় গণতান্ত্রিক উন্নয়ন অর্থাৎ দেশের সব মানুষের উন্নয়ন। শুধু ২২ পরিবারের উন্নয়ন চায়নি বলেই তো দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও জনগণ কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক উন্নয়নের রূপ দেখতে পায়নি। আসলে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুশাসন তথা আইনের শাসন। এর অভাবে প্রকৃত উন্নয়ন ও স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ এখনো সম্ভব হয়নি।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার এখন কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে বলা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে বন্দুকযুদ্ধে সরকারি ঘরানার কিছু মানুষকে নিহত হতে দেখা গেছে। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের মত বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সাময়িকভাবে সংকট মোকাবিলার কৌশল গ্রহণ না করে বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। প্রসঙ্গত তারা অনুরাগ ও বিরাগের মনোভাব পরিত্যাগ করে ন্যায়ের চেতনায় সংবিধানের আলোকে দেশ পরিচালনার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, সরকারদলীয় লোকদের এখন ক্রসফায়ারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে কেন? এমন পরিস্থিতিতো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি ঘরানার লোকজন প্রশাসনের প্রশ্রয় পেয়েছে, আইনের শাসনের বদলে তারা দলীয় শাসনের সুখ ভোগ করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখনতো তারা আর কথা শুনতে চায় না- সরকারের ইমেজ নষ্ট হলেও না। অতএব বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার! এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্রসফায়ার আইনের শাসনের বড় অন্তরায়। এতদিন বাংলাদেশের কোনো সরকারই এটা মানেইনি যে, ক্রসফায়ার হচ্ছে। তবে এখন নতুন মাত্রা দেখা যাচ্ছে, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই এটা করা হচ্ছে। সরকারের একজন মন্ত্রী এমনভাবেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যে, দলের ছাত্র বা যুব সংগঠনের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আবার সরকারের অন্য একটি অংশ প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করছেন। তবে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, আইন লংঘন করে এভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে তার মূল্য সরকারকেই দিতে হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশ-র‌্যাবের মধ্যে হত্যা করার একটি সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। এটি যে কোনো দেশের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য হুমকি স্বরূপ। অতএব আমরা মনে করি, হুমকির পথ পরিহার করে এখন সরকারের উচিত হবে অনুরাগ-বিরাগ তথা দলকানা মনোভাব বর্জন এবং ন্যায়ের চেতনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। কারণ আইনের শাসনের বিকল্পও আইনের শাসনই। এত স্পষ্ট বিষয় তো আমাদের রাজনীতিবিদ কিংবা সরকারের না বোঝার কথা নয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হয় না তারা পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছেন। নাকি উপলব্ধি করেও নৈতিক মেরুদণ্ডের অভাবে তারা সঙ্গত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন?
আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, বিচার বিভাগকে পেছনে ফেলে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবে না। বিচারহীনতার কারণেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। কোনো সভ্য দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে ২৩ আগস্ট জাতীয় সংসদের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন সুরঞ্জিত সেন। এদিকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগি সংগঠনের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন- দল, সহযোগি ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু একাডেমী আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আরো বলেন, এখনই আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রথমে ছাত্রসংগঠনকে নীতিপরায়ণ ও আদর্শের দিকে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য ছাত্রলীগের সাবেক নীতিপরায়ণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদের ও সৈয়দ আশরাফের মত ব্যক্তিদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। তারা সারাদেশ ঘুরলেই ছাত্রলীগসহ সব সংগঠনে শ্ঙ্খৃলা, আদর্শ ও নীতিপরায়ণতা ফিরে আসবে।
বঙ্গবন্ধু একাডেমী আয়োজিত আলোচনা সভায় সুরঞ্জিত সেনাগুপ্ত সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নীতি ও আদর্শের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। খুবই সঙ্গত আহ্বান। আসলে নীতি ও আদর্শের পথ ছেড়ে মানুষ কখনো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মানুষ যখন ক্ষমতায় থাকে, লক্ষ্যে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তখন এই সত্য ভুলে যায়। ফলে নীতি ও আদর্শের অবর্তমানে দমন-পীড়ন ও দৌরাত্ম্যের মাত্রা বাড়ে। এতে শুধু দল নয়, দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনেও সহিষ্ণুতার অভাবে দ্বন্দ্বসংঘাতের মাত্রা বাড়ে। আর নীতিহীনতার রাজনীতি দলের জন্য কতটা মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে তা হয়তো এখন আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করছে। এ কারণেই এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলছেন। সঙ্গত উপলব্ধি দেরীতে হলেও মঙ্গল। তবে দেখার বিষয় হলো, শাসক দল নীতি ও আদর্শের পথে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা এগিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই ব্যর্থতার পাল্লা অনেক ভারী হয়ে গেছে, এবার দিনবদল প্রয়োজন। অঙ্গীকার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads