পাঠকরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বহুদিন ধরে দেশের রাজনীতি থেকে অনেক দূরে রয়েছি। শখ বা ইচ্ছা করে নয়, আসলে ভয়ের কারণে। এই ভয় পাওয়ার পেছনে ‘অবদান’ রেখেছেন দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান যাকে ‘চান্স সম্পাদক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেউ কেউ আবার একথাও বলেছেন, তিনি নাকি ‘ঠিক’ সাংবাদিক নন! সেই মাহমুদুর রহমানকে গত ১৩ আগস্ট দুদকের একটি সাজানো মামলায় তিন বছরের কারাদ- দিয়েছে আদালত। এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। টাকাটা না দিলে তাকে আরো এক মাস কারাগারে কাটাতে হবে। যেহেতু আদালতের ব্যাপার সেহেতু এ প্রসঙ্গে কথা না বাড়ানোই ভালো, যদিও তার আইনজীবীরা বলেছেন, মাহমুদুর রহমান ন্যায় বিচার পাননি। দুদক নাকি ভুয়া সাক্ষী পর্যন্ত হাজির করেও নিজেদের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। একই কারণে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীরা। সুতরাং এই সময়ে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
তবে কিছু কথা আবার না বলেও পারা যায় না। প্রাসঙ্গিক একটি বড় কথা হলো, বিগত কয়েক বছরে গ্রেফতার এবং রিমান্ড দুটিরই প্রধান উদাহরণ হয়ে উঠেছেন ‘বেচারা’ মাহমুদুর রহমান। একটি মামলায় সাজা এতদিনে দেয়া হলেও ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সকালে কমান্ডো স্টাইলে অপারেশন চালিয়ে সরকার আমার দেশ অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল তাকে। মূলত গুম হওয়ার ভয়ে ১১৯ দিন ধরে অফিসে কাটাচ্ছিলেন তিনি। কি এমন ‘অপরাধ’ করেছিলেন, যার কারণে তাকে বাসা-বাড়ি ফেলে অফিসে কাটাতে হচ্ছিল? কারণটি ছিল ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাবেক বিচারপতির কিছু স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করে দেয়া। এসব সংলাপে ওই সাবেক বিচারপতি বিদেশে বসবাসরত একজন কথিত আইনজ্ঞের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সবিস্তারে মতবিনিময় করেছিলেন।
সবই হয়তো ঠিকঠাকই থাকতো কিন্তু এরই মধ্যে সে সংলাপের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী দি ইকনোমিস্ট। সাময়িকীটি স্কাইপ সংলাপ প্রকাশও করে দিয়েছিল। মাহমুদুর রহমানের ‘অপরাধ’, তিনি দি ইকনোমিস্ট-এর প্রকাশ করা সংলাপের কিছু বিশেষ অংশ দৈনিক আমার দেশ-এ ছাপিয়েছিলেন। ক্ষমতাসীনদের জন্য এটুকুই অবশ্য যথেষ্ট ছিল। তেজগাঁও থানায় মাহমুদুর রহমানের নামে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন তারা। অভিযোগও যেমন-তেমন ছিল না, সোজা রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন মাহমুুদুর রহমান। অন্যদিকে সিনিয়র আইনজীবীসহ বিশেষজ্ঞরা কিন্তু আইনের ধারা-উপধারা উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন, স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করার মাধ্যমে মাহমুদুর রহমান কোনো অপরাধই করেননি। এর একটি কারণ, বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ‘উইকিলিক্স’ থেকে ভারতের ‘তেহেলকা ডট কম’ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অসংখ্য সংস্থা বহু বছর ধরে এ ধরনের সংলাপ এবং রাষ্ট্রীয় গোপন নথিপত্র প্রকাশ করে চলেছে। দ্বিতীয় কারণ, আমার দেশ-এরও আগে স্কাইপ সংলাপ দি ইকনোমিস্টসহ বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং এ নিয়ে কোনো মামলা চলতে পারে না। তৃতীয়ত, স্কাইপ কেলেংকারীর প্রধান নায়ক এবং ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক ওই বিচারপতি সব দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করায় অভিযোগের সত্যতাই শুধু প্রমাণিত হয়নি, মামলার মেরিটও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চতুর্থত, মামলা করতে হলে ওই বিচারপতিকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার, যিনি সংবিধান ও চাকরির শপথ ভঙ্গ করে মামলার গোপন তথ্য ফাঁস করেছিলেন অভিযোগ এনে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ছেড়েছে। মামলাও দিয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহের! অথচ স্কাইপ সংলাপ বা কোনো তথ্য প্রকাশ করার কারণে আর যা-ই হোক, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগে মামলা করা যায় না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা এই সহজ কথাটুকু না বোঝার ভান করেছেন।
এজন্যই ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়েছিল মাহমুদুর রহমানকে। কথা শুধু সে কারণে ওঠেনি। সেদিনই একদিকে আরো তিনটি মামলায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল তাকে, অন্যদিকে রাতের বেলায় পুলিশকে দিয়ে আমার দেশ-এর ছাপাখানায় তল্লাশির নামে ‘গণতান্ত্রিক’ ডাকাতি করিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন আমার দেশ-এর ছাপাখানা। এরপর পত্রিকাটি ছাপানো হচ্ছিল আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে। কিন্তু আইনসম্মতভাবে হলেও সরকার শুধু ছাপানো বন্ধ ও পত্রিকা জব্দ করেনি, দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদ এবং মাহমুদুর রহমানের মায়ের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকেছিল। পুলিশ একই সঙ্গে ১৯ জন গরীব বাইন্ডারকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এসব পদক্ষেপের ফলে সরাসরি আক্রান্ত আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। সংবিধানে নিষেধ থাকায় সরকার অবশ্য আমার দেশকে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করেনি। পা বাড়িয়েছে বাঁকা পথে। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রেসে।
সরকারের এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে বন্দি অবস্থাতেই অনশন শুরু করেছিলেন মাহমুদুর রহমান। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জানানো দরকার, রিমান্ডে নিয়ে সরকার মাহমুদুর রহমানকে কিন্তু ‘জামাই আদরে’ রাখেনি। ১৯ এপ্রিল জাতীয় নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট ফরহাদ মজহার হাসপাতালে মাহমুদুর রহমানকে দেখে আসার পর আমার দেশ পরিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, হাত ও পা থেকে শুরু করে শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেখানে ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়নি। প্রতিটি স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ১৭ এপ্রিলও। রিমান্ডের মেয়াদ বাকি থাকতেই পুলিশ সেদিন মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করেছিল। পুলিশ কেন তাকে আগেভাগে আদালতে হাজির করেছে এবং কেন আবারও রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানায়নি তার কারণ জানা গিয়েছিল মাহমুদুর রহমানের চেহারা এবং শারীরিক অবস্থা দেখে। নির্যাতনের কারণে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে তখন রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তিনি এমনকি দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তার জীবন নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছিল। মূলত সে কারণেই তাড়াহুড়ো করে আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাকে। একই কারণে মাহমুদুর রহমানকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানায়নি পুলিশ। একজন সম্মানিত সম্পাদকের অবস্থা কেন এতটা শোচনীয় হয়েছে এবং মেয়াদ বাকি থাকতেই কেন তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। বিচারক সোজা তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষও মন্দ দেখায়নি। তারা পরদিন, ১৮ এপ্রিল মাহমুদুর রহমানকে বিএসএমএমইউ তথা সাবেক পিজি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে ‘দায়’ সেরেছিল।
অন্য একটি কারণও অবশ্য ছিল। সে কারণ মাহমুদুর রহমানের আমরণ অনশন। তিনটি দাবি আদায়ের জন্য ১৫ এপ্রিল থেকে তিনি অনশন শুরু করেছিলেন ১. তার মা এবং দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার; ২. দৈনিক আমার দেশ-এর ছাপাখানায় পুলিশের লাগানো তালা খুলে দিয়ে পত্রিকার প্রকাশনা বাধাহীন করা; এবং ৩. গ্রেফতারকৃত ১৯ জন বাইন্ডারকে মুক্তি দেয়া। রিমান্ডে নির্যাতনের পাশাপাশি নিজে অনশন করায় গুরুতররূপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মাহমুদুর রহমান। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, মাহমুদুর রহমানের হৃদস্পন্দন মাত্র ৪৮-এ নেমে এসেছিল, ব্লাড প্রেসার ওঠানামা করছিল ৪৯ থেকে ৯০-এর মধ্যে, শরীরের পটাশিয়াম কমে গিয়েছিল, রক্তে ইউরিয়া ও সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, একটি কিডনি যথাযথভাবে কাজ করছিল না, প্রস্রাব একেবারেই হচ্ছিল না। তার অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতাও অনেক কমে গিয়েছিল। অর্থাৎ মাহমুদুর রহমান মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের মতে সব মিলিয়ে এমন ছয়টি মারাত্মক রোগেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, যেগুলোর যে কোনো একটির কারণে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারতো। ওই যাত্রায় বেঁচে গেলেও তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবেন না। এজন্যই উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা বলেছিলেন, অনতিবিলম্বে তার অনশন ভেঙে স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া শুরু করা দরকার। দ্রুত দরকার তাকে প্রতিটি বিষয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়াও।
মাহমুদুর রহমান অবশ্য পুলিশ এবং আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘বাঁচিয়ে’ দিয়েছিলেন। হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফির পাশাপাশি সাংবাদিক ও পেশাজীবী নেতাদের অনুরোধে ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি তার মায়ের হাতে শরবত খেয়ে অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। এখানে মাহমুদুর রহমানকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে আপত্তি ও প্রতিবাদের কিছু কারণ লক্ষ্য করা দরকার। তেজগাঁও থানায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি হয়েছিল ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর আর মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল। মাঝখানে দীর্ঘ চারটি মাস কেটে গিয়েছিল। অভিযোগ সত্য হলে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের জন্য এত বেশিদিন নিশ্চয়ই সময় লাগার কথা নয়। সব তথ্য-প্রমাণই তো পুলিশের কাছে থাকার কথা! বাস্তবে এ থেকেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, উদ্দেশ্য আসলে অন্যরকমই ছিল। মাহমুদুর রহমানকে যে মামলাগুলোতে ফাঁসানো হয়েছিল সেগুলোর প্রতিটিই ছিল মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজানো।
ঘটনাপ্রবাহে বিচার বিভাগ ও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সরকারের উপেক্ষা এসেছিল দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে। কারণ, বিশেষ করে রিমান্ডের ব্যাপারে সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায় অমান্য করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল দেয়া এক রায়ে হাই কোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সুনির্দিষ্ট দশটি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেয়া যাবে না। রিমান্ডে নিতে হলেও সর্বোচ্চ তিনদিনের বেশি কাউকে রিমান্ডে রাখা যাবে না। তাছাড়া রিমান্ডে নেয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। রিমান্ডে নেয়ার আগে ও পরে অভিযুক্তকে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে, প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আইনজীবী ও স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার ও আলোচনা করার সুযোগও দিতে হবে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে সরকার সবদিক থেকেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবই সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও মনোভাবের কারণে। মাহমুদুর রহমানের জীবন তো মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনাও এখনো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আসলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। রাষ্ট্রের এ দুটি স্তম্ভের স্বাধীন ভূমিকার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ন্যক্কারজনক নীতি ও মনোভাবের প্রমাণ অতীতেও বহুবার পাওয়া গেছে। সে একই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নেয়নি। বিস্তারিত উল্লেখের পরিবর্তে এখানে মাহমুদুর রহমানের উদাহরণ স্মরণ করলে দেখা যাবে, সরকারের চাপে বিচারকরাও কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। যেমন ২০১০ সালে প্রথম দফা রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়ার পর আদালতে দাঁড়িয়ে মাহমুদুর রহমান তাকে ‘বাঁচানোর’ জন্য বিচারকের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাকে বাঁচান!’ কিন্তু যে সম্পাদকের নেতৃত্বে দৈনিক আমার দেশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সব সময় কলম যুদ্ধ করেছে সে সম্পাদককেই সেবার রীতিমতো একজন ‘বেচারা’ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল!
প্রসঙ্গক্রমে বিশেষ করে আলোচিত হয়েছিল রিমান্ডের বিষয়টি। কারণ, মাহমুদুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি নন, সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালত প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্যজনের রিমান্ড মঞ্জুর করে চলেছে। অথচ রিমান্ডে নেয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য জানার জন্য। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় প্রত্যেককেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানছে না যে কথাটা আগেই জানানো হয়েছে। দেখা গেছে, রিমান্ড মঞ্জুর করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে বিচারকের এখতিয়ার হলেও এই সরকারের আমলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। রাজনৈতিক মামলায় বিচারকদের ওপর নাকি ‘চাপ’ থাকে। এই ‘চাপ’ ক্ষমতাসীনরাই দিয়ে থাকেন। মাহমুদুর রহমানকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহেও পরিষ্কার হয়েছিল, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার চরমভাবেই অবজ্ঞা দেখাচ্ছে। এর ফলে বেশি ক্ষতি হয়েছে স্বাধীন বিচার বিভাগের। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই এ অবস্থার আশু অবসান দরকার। সরকারের উচিত অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়া এবং প্রেসের তালা খুলে দিয়ে আমার দেশ-এর প্রকাশনার সব বাধা দূর করা। এতটা অবশ্য বর্তমান সরকারের কাছে আশা করা যায় না। কারণ, গণমাধ্যমের ব্যাপারে তো বটেই বিশেষ করে ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান এবং দৈনিক আমার দেশ-এর প্রশ্নেও সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত রয়েছে। একই কারণে মাহমুদুর রহমানকে যেমন সহজে ছেড়ে দেয়া হবে না তেমনি বাজারে আসতে পারবে না দৈনিক আমার দেশও।
তবে কিছু কথা আবার না বলেও পারা যায় না। প্রাসঙ্গিক একটি বড় কথা হলো, বিগত কয়েক বছরে গ্রেফতার এবং রিমান্ড দুটিরই প্রধান উদাহরণ হয়ে উঠেছেন ‘বেচারা’ মাহমুদুর রহমান। একটি মামলায় সাজা এতদিনে দেয়া হলেও ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সকালে কমান্ডো স্টাইলে অপারেশন চালিয়ে সরকার আমার দেশ অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল তাকে। মূলত গুম হওয়ার ভয়ে ১১৯ দিন ধরে অফিসে কাটাচ্ছিলেন তিনি। কি এমন ‘অপরাধ’ করেছিলেন, যার কারণে তাকে বাসা-বাড়ি ফেলে অফিসে কাটাতে হচ্ছিল? কারণটি ছিল ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাবেক বিচারপতির কিছু স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করে দেয়া। এসব সংলাপে ওই সাবেক বিচারপতি বিদেশে বসবাসরত একজন কথিত আইনজ্ঞের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সবিস্তারে মতবিনিময় করেছিলেন।
সবই হয়তো ঠিকঠাকই থাকতো কিন্তু এরই মধ্যে সে সংলাপের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী দি ইকনোমিস্ট। সাময়িকীটি স্কাইপ সংলাপ প্রকাশও করে দিয়েছিল। মাহমুদুর রহমানের ‘অপরাধ’, তিনি দি ইকনোমিস্ট-এর প্রকাশ করা সংলাপের কিছু বিশেষ অংশ দৈনিক আমার দেশ-এ ছাপিয়েছিলেন। ক্ষমতাসীনদের জন্য এটুকুই অবশ্য যথেষ্ট ছিল। তেজগাঁও থানায় মাহমুদুর রহমানের নামে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন তারা। অভিযোগও যেমন-তেমন ছিল না, সোজা রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন মাহমুুদুর রহমান। অন্যদিকে সিনিয়র আইনজীবীসহ বিশেষজ্ঞরা কিন্তু আইনের ধারা-উপধারা উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন, স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করার মাধ্যমে মাহমুদুর রহমান কোনো অপরাধই করেননি। এর একটি কারণ, বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো ‘উইকিলিক্স’ থেকে ভারতের ‘তেহেলকা ডট কম’ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অসংখ্য সংস্থা বহু বছর ধরে এ ধরনের সংলাপ এবং রাষ্ট্রীয় গোপন নথিপত্র প্রকাশ করে চলেছে। দ্বিতীয় কারণ, আমার দেশ-এরও আগে স্কাইপ সংলাপ দি ইকনোমিস্টসহ বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং এ নিয়ে কোনো মামলা চলতে পারে না। তৃতীয়ত, স্কাইপ কেলেংকারীর প্রধান নায়ক এবং ‘আন্তর্জাতিক’ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক ওই বিচারপতি সব দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করায় অভিযোগের সত্যতাই শুধু প্রমাণিত হয়নি, মামলার মেরিটও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চতুর্থত, মামলা করতে হলে ওই বিচারপতিকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার, যিনি সংবিধান ও চাকরির শপথ ভঙ্গ করে মামলার গোপন তথ্য ফাঁস করেছিলেন অভিযোগ এনে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে ছেড়েছে। মামলাও দিয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহের! অথচ স্কাইপ সংলাপ বা কোনো তথ্য প্রকাশ করার কারণে আর যা-ই হোক, রাষ্ট্রদ্রোহের মতো গুরুতর অভিযোগে মামলা করা যায় না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা এই সহজ কথাটুকু না বোঝার ভান করেছেন।
এজন্যই ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়েছিল মাহমুদুর রহমানকে। কথা শুধু সে কারণে ওঠেনি। সেদিনই একদিকে আরো তিনটি মামলায় ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল তাকে, অন্যদিকে রাতের বেলায় পুলিশকে দিয়ে আমার দেশ-এর ছাপাখানায় তল্লাশির নামে ‘গণতান্ত্রিক’ ডাকাতি করিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন আমার দেশ-এর ছাপাখানা। এরপর পত্রিকাটি ছাপানো হচ্ছিল আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেসে। কিন্তু আইনসম্মতভাবে হলেও সরকার শুধু ছাপানো বন্ধ ও পত্রিকা জব্দ করেনি, দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদ এবং মাহমুদুর রহমানের মায়ের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকেছিল। পুলিশ একই সঙ্গে ১৯ জন গরীব বাইন্ডারকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এসব পদক্ষেপের ফলে সরাসরি আক্রান্ত আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। সংবিধানে নিষেধ থাকায় সরকার অবশ্য আমার দেশকে ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করেনি। পা বাড়িয়েছে বাঁকা পথে। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রেসে।
সরকারের এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে বন্দি অবস্থাতেই অনশন শুরু করেছিলেন মাহমুদুর রহমান। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জানানো দরকার, রিমান্ডে নিয়ে সরকার মাহমুদুর রহমানকে কিন্তু ‘জামাই আদরে’ রাখেনি। ১৯ এপ্রিল জাতীয় নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট ফরহাদ মজহার হাসপাতালে মাহমুদুর রহমানকে দেখে আসার পর আমার দেশ পরিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, হাত ও পা থেকে শুরু করে শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেখানে ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়নি। প্রতিটি স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল ১৭ এপ্রিলও। রিমান্ডের মেয়াদ বাকি থাকতেই পুলিশ সেদিন মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করেছিল। পুলিশ কেন তাকে আগেভাগে আদালতে হাজির করেছে এবং কেন আবারও রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানায়নি তার কারণ জানা গিয়েছিল মাহমুদুর রহমানের চেহারা এবং শারীরিক অবস্থা দেখে। নির্যাতনের কারণে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে তখন রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তিনি এমনকি দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে তার জীবন নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছিল। মূলত সে কারণেই তাড়াহুড়ো করে আদালতে হাজির করা হয়েছিল তাকে। একই কারণে মাহমুদুর রহমানকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানায়নি পুলিশ। একজন সম্মানিত সম্পাদকের অবস্থা কেন এতটা শোচনীয় হয়েছে এবং মেয়াদ বাকি থাকতেই কেন তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। বিচারক সোজা তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষও মন্দ দেখায়নি। তারা পরদিন, ১৮ এপ্রিল মাহমুদুর রহমানকে বিএসএমএমইউ তথা সাবেক পিজি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে ‘দায়’ সেরেছিল।
অন্য একটি কারণও অবশ্য ছিল। সে কারণ মাহমুদুর রহমানের আমরণ অনশন। তিনটি দাবি আদায়ের জন্য ১৫ এপ্রিল থেকে তিনি অনশন শুরু করেছিলেন ১. তার মা এবং দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার; ২. দৈনিক আমার দেশ-এর ছাপাখানায় পুলিশের লাগানো তালা খুলে দিয়ে পত্রিকার প্রকাশনা বাধাহীন করা; এবং ৩. গ্রেফতারকৃত ১৯ জন বাইন্ডারকে মুক্তি দেয়া। রিমান্ডে নির্যাতনের পাশাপাশি নিজে অনশন করায় গুরুতররূপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মাহমুদুর রহমান। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, মাহমুদুর রহমানের হৃদস্পন্দন মাত্র ৪৮-এ নেমে এসেছিল, ব্লাড প্রেসার ওঠানামা করছিল ৪৯ থেকে ৯০-এর মধ্যে, শরীরের পটাশিয়াম কমে গিয়েছিল, রক্তে ইউরিয়া ও সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, একটি কিডনি যথাযথভাবে কাজ করছিল না, প্রস্রাব একেবারেই হচ্ছিল না। তার অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতাও অনেক কমে গিয়েছিল। অর্থাৎ মাহমুদুর রহমান মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের মতে সব মিলিয়ে এমন ছয়টি মারাত্মক রোগেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, যেগুলোর যে কোনো একটির কারণে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারতো। ওই যাত্রায় বেঁচে গেলেও তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন যাপন করতে পারবেন না। এজন্যই উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা বলেছিলেন, অনতিবিলম্বে তার অনশন ভেঙে স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া শুরু করা দরকার। দ্রুত দরকার তাকে প্রতিটি বিষয়ে উন্নত চিকিৎসা দেয়াও।
মাহমুদুর রহমান অবশ্য পুলিশ এবং আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘বাঁচিয়ে’ দিয়েছিলেন। হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফির পাশাপাশি সাংবাদিক ও পেশাজীবী নেতাদের অনুরোধে ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি তার মায়ের হাতে শরবত খেয়ে অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। এখানে মাহমুদুর রহমানকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে আপত্তি ও প্রতিবাদের কিছু কারণ লক্ষ্য করা দরকার। তেজগাঁও থানায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি হয়েছিল ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর আর মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল। মাঝখানে দীর্ঘ চারটি মাস কেটে গিয়েছিল। অভিযোগ সত্য হলে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের জন্য এত বেশিদিন নিশ্চয়ই সময় লাগার কথা নয়। সব তথ্য-প্রমাণই তো পুলিশের কাছে থাকার কথা! বাস্তবে এ থেকেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, উদ্দেশ্য আসলে অন্যরকমই ছিল। মাহমুদুর রহমানকে যে মামলাগুলোতে ফাঁসানো হয়েছিল সেগুলোর প্রতিটিই ছিল মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজানো।
ঘটনাপ্রবাহে বিচার বিভাগ ও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সরকারের উপেক্ষা এসেছিল দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে। কারণ, বিশেষ করে রিমান্ডের ব্যাপারে সরকার সর্বোচ্চ আদালতের রায় অমান্য করেছিল। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল দেয়া এক রায়ে হাই কোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সুনির্দিষ্ট দশটি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন। একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেয়া যাবে না। রিমান্ডে নিতে হলেও সর্বোচ্চ তিনদিনের বেশি কাউকে রিমান্ডে রাখা যাবে না। তাছাড়া রিমান্ডে নেয়ার পর অভিযুক্ত ব্যক্তির আইনজীবীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। রিমান্ডে নেয়ার আগে ও পরে অভিযুক্তকে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে, প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আইনজীবী ও স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার ও আলোচনা করার সুযোগও দিতে হবে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে সরকার সবদিক থেকেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসবই সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও মনোভাবের কারণে। মাহমুদুর রহমানের জীবন তো মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনাও এখনো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আসলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। রাষ্ট্রের এ দুটি স্তম্ভের স্বাধীন ভূমিকার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ন্যক্কারজনক নীতি ও মনোভাবের প্রমাণ অতীতেও বহুবার পাওয়া গেছে। সে একই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও বিচার বিভাগ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নেয়নি। বিস্তারিত উল্লেখের পরিবর্তে এখানে মাহমুদুর রহমানের উদাহরণ স্মরণ করলে দেখা যাবে, সরকারের চাপে বিচারকরাও কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। যেমন ২০১০ সালে প্রথম দফা রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়ার পর আদালতে দাঁড়িয়ে মাহমুদুর রহমান তাকে ‘বাঁচানোর’ জন্য বিচারকের কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাকে বাঁচান!’ কিন্তু যে সম্পাদকের নেতৃত্বে দৈনিক আমার দেশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সব সময় কলম যুদ্ধ করেছে সে সম্পাদককেই সেবার রীতিমতো একজন ‘বেচারা’ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল!
প্রসঙ্গক্রমে বিশেষ করে আলোচিত হয়েছিল রিমান্ডের বিষয়টি। কারণ, মাহমুদুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি নন, সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালত প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্যজনের রিমান্ড মঞ্জুর করে চলেছে। অথচ রিমান্ডে নেয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য জানার জন্য। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় প্রত্যেককেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানছে না যে কথাটা আগেই জানানো হয়েছে। দেখা গেছে, রিমান্ড মঞ্জুর করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে বিচারকের এখতিয়ার হলেও এই সরকারের আমলে বিচারকরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। রাজনৈতিক মামলায় বিচারকদের ওপর নাকি ‘চাপ’ থাকে। এই ‘চাপ’ ক্ষমতাসীনরাই দিয়ে থাকেন। মাহমুদুর রহমানকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহেও পরিষ্কার হয়েছিল, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার চরমভাবেই অবজ্ঞা দেখাচ্ছে। এর ফলে বেশি ক্ষতি হয়েছে স্বাধীন বিচার বিভাগের। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই এ অবস্থার আশু অবসান দরকার। সরকারের উচিত অবিলম্বে মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়া এবং প্রেসের তালা খুলে দিয়ে আমার দেশ-এর প্রকাশনার সব বাধা দূর করা। এতটা অবশ্য বর্তমান সরকারের কাছে আশা করা যায় না। কারণ, গণমাধ্যমের ব্যাপারে তো বটেই বিশেষ করে ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান এবং দৈনিক আমার দেশ-এর প্রশ্নেও সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত রয়েছে। একই কারণে মাহমুদুর রহমানকে যেমন সহজে ছেড়ে দেয়া হবে না তেমনি বাজারে আসতে পারবে না দৈনিক আমার দেশও।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন