সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫

ছাত্রলীগ-যুবলীগ প্রসঙ্গ : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয়


অধুনা ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও প্রকাশ্যে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা তাদের পিতৃ ও মাতৃ সংগঠন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে হয়। বলাবাহুল্য, তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এতদিন পর্যন্ত দেশবাসী ত্যক্তবিরক্ত হলেও দল ও সরকার ছিলেন নির্বিকার। অনেকের মতে তাদের অপরাধ আমলে নেয়া এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়া অথবা সংশোধন করার ব্যাপারেও তাদের মধ্যে একটা অনীহা সর্বদা পরিলক্ষিত হয়েছে। গত ৭ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, যখনি ছাত্রলীগ, যুবলীগ অথবা ক্ষমতাসীন দলের কোনও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোনও বড় ধরনের অপরাধপ্রবণতায় জড়িয়ে পড়েছে তখনি দায়িত্বশীল মহল থেকে তার সাথে তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে হয় বলা হয়েছে যে শিবির, ছাত্রদল অথবা জামায়াত বিএনপির লোকেরা ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে ঐ জঘন্য অপরাধ করেছে অথবা অপরাধীদের অপরাধকে আমলে না নিয়েই তাদের আরো অপরাধ করার ‘লাইসেন্স’ দিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির-বিএনপির অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য সরকারি দল কমিটিও গঠন করে দিয়েছিল। কিন্তু এই কমিটির রিপোর্ট আর কখনো পাওয়া যায়নি। আর যাবেই বা কেমন করে? অপরাধী জন্ম ও রক্ত সূত্রে যেখানে আওয়ামী পরিবারের সেখানে বিএনপি-জামায়াত আসবে কোত্থেকে? অবশ্য এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন নেতাকর্মীর মধ্যে যে বাস্তব অনুভূতি মোটেই ছিল না তা নয়। ছিল বলেই সাবেক একজন মন্ত্রী ২০১০ সালে পাবনায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে গিয়ে অদ্ভূত একটি প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন এবং তা হচ্ছে নেতৃত্বে ইচ্ছুক ছাত্রদের রক্তের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা। তার হয়ত ধারণা ছিল এর মাধ্যমে মাদকাসক্তদের নেতৃত্বে আসা তিনি বন্ধ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি। বরং তার এই প্রচেষ্টার পর ছাত্রলীগ-যুবলীগের অপরাধপ্রবণতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা গেছে যে, যেখানে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি, যৌনাচার তথা ইভটিজিং সেখানেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ মাদক ব্যবসা, ইয়াবা ব্যবসা, ভর্তি বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বলপূর্বক অনৈতিক কাজে ব্যবহার সর্বত্রই তাদের অবাধ বিচরণ। তাদের অপকর্মে যে যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা তাদের মারধর-অপদস্ত করতে পিছপা হয়নি। শিক্ষক, পুলিশ-বিজিবি-র‌্যাব কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি কর্মকর্তারাও ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। এর কোনও বিচার হয়নি। আবার দলীয় নেতা বা এমপিরা যেখানে তাদের ঠেকানোর কথা, তারা তা না করে তাদের কেউ কেউ নিজেরাই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। ফলে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করেছে। যেনতেন প্রকারে অর্থবিত্ত উপার্জন, ভোগ-লালসা, নারীর সম্ভ্রমহানি, চাঁদা ভাগাভাগি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় তারা এতই লিপ্ত হয়ে পড়ে যে তাদের মধ্য থেকে দলীয় ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় এবং তারা একে অন্যের হত্যাকারীতে পরিণত হয়। গত তিন সপ্তাহে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে যারা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে অথবা যাদের পিটিয়ে মারা হয়েছে তাদের প্রত্যেকের কেসগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতিভাত হয় যে, ক্ষমতাসীনদের আস্কারায় তারা নিজেদের এতই ক্ষমতবান মনে করা শুরু করেছিল যে, তাদের দৃষ্টিতে দেশটি তাদের সা¤্রাজ্য এবং তারা নিজেরা এর স¤্রাটে পরিণত হয়েছিল, যেখানে বসবাস করতে হলে তাদের কথায় উঠতে বসতে হবে এবং সেখানে তাদের কথাই চূড়ান্ত হবে। এ জন্যে যদি কারুর সম্পত্তি, সম্মান-সতীত্ব ও জীবন দিতে হয় তা হলে তাদের কিছু আসে যায় না। এই অবস্থায় মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে; সারা দেশে ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে। এটা কারুর জন্যই শুভ হতে পারে না।
কয়েক মাস আগে ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন যে, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরাই ছাত্রলীগ করে। প্রধানমন্ত্রী এক সম্মেলনে ছাত্রলীগকে তার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছেন। গত কয়েক দিনে মন্ত্রীদের অনেকেরই গলার সুর বদলে গেছে। এটা তাদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত বাস্তব উপলব্ধিগত অনুভূতি না সস্তা পপুলারিটি কুড়ানোর কৌশল তা বলা মুশকিল। যদি বাস্তব উপলব্ধি হয় তাহলে তাদের অনেক কিছুই করার আছে বলে মনে হয়। কেননা বানরকে মাথায় তুলতে নেই। অবশ্য তাদের সবাই যে বানর তা আমি মনে করি না।
সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর একটি উক্তি দেশবাসীকে হতাশ করেছে। তিনি বলেছেন যে, লম্পট ছেলেরাই শুধু ছাত্রলীগ-যুবলীগ করে। কথাটার তাৎপর্য কি তিনি নিশ্চয়ই তা বুঝেন। তার এই মন্তব্যের পর অন্য কোন মন্ত্রী, এমপি অথবা ছাত্রলীগ-যুবলীগের কোনও নেতাকর্মী প্রতিবাদ করেননি। এই দু’টি সংগঠনের অপরাধের মাত্রা হয়ত এত তুঙ্গে উঠেছে যে তার মন্তব্যটির প্রতিবাদ করার ক্ষেত্র ও যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। বাস্তবতা যাই হোক আমি এ ধরনের প্রান্তিক মন্তব্যে হতাশ। ছাত্রলীগ-যুবলীগ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সরবরাহকারী দু’টি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান দু’টি যদি লম্পটদের প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি তা সহজেই অনুমেয়। আমার ধারণা, প্রতিষ্ঠান দু’টিতে অনেক ভাল ভাল ছেলেও আছে, তবে তাদের মূল্যায়ন নেই, এখানে গ্রেসাম্স্ ল্ হয়ত কাজ করেছে। ইধফ সড়হবু ফৎরাবং মড়ড়ফ সড়হবু ড়ঁঃ ড়ভ পরৎপঁষধঃরড়হ.  যারা নষ্ট হয়ে গেছে তাদের সংখ্যা এত বেশি যে হয়ত ভাল ছেলেরা নিজেদের এসার্ট করতে পারছে না। আওয়ামী লীগকে তার প্রয়োজন ও অস্তিত্বের স্বার্থে ভাল ছেলেদের উপরে তুলে আনা প্রয়োজন। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম-হত্যা, গুম প্রভৃতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নেতৃত্ব শূন্য করছেন। নিজ দলও যদি গুণী নেতৃত্ব হারায় তাহলে এদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়তে বাধ্য।
গত ২০ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকসহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত একটি খবর অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘একশানে সরকার : প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, ভাবমূর্তি নষ্টকারীদের কোনও ছাড় নয়। কঠোর ব্যবস্থা নিতে এসপিদের কাছে পুলিশ সদর দফতরের ই-মেইল’ শিরোনামে প্রকাশিত রিপোর্টটি তাৎপর্যপূর্ণ। কথাটি যদি সত্য হয় এবং দল-মত-নির্বিশেষে প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পায় তা হলে শুধু সরকার নয় দেশের ইমেজও উদ্ধার হবে। একটি স্বাধীন দেশের সরকার বাইরের শক্তির উপর নির্ভর করে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। নিজ দেশের জনগণের সমর্থন তার বেশি দরকার। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এই সমর্থন নিশ্চিত হয়। এই মুহূর্তে সরকারের জন্য এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
সম্প্রতি পুলিশ-র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতার নিহত হবার ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনকে আলোড়িত করে তুলেছে। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত কিছু কিছু নেতা বলবার চেষ্টা করছেন যে আমরা একশন শুরু করে দিয়েছি। নিজ দলের লোকদেরও ক্ষমা করছি না। কেউ কেউ আবার বলছেন যে, বিষয়টি লেফাফাদুরস্তির মতো হচ্ছে। এতোদিন বিরোধীদলীয় কর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার বানানো হয়েছে এবং এতে সরকার দেশে-বিদেশে বিরাট সমালোচনার মুখে পড়েছে। এখন নিজ দলের কিছু লোককে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার বানিয়ে তারা বিরোধী নিধনযজ্ঞকে আরও শক্তিশালী করতে চায়। আমি বিচারবহির্ভূত যে কোন হত্যাকাণ্ডের বিরোধী। প্রতিটি গুলীর হিসাব থাকা দরকার। যারা অপরাধী তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে আইন অনুযায়ী জেল-ফাঁসি দেয়াই আইনের শাসনের চাহিদা। এর ব্যতিক্রম হলে দেশ মগেরমুল্লুক হয়ে যায়। আইনী প্রক্রিয়ার বাইরে মানুষের জীবন যাতে বিপন্ন না হয় তা দেখা সরকারের দায়িত্ব। ছাত্রলীগ-যুবলীগের কেউ যদি অপরাধী হয় আইন অনুযায়ীই তাদের বিচার হওয়া উচিত এবং এ ক্ষেত্রে কারুর প্রভাব যাতে বিচারের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় তা দেখা সরকারের দায়িত্ব। এ প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা, অপরাধী কাউকে ছাড় না দেয়ার ঘোষণা এবং কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এসপিদের পুলিশ সদর দফতরের ই-মেলকে আমি ইতিবাচক বলে মনে করি। অবশ্য এ ধরনের নির্দেশনা ও ঘোষণার কথা আমরা আগেও শুনেছি। কিন্তু তার আমল হতে দেখিনি। ফলে হতাশ হতে হয়েছে। আমি যুবলীগ-ছাত্রলীগের দেশব্যাপী হাজার হাজার অপকর্মের মধ্যে মাত্র দু’টি উল্লেখযোগ্য কেইস এখানে উল্লেখ করতে চাই। একটি হচ্ছে মতিঝিল মেট্রোপলিটান পুলিশ সদর দফতরের অতি নিকটে ৮৯ ও ৮৯/১, আরামবাগে। ডিসিসি দক্ষিণের একজন কাউন্সিলার ও যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী উপরোক্ত দু’টি হোল্ডিং -এ অবস্থিত বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের তিনটি ভবন জবর-দখল করে গত দেড় মাস ধরে ভাড়াটিয়াদের জিম্মি করে রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা প্রদান, অপরাধীদের শাস্তি প্রদান এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাবার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃৃপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। তারা সেই সহযোগিতা এখনো পাচ্ছে না। দ্বিতীয় কেইসটি হচ্ছে ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার গজারিয়া বাজারের। সেখানে যুবলীগ-ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী কয়েকটি হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি জবর-দখল করে রেখেছে। সেখানে থানা পুলিশ দখল মুক্ত করার জন্য গিয়ে হামলা ও মারধরের শিকার হয়ে থানায় এসে মামলা করেছে। ইনসেটে এই মামলার বিবরণী পাঠকদের সুবিধার জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো অতি সাম্প্রতিক। আমি আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনও প্রকার অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এতে আইনের শাসন শক্তিশালী হবে। সরকারের দুর্নাম ঘুচবে।­
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads