লাই দিতে দিতে জন প্রতিনিধিত্বহীন সরকার পুলিশ বাহিনীকে কোথায় নিয়ে তুলেছে, সেটা বোঝার ক্ষমতাও বোধ করি তারা হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা এখন তাদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে হামেশাই রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কখনও কখনও মনে হচ্ছে, সরকার এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা নিজেরা না বলে পুলিশে বাহিনীকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন, যেভাবে তারা অনেক রাজনৈতিক ইস্যু আদালতের মাধ্যম সমাধান করার চেষ্টা করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার যা বলে থাকে, তা হচ্ছে, আদালত আদেশ দিয়েছে, আমাদের কী বলার আছে। এখন হয়তো বলবে, পুলিশ বলেছে, আমাদের কী বলার আছে। যেন পুলিশ আদালতর মতো একটি রাষ্ট্রীয় স্তম্ভে পরিণত হয়েছে।
পুলিশের প্রাথমিক দায়িত্ব দেশের আইন-শৃঙ্খরা রক্ষা করা। সেদিকে তাদের মনোযোগ এখন অতি সামান্যই। বরং সরকারি নির্দেশে ও মদতে তারা সরকার সমর্থক একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। না, পুলিশ কিছুতেই বিচার বিভাগের মতো স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বিচার করার দায়িত্বও দেশের সংবিধান বা কোনো আদালত তাদের দেয়নি। রাজনৈতিক দলের কোনো বক্তব্যের জবাব এ পর্যন্ত রাজনীতিকরাই দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তার মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটতে শুরু করেছে। সরকারের তরফ থেকেও বলা হচ্ছে রাজনীতিকরা পুলিশ সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দিলে সে বক্তব্যের জবাব দেবার অধিকার পুলিশের রয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে তো পুলিশেরই দেশ চালাবার কথা, রাজনীতিকদের নয়।
পুলিশের কর্মকান্ড দেখে কখনও কখনও মনে হচ্ছে, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এই প্রবণতা সরকারের জন্য কতখানি বিপজ্জনক, সেটা সরকারের উপলব্ধি করার দরকার আছে। পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার অধিকার এই কারণে দেওয়া হয়নি যে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি। সরকারের পরিবর্তন হয়, কিন্তু সরকারি কর্মচারিরা তাদের চাকরিতে বহাল থাকেন এবং নতুন সরকারের অধীনে তাদের নির্দেশেই এসব কর্মচারিকে কাজ করে যেতে হয়। বর্তমান সরকারের মেয়াদ কেয়ামত পর্যন্ত নয়। তাদের যেতে হবে। অতএব অতি উৎসাহ ছেড়ে পুলিশের উচিত তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। কিন্তু পুলিশ নির্ভর সরকার তাদের ব্যবহার করে করে একটি দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করে ফেলছে।
এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য কী হয়, তার প্রমাণ আছে দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র ইকুয়েডরে। সেখানকার প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ক্যারেরা পুলিশকে সীমাহীন শক্তি দিয়ে আর বিরোধীদের দমনে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। পুলিশের শুধু চাই আর চাই। পুলিশের খাঁই মেটাতে মেটাতে এক সময় অতীষ্ঠ হয়ে পড়েন ক্যারেরা। এরই পরিণতিতে আরও দাবি-দাওয়া নিয়ে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইকুয়েডরে পুলিশই এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্যারেরাকে সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে বসে। পুলিশ ইকুয়েডরের সকল মহাসড়ক অবরোধ করে, জাতীয় সংসদ ভবন, বিমানবন্দরসমূহ ও টিভি স্টেশনগুলো দখল করে নেয়। সরকারের কাছে আরও সুবিধা দাবি করে না পাওয়ায় তারা এই কান্ড ঘটায়। তারা সার দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। দেশের সাতটি প্রদেশের রাজধানীসহ সর্বত্র এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
পুলিশ বাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে রাফায়েল ক্যারেরা পরিস্থিতি শান্ত করতে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন পুলিশ সদর দফতরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পুলিশ বাহিনীর হাতে মার খেয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশেরা হাসপাতালও ঘেরাও করে রাখে। ক্যারেরা সেখান থেকে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ক্যারেরা অভিযোগ করেন যে, এর পেছনে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ছিল। তবে ১০ দিন পর পুলিশের অন্য সব দাবি মেনে নিলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দূর হয়নি।
তার কিছু প্রমাণ আমরা পেলাম ডিসি বা জেলা প্রশাসক সম্মেলনে। গত ২৮, ২৯, ৩০ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জেলা প্রশাসকদের সম্মেলন। সে সম্মেলনে জেলা প্রশাসকরা সকল ভয়ডর উপেক্ষা করেই পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে তাদের ক্ষোভের কথা বলে গেছেন। তারা বলেছেন, পুলিশের এসপি কথা শোনেন না। ডাকলে আসেন না। আর এসপি আসেন না বলেই জেলার কোনো কর্মকর্তাই ডিসির ডাকে সাড়া দেন না। চমৎকার চলছে প্রশাসন। সরকার জেলাগুলোকে দেশের প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করার পর জেলা প্রশাসকেরই হবার কথা জেলার প্রধান কর্মকর্তা। পাকিস্তান আমল থেকেই এ ব্যবস্থা বহাল ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালের সময় প্রশাসনিক কিছু পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হলেও দেশের প্রশাসনিক ইউনিট জেলাই ছিল। তাতে কাজের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।
কিন্তু ২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনের পর থেকেই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনের চেয়ে পুলিশের ওপরই অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর তখন থেকেই বিরোধী দল নির্মূলের অভিযানে নামে সরকার। আর ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে কিছু লোকের নাম ঘোষণা করে দিয়ে তাদের এমপি বানানো হয়। সেই জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদ দিয়েই চলছে সরকার। কিন্তু সিনাজুরির অভাব নেই তাদের। আর এই সিনাজুরি শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে বিরোধী দল দমনে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা করছে না। অভিযোগ আছে, সরকার খুন, গুম, মামলা, হামলা সব কিছু যথাসম্ভব করাচ্ছে পুলিশ দিয়ে। আর পুলিশের সহযোগী শক্তি হিসেবে হায়েনার মতো লেলিয়ে দিয়েছে তাদের ঘাতক বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগকে। পুলিশের দায়মুক্তি তাই এখন সভ্য সমাজের সকল নিয়মনীতির বাইরে চলে গিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ তার অধিকার ও ক্ষমতার গন্ডি পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। সরকার যখন দমন-পীড়ন গুম-খুনে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, তখন পুলিশ নিজেও ফায়দা হাসিলের জন্য গুম খুন অপহরণ মুক্তিপণের মতো ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়ছে। সেক্ষেত্রে সরকারের আর কিছুই করার থাকে না। এখন হরহামেশাই তেমন ঘটনা ঘটছে। আর সরকারকে পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইতে হচ্ছে। সদ্য পদোন্নতি পাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও কখনও কখনও পুলিশের কাছে অসহায় বলে মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছিলেন যে, বাংলা নববর্ষে যারা ঢাকা বিশাববিদ্যালয় চত্বরে নারীদের লাঞ্ছিত করেছিল, তাদের কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। শিগগিরই অন্যদেরও আটক করা হবে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের তরফ থেকে জানানো হলো যে, না না তারা ঐ ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করেনি।
ঐ বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদকারী ছাত্ররা নির্যাতনকারী কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেছিল। কিন্তু শাহবাগ থানা এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের চা খাইয়ে সসম্মানে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল যে, ভিডিও ফুটেজ দেখে নারীদের শ্লীলতাহানিকারী কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পত্রপত্রিকায় ভিডিও ফুটেজ থেকে তাদের স্পষ্ট ছবি প্রকাশ করে দেয়। তখন পুলিশ নারীর শ্লীলতাহানিকারীদের ছবি নিজেরাই প্রকাশ করে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যে, কেউ যদি এদের ধরিয়ে দিতে পারে, তবে তাদের লক্ষ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। তবু আজ পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যাকারীদের একজনকে অর্থের বিনিময়ে সৌদি আরব পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল পুলিশ। প্রথমে তাদের ব্যাপারে চুপ করেই ছিল সরকার। কিন্তু জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ধারণা করি, শিগগিরই তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে অন্য কোনো থানায় পোস্টিং দেওয়া হবে।
গত ০১ আগস্ট মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে দেশে মত প্রকশের স্বাধীনতা হরণ ও সভাসমাবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিচার বহির্র্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হয়েছে পাঁচ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৪৭৫ জন। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিরোধী দলের ৪০ জন নেতাকর্মীকে গুম করা হয়। তাদের মধ্যে ৯ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ২১ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন। সেই সাথে বিচারহীনতার কারণে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের জমি দখল, হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। তাছাড়া জুলাই মাসেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, যৌতুক-সহিংসতা ও এসিড-সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুর্বৃত্তায়নের ফলে অন্তর্দলীয় অসংখ্য কোন্দলের ঘটনা ঘটেছে। এসব কোন্দলের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অন্যায় স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে। এসব সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের ও মতের সভাসমাবেশ ও মিছিলে বাধা দিচ্ছে এবং পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের দিয়ে হামলা চালাচ্ছে। রমজানের সময়ও বিরোধী দলের ইফতার মাহফিলে ক্ষমতাসীন দলের দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনও এ বিষয়ে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের বাহাদুরি এখন শুধুমাত্র দুর্বলের ওপর। মনে হয়, এতেও ক্ষুব্ধ হয়েছে পুলিশ। পুলিশের সদর দফতর থেকে গত ২ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ সরাসরি ঐ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছে এবং তাদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পুলিশ বলেছে, সংস্থা দুটির বক্তব্য বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী, যা আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। পুলিশ আত্মরক্ষার অধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করেছে কিনা, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে কিনা, তা অনুসন্ধান করেন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন নির্বাহী কমিটি। এমন কি সেটা আদালতেও বিচারযোগ্য। আত্মরক্ষার অধিকার প্রযোগে পুলিশের ভূমিকা আইনানুগ কি বেআইনি, সেটা বলার এখতিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের। জুলাই মাসে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালত বিচারবহির্ভূত বলেননি। আগ বাড়িয়ে ঐ এনজিও দুটো বাংলাদেশ পুলিশের ওপর হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপাচ্ছে। এটা মানহানিকর ও ফৌজদারি অপরাধের শামিল। আদালতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অধিকার কোনো এনজিওকে দেয়নি দেশের আইন। তাই ঐ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে দুটো এনজিওর বক্তব্য এদেশের আইন এবং আদালতকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। ঐ দুটি সংগঠন যেভাবে মন্তব্য করছে, তা বেআইনি। পুলিশের কাজের আইনগত দিক নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে আদালতের । তারা এধরনের কথা বলার অধিকার রাখে না।
আমরাও বলতে চাই, কে কি অধিকার রাখে আর না রাখে, সে সিদ্ধান্ত পুলিশ নাই বা নিল, তেমন সিদ্ধান্ত আদালতই নিন।
পুলিশের প্রাথমিক দায়িত্ব দেশের আইন-শৃঙ্খরা রক্ষা করা। সেদিকে তাদের মনোযোগ এখন অতি সামান্যই। বরং সরকারি নির্দেশে ও মদতে তারা সরকার সমর্থক একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। না, পুলিশ কিছুতেই বিচার বিভাগের মতো স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বিচার করার দায়িত্বও দেশের সংবিধান বা কোনো আদালত তাদের দেয়নি। রাজনৈতিক দলের কোনো বক্তব্যের জবাব এ পর্যন্ত রাজনীতিকরাই দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তার মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটতে শুরু করেছে। সরকারের তরফ থেকেও বলা হচ্ছে রাজনীতিকরা পুলিশ সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দিলে সে বক্তব্যের জবাব দেবার অধিকার পুলিশের রয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে তো পুলিশেরই দেশ চালাবার কথা, রাজনীতিকদের নয়।
পুলিশের কর্মকান্ড দেখে কখনও কখনও মনে হচ্ছে, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। এই প্রবণতা সরকারের জন্য কতখানি বিপজ্জনক, সেটা সরকারের উপলব্ধি করার দরকার আছে। পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার অধিকার এই কারণে দেওয়া হয়নি যে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি। সরকারের পরিবর্তন হয়, কিন্তু সরকারি কর্মচারিরা তাদের চাকরিতে বহাল থাকেন এবং নতুন সরকারের অধীনে তাদের নির্দেশেই এসব কর্মচারিকে কাজ করে যেতে হয়। বর্তমান সরকারের মেয়াদ কেয়ামত পর্যন্ত নয়। তাদের যেতে হবে। অতএব অতি উৎসাহ ছেড়ে পুলিশের উচিত তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। কিন্তু পুলিশ নির্ভর সরকার তাদের ব্যবহার করে করে একটি দানবীয় বাহিনীতে পরিণত করে ফেলছে।
এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্য কী হয়, তার প্রমাণ আছে দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র ইকুয়েডরে। সেখানকার প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ক্যারেরা পুলিশকে সীমাহীন শক্তি দিয়ে আর বিরোধীদের দমনে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। পুলিশের শুধু চাই আর চাই। পুলিশের খাঁই মেটাতে মেটাতে এক সময় অতীষ্ঠ হয়ে পড়েন ক্যারেরা। এরই পরিণতিতে আরও দাবি-দাওয়া নিয়ে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইকুয়েডরে পুলিশই এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্যারেরাকে সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে বসে। পুলিশ ইকুয়েডরের সকল মহাসড়ক অবরোধ করে, জাতীয় সংসদ ভবন, বিমানবন্দরসমূহ ও টিভি স্টেশনগুলো দখল করে নেয়। সরকারের কাছে আরও সুবিধা দাবি করে না পাওয়ায় তারা এই কান্ড ঘটায়। তারা সার দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। দেশের সাতটি প্রদেশের রাজধানীসহ সর্বত্র এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
পুলিশ বাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে রাফায়েল ক্যারেরা পরিস্থিতি শান্ত করতে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন পুলিশ সদর দফতরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পুলিশ বাহিনীর হাতে মার খেয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পুলিশেরা হাসপাতালও ঘেরাও করে রাখে। ক্যারেরা সেখান থেকে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ক্যারেরা অভিযোগ করেন যে, এর পেছনে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা ছিল। তবে ১০ দিন পর পুলিশের অন্য সব দাবি মেনে নিলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দূর হয়নি।
তার কিছু প্রমাণ আমরা পেলাম ডিসি বা জেলা প্রশাসক সম্মেলনে। গত ২৮, ২৯, ৩০ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জেলা প্রশাসকদের সম্মেলন। সে সম্মেলনে জেলা প্রশাসকরা সকল ভয়ডর উপেক্ষা করেই পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে তাদের ক্ষোভের কথা বলে গেছেন। তারা বলেছেন, পুলিশের এসপি কথা শোনেন না। ডাকলে আসেন না। আর এসপি আসেন না বলেই জেলার কোনো কর্মকর্তাই ডিসির ডাকে সাড়া দেন না। চমৎকার চলছে প্রশাসন। সরকার জেলাগুলোকে দেশের প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করার পর জেলা প্রশাসকেরই হবার কথা জেলার প্রধান কর্মকর্তা। পাকিস্তান আমল থেকেই এ ব্যবস্থা বহাল ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালের সময় প্রশাসনিক কিছু পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হলেও দেশের প্রশাসনিক ইউনিট জেলাই ছিল। তাতে কাজের কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।
কিন্তু ২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনের পর থেকেই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসনের চেয়ে পুলিশের ওপরই অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর তখন থেকেই বিরোধী দল নির্মূলের অভিযানে নামে সরকার। আর ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে কিছু লোকের নাম ঘোষণা করে দিয়ে তাদের এমপি বানানো হয়। সেই জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদ দিয়েই চলছে সরকার। কিন্তু সিনাজুরির অভাব নেই তাদের। আর এই সিনাজুরি শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে বিরোধী দল দমনে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা করছে না। অভিযোগ আছে, সরকার খুন, গুম, মামলা, হামলা সব কিছু যথাসম্ভব করাচ্ছে পুলিশ দিয়ে। আর পুলিশের সহযোগী শক্তি হিসেবে হায়েনার মতো লেলিয়ে দিয়েছে তাদের ঘাতক বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগকে। পুলিশের দায়মুক্তি তাই এখন সভ্য সমাজের সকল নিয়মনীতির বাইরে চলে গিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ তার অধিকার ও ক্ষমতার গন্ডি পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। সরকার যখন দমন-পীড়ন গুম-খুনে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, তখন পুলিশ নিজেও ফায়দা হাসিলের জন্য গুম খুন অপহরণ মুক্তিপণের মতো ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়ছে। সেক্ষেত্রে সরকারের আর কিছুই করার থাকে না। এখন হরহামেশাই তেমন ঘটনা ঘটছে। আর সরকারকে পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইতে হচ্ছে। সদ্য পদোন্নতি পাওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও কখনও কখনও পুলিশের কাছে অসহায় বলে মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছিলেন যে, বাংলা নববর্ষে যারা ঢাকা বিশাববিদ্যালয় চত্বরে নারীদের লাঞ্ছিত করেছিল, তাদের কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। শিগগিরই অন্যদেরও আটক করা হবে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের তরফ থেকে জানানো হলো যে, না না তারা ঐ ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করেনি।
ঐ বর্বরোচিত নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদকারী ছাত্ররা নির্যাতনকারী কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেছিল। কিন্তু শাহবাগ থানা এক ঘণ্টার মধ্যে তাদের চা খাইয়ে সসম্মানে ছেড়ে দিয়ে বলেছিল যে, ভিডিও ফুটেজ দেখে নারীদের শ্লীলতাহানিকারী কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পত্রপত্রিকায় ভিডিও ফুটেজ থেকে তাদের স্পষ্ট ছবি প্রকাশ করে দেয়। তখন পুলিশ নারীর শ্লীলতাহানিকারীদের ছবি নিজেরাই প্রকাশ করে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যে, কেউ যদি এদের ধরিয়ে দিতে পারে, তবে তাদের লক্ষ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। তবু আজ পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যাকারীদের একজনকে অর্থের বিনিময়ে সৌদি আরব পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল পুলিশ। প্রথমে তাদের ব্যাপারে চুপ করেই ছিল সরকার। কিন্তু জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ধারণা করি, শিগগিরই তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ বাতিল করে অন্য কোনো থানায় পোস্টিং দেওয়া হবে।
গত ০১ আগস্ট মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে দেশে মত প্রকশের স্বাধীনতা হরণ ও সভাসমাবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিচার বহির্র্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে নিহত হয়েছে পাঁচ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৪৭৫ জন। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিরোধী দলের ৪০ জন নেতাকর্মীকে গুম করা হয়। তাদের মধ্যে ৯ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ২১ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১০ জন। সেই সাথে বিচারহীনতার কারণে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের জমি দখল, হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। তাছাড়া জুলাই মাসেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, যৌতুক-সহিংসতা ও এসিড-সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুর্বৃত্তায়নের ফলে অন্তর্দলীয় অসংখ্য কোন্দলের ঘটনা ঘটেছে। এসব কোন্দলের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অন্যায় স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে। এসব সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের ও মতের সভাসমাবেশ ও মিছিলে বাধা দিচ্ছে এবং পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের দিয়ে হামলা চালাচ্ছে। রমজানের সময়ও বিরোধী দলের ইফতার মাহফিলে ক্ষমতাসীন দলের দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়েছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনও এ বিষয়ে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, রাষ্ট্রের বাহাদুরি এখন শুধুমাত্র দুর্বলের ওপর। মনে হয়, এতেও ক্ষুব্ধ হয়েছে পুলিশ। পুলিশের সদর দফতর থেকে গত ২ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ সরাসরি ঐ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছে এবং তাদের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পুলিশ বলেছে, সংস্থা দুটির বক্তব্য বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী, যা আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। পুলিশ আত্মরক্ষার অধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করেছে কিনা, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে কিনা, তা অনুসন্ধান করেন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বাধীন নির্বাহী কমিটি। এমন কি সেটা আদালতেও বিচারযোগ্য। আত্মরক্ষার অধিকার প্রযোগে পুলিশের ভূমিকা আইনানুগ কি বেআইনি, সেটা বলার এখতিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের। জুলাই মাসে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালত বিচারবহির্ভূত বলেননি। আগ বাড়িয়ে ঐ এনজিও দুটো বাংলাদেশ পুলিশের ওপর হত্যাকাণ্ডের দায়ভার চাপাচ্ছে। এটা মানহানিকর ও ফৌজদারি অপরাধের শামিল। আদালতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অধিকার কোনো এনজিওকে দেয়নি দেশের আইন। তাই ঐ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে দুটো এনজিওর বক্তব্য এদেশের আইন এবং আদালতকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। ঐ দুটি সংগঠন যেভাবে মন্তব্য করছে, তা বেআইনি। পুলিশের কাজের আইনগত দিক নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে আদালতের । তারা এধরনের কথা বলার অধিকার রাখে না।
আমরাও বলতে চাই, কে কি অধিকার রাখে আর না রাখে, সে সিদ্ধান্ত পুলিশ নাই বা নিল, তেমন সিদ্ধান্ত আদালতই নিন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন