ব্রিটিশ শাসনমুক্ত স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর একটি স্বপ্ন বা পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন পর্যায়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। অমন আলোচনা অবশ্যই বিনা কারণে শুরু হয়নি। আলোচনার পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সকল মহলে উদ্বেগ-আশংকাও প্রবলভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে। কেন- সে প্রশ্নের উত্তর এই নিবন্ধ পড়লে পাঠকরা নিজেরাই পেয়ে যাবেন। সেদিকে যাওয়ার আগে পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু সম্পর্কে সংক্ষেপে জানানো দরকার। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশরা বিদায় নেয়ার পর এই নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। নামে গণতন্ত্রের পূজারী হলেও পদটিতে ছিলেন তিনি ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর সময় পর্যন্ত। ওই সময়কালে পাঁচ বছর পর পর জাতীয় তথা লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচন নিয়মিতভাবেই হয়েছে, কিন্তু মিস্টার নেহরুকে কেউ সরাতে পারেননি। দুর্দান্ত ক্ষমতাধর নেহরুর ক্ষমতালিপ্সাও যথেষ্টই ছিল। বাংলাদেশের স্টাইলে পারিবারিক রাজত্বের ভিত্তিও তিনিই স্থাপন করে গেছেন। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে শত শত যোগ্য, ত্যাগী, সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতা থাকা সত্ত্বেও নিজের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি দলের প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলেন। সে অবস্থানের সূত্র ধরেই ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ইন্দিরার পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তার ছেলে রাজিব গান্ধী। কংগ্রেসের বর্তমান নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ। এখন প্রস্তুতি চলছে ইন্দিরার নাতি ও সোনিয়া-রাজিবের ছেলে রাহুল গান্ধীকে দলের নেতৃত্বে আনার এবং সম্ভব হলে প্রধানমন্ত্রী বানানোর। গত বছরের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটায় রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হতে না পারলেও ভারত এখনো নেহরু ডাইনেস্টির রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপটে তাই বলা যায়, জওয়াহেরলাল নেহরু সাধারণ কোনো নেতা ছিলেন না। ‘মহাত্মা’ নামে পরিচিত মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধীর আবির্ভাব না ঘটলে ভারতীয়দের জাতির পিতার আসনটিও নেহরুর দখলেই চলে যেতো। সে যোগ্যতা তার ছিল।
এবার পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুকে টেনে আনার কারণ সম্পর্কে বলা যাক। বিটিশরা বিদায় নিলেও মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান যাতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে ব্যাপারে গান্ধী ও নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং ভারতীয় হিন্দুরা শেষ পর্যন্তও চেষ্টা করেছিল। দাঙ্গার অড়ালে তাদের হাতে হাজার হাজার মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশুর অসহায় মৃত্যু ঘটেছে। এত কিছুর পরও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় দলের ভেতরে-বাইরে তীব্র নিন্দা-সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন গান্ধী ও নেহরু। মিস্টার গান্ধীকে তো মেরেই ফেলা হয়েছিল। অমন এক অবস্থার মধ্যেই নেহরু তার ঐতিহাসিক ভিশন বা স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভারত মাতার’ এই বিভক্তি নিতান্তই সাময়িক ব্যাপার। ভারতকে আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। অর্থাৎ এক রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে- ‘ভারত মাতা’ অখ-ই থাকবে। নেহরুর এ ‘ভিশন’কে দলীয় প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করেছিল কংগ্রেস। এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের মাস ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নেতৃত্বে ‘ভারত মাতাকে’ অখণ্ড তথা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কর্মকাণ্ডও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ছয় মাসের জন্য কোলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, ছয় মাসের প্রশ্ন ওঠে না, ছয় ঘণ্টার জন্যও ঢাকাকে কোলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আগ্রহী পাঠকরা এসব বিষয়ে জানার জন্য আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ দুটি পড়ে দেখতে পারেন। দেখবেন, পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে কতটা ভয়ংকর ও হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন নেহরুসহ ভারতের হিন্দু নেতারা।
এভাবেই শুরু হয়েছিল। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনো। পাকিস্তানের ভাংগন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটার পর ভারতীয়দের তৎপরতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের সম্প্রসারণবাদী নীতি-কৌশল ও অসংখ্য কর্মকা-ের উল্লেখ করা সম্ভব। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীর ঢাকা সফরকেন্দ্রিক আলোচনা এখনো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বের সঙ্গেই চলছে। মিস্টার মোদীর এ সফরকালে স্বাক্ষরিত ডজন ডজন চুক্তি ও সমঝোতাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ আদৌ কিছু পেয়েছে কি না, নাকি নেহরুর সেই ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারতই সবকিছু নিয়ে গেছে- এসব প্রশ্নও প্রাধান্যে উঠে এসেছে। উদ্বিগ্ন দেশপ্রেমিকরা প্রসঙ্গক্রমে ‘সিকিম সিনড্রম’-এর কথা তুলেছেন। সেই সাথে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে লেন্দুপ দর্জির নামও। এই লেন্দুপ দর্জি ছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিমের শেষ প্রধানমন্ত্রী। সিকিমের ‘মির জাফর’ হিসেবে নিন্দিত ও ঘৃণিত রাজনীতিক লেন্দুপ দর্জির পরিণতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেকে তার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো কোনো বিশেষজনকে লেন্দুপ দর্জির ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।
হঠাৎ কেন ‘সিকিম সিনড্রম’ নিয়ে আলোচনা প্রাধান্যে এসেছে এবং লেন্দুপ দর্জির নামই বা কেন বারবার উঠে আসছে তার কারণ জানার জন্য ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সিকিমও স্বাধীন রাষ্ট্রের অবস্থান অর্জন করেছিল। গায়ের জোরে হায়দরাবাদসহ ক্ষুদ্র কয়েকটি রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু সিকিমের স্বাধীনতা হরণ করা থেকে বিরত ছিলেন। অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল ১৯৬৮ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং গঠিত হওয়ার পর। ‘র’ সিকিম ও ভুটানকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৮ সালেই জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়ে যাওয়ায় ভুটান ‘র’-এর হাতছাড়া হয়ে যায়। ‘র’ তখন সিকিমের দিকে হাত বাড়ায় এবং দালাল হিসেবে বেছে নেয় রাজনীতিক লেন্দুপ দর্জিকে। লেন্দুপ ছিলেন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (সিএনসি)-এর নেতা। ‘র’-এর প্ররোচনায় সিএনসি রাজা চোগিয়ালের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। সিকিমবাসীকে বোঝানো হয়, রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানো গেলেই তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে। গবেষণায় ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিএনসির সে আন্দোলনে ‘র’ প্রায় প্রকাশ্যেই অংশ নিয়েছিল। হাজার হাজার ভারতীয় সেনাকে সে সময় মিছিলে ও সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। কিন্তু সিকিমবাসীর মতো একই পার্বত্য চেহারার ছিল বলে তাদের পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়নি।
রাজতন্ত্র বিরোধী ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সিএনসি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে দেশটির সংসদে ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টিতে বিজয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন লেন্দুপ দর্জি। নিরংকুশ এ বিজয়কেই লেন্দুপ দর্জি ভারতের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। সংসদের মাধ্যমে প্রথমে তিনি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়েছিলেন সিকিমকে ভারতের রাজ্য বানানোর পদক্ষেপ। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল একটি লোক দেখানো গণভোটের আয়োজন করা হলেও ‘র’-এর সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সাধারণ সিকিমবাসী ভোট দেয়ারই সুযোগ পায়নি। ফলে তথাকথিত গণভোটে ভারতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব পাস হয়েছিল। ক’দিন পর, ১৯৭৫ সালেরই ২৬ এপ্রিল সিকিমের সংসদ সিকিমকে ভারতের রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছিল। সে অনুরোধের ভিত্তিতে সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুগ্রহে সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন লেন্দুপ দর্জি। এভাবেই জাতীয় পর্যায়ের একজন জনপ্রিয় নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতা খুইয়েছিল সিকিম। সর্বাত্মকভাবে ভারতের দালালি করলেও লেন্দুপ দর্জিকে অবশ্য মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে হয়েছিল। মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৭৯ সালেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে সিকিমবাসী তাকে ঘৃণার সঙ্গে বিতাড়িত করেছিল। জনগণ তাকে এতটাই ঘৃণা করেছে যে, মৃত্যুর সময়ও লেন্দুপ দর্জি সিকিমে আসতে পারেননি। ভারতের কলিমপঙে ২০০৭ সালে তাকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। মৃত্যুর আগে দেয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলে গেছেন, দিল্লি অর্থাৎ ভারত সরকার তাকে আগের মতো সম্মান দেখানো দূরে থাকুক, সামান্য পাত্তাও দেয় না। দ্বিতীয় সারির কোনো ভারতীয় নেতার সঙ্গে কথা বলার জন্যও তাকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়।
বর্তমান বাংলাদেশে কেন সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জিকে নিয়ে জোর আলোচনা চলছে তার কারণ সম্ভবত পৃথকভাবে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত লক্ষ্য করলেই আশংকার কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সেবার লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ‘রোডম্যাপ’-এর পটভূমি রচনা করা হয়েছিল। সবশেষে শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ ক্ষমতা দখলকারী মইন-ফখরুদ্দিনরা এমন এক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন যে নির্বাচনে মিনিটে ১৭ জন পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছে বলে দেখানো হয়েছিল। এ ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ, নিজের ভোটার নাম্বার ও নাম-ঠিকানা জানিয়ে ও মুরি বইতে স্বাক্ষর দিয়ে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করা, আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগানো, পোলিং বুথের ভেতরে যাওয়া, পছন্দের প্রার্থীর ঘরে সিল মারা এবং ব্যালট পেপার ভাঁজ করে স্বচ্ছ বাক্সে ফেলা পর্যন্ত কাজগুলো সারতে হলে কম করে হলেও পাঁচ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগার কথা। সুতরাং প্রতি মিনিটে ১৭ জন করে ভোটারের পক্ষে ভোট দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ভোটের ব্যবধানও চৌর্যবৃত্তির বিষয়টিকে পরিষ্কার করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক কোটি ৫৮ লাখ এবং বিএনপি এক কোটি ৪২ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল ১৬ লাখ ভোটের। এর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই কোটি ২৩ লাখ এবং বিএনপি দুই কোটি ২৮ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখ ভোটের। এটাও স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনে দুই প্রধান দলের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান দেখানো হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ! দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট যেখানে বেড়েছে এক কোটি ১৯ লাখ, বিএনপির সেখানে বেড়েছিল মাত্র তিন লাখ! এত বিরাট ব্যবধান শুধু অস্বাভাবিক নয়, অগ্রহণযোগ্যও। কিন্তু সেটাই ঘটানো হয়েছিল। ঠিক কোন দেশ এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছিল সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে অনেক আগেই। সে দেশের সে ঋণই শোধ করা হচ্ছে বিগত প্রায় সাত বছর ধরে।
এরই ধারাবাহিকতায়ই আয়োজিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল অনেক আগে থেকে। মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের পতন ঘটবে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সম্পর্কিত রায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পাশাপাশি সংবিধানে এমনভাবেই নানা সংশোধনী আনা হয়েছে যার ফলে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে কারো পক্ষেই নির্বাচনে জিতে আসা এবং সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। এতকিছুর পরও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি ক্ষমতাসীনরা। তার সরকার তাই র্যাব পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এবং গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদেরও মাঠে নামিয়েছিল। গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালানো হয়েছে গুম ও হত্যার অভিযান। একযোগে প্রতারণার কৌশলও নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সংলাপ ও সমঝোতার আড়ালে একদিকে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেছেন, অন্যদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে ঠেলে দিয়েছেন নির্বাচনের বাইরে। ১৫৩ জন এমপিকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ করার রেকর্ড গড়েই থেমে যাননি তারা, একই সঙ্গে ভোট জালিয়াতিও করেছেন যথেচ্ছভাবে। পাঁচ থেকে সাত শতাংশের বেশি ভোট না পড়লেও দাবি করেছেন, ভোট নাকি পড়েছে ৪০ শতাংশ! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কথাটা এমনভাবে বলেছেন, যেন ওটা ৪০ নয়, ৮০ শতাংশ! অনন্দে উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্যই করেননি যে, প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার মধ্যে আর যা-ই হোক, গর্বের কিছু থাকতে পারে না। কারণ, ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার অর্থ হলো, বাকি ৬০ শতাংশ ভোটার তাকে ভোট দেননি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অংকে এতটা কাঁচা নন যে ৪০ এবং ৬০-এর মধ্যকার পার্থক্যটুকু তিনি বুঝতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও একদিকে বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায় ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদণ্ডহীন’ নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য এবং সম্ভবত তারই নির্দেশে ৩৯ দশমিক ৮৯ শতাংশের একটা হিসাব দাঁড় করিয়েছে, অন্যদিকে লজ্জা-শরমের মুণ্ডু চিবিয়ে খেয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে হিসাবটিকেই আঁকড়ে ধরেছেন। জনগণকেও তিনি সে কথাটাই শুনিয়ে ছেড়েছেন।
দেশপ্রেমিকদের মধ্যে উদ্বেগ-আশংকাও ছড়িয়ে পড়েছে এই মিথ্যাচারের কারণে, সেজন্যই প্রাধান্যে এসেছে ‘সিকিম সিনড্রম’ ও লেন্দুপ দর্জির প্রসঙ্গ। কারণ, এ শুধু প্রতিপক্ষগুলোর অভিযোগ নয়, ঘটনাপ্রবাহেও প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা এগোচ্ছেন দেশকে একদলীয় শাসনের অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। সংবিধানের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা আসলে সেটাই নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফলে আগামী দিনগুলোতে দেশে গণতন্ত্রই শুধু ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না, জনগণের ওপর আবারও চেপে বসতে পারে বাকশালের মতো একদলীয় শাসন। আর গণতন্ত্র যদি না থাকে তাহলে এক পর্যায়ে টান পড়তে পারে দেশের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়েও। পরিণতিতে বিপন্ন হতে পারে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এখানেই এসেছে সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। এ কথাটা বলে জনগণকে সাবধান করে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়াও। তিনি সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জির উদাহরণ দিয়ে যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। লেন্দুপ দর্জির পরিণতি ও সিকিমের ইতিহাস থেকে বেছে বেছে বিশেষ একজনকেই কেন তিনি শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তার কারণ নিয়ে সম্ভবত কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না।
এতক্ষণে পাঠকরা সম্ভবত নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। শেষ করার আগে শুধু এটুকু জানিয়ে রাখাই যথেষ্ট যে, দেশপ্রেমিকরা অবশ্য বাংলাদেশকে কারও পক্ষে গিলে খাওয়ার বিষয়টি সহজে সম্ভব হবে বলে মনে করেন না। কারণ, মওলানা ভাসানী থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত এমন অনেক নেতাই এদেশে রাজনীতি করে গেছেন, যারা কখনো সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। কথাটা ভারতীয়দের মতো লেন্দুপ দর্জি হতে ইচ্ছুকদেরও নিশ্চয়ই জানা রয়েছে।
এবার পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুকে টেনে আনার কারণ সম্পর্কে বলা যাক। বিটিশরা বিদায় নিলেও মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান যাতে প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে ব্যাপারে গান্ধী ও নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস এবং ভারতীয় হিন্দুরা শেষ পর্যন্তও চেষ্টা করেছিল। দাঙ্গার অড়ালে তাদের হাতে হাজার হাজার মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশুর অসহায় মৃত্যু ঘটেছে। এত কিছুর পরও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় দলের ভেতরে-বাইরে তীব্র নিন্দা-সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন গান্ধী ও নেহরু। মিস্টার গান্ধীকে তো মেরেই ফেলা হয়েছিল। অমন এক অবস্থার মধ্যেই নেহরু তার ঐতিহাসিক ভিশন বা স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘ভারত মাতার’ এই বিভক্তি নিতান্তই সাময়িক ব্যাপার। ভারতকে আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। অর্থাৎ এক রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে- ‘ভারত মাতা’ অখ-ই থাকবে। নেহরুর এ ‘ভিশন’কে দলীয় প্রস্তাব আকারে গ্রহণ করেছিল কংগ্রেস। এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের মাস ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নেতৃত্বে ‘ভারত মাতাকে’ অখণ্ড তথা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কর্মকাণ্ডও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ছয় মাসের জন্য কোলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, ছয় মাসের প্রশ্ন ওঠে না, ছয় ঘণ্টার জন্যও ঢাকাকে কোলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। আগ্রহী পাঠকরা এসব বিষয়ে জানার জন্য আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ দুটি পড়ে দেখতে পারেন। দেখবেন, পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে কতটা ভয়ংকর ও হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন নেহরুসহ ভারতের হিন্দু নেতারা।
এভাবেই শুরু হয়েছিল। সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে এখনো। পাকিস্তানের ভাংগন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটার পর ভারতীয়দের তৎপরতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয়দের সম্প্রসারণবাদী নীতি-কৌশল ও অসংখ্য কর্মকা-ের উল্লেখ করা সম্ভব। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদীর ঢাকা সফরকেন্দ্রিক আলোচনা এখনো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বের সঙ্গেই চলছে। মিস্টার মোদীর এ সফরকালে স্বাক্ষরিত ডজন ডজন চুক্তি ও সমঝোতাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ আদৌ কিছু পেয়েছে কি না, নাকি নেহরুর সেই ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারতই সবকিছু নিয়ে গেছে- এসব প্রশ্নও প্রাধান্যে উঠে এসেছে। উদ্বিগ্ন দেশপ্রেমিকরা প্রসঙ্গক্রমে ‘সিকিম সিনড্রম’-এর কথা তুলেছেন। সেই সাথে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে লেন্দুপ দর্জির নামও। এই লেন্দুপ দর্জি ছিলেন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত স্বাধীন রাষ্ট্র সিকিমের শেষ প্রধানমন্ত্রী। সিকিমের ‘মির জাফর’ হিসেবে নিন্দিত ও ঘৃণিত রাজনীতিক লেন্দুপ দর্জির পরিণতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেকে তার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো কোনো বিশেষজনকে লেন্দুপ দর্জির ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।
হঠাৎ কেন ‘সিকিম সিনড্রম’ নিয়ে আলোচনা প্রাধান্যে এসেছে এবং লেন্দুপ দর্জির নামই বা কেন বারবার উঠে আসছে তার কারণ জানার জন্য ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সিকিমও স্বাধীন রাষ্ট্রের অবস্থান অর্জন করেছিল। গায়ের জোরে হায়দরাবাদসহ ক্ষুদ্র কয়েকটি রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু সিকিমের স্বাধীনতা হরণ করা থেকে বিরত ছিলেন। অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল ১৯৬৮ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং গঠিত হওয়ার পর। ‘র’ সিকিম ও ভুটানকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৮ সালেই জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়ে যাওয়ায় ভুটান ‘র’-এর হাতছাড়া হয়ে যায়। ‘র’ তখন সিকিমের দিকে হাত বাড়ায় এবং দালাল হিসেবে বেছে নেয় রাজনীতিক লেন্দুপ দর্জিকে। লেন্দুপ ছিলেন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (সিএনসি)-এর নেতা। ‘র’-এর প্ররোচনায় সিএনসি রাজা চোগিয়ালের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। সিকিমবাসীকে বোঝানো হয়, রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানো গেলেই তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হবে। গবেষণায় ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিএনসির সে আন্দোলনে ‘র’ প্রায় প্রকাশ্যেই অংশ নিয়েছিল। হাজার হাজার ভারতীয় সেনাকে সে সময় মিছিলে ও সমাবেশে অংশ নিতে দেখা গেছে। কিন্তু সিকিমবাসীর মতো একই পার্বত্য চেহারার ছিল বলে তাদের পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়নি।
রাজতন্ত্র বিরোধী ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সিএনসি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে দেশটির সংসদে ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টিতে বিজয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন লেন্দুপ দর্জি। নিরংকুশ এ বিজয়কেই লেন্দুপ দর্জি ভারতের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। সংসদের মাধ্যমে প্রথমে তিনি রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়েছিলেন সিকিমকে ভারতের রাজ্য বানানোর পদক্ষেপ। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল একটি লোক দেখানো গণভোটের আয়োজন করা হলেও ‘র’-এর সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সাধারণ সিকিমবাসী ভোট দেয়ারই সুযোগ পায়নি। ফলে তথাকথিত গণভোটে ভারতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব পাস হয়েছিল। ক’দিন পর, ১৯৭৫ সালেরই ২৬ এপ্রিল সিকিমের সংসদ সিকিমকে ভারতের রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছিল। সে অনুরোধের ভিত্তিতে সিকিমকে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুগ্রহে সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন লেন্দুপ দর্জি। এভাবেই জাতীয় পর্যায়ের একজন জনপ্রিয় নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় স্বাধীনতা খুইয়েছিল সিকিম। সর্বাত্মকভাবে ভারতের দালালি করলেও লেন্দুপ দর্জিকে অবশ্য মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে হয়েছিল। মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৭৯ সালেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে সিকিমবাসী তাকে ঘৃণার সঙ্গে বিতাড়িত করেছিল। জনগণ তাকে এতটাই ঘৃণা করেছে যে, মৃত্যুর সময়ও লেন্দুপ দর্জি সিকিমে আসতে পারেননি। ভারতের কলিমপঙে ২০০৭ সালে তাকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। মৃত্যুর আগে দেয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলে গেছেন, দিল্লি অর্থাৎ ভারত সরকার তাকে আগের মতো সম্মান দেখানো দূরে থাকুক, সামান্য পাত্তাও দেয় না। দ্বিতীয় সারির কোনো ভারতীয় নেতার সঙ্গে কথা বলার জন্যও তাকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়।
বর্তমান বাংলাদেশে কেন সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জিকে নিয়ে জোর আলোচনা চলছে তার কারণ সম্ভবত পৃথকভাবে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত লক্ষ্য করলেই আশংকার কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সেবার লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ‘রোডম্যাপ’-এর পটভূমি রচনা করা হয়েছিল। সবশেষে শেখ হাসিনার ‘আন্দোলনের ফসল’ ক্ষমতা দখলকারী মইন-ফখরুদ্দিনরা এমন এক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন যে নির্বাচনে মিনিটে ১৭ জন পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছে বলে দেখানো হয়েছিল। এ ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ, নিজের ভোটার নাম্বার ও নাম-ঠিকানা জানিয়ে ও মুরি বইতে স্বাক্ষর দিয়ে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করা, আঙুলে অমোচনীয় কালি লাগানো, পোলিং বুথের ভেতরে যাওয়া, পছন্দের প্রার্থীর ঘরে সিল মারা এবং ব্যালট পেপার ভাঁজ করে স্বচ্ছ বাক্সে ফেলা পর্যন্ত কাজগুলো সারতে হলে কম করে হলেও পাঁচ মিনিট পর্যন্ত সময় লাগার কথা। সুতরাং প্রতি মিনিটে ১৭ জন করে ভোটারের পক্ষে ভোট দেয়া একেবারেই সম্ভব নয়। প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ভোটের ব্যবধানও চৌর্যবৃত্তির বিষয়টিকে পরিষ্কার করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক কোটি ৫৮ লাখ এবং বিএনপি এক কোটি ৪২ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল ১৬ লাখ ভোটের। এর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই কোটি ২৩ লাখ এবং বিএনপি দুই কোটি ২৮ লাখ ভোট পেয়েছিল। ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখ ভোটের। এটাও স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ২০০৮-এর নির্বাচনে দুই প্রধান দলের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান দেখানো হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ! দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট যেখানে বেড়েছে এক কোটি ১৯ লাখ, বিএনপির সেখানে বেড়েছিল মাত্র তিন লাখ! এত বিরাট ব্যবধান শুধু অস্বাভাবিক নয়, অগ্রহণযোগ্যও। কিন্তু সেটাই ঘটানো হয়েছিল। ঠিক কোন দেশ এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেছিল সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে অনেক আগেই। সে দেশের সে ঋণই শোধ করা হচ্ছে বিগত প্রায় সাত বছর ধরে।
এরই ধারাবাহিকতায়ই আয়োজিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল অনেক আগে থেকে। মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগের পতন ঘটবে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সম্পর্কিত রায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পাশাপাশি সংবিধানে এমনভাবেই নানা সংশোধনী আনা হয়েছে যার ফলে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে কারো পক্ষেই নির্বাচনে জিতে আসা এবং সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। এতকিছুর পরও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি ক্ষমতাসীনরা। তার সরকার তাই র্যাব পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এবং গুণ্ডা-সন্ত্রাসীদেরও মাঠে নামিয়েছিল। গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালানো হয়েছে গুম ও হত্যার অভিযান। একযোগে প্রতারণার কৌশলও নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। সংলাপ ও সমঝোতার আড়ালে একদিকে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেছেন, অন্যদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে ঠেলে দিয়েছেন নির্বাচনের বাইরে। ১৫৩ জন এমপিকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ করার রেকর্ড গড়েই থেমে যাননি তারা, একই সঙ্গে ভোট জালিয়াতিও করেছেন যথেচ্ছভাবে। পাঁচ থেকে সাত শতাংশের বেশি ভোট না পড়লেও দাবি করেছেন, ভোট নাকি পড়েছে ৪০ শতাংশ! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কথাটা এমনভাবে বলেছেন, যেন ওটা ৪০ নয়, ৮০ শতাংশ! অনন্দে উচ্ছ্বসিত প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্যই করেননি যে, প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার মধ্যে আর যা-ই হোক, গর্বের কিছু থাকতে পারে না। কারণ, ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার অর্থ হলো, বাকি ৬০ শতাংশ ভোটার তাকে ভোট দেননি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অংকে এতটা কাঁচা নন যে ৪০ এবং ৬০-এর মধ্যকার পার্থক্যটুকু তিনি বুঝতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও একদিকে বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায় ‘অথর্ব’ ও ‘মেরুদণ্ডহীন’ নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য এবং সম্ভবত তারই নির্দেশে ৩৯ দশমিক ৮৯ শতাংশের একটা হিসাব দাঁড় করিয়েছে, অন্যদিকে লজ্জা-শরমের মুণ্ডু চিবিয়ে খেয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সে হিসাবটিকেই আঁকড়ে ধরেছেন। জনগণকেও তিনি সে কথাটাই শুনিয়ে ছেড়েছেন।
দেশপ্রেমিকদের মধ্যে উদ্বেগ-আশংকাও ছড়িয়ে পড়েছে এই মিথ্যাচারের কারণে, সেজন্যই প্রাধান্যে এসেছে ‘সিকিম সিনড্রম’ ও লেন্দুপ দর্জির প্রসঙ্গ। কারণ, এ শুধু প্রতিপক্ষগুলোর অভিযোগ নয়, ঘটনাপ্রবাহেও প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা এগোচ্ছেন দেশকে একদলীয় শাসনের অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। সংবিধানের আড়াল নিয়ে ক্ষমতাসীনরা আসলে সেটাই নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফলে আগামী দিনগুলোতে দেশে গণতন্ত্রই শুধু ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না, জনগণের ওপর আবারও চেপে বসতে পারে বাকশালের মতো একদলীয় শাসন। আর গণতন্ত্র যদি না থাকে তাহলে এক পর্যায়ে টান পড়তে পারে দেশের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়েও। পরিণতিতে বিপন্ন হতে পারে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এখানেই এসেছে সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জির বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। এ কথাটা বলে জনগণকে সাবধান করে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়াও। তিনি সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জির উদাহরণ দিয়ে যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। লেন্দুপ দর্জির পরিণতি ও সিকিমের ইতিহাস থেকে বেছে বেছে বিশেষ একজনকেই কেন তিনি শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তার কারণ নিয়ে সম্ভবত কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না।
এতক্ষণে পাঠকরা সম্ভবত নিবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন। শেষ করার আগে শুধু এটুকু জানিয়ে রাখাই যথেষ্ট যে, দেশপ্রেমিকরা অবশ্য বাংলাদেশকে কারও পক্ষে গিলে খাওয়ার বিষয়টি সহজে সম্ভব হবে বলে মনে করেন না। কারণ, মওলানা ভাসানী থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত এমন অনেক নেতাই এদেশে রাজনীতি করে গেছেন, যারা কখনো সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। কথাটা ভারতীয়দের মতো লেন্দুপ দর্জি হতে ইচ্ছুকদেরও নিশ্চয়ই জানা রয়েছে।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন