সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক ও খ্যাতনামা লেখক-কলামিস্ট ড. জাফর ইকবালের একটি খেদোক্তি এবং মন্তব্য আমাকে বিশেষভাবে মর্মাহত করেছে। বলাবাহুল্য গত পরশু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। এই হামলায় ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী ও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই সিনিয়র শিক্ষিকা ড. ইয়াসমিন হকসহ অন্তত ১০ জন শিক্ষক মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী ড. জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেছেন, “যে ছাত্ররা শিক্ষকদের উপর হামলা করেছে তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত।” তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্রলীগের ছেলেরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের উপর হামলা করেছে। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুক্ত হয়েছিল সেই স্লোগানের এত বড় অপমান আমি আমার জীবনে দেখিনি।’ জাতীয় দৈনিকগুলো এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলা, মারধরসহ তাদের লাঞ্ছিত করার সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশের পাশাপাশি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব, ক্ষুব্ধ ও অপমানিত শিক্ষক ড. জাফর ইকবালের বৃষ্টির মধ্যে ছাতা গুটিয়ে বসে থাকার একটি ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। ছবিতে মনে হচ্ছিল তিনি কাঁদছেন, তবে বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় তার চোখ মুখ থেকে পড়া পানি কান্নার না বৃষ্টির তা বুঝা যাচ্ছিল না। যাই হোক শিক্ষকদের উপর হামলা ও তার অবস্থা দেখে আমি দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছি। তার উপলব্ধি এবং গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাবার ইচ্ছা আমার হৃদয়কে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। এক সময় আমি শিক্ষকতা করতাম, ছাত্রদের তরফ থেকে অপমানিত হওয়া একজন শিক্ষকের জন্য কত বড় আঘাত তা আমি বুঝতে পারি। আমার শিক্ষকতা জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল যেই ঘটনা আমাকে শিক্ষকতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। এই ঘটনার পেছনেও ছাত্রলীগের একজন নেতা জড়িত ছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৭০ সাল। তখন আমি ঢাকার কায়েদে আজম কলেজে অধ্যাপনা করি। ঐ বছর ডিগ্রী পরীক্ষায় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে আমার ইনভিজিলেশান ডিউটি পড়েছিল। জগন্নাথ কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক আবদুল মতিন এবং আমার একই হলে ডিউটি পড়েছিল। ঐ কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি ঐ হলে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। নকল করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন। তার খাতা জব্দ করতে গিয়ে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি নকল করছেন তার সহজ উত্তর ছিল, আমি নকল করছি না, বই দেখে আসলটা লিখছি। তিনি বল প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। তবে তার উত্তরটি আমার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। যে শিক্ষা আসল নকল তথা মূল্যবোধ শেখাতে পারে না সে শিক্ষা জাতির কল্যাণে আসতে পারে না। আমার তখনি মনে হয়েছিল ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ মানুষ নয় গরু তৈরি করছে। আবার গরু চরানো সবার কাজ নয়। এর দু’বছর পর আমি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
এর মধ্যে গঙ্গা যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। অধঃপতিত ছাত্রলীগের ইমেজ তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ এখন প্রকৃত ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বশীল কোনও সংগঠন নয়। এটি এখন একটি আতঙ্ক আর কলঙ্কের নাম। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, হোস্টেলের সিট বাণিজ্য, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা, তাদের গুম ও হত্যা, মেয়েদের শ্লীলতাহানি প্রভৃতি এখন তাদের প্রধান কাজ, শিক্ষা নয়। ড. জাফর ইকবাল সাহেবদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আস্কারা দিয়ে শুরু থেকে তারা যদি ছাত্রলীগকে মাথায় না উঠাতেন তাহলে পরিস্থিতি হয়ত আজকের এই অবস্থায় পৌঁছাতো না। ছাত্রলীগ যখন ছাত্রদল, শিবিরসহ প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উৎখাতের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিল এবং করছে তখন আজকের আক্রান্ত শিক্ষকরাই তাদের উৎসাহ দিয়েছেন এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্রলীগ নেতারা যখন প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করেছে তখন এই শিক্ষকরা চুপ থেকে তাদের সমর্থন যুগিয়েছেন, অনেকে সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গসুখ পাবার আশায় তাদের সহায়তা কামনা করেছেন। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অনৈতিক কাজে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক ও অত্যাচারে ক্ষুব্ধ ছাত্রীরা যখন কয়েক বছর আগে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের কীর্তি ফাঁস করলো তখন নির্যাতিতা ছাত্রীদের সমর্থনে একজন শিক্ষক কি এগিয়ে এসেছিলেন? এই শিক্ষকদের অনেককে আমরা চিনি যারা ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা ও ক্লাস পাওয়াকে জিম্মি করে তাদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সাথে জড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছেন অথবা পড়েছেন। আবার আদর্শিক কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল ম্যানিপুলেট করার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১৯৯৯-২০০০ সেশনে অর্থনীতি বিভাগের একটি মেয়ে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পেয়েছিল। ফরিদা ইয়াসমীন নামক ঐ মেয়েটির প্রাপ্ত স্কোর ছিল ২.৯৯৫। তার প্রথম শ্রেণী প্রাপ্তির অনুকূলে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তও ছিল। কিন্তু শিক্ষকরা তার বিরোধিতা করে তার .০০৫ নম্বর কম প্রাপ্তি দেখিয়ে তাকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছেন। কারণ ছিল আদর্শিক; মেয়েটি নামায পড়তো এবং হিজাবের অনুসারী ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, মেয়েটিকে প্রথম শ্রেণী দেয়া হলে তার মেধাবী ক্যারিয়ারের প্রেক্ষাপটে যদি ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে সে আসে তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তাদের দলের প্রাধান্য থাকবে না। তাদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য ছাত্রলীগের তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়েদের প্রথম শ্রেণী দিয়ে শিক্ষকতার পেশায় নেয়ার অনেক অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। এ অবস্থায় ড. জাফর ইকবালসহ শিক্ষকদের মধ্যে যারা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে হতাশ হচ্ছেন অথবা আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন তাদের জন্য আমার করুণা হয়। তাদের উচিত এ ধরনের সংগঠনের উপর থেকে অবিলম্বে সমর্থন প্রত্যাহার করে এমন একটি সংগঠনকে সমর্থন করা যার নেতাকর্মীরা সুকৃতি প্রতিষ্ঠা করে এবং দুষ্কৃতিকে প্রতিরোধ করে ও শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা রক্ষা করে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সারা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রলীগ সরকারি ছত্রছায়ায় যে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে আসছে ড. জাফর ইকবালের দলভুক্ত কয়জন শিক্ষক তার প্রতিবাদ করেছেন ? শিক্ষকতা পেশা থেকে সরে দঁাঁড়িয়েছেন ? কিছু আলঙ্কারিক পদ থেকে কয়েক বছর আগে কয়েকজনের পদত্যাগের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু দেশবাসী ঐ ঘটনাকেও নাটক বলেছিলেন। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সোসাল মিডিয়ায় ইতোমধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার যারা নিন্দা করেছেন তাদের সৎ সাহসের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। নিন্দার খাতিরে নিন্দা করে লাভ নেই। নিন্দা ফলপ্রসূ হওয়া দরকার। ছাত্রলীগের নিন্দায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার মুখর হয়েছিলেন এবং সংগঠনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি আবার ঐ পদেই ফিরে এসেছেন। তাদের চরিত্রের কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? অবশ্যই না। ছাত্রলীগের ব্যাপারে সিলেটের মানুষের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের হোস্টেলকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। কালের সাক্ষী ঐ হোস্টেলটি ছিল উপমহাদেশের বহু জ্ঞানী-গুণীর স্মৃতিধন্য একটি ভবন। মেধার ভিত্তিতে এ হোস্টেলে সীট বণ্টনের রীতি ছিল। এই মানদ-ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছাত্ররা এই হোস্টেলের বেশির ভাগ আসন পায় এবং ছাত্রলীগ মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় বঞ্চিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আগুন লাগিয়ে তা জ্বালিয়ে দেয়। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এর নিন্দা করেছিলেন। কেউ কেউ চোখের পানিও ফেলেছিলেন। ছাত্রলীগের অপরাধীরা আজো শাস্তি পায়নি। কেন পায়নি সরকারই ভাল বলতে পারবেন। বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মী অপরাধ না করেও এমনকি জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায়ও অগ্নিসংযোগের মামলায় চার্জশিট পাচ্ছেন; মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন। অগ্নিসংযোগকারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রাজকীয় হালতে মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করছেন। মানুষ বিস্মিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা অথবা বৃষ্টিতে ভিজে কান্নাকাটি করলে অবস্থার কোনও উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। কাজেই আসুন আমরা সবাই মিলে ছাত্রলীগকে বেআইনি ঘোষণার দাবি তুলি এবং এমন সংগঠনকে সমর্থন করি যার নেতাকর্মীরা সৎ, নিষ্ঠাবান, পড়া-লেখায় মনোযোগী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও বেআদবি করে না এবং গোড়া নয় কিন্তু ধর্মপ্রাণ। এরা আমাদের সম্পদ। সাহস থাকলে এগিয়ে আসুন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী ড. জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেছেন, “যে ছাত্ররা শিক্ষকদের উপর হামলা করেছে তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত।” তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্রলীগের ছেলেরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের উপর হামলা করেছে। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুক্ত হয়েছিল সেই স্লোগানের এত বড় অপমান আমি আমার জীবনে দেখিনি।’ জাতীয় দৈনিকগুলো এবং বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষকদের উপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলা, মারধরসহ তাদের লাঞ্ছিত করার সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশের পাশাপাশি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব, ক্ষুব্ধ ও অপমানিত শিক্ষক ড. জাফর ইকবালের বৃষ্টির মধ্যে ছাতা গুটিয়ে বসে থাকার একটি ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। ছবিতে মনে হচ্ছিল তিনি কাঁদছেন, তবে বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় তার চোখ মুখ থেকে পড়া পানি কান্নার না বৃষ্টির তা বুঝা যাচ্ছিল না। যাই হোক শিক্ষকদের উপর হামলা ও তার অবস্থা দেখে আমি দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছি। তার উপলব্ধি এবং গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাবার ইচ্ছা আমার হৃদয়কে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। এক সময় আমি শিক্ষকতা করতাম, ছাত্রদের তরফ থেকে অপমানিত হওয়া একজন শিক্ষকের জন্য কত বড় আঘাত তা আমি বুঝতে পারি। আমার শিক্ষকতা জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল যেই ঘটনা আমাকে শিক্ষকতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। এই ঘটনার পেছনেও ছাত্রলীগের একজন নেতা জড়িত ছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৭০ সাল। তখন আমি ঢাকার কায়েদে আজম কলেজে অধ্যাপনা করি। ঐ বছর ডিগ্রী পরীক্ষায় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে আমার ইনভিজিলেশান ডিউটি পড়েছিল। জগন্নাথ কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপক আবদুল মতিন এবং আমার একই হলে ডিউটি পড়েছিল। ঐ কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি ঐ হলে পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। নকল করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন। তার খাতা জব্দ করতে গিয়ে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি নকল করছেন তার সহজ উত্তর ছিল, আমি নকল করছি না, বই দেখে আসলটা লিখছি। তিনি বল প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। তবে তার উত্তরটি আমার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। যে শিক্ষা আসল নকল তথা মূল্যবোধ শেখাতে পারে না সে শিক্ষা জাতির কল্যাণে আসতে পারে না। আমার তখনি মনে হয়েছিল ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ মানুষ নয় গরু তৈরি করছে। আবার গরু চরানো সবার কাজ নয়। এর দু’বছর পর আমি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
এর মধ্যে গঙ্গা যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। অধঃপতিত ছাত্রলীগের ইমেজ তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগ এখন প্রকৃত ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বশীল কোনও সংগঠন নয়। এটি এখন একটি আতঙ্ক আর কলঙ্কের নাম। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, হোস্টেলের সিট বাণিজ্য, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা, তাদের গুম ও হত্যা, মেয়েদের শ্লীলতাহানি প্রভৃতি এখন তাদের প্রধান কাজ, শিক্ষা নয়। ড. জাফর ইকবাল সাহেবদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আস্কারা দিয়ে শুরু থেকে তারা যদি ছাত্রলীগকে মাথায় না উঠাতেন তাহলে পরিস্থিতি হয়ত আজকের এই অবস্থায় পৌঁছাতো না। ছাত্রলীগ যখন ছাত্রদল, শিবিরসহ প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের উৎখাতের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিল এবং করছে তখন আজকের আক্রান্ত শিক্ষকরাই তাদের উৎসাহ দিয়েছেন এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্রলীগ নেতারা যখন প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করেছে তখন এই শিক্ষকরা চুপ থেকে তাদের সমর্থন যুগিয়েছেন, অনেকে সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গসুখ পাবার আশায় তাদের সহায়তা কামনা করেছেন। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের অনৈতিক কাজে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক ও অত্যাচারে ক্ষুব্ধ ছাত্রীরা যখন কয়েক বছর আগে প্রেস কনফারেন্স করে তাদের কীর্তি ফাঁস করলো তখন নির্যাতিতা ছাত্রীদের সমর্থনে একজন শিক্ষক কি এগিয়ে এসেছিলেন? এই শিক্ষকদের অনেককে আমরা চিনি যারা ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা ও ক্লাস পাওয়াকে জিম্মি করে তাদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সাথে জড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছেন অথবা পড়েছেন। আবার আদর্শিক কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল ম্যানিপুলেট করার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১৯৯৯-২০০০ সেশনে অর্থনীতি বিভাগের একটি মেয়ে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী পেয়েছিল। ফরিদা ইয়াসমীন নামক ঐ মেয়েটির প্রাপ্ত স্কোর ছিল ২.৯৯৫। তার প্রথম শ্রেণী প্রাপ্তির অনুকূলে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তও ছিল। কিন্তু শিক্ষকরা তার বিরোধিতা করে তার .০০৫ নম্বর কম প্রাপ্তি দেখিয়ে তাকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছেন। কারণ ছিল আদর্শিক; মেয়েটি নামায পড়তো এবং হিজাবের অনুসারী ছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, মেয়েটিকে প্রথম শ্রেণী দেয়া হলে তার মেধাবী ক্যারিয়ারের প্রেক্ষাপটে যদি ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে সে আসে তা হলে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তাদের দলের প্রাধান্য থাকবে না। তাদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য ছাত্রলীগের তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়েদের প্রথম শ্রেণী দিয়ে শিক্ষকতার পেশায় নেয়ার অনেক অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। এ অবস্থায় ড. জাফর ইকবালসহ শিক্ষকদের মধ্যে যারা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে হতাশ হচ্ছেন অথবা আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন তাদের জন্য আমার করুণা হয়। তাদের উচিত এ ধরনের সংগঠনের উপর থেকে অবিলম্বে সমর্থন প্রত্যাহার করে এমন একটি সংগঠনকে সমর্থন করা যার নেতাকর্মীরা সুকৃতি প্রতিষ্ঠা করে এবং দুষ্কৃতিকে প্রতিরোধ করে ও শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা রক্ষা করে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সারা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রলীগ সরকারি ছত্রছায়ায় যে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে আসছে ড. জাফর ইকবালের দলভুক্ত কয়জন শিক্ষক তার প্রতিবাদ করেছেন ? শিক্ষকতা পেশা থেকে সরে দঁাঁড়িয়েছেন ? কিছু আলঙ্কারিক পদ থেকে কয়েক বছর আগে কয়েকজনের পদত্যাগের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু দেশবাসী ঐ ঘটনাকেও নাটক বলেছিলেন। প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সোসাল মিডিয়ায় ইতোমধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার যারা নিন্দা করেছেন তাদের সৎ সাহসের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। নিন্দার খাতিরে নিন্দা করে লাভ নেই। নিন্দা ফলপ্রসূ হওয়া দরকার। ছাত্রলীগের নিন্দায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার মুখর হয়েছিলেন এবং সংগঠনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষকের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি আবার ঐ পদেই ফিরে এসেছেন। তাদের চরিত্রের কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে? অবশ্যই না। ছাত্রলীগের ব্যাপারে সিলেটের মানুষের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের হোস্টেলকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। কালের সাক্ষী ঐ হোস্টেলটি ছিল উপমহাদেশের বহু জ্ঞানী-গুণীর স্মৃতিধন্য একটি ভবন। মেধার ভিত্তিতে এ হোস্টেলে সীট বণ্টনের রীতি ছিল। এই মানদ-ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছাত্ররা এই হোস্টেলের বেশির ভাগ আসন পায় এবং ছাত্রলীগ মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় বঞ্চিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আগুন লাগিয়ে তা জ্বালিয়ে দেয়। স্বয়ং অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এর নিন্দা করেছিলেন। কেউ কেউ চোখের পানিও ফেলেছিলেন। ছাত্রলীগের অপরাধীরা আজো শাস্তি পায়নি। কেন পায়নি সরকারই ভাল বলতে পারবেন। বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মী অপরাধ না করেও এমনকি জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায়ও অগ্নিসংযোগের মামলায় চার্জশিট পাচ্ছেন; মিথ্যা মামলায় জেল খাটছেন। অগ্নিসংযোগকারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রাজকীয় হালতে মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করছেন। মানুষ বিস্মিত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা অথবা বৃষ্টিতে ভিজে কান্নাকাটি করলে অবস্থার কোনও উন্নতি হবে বলে মনে হয় না। কাজেই আসুন আমরা সবাই মিলে ছাত্রলীগকে বেআইনি ঘোষণার দাবি তুলি এবং এমন সংগঠনকে সমর্থন করি যার নেতাকর্মীরা সৎ, নিষ্ঠাবান, পড়া-লেখায় মনোযোগী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও বেআদবি করে না এবং গোড়া নয় কিন্তু ধর্মপ্রাণ। এরা আমাদের সম্পদ। সাহস থাকলে এগিয়ে আসুন।
ড. মোঃ নূরুল আমিন