সর্বত্র একই প্রশ্ন, কোথায় যাচ্ছি আমরা? যার সাথেই দেখা হয় তিনিই প্রশ্ন করেন, এই অস্থিরতার শেষ হবে কবে? সম্প্রতি তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে। সেগুলো হল, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি। দ্বিতীয় ঘটনা হল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক সাবেক ছাত্র নেতা ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেফতার। তার বিরুদ্ধে সেনা বিদ্রোহে উসকানি দানের অভিযোগ করা হয়েছে। তৃতীয় ঘটনা হল, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী এবং শেখ মুজিবের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রনেতা ড. কামাল হোসেনকে গ্রেফতারের দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশের মর্যাদাশীল ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। একের পর এক এমন নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ নিয়ে সরকার কি হাসিল করতে চায় সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। এসব দমন নীতির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আসলে দমন করা যায় না। বরং সাময়িক অসুবিধা হলেও যাদেরকে দমন করতে চাওয়া হচ্ছে তাদের মনোবলকে আরও ইস্পাত কঠিন করা হয়।
প্রথমে শুরু করছি বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতার প্রসঙ্গ নিয়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। দুর্নীতির মামলায় আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এ আদেশ দিয়েছেন বকশিবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালত-৩। বিচারক আবু আহমেদ জমাদার গতকাল এ আদেশ দেন। আদেশটি বাতিলের জন্য আবেদন করা হলেও তা খারিজ করেন ওই আদালত। আদেশের কপি পৌঁছে গেছে গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট ও রমনা থানায়। এদিকে দুদকের দায়ের করা এই মামলাকে মিথ্যা বানোয়াট দাবি করে সংশ্লিষ্ট আদেশকেও বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির তীব্র নিন্দা জানিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে ২০ দলের নেতাকর্মীরা।
বেগম জিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানায় শুধুমাত্র দেশেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, বিদেশেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই গ্রেফতারি পরোয়ানায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। গত বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় জাতিসংঘ সদর দফতরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান সংস্থার মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমান মান্নার গ্রেফতারের প্রসঙ্গও উঠে আসে। সংবাদ সম্মেলনে জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির খবর ইতোমধ্যেই মহাসচিব অবহিত হয়েছেন এবং এই ঘটনায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মহাসচিব সেখানে আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছেন। সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো মহাসচিবের দেয়া দায়িত্ব অনুযায়ী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার পত্রিকান্তরের খবর মোতাবেক গ্রেফতার, কারাবরণসহ যে কোন ধরনের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত বিএনপি-চেয়ার পারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। আইনজীবীদের কাছে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে যান তার ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরীন এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। তারাই প্রথম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি জানান। কার্যালয়ে অবস্থানকারী সূত্র জানায়, গ্রেফতারি পরোয়ানার খবরটি স্বাভাবিকভাবে নেন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতারা তার কাছে যান। তিনি নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা কি চিন্তিত? আমি চিন্তিত নই। রাজনীতির ইতিহাসে এমন প্রতিহিংসার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ব্যক্তিগতভাবে জেল-জুলুমও আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কাঙ্খিত সমাধান না আসা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। আরও অনেক কষ্ট করতে হবে। আপনারা কি কষ্ট করতে পারবেন? এ সময় নেতারা হাসিমুখে তাকে সায় দেন।
দুই.
একের পর এক গ্রেফতারের হুমকি এবং গ্রেফতারের উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। কিন্তু ভয় পাওয়া তো দূরের কথা খালেদা জিয়া বরং আরো শক্ত এবং আরো কঠোর হয়েছেন। শুক্রবারের পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, টলেননি খালেদা জিয়া। পরোয়ানায় লেশমাত্র শঙ্কাবোধ নেই। বরং চলমান লড়াইয়ের কৌশল ঘষা মাঝা করছেন। গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন সরকারের গতিবিধি। গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ক্ষমতাসীনদের ‘পলিটিক্সের এসিড টেস্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বিরাজমান টালমাটাল পরিস্থিতির শেষ দেখার অপেক্ষায় তিনি। তাই আটঘাট বেঁধে চূড়ান্ত ধাক্কা দেয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করছেন। প্রস্তুতির মূল চাবিকাঠি দিয়েছেন বিকল্প নেতৃত্ব দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে। লন্ডন থেকেই দেশে সাংগঠনিক ৭৫ জেলার প্রতিটি ইউনিটের মাঠ নেতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন তিনিই। বিএনপির আন্দোলনের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ের একাধিক নেতা দলীয় চেয়ারপারসনের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা গুলশান, রমনা ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় পৌঁছানো হয়েছে। অস্থায়ী কারাগার হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধাকে। বিএনপি দলীয় সূত্র বলছে, মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ৪ মার্চ। কিন্তু তারিখ যাই হোক ওই আদালতকেই আস্থায় নিতে পারছেন না খালেদা জিয়া। তাই ম্যাডামও মার্চের ‘চার’ দেখার অপেক্ষায়। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও মামলা (নভো থিয়েটার) ছিল। তিনিও আদালতে যাননি এমন নজির আছে। তার বেলায় তো এমন আদেশ দেয়া হয়নি। তাহলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেলায় কেন এমন আদেশ? প্রশ্ন রাখেন ব্যারিস্টার খোকন।
অপর একটি পত্রিকায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরেও আন্দোলনে অনড় ও অবিচল রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। গ্রেফতারসহ যেকোনো পরিণতির জন্য প্রস্তুত আছেন বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, গ্রেফতার হলেও আন্দোলন থেকে একচুলও নড়বেন না বিএনপি চেয়ারপারসন। গত বুধবার কোর্ট থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তা তিনটি থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। থানার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত হয় খবর। এতে ধারণা করা হচ্ছিল যে তিনি হয়তো বুধবার রাতেই গ্রেফতার হবেন। কিন্তু তা হয়নি। বরং গতকাল থানাগুলো উল্টো বলছে যে তারা গ্রেফতারি পরোয়ানা পাননি। এতে বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ যে কোনো চাপ অথবা সরকার নিজেই বেগম জিয়ার গ্রেফতারের চাপ নিতে পারবেন কিনা সেসব বিষয় চিন্তা করেই হয়তো তাকে গ্রেফতার করা নিয়ে সরকার একটু দ্বিধান্বিত। বিএনপির গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার হতে পারেন এজন্য তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ঔষুধসহ ব্যবহারের জন্য কাপড় গুছিয়ে রেখেছেন। তার অনুপস্থিতিতে কিভাবে আন্দোলন চলবে সে ব্যাপারে আগে থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে ‘আন্দোলনের ছক’ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই তৃণমূল নেতাকর্মীরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাবে বলে গুলশান কার্যালয়ের সূত্র জানিয়েছে।
তিন.
পক্ষান্তরে সরকারের অবস্থানও অনড়। সরকারের অবস্থান সম্পর্কে একটি প্রাচীন বাংলা দৈনিকের প্রধান সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপিকে এক বিন্দুও ছাড় দেবে না সরকার। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চূড়ান্ত পরিণতির কথা ভাবা হচ্ছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পেট্রল বোমা হামলা মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গণতন্ত্রে কেউ রাজা-রাণী নন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আইনের আওতার বাইরে নন। অন্যায়-অশান্তি, অপরাধ করলে বিচার হবে, জেল খাটতে হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিচারের বাইরে থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে হুশিয়ারি ব্যক্ত করেন তিনি। এ দিন খুলনায় এক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, খালেদা জিয়াকে সারা জীবন জেলের মধ্যে কাটাতে হবে।
দুই দল এবং দুই নেত্রী যে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় সেটি বিদেশীরাও বুঝে গেছে। গত বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। বৈঠকে জানানো হয় যে, তারা বাংলাদেশে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝেছে তা হল দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কোনো সুযোগ তারা দেখছে না। তারা জানান, বিবদমান পক্ষগুলো খুবই অনমনীয় অবস্থানে। ঢাকায় কেউ কেউ তাদের জানিয়েছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না। যদি এভাবে চলতে থাকে পরিস্থিতি একপর্যায়ে গৃহযুদ্ধের রূপ নিতে পারে। বৈঠকে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, চলমান সহিংসতা বন্ধে দেশটির সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
বিরোধী দল সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সরকার যতই হালকাভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করুক না কেন বাস্তব অবস্থা হলো এই যে, বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরতে ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে অবশ্যই বিরোধীদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানাতে হবে সরকারকে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এসব কথা বলা হয়। ‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিংক’ (বাংলাদেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে) শীর্ষক ওই সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক নৈরাজ্যের প্রান্তসীমায় উপনীত বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উভয়েই আপসহীন অবস্থানে। উভয় দলই যদি অনড় অবস্থান থেকে ফিরে না আসে, তাদের নেতাকর্মীদের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ না করে সংকটাপন্ন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রকৃত সংলাপ শুরু না করে- তাহলে যে সহিংসতা দেশকে গ্রাস করেছে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এতে নাগরিক ও সামাজিক অধিকার আরও সংকটে পতিত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে। ‘ঢাকায় ৭২ ঘণ্টা’ শীর্ষক একটি লেখায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপকমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান প্রেদা এসব মন্তব্য করেন। চলতি মাসেই প্রেদার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে।
পত্র পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বেগম জিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার গ্রেতারের বিষয়টি জাতি সংঘের মহাসচিব বান কি মুন অবহিত আছেন। তারা পরিস্থিতির ওপর নজারদারি অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এগুলোতে কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না। যে সমাধানটি এক ঘন্টার মধ্যে হতে পারে সেই সমাধানের পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাচ্ছেন না। আগামী দিনে বাংলাদেশের ইতিহাস যদি বাজে ভাবে লেখা হয় তাহলে শেখ হাসিনা সেই দায় থেকে অব্যাহতি পাবেন না।
প্রথমে শুরু করছি বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতার প্রসঙ্গ নিয়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। দুর্নীতির মামলায় আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এ আদেশ দিয়েছেন বকশিবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালত-৩। বিচারক আবু আহমেদ জমাদার গতকাল এ আদেশ দেন। আদেশটি বাতিলের জন্য আবেদন করা হলেও তা খারিজ করেন ওই আদালত। আদেশের কপি পৌঁছে গেছে গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট ও রমনা থানায়। এদিকে দুদকের দায়ের করা এই মামলাকে মিথ্যা বানোয়াট দাবি করে সংশ্লিষ্ট আদেশকেও বেআইনি বলে মন্তব্য করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির তীব্র নিন্দা জানিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে ২০ দলের নেতাকর্মীরা।
বেগম জিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানায় শুধুমাত্র দেশেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, বিদেশেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এই গ্রেফতারি পরোয়ানায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। গত বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় জাতিসংঘ সদর দফতরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান সংস্থার মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর রহমান মান্নার গ্রেফতারের প্রসঙ্গও উঠে আসে। সংবাদ সম্মেলনে জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির খবর ইতোমধ্যেই মহাসচিব অবহিত হয়েছেন এবং এই ঘটনায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মহাসচিব সেখানে আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছেন। সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো মহাসচিবের দেয়া দায়িত্ব অনুযায়ী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার পত্রিকান্তরের খবর মোতাবেক গ্রেফতার, কারাবরণসহ যে কোন ধরনের পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত বিএনপি-চেয়ার পারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। আইনজীবীদের কাছে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে যান তার ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরীন এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দারের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। তারাই প্রথম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি জানান। কার্যালয়ে অবস্থানকারী সূত্র জানায়, গ্রেফতারি পরোয়ানার খবরটি স্বাভাবিকভাবে নেন খালেদা জিয়া। কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতারা তার কাছে যান। তিনি নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা কি চিন্তিত? আমি চিন্তিত নই। রাজনীতির ইতিহাসে এমন প্রতিহিংসার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ব্যক্তিগতভাবে জেল-জুলুমও আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কাঙ্খিত সমাধান না আসা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। আরও অনেক কষ্ট করতে হবে। আপনারা কি কষ্ট করতে পারবেন? এ সময় নেতারা হাসিমুখে তাকে সায় দেন।
দুই.
একের পর এক গ্রেফতারের হুমকি এবং গ্রেফতারের উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। কিন্তু ভয় পাওয়া তো দূরের কথা খালেদা জিয়া বরং আরো শক্ত এবং আরো কঠোর হয়েছেন। শুক্রবারের পত্র-পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, টলেননি খালেদা জিয়া। পরোয়ানায় লেশমাত্র শঙ্কাবোধ নেই। বরং চলমান লড়াইয়ের কৌশল ঘষা মাঝা করছেন। গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন সরকারের গতিবিধি। গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ক্ষমতাসীনদের ‘পলিটিক্সের এসিড টেস্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বিরাজমান টালমাটাল পরিস্থিতির শেষ দেখার অপেক্ষায় তিনি। তাই আটঘাট বেঁধে চূড়ান্ত ধাক্কা দেয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করছেন। প্রস্তুতির মূল চাবিকাঠি দিয়েছেন বিকল্প নেতৃত্ব দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে। লন্ডন থেকেই দেশে সাংগঠনিক ৭৫ জেলার প্রতিটি ইউনিটের মাঠ নেতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন তিনিই। বিএনপির আন্দোলনের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ের একাধিক নেতা দলীয় চেয়ারপারসনের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা গুলশান, রমনা ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় পৌঁছানো হয়েছে। অস্থায়ী কারাগার হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধাকে। বিএনপি দলীয় সূত্র বলছে, মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ৪ মার্চ। কিন্তু তারিখ যাই হোক ওই আদালতকেই আস্থায় নিতে পারছেন না খালেদা জিয়া। তাই ম্যাডামও মার্চের ‘চার’ দেখার অপেক্ষায়। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও মামলা (নভো থিয়েটার) ছিল। তিনিও আদালতে যাননি এমন নজির আছে। তার বেলায় তো এমন আদেশ দেয়া হয়নি। তাহলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেলায় কেন এমন আদেশ? প্রশ্ন রাখেন ব্যারিস্টার খোকন।
অপর একটি পত্রিকায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরেও আন্দোলনে অনড় ও অবিচল রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়া। গ্রেফতারসহ যেকোনো পরিণতির জন্য প্রস্তুত আছেন বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, গ্রেফতার হলেও আন্দোলন থেকে একচুলও নড়বেন না বিএনপি চেয়ারপারসন। গত বুধবার কোর্ট থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তা তিনটি থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। থানার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত হয় খবর। এতে ধারণা করা হচ্ছিল যে তিনি হয়তো বুধবার রাতেই গ্রেফতার হবেন। কিন্তু তা হয়নি। বরং গতকাল থানাগুলো উল্টো বলছে যে তারা গ্রেফতারি পরোয়ানা পাননি। এতে বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ যে কোনো চাপ অথবা সরকার নিজেই বেগম জিয়ার গ্রেফতারের চাপ নিতে পারবেন কিনা সেসব বিষয় চিন্তা করেই হয়তো তাকে গ্রেফতার করা নিয়ে সরকার একটু দ্বিধান্বিত। বিএনপির গুলশান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার হতে পারেন এজন্য তিনি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। ঔষুধসহ ব্যবহারের জন্য কাপড় গুছিয়ে রেখেছেন। তার অনুপস্থিতিতে কিভাবে আন্দোলন চলবে সে ব্যাপারে আগে থেকেই তৃণমূল পর্যায়ে ‘আন্দোলনের ছক’ বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই তৃণমূল নেতাকর্মীরা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাবে বলে গুলশান কার্যালয়ের সূত্র জানিয়েছে।
তিন.
পক্ষান্তরে সরকারের অবস্থানও অনড়। সরকারের অবস্থান সম্পর্কে একটি প্রাচীন বাংলা দৈনিকের প্রধান সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপিকে এক বিন্দুও ছাড় দেবে না সরকার। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চূড়ান্ত পরিণতির কথা ভাবা হচ্ছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পেট্রল বোমা হামলা মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গণতন্ত্রে কেউ রাজা-রাণী নন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আইনের আওতার বাইরে নন। অন্যায়-অশান্তি, অপরাধ করলে বিচার হবে, জেল খাটতে হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিচারের বাইরে থাকার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে হুশিয়ারি ব্যক্ত করেন তিনি। এ দিন খুলনায় এক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, খালেদা জিয়াকে সারা জীবন জেলের মধ্যে কাটাতে হবে।
দুই দল এবং দুই নেত্রী যে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় সেটি বিদেশীরাও বুঝে গেছে। গত বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। বৈঠকে জানানো হয় যে, তারা বাংলাদেশে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝেছে তা হল দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কোনো সুযোগ তারা দেখছে না। তারা জানান, বিবদমান পক্ষগুলো খুবই অনমনীয় অবস্থানে। ঢাকায় কেউ কেউ তাদের জানিয়েছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে না। যদি এভাবে চলতে থাকে পরিস্থিতি একপর্যায়ে গৃহযুদ্ধের রূপ নিতে পারে। বৈঠকে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, চলমান সহিংসতা বন্ধে দেশটির সব পক্ষকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
বিরোধী দল সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সরকার যতই হালকাভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করুক না কেন বাস্তব অবস্থা হলো এই যে, বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরতে ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে অবশ্যই বিরোধীদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানাতে হবে সরকারকে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এসব কথা বলা হয়। ‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিংক’ (বাংলাদেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে) শীর্ষক ওই সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক নৈরাজ্যের প্রান্তসীমায় উপনীত বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উভয়েই আপসহীন অবস্থানে। উভয় দলই যদি অনড় অবস্থান থেকে ফিরে না আসে, তাদের নেতাকর্মীদের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ না করে সংকটাপন্ন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রকৃত সংলাপ শুরু না করে- তাহলে যে সহিংসতা দেশকে গ্রাস করেছে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এতে নাগরিক ও সামাজিক অধিকার আরও সংকটে পতিত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও গৃহযুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে। ‘ঢাকায় ৭২ ঘণ্টা’ শীর্ষক একটি লেখায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপকমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান প্রেদা এসব মন্তব্য করেন। চলতি মাসেই প্রেদার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে।
পত্র পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বেগম জিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার গ্রেতারের বিষয়টি জাতি সংঘের মহাসচিব বান কি মুন অবহিত আছেন। তারা পরিস্থিতির ওপর নজারদারি অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এগুলোতে কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না। যে সমাধানটি এক ঘন্টার মধ্যে হতে পারে সেই সমাধানের পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাচ্ছেন না। আগামী দিনে বাংলাদেশের ইতিহাস যদি বাজে ভাবে লেখা হয় তাহলে শেখ হাসিনা সেই দায় থেকে অব্যাহতি পাবেন না।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন