দেশে কোনো নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনের দাবিতে ৫৫ দিনের মতো অবরোধ চলছে। পাটুরিয়ায় কার্গোর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যাওয়ায় ৭০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আর প্রতিদিন ক্রসফায়ারে মানুষ মরছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি একদিনেই ঢাকা ও ঝিনাইদহে ছয়জন মানুষ কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। পেট্রলবোমায় প্রাণহানির ঘটনা যখন কমে এসেছে, তখন বাড়ছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণহানির সংখ্যা। সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে, শিগগিরই ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার কথোপকথনের ঘটনা ফাঁস হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
বাংলাদেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কাহিনী যখন থেকে প্রচারিত হয়েছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে অবিশ্বাস। বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা বলছে তা বিশ্বাস করছে না কেউ। কখনও কখনও তাদের বক্তব্য আজগুবি ঠেকছে। এবং এটা চলছে ধারাবাহিকভাবেই। সর্বশেষ ঢাকা ও ঝিনাইদহে যে ছয়জন তরুণ খুন হলেন তার কোনো দায়-দায়িত্বই যেন কেউ নিতে চাইছে না। পুলিশ বলছে ঢাকায় যে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে তাদের একজন মারা গেছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’। বাকি তিনজন ‘গণপিটুনি’তে নিহত হয়েছেন। যে তিনজন ‘গণপিটুনি’তে মারা গিয়েছে বলে পুলিশ দাবি করছে, তাদের দেহে পাওয়া গেছে ৫৪টি গুলির চিহ্ন। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে গুলির চিহ্নের কথা উল্লেখ রয়েছে। এলাকায় গিয়ে সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, সেখানে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। রাত ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে আশপাশের বাসিন্দারা কেবল গুলির শব্দই শুনেছে। চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি, হল্লার কোনো শব্দ তারা শোনেনি। ঘটনাস্থল এলাকায় পড়ে ছিলো গুলির খোসা, রক্তমাখা দড়ি আর ছোপ ছোপ রক্ত। এদিকে ঝিনাইদহে যে দুই তরুণের লাশ পাওয়া গেছে তাদের পরিবারের অভিযোগ, কয়েকদিন আগে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এই দুইজনই বিএনপি’র কর্মী ছিলেন। এভাবেই নির্বিচার হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাগুলো পুলিশের ভাষ্যমতে একই রকম। যাকে আটক করা হলো, তাকে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পথিমধ্যে তার সহযোগীরা পুলিশের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে সবসময় পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশের গায়েও গুলি লাগে না। সহযোগীদের গুলির আঘাতে পুলিশের গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আবার যারা এই হামলা চালায় তাদের কেউও কখনও পুলিশের গুলিতে হতাহত হয় না। শুধু পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তি নিহত হন। এর নামই ‘বন্দুকযুদ্ধ’। ফলে সাধারণভাবে কেউই এই কাহিনী বিশ্বাস করে না। কিন্তু কাহিনীর এই ধারাবিবরণী বহুদিন ধরে চলে আসছে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিংবা যারা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম অপরাধের কোনো আলামত নেই। থানায় কেউ কোনোদিন তাদের নামে একটি জিডিও করেননি। নিরীহ মানুষ, দোকানদার, পথচারী, বাস হেলপার, কন্ডাক্টর এই শ্রেণীর লোকেরাও বন্দুকযুদ্ধের শিকার হচ্ছেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরে যারা বন্দুকযুদ্ধের শিকার হন তাদের দুইজনের একজন বাসের হেলপার। অপরজন লেগুনার হেলপার। হাঁটুর উপরে গুলি খেয়ে যারা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, পুলিশের এই গুলির কারণে যাদের পা কেটে ফেলতে হয়েছে, এবং চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদেরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। কেউ দোকানদার, কেউ স্কুলছাত্র, কেউ বা ঝুট ব্যবসায়ী। পরিবারের তরফ থেকে দাবি করা হয় আটক করার পর পুলিশ তাদের কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেছিলো। দিতে পারেনি বলে গুলি করা হয়েছে। তাতে কারো লাভ হয়নি। বরং পথে বসে গেছে এক একটি পরিবার।
এক্ষেত্রে পুলিশের আরও একটি প্রচলিত কথা আছে। আর তা হলো, নিহত ব্যক্তির নামে একাধিক মামলা ছিল। সেভাবে চিন্তা করলে মামলা থাকলেই যেন তাকে নির্বিচারে হত্যা করা জায়েজ। পুলিশের মামলারও কোনো আদি-অন্ত নেই। মামলার ধরন এ রকম যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখি কোনো একটি ঘটনায়, ধরা যাক, ককটেলবাজি, পুলিশের কাজে বাধাদান ইত্যাদি অভিযোগে দশজনের নামে মামলা করে আর ৫০০ অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম তাতে অন্তর্ভুক্ত করে দেয় পুলিশ। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তিদের নাম সেই হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির তালিকায় লিখে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কারো নামে মামলা থাকলেই পুলিশ নিশ্চয়ই তাকে হত্যার অধিকার রাখে না। ‘ক্রসফায়ারে’র ক্ষেত্রে এমন অধিকার-অনধিকার বাছ-বিচার আমরা কমই দেখি।
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, পুলিশই যেন অভিযোগকারী, বিচারক এবং দন্ড কার্যকর করার অধিকারী। দেশের কোনো আইনে তাদের এমন অধিকার দেওয়া হয়নি। অথচ সে রকমই ঘটছে। পুলিশের তরফ থেকে আরও একটি কথা বলা হয়। আর তা হলো, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তি বিএনপি বা জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিল। এটা কী ধরনের অভিযোগ, সেটা বোঝা বেশ মুশকিলের কথা। ভাবখানা যেন এমন যে, বিএনপি বা জামায়াত-শিবিরের কর্মী হলে তাদের নির্বিচারে হত্যা করা যায়। এমন কি নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সংগঠনের নেতা কর্মীকেও নির্বিচারে হত্যা করা যায়। তাছাড়া বিএনপি বা জামায়াত নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। ফলে এসব হত্যাকান্ড স্রেফ হত্যাকান্ডই। অন্যসব হত্যাকান্ডের যেমন বিচার হয় বা হওয়া উচিত এ ধরনের হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। তা হলো আটকের পর অস্বীকার। বাংলাদেশের নাগরিকদের বিপদ হয়েছে এই যে, তাদের ধরতে আসার সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। যে কেউ যে কোনো সময় যে কোনো বেশে যে কাউকে আটক করতে আসতে পারে। আটক করতে আসে র্যাব। আটক করতে আসে ডিবি পুলিশ। আটক করতে আসে পোশাক পরা পুলিশ। এমনকি ইউনিফর্ম ছাড়া পুলিশও আসে আটক করতে। আর বিপদ হলো এই যে, আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা স্রেফ অস্বীকার করে বসে। আবার পরে কখনও তাদের আটকের কথা স্বীকার করে, কখনও করে না। যখন করে না, পরিবারে এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় তখন। কখনও কখনও আটককৃতরা একেবারেই গুম হয়ে যান। কখনও কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায় লাশ। কখনও পাওয়া যায় না। কখনও শোনানো হয় ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কাহিনী।
কার্যত বাংলাদেশ এভাবেই এখন একটি আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে তখন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ভাগ্যে কী ঘটবে, তা আমাদের জানা নেই। সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার কথোপকথনের গোয়েন্দা রেকর্ড প্রকাশিত হবার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে তিনটায় বনানীর একটি বাসা থেকে তাকে ডিবি পুলিশ আটক করেছে বলে মান্নার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ২৪ তারিখ বেলা দেড়টা পর্যন্ত পুলিশ সে কথা স্বীকার করেনি। এ সময় তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী বেগম সুলতানা মাহমুদুর রহমান মান্নার সন্ধান চেয়ে বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছেন। এই পরিস্থিতিটাই বিপজ্জনক। কথোপকথনের ঐ রিপোর্টটি ২৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৩০টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়। সংসদে এমপিরা তাকে গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকেন।
সাধারণত নিয়ম হলো, কাউকে আটক করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। যখন পুলিশের তরফ থেকে অস্বীকার করা হয় যে, তাকে গ্রেফতারই করা হয়নি তখন স্বজনদের মধ্যে ভয় বাড়তে থাকে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি গুম হয়ে যায়, তবে কাউকে তার গুমের দায়িত্ব নিতে হয় না। পুলিশও হাত ঝেড়ে বলে দিতে পারে, আমরা তাকে আটকই করিনি। তার খবরও জানি না। যদিও কোনো মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেলে তাকে খুঁজে বের করাও পুলিশেরই দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন না করার নানা অজুহাত পুলিশকে দিতে শুনেছি। পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা অনেক সময় এমনও বলেছেন যে, তার নামে মামলা রয়েছে। ফলে সে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছে। ব্যস, দায়িত্ব শেষ।
এর আগে বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নেতা ইলিয়াস আলী এইভাবে গুম হয়ে যান। এখনও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। সে সময় অনুসন্ধানে যা তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, একটি বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাকে তার বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় বাধা দিতে গিয়েছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী এক টহল পুলিশ। তাকে ঐ বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে সরিয়ে দেন। কিন্তু কোনো বাহিনীই স্বীকার করেনি যে, ইলিয়াস আলীকে তারা আটক করেছে। আর আজ পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোনো সন্ধানও পাওয়া যায়নি। এভাবে গুম হয়ে গেছে বহু মানুষ।
মাহমুদুর রহমান মান্নার তাহলে কী হলো? পরিবার বলছে, ডিবি পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, তারা তাকে আটক করেনি। এ এক বিপজ্জনক অবস্থা। সেক্ষেত্রে কাউকে যদি ডিবি পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে আটক করতে যায়, তাহলে ঐ পরিবারের সদস্যদের করণীয় কী? তারা কি তাদের অফিসিয়াল প্যাডে লিখিত চাইবেন যে, আটক যে করে নিয়ে যাচ্ছেন, তার রিসিট দেন। তখন যে তারা পরিবারের সদস্যদেরও বেধড়ক পিটুনি দিতে থাকবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এবং এর কোনো বিচারও নেই। এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে না পেয়ে তার পরিবারের নারী সদস্যদের উপরও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অহরহ মিথ্যাচারও চলছে।
আমরা বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকা-ই মেনে নিতে রাজি নই। এসব হত্যাকা-েরও বিচার হওয়া উচিত। একই সঙ্গে খানিকটা আতঙ্কিতও বোধ করছি, মাহমুদুর রহমান মান্নার জন্য। আমরা আশা করি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সরকার অবিলম্বে আদালতে হাজির করবে। তার যদি কোনো দোষ হয়ে থাকে, তার বিচার আদালত করবে, পুলিশ নয়।
বাংলাদেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কাহিনী যখন থেকে প্রচারিত হয়েছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে অবিশ্বাস। বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা বলছে তা বিশ্বাস করছে না কেউ। কখনও কখনও তাদের বক্তব্য আজগুবি ঠেকছে। এবং এটা চলছে ধারাবাহিকভাবেই। সর্বশেষ ঢাকা ও ঝিনাইদহে যে ছয়জন তরুণ খুন হলেন তার কোনো দায়-দায়িত্বই যেন কেউ নিতে চাইছে না। পুলিশ বলছে ঢাকায় যে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে তাদের একজন মারা গেছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’। বাকি তিনজন ‘গণপিটুনি’তে নিহত হয়েছেন। যে তিনজন ‘গণপিটুনি’তে মারা গিয়েছে বলে পুলিশ দাবি করছে, তাদের দেহে পাওয়া গেছে ৫৪টি গুলির চিহ্ন। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে গুলির চিহ্নের কথা উল্লেখ রয়েছে। এলাকায় গিয়ে সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, সেখানে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। রাত ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে আশপাশের বাসিন্দারা কেবল গুলির শব্দই শুনেছে। চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি, হল্লার কোনো শব্দ তারা শোনেনি। ঘটনাস্থল এলাকায় পড়ে ছিলো গুলির খোসা, রক্তমাখা দড়ি আর ছোপ ছোপ রক্ত। এদিকে ঝিনাইদহে যে দুই তরুণের লাশ পাওয়া গেছে তাদের পরিবারের অভিযোগ, কয়েকদিন আগে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। এই দুইজনই বিএনপি’র কর্মী ছিলেন। এভাবেই নির্বিচার হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।
‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাগুলো পুলিশের ভাষ্যমতে একই রকম। যাকে আটক করা হলো, তাকে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পথিমধ্যে তার সহযোগীরা পুলিশের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে সবসময় পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশের গায়েও গুলি লাগে না। সহযোগীদের গুলির আঘাতে পুলিশের গাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। আবার যারা এই হামলা চালায় তাদের কেউও কখনও পুলিশের গুলিতে হতাহত হয় না। শুধু পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তি নিহত হন। এর নামই ‘বন্দুকযুদ্ধ’। ফলে সাধারণভাবে কেউই এই কাহিনী বিশ্বাস করে না। কিন্তু কাহিনীর এই ধারাবিবরণী বহুদিন ধরে চলে আসছে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিংবা যারা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম অপরাধের কোনো আলামত নেই। থানায় কেউ কোনোদিন তাদের নামে একটি জিডিও করেননি। নিরীহ মানুষ, দোকানদার, পথচারী, বাস হেলপার, কন্ডাক্টর এই শ্রেণীর লোকেরাও বন্দুকযুদ্ধের শিকার হচ্ছেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরে যারা বন্দুকযুদ্ধের শিকার হন তাদের দুইজনের একজন বাসের হেলপার। অপরজন লেগুনার হেলপার। হাঁটুর উপরে গুলি খেয়ে যারা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, পুলিশের এই গুলির কারণে যাদের পা কেটে ফেলতে হয়েছে, এবং চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদেরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। কেউ দোকানদার, কেউ স্কুলছাত্র, কেউ বা ঝুট ব্যবসায়ী। পরিবারের তরফ থেকে দাবি করা হয় আটক করার পর পুলিশ তাদের কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেছিলো। দিতে পারেনি বলে গুলি করা হয়েছে। তাতে কারো লাভ হয়নি। বরং পথে বসে গেছে এক একটি পরিবার।
এক্ষেত্রে পুলিশের আরও একটি প্রচলিত কথা আছে। আর তা হলো, নিহত ব্যক্তির নামে একাধিক মামলা ছিল। সেভাবে চিন্তা করলে মামলা থাকলেই যেন তাকে নির্বিচারে হত্যা করা জায়েজ। পুলিশের মামলারও কোনো আদি-অন্ত নেই। মামলার ধরন এ রকম যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখি কোনো একটি ঘটনায়, ধরা যাক, ককটেলবাজি, পুলিশের কাজে বাধাদান ইত্যাদি অভিযোগে দশজনের নামে মামলা করে আর ৫০০ অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম তাতে অন্তর্ভুক্ত করে দেয় পুলিশ। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তিদের নাম সেই হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির তালিকায় লিখে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কারো নামে মামলা থাকলেই পুলিশ নিশ্চয়ই তাকে হত্যার অধিকার রাখে না। ‘ক্রসফায়ারে’র ক্ষেত্রে এমন অধিকার-অনধিকার বাছ-বিচার আমরা কমই দেখি।
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, পুলিশই যেন অভিযোগকারী, বিচারক এবং দন্ড কার্যকর করার অধিকারী। দেশের কোনো আইনে তাদের এমন অধিকার দেওয়া হয়নি। অথচ সে রকমই ঘটছে। পুলিশের তরফ থেকে আরও একটি কথা বলা হয়। আর তা হলো, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ব্যক্তি বিএনপি বা জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিল। এটা কী ধরনের অভিযোগ, সেটা বোঝা বেশ মুশকিলের কথা। ভাবখানা যেন এমন যে, বিএনপি বা জামায়াত-শিবিরের কর্মী হলে তাদের নির্বিচারে হত্যা করা যায়। এমন কি নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সংগঠনের নেতা কর্মীকেও নির্বিচারে হত্যা করা যায়। তাছাড়া বিএনপি বা জামায়াত নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। ফলে এসব হত্যাকান্ড স্রেফ হত্যাকান্ডই। অন্যসব হত্যাকান্ডের যেমন বিচার হয় বা হওয়া উচিত এ ধরনের হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। তা হলো আটকের পর অস্বীকার। বাংলাদেশের নাগরিকদের বিপদ হয়েছে এই যে, তাদের ধরতে আসার সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। যে কেউ যে কোনো সময় যে কোনো বেশে যে কাউকে আটক করতে আসতে পারে। আটক করতে আসে র্যাব। আটক করতে আসে ডিবি পুলিশ। আটক করতে আসে পোশাক পরা পুলিশ। এমনকি ইউনিফর্ম ছাড়া পুলিশও আসে আটক করতে। আর বিপদ হলো এই যে, আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা স্রেফ অস্বীকার করে বসে। আবার পরে কখনও তাদের আটকের কথা স্বীকার করে, কখনও করে না। যখন করে না, পরিবারে এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় তখন। কখনও কখনও আটককৃতরা একেবারেই গুম হয়ে যান। কখনও কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায় লাশ। কখনও পাওয়া যায় না। কখনও শোনানো হয় ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কাহিনী।
কার্যত বাংলাদেশ এভাবেই এখন একটি আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে তখন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ভাগ্যে কী ঘটবে, তা আমাদের জানা নেই। সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার কথোপকথনের গোয়েন্দা রেকর্ড প্রকাশিত হবার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে তিনটায় বনানীর একটি বাসা থেকে তাকে ডিবি পুলিশ আটক করেছে বলে মান্নার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ২৪ তারিখ বেলা দেড়টা পর্যন্ত পুলিশ সে কথা স্বীকার করেনি। এ সময় তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী বেগম সুলতানা মাহমুদুর রহমান মান্নার সন্ধান চেয়ে বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেছেন। এই পরিস্থিতিটাই বিপজ্জনক। কথোপকথনের ঐ রিপোর্টটি ২৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৩০টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়। সংসদে এমপিরা তাকে গ্রেফতারের দাবি জানাতে থাকেন।
সাধারণত নিয়ম হলো, কাউকে আটক করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। যখন পুলিশের তরফ থেকে অস্বীকার করা হয় যে, তাকে গ্রেফতারই করা হয়নি তখন স্বজনদের মধ্যে ভয় বাড়তে থাকে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি গুম হয়ে যায়, তবে কাউকে তার গুমের দায়িত্ব নিতে হয় না। পুলিশও হাত ঝেড়ে বলে দিতে পারে, আমরা তাকে আটকই করিনি। তার খবরও জানি না। যদিও কোনো মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেলে তাকে খুঁজে বের করাও পুলিশেরই দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন না করার নানা অজুহাত পুলিশকে দিতে শুনেছি। পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা অনেক সময় এমনও বলেছেন যে, তার নামে মামলা রয়েছে। ফলে সে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপন করেছে। ব্যস, দায়িত্ব শেষ।
এর আগে বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নেতা ইলিয়াস আলী এইভাবে গুম হয়ে যান। এখনও তার কোনো খোঁজ মেলেনি। সে সময় অনুসন্ধানে যা তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায়, একটি বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাকে তার বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় বাধা দিতে গিয়েছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী এক টহল পুলিশ। তাকে ঐ বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে সরিয়ে দেন। কিন্তু কোনো বাহিনীই স্বীকার করেনি যে, ইলিয়াস আলীকে তারা আটক করেছে। আর আজ পর্যন্ত ইলিয়াস আলীর কোনো সন্ধানও পাওয়া যায়নি। এভাবে গুম হয়ে গেছে বহু মানুষ।
মাহমুদুর রহমান মান্নার তাহলে কী হলো? পরিবার বলছে, ডিবি পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, তারা তাকে আটক করেনি। এ এক বিপজ্জনক অবস্থা। সেক্ষেত্রে কাউকে যদি ডিবি পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে আটক করতে যায়, তাহলে ঐ পরিবারের সদস্যদের করণীয় কী? তারা কি তাদের অফিসিয়াল প্যাডে লিখিত চাইবেন যে, আটক যে করে নিয়ে যাচ্ছেন, তার রিসিট দেন। তখন যে তারা পরিবারের সদস্যদেরও বেধড়ক পিটুনি দিতে থাকবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এবং এর কোনো বিচারও নেই। এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে না পেয়ে তার পরিবারের নারী সদস্যদের উপরও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অহরহ মিথ্যাচারও চলছে।
আমরা বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকা-ই মেনে নিতে রাজি নই। এসব হত্যাকা-েরও বিচার হওয়া উচিত। একই সঙ্গে খানিকটা আতঙ্কিতও বোধ করছি, মাহমুদুর রহমান মান্নার জন্য। আমরা আশা করি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সরকার অবিলম্বে আদালতে হাজির করবে। তার যদি কোনো দোষ হয়ে থাকে, তার বিচার আদালত করবে, পুলিশ নয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন