এখন আলোচনার তুঙ্গে পেট্রল বোমাবাজ। সন্দেহ নেই, বাসে ট্রাকে নিরীহ মানুষের উপর যারা পেট্রল বোমা মারছে, তারা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছে। এ অপরাধকে মানবতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই নানা প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। বিশদলীয় জোটের অবরোধ শুরু হয়েছে ৬ জানুয়ারি থেকে। তার আগে ৩ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে অবরোধ ডেকেছিল সরকার। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বিশদলীয় জোট আহূত ঢাকার সমাবেশ ভন্ডুল করার জন্য সরকার সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। তার আগে ২৭ ডিসেম্বর (২০১৪) গাজীপুরে আহূত বিশদলীয় জোটের জনসভা পণ্ড করতে আওয়ামী লীগ সেখানে ছাত্রলীগকে দিয়ে এক জনসভা ডাকায়। যদিও ঐ সমাবেশ করার জন্য তারা বেশ আগেই জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করেছিল। তারও আগে ২৩ ডিসেম্বর (২০১৪) বিশদলীয় জোটের সভা করার কথা ছিল গাজীপুরে। কিন্তু ঐ দিন প্রধানমন্ত্রী টঙ্গী শ্রমিক সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ায় বিশদলীয় জোট জনসভার তারিখ পরিবর্তন করে।
ছাত্রলীগের ঐ জনসভা আহবানের পর সরকার জেলা প্রশাসককে দিয়ে ঐ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করায়। ফলে বিএনপি আহূত জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। আবার ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও, আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, দিনভর সেখানে পুলিশের সামনে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ করলো ছাত্রলীগ। এবং কী আশ্চর্য, তাতে সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হলো না।
আসল বিপদটা ছিল অন্য জায়গায়। ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে বেশ কয়েকটি জনসভার ডাক দেয়। তার সবগুলোই মর্মান্তিক রকম ফ্লপ হয়েছিল। এর কোনোটায় প্রধান অতিথি ছিলেন হাসিনা তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়। কোনোটায় বা দলীয় শীর্ষ নেতারা ছিলেন বক্তা। একটায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনসভায় লোক সমাগম না হওয়ায় জয় সভায় উপস্থিত হননি। আর একটি জনসভায় মন্ত্রী নেতারা উপস্থিত ছিলেন বটে, কিন্তু তাদের বক্তব্য শোনার জন্য কোনো শ্রোতা ছিল না। ফলে তারা সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ বেতারের শিল্পীদের দিয়ে গান গাইয়ে লোক সমাগমের চেষ্টা করেছিলেন তারা। কিন্তু সে চেষ্টাও হাস্যকর রকম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সর্বশেষ জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। কিন্তু তাতেও দুই-তিন হাজারের বেশি লোক সমাগম হয়নি। যা-ও-বা হয়েছিল তাদেরও বেশিরভাগ ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। মিউনিসিপ্যালিটির গাড়িতে করে এদের জনসভাস্থলে নিয়ে আসা হয়েছিল।
কিন্তু তার আগের কয়েক মাস বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই জনসভা করতে গেছেন, সেখানেই স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা শঙ্কিত ছিলেন ৫ জানুয়ারি সোহরোওয়ার্দীতে তিনি যে জনসভার ডাক দিয়েছিলেন, সেটিও একইভাবে ফ্লপ করে যাবে। আর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট নয়াপল্টনের যে জনসভার ডাক দিয়েছিলেন, তাতে কমপক্ষে ১০ লক্ষ লোক সমাগম হবে। এবং অথর্ব গোয়েন্দা বিভাগ রিপোর্ট দিয়েছিলো যে, এই ১০ লক্ষ লোক রাজপথে বসে পড়বে আর সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই বসে পড়বে আর সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পতন ঘটবে, তা কি আদৌ সম্ভব? এই দশ লাখ লোককে রাস্তায় বসে থাকতে হবে বেশ কিছুদিন। তারা খাবে কি? থাকবে কোথায়? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিবে কীভাবে? তাদের জন্য তো আর শাহবাগীদের মতো সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমান টয়লেট-গোসলখানা ব্যবহার করবে না। প্রতিদিন হাজার হাজার প্যাকেট খাবারও বিতরণ করবে না। এমনকি আসবে না লক্ষ লক্ষ পানির বোতল। গোয়েন্দা বিভাগ সেসব খতিয়ে দেখেনি। এসব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হলো, বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
৩ তারিখ রাতেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীকে গ্রেফতার করে অনেকটা এরশাদ স্টাইলে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বিএনপির কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। সে সময় বিশদলীয় জোট নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে ১১টায় তিনি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে সরকার তার কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সকল গেইটে তালা লাগিয়ে দেয়। তিনি তার কার্যালয়েই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরদিন থেকে শুরু হয় নানা নাটক। রাস্তা থেকে ডজনখানেক ইট-বালুর ট্রাক ধরে এনে বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ের পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্যালয়ের সামনে নিয়ে আসা হয় প্রিজন ভ্যান, জলকামান, অ্যাম্বুলেন্স। এলাকাটি হয়ে ওঠে রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র।
৫ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩টায় নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া সমাবেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সরকার তো তাকে বের হতে দেয়ইনি, বরং তার ও তার নেতাকর্মীদের উপর বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ বিষ পেপার স্প্রে ছুঁড়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পরের ঘটনাগুলো ঘটে দ্রুত। বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় ঘিরে একের পর এক নাটক চলতে থাকে। কখনও নিরাপত্তা বেষ্টনী দুই স্তরে নেমে আসে। কখনও ছয় স্তরে উঠে যায়। কখনও তার গেইটের তালা খোলে। কখনও আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ার ইন্তেকাল করেন। শোকের ছায়া নেমে আসে সারাদেশে। ২৭ তারিখ তার লাশ নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। আদরের সন্তানের লাশ দেখে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে শোক জানাতে গেইট পর্যন্ত গিয়ে ফেরত আসেন। সেদিনই দুপুরে যাত্রাবাড়িতে বাস পোড়ানোর কেসে হুকুমের আসামী করে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সরকার। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাকে সমবেদনা জানাতে যান প্রধানমন্ত্রী। তা নিয়েও নাটক এবং প্রশ্নের শেষ নেই। তার তিনদিন পর গুলশানস্থ বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। সঙ্গে টিএনটি টেলিফোন ও মোবাইল সংযোগ, ডিস লাইন, ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে সরকার।
তার পরের ঘটনাই সবচাইতে মারাত্মক। ৫ তারিখে বিশদলীয় জোট ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত আছে। কিন্তু বাড়তে থাকে পেট্রল বোমা হামলা। সরকার নামিয়ে দেয় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাহিনী। অপারেশনে নেমে তারা যে ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো, তাতে মনে হয়, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ঐ তিনবাহিনীই গ্রহণ করেছে। তাদের ভাষা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর ভাষা নয়। সে ভাষা অধম তথা ‘হাইব্রিড’ আওয়ামী নেতাদের চেয়েও নিকৃষ্ট। সরকারই যদি প্রকৃত ক্ষমতাধর হতো, তাহলে ঐ তিন বাহিনী প্রধান এ ধরনের উক্তি করতে পারতেন না। এরপর রহস্যজনকভাবে বেড়ে গেছে পেট্রল বোমা হামলার ঘটনা।
সত্য যে এই পেট্রল বোমা হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগুনে পুড়ে যারা হাসপাতালের বেড়ে কাতরাচ্ছেন, তারা নিরীহ মানুষ। কিন্তু কে চালাচ্ছে এই পেট্রল বোমা হামলা সে প্রশ্নে আওয়ামী ঘরানার লোকেরা এবং ক্ষীয়মান বামদলের নেতারা একযোগে বলার চেষ্টা করছেন যে, পেট্রল বোমা হামলার জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী, বিএনপি তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন চিত্র উঠে আসে। ইতিমধ্যে সরকার অবরোধ কর্মসূচী ভ-ুল করে দেওয়ার জন্য বাস-ট্রাক চালকদের এই বলে আশ্বাস দেয় যে, আপনারা গাড়ি চালান, সরকার র্যাব-পুলিশ-বিজিবি দিয়ে পাহারা দিবে। পাহারা দেওয়া শুরু হয়। পেট্রল বোমা হামলাও বাড়তে থাকে। এ পর্যন্ত যে কয়েকটি বড় ধরনের পেট্রল বোমা হামলা হয়েছে, তার সব ক’টি বাস-ট্রাকের সামনে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, আনসার বাহিনী নিয়োজিত ছিল। তার মাঝখানেই পেট্রল বোমাবাজরা বাস-ট্রাকে হামলা চালায়। ডজন ডজন মানুষের পুড়িয়ে মারা ও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ সরকার শত স্টান্টবাজি সত্ত্বেও মানুষের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। আরও আশ্চর্য ঘটনা এই যে, ঐসব বন্দুকধারী পাহারাদাররা ঘটনাস্থলে কোনো বোমাবাজকেই পাকড়াও করতে পারেনি বা গুলি করে হত্যা করেনি। পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে।
সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় যে, ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে পুলিশ ১০টি পেট্রল বোমা উদ্ধার করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদের ভাড়া বাড়িতে ৭ ফেব্রুয়ারি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এ বিস্ফোরণের পর পুলিশ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কাউকে ঢুকতে দেয়নি। বাড়িতে আগুন লাগলে দমকল বাহিনী সে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিস্ফোরণ নিয়ে কেউ কোনো কথাই বলতে চায়নি। আসলে সেটি ছিল সম্ভবত ঐ সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণাধীন পেট্রল বোমার কারখানা। গত ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকা থেকে বিপুল পেট্রল বোমাসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। সংবাদপত্রের খবরে দেখা যায়, ৫ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে চার ছাত্রলীগ নেতা আহত হয়েছে। একইদিন রাজশাহীতে রাজশাহী বিশ্বদ্যালয়ের ফেসবুকের অফিসিয়াল পেজ-এ ঘোষণা দিয়ে জানায় যে, বোমা আমরা মেরেছি। দোষ হচ্ছে ছাত্রদল-জামায়াত শিবিরের। এই হচ্ছে পলিটিক্স। ৫ ফেব্রুয়ারি চৌদ্দগ্রামে পেট্রল বোমাসহ দুই যুগলীগ নেতাকে আটক করা হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর শীর্ষ সংবাদে বলা হয় ‘জামিনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রত্যায়নপত্র/ বোমাবাজরা সৎ ও মেধাবী’। তাতে বলা হয়, নাশকতার দায়ে কমপক্ষে ৫০০ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মুক্তির জন্য সৎ ও মেধাবী সার্টিফিকেট দিয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপিসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা। গ্রেফতারকৃতরা যদি আওয়ামী লীগের না-ই হবেন, তবে তাদের সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দেওয়াও প্রয়োজন আওয়ামী নেতাদের কেনো হবে? এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব হানিফ বলেছেন, বিএনপি যদি হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা মধ্যে তারা পেট্রল বোমাবাজির অবসান ঘটাতে পারবে। তবে কি পেট্রল বোমাবাজরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন? এদিকে আবার প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, পেট্রল বোমা হামলার ধরন দেখে মনে হয় ‘এটা যেন মিলিটারী অপারেশন। যারা করেছে তারা দক্ষতার সঙ্গে করেছে। তার মনে হয়েছে তারা আগে থেকেই এলাকা রেকি করেছে। আর পেট্রল বোমায় যে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো সাধারণ দাহ্য পদার্থ নয়। বিশেষ ধরনের পদার্থ যা বিশেষ ধরনের লোকদের কাছে থাকাই স্বাভাবিক।’
এই হলো পেট্রল বোমা কাহিনী। আমি এদেশের নাগরিক, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক সকলের কাছে একটি চিত্র তুলে ধরলাম মাত্র। বিবেচনার ভার দেশবাসীর।
ছাত্রলীগের ঐ জনসভা আহবানের পর সরকার জেলা প্রশাসককে দিয়ে ঐ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করায়। ফলে বিএনপি আহূত জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। আবার ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও, আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, দিনভর সেখানে পুলিশের সামনে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ করলো ছাত্রলীগ। এবং কী আশ্চর্য, তাতে সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হলো না।
আসল বিপদটা ছিল অন্য জায়গায়। ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ সোহরোওয়ার্দী উদ্যানে বেশ কয়েকটি জনসভার ডাক দেয়। তার সবগুলোই মর্মান্তিক রকম ফ্লপ হয়েছিল। এর কোনোটায় প্রধান অতিথি ছিলেন হাসিনা তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়। কোনোটায় বা দলীয় শীর্ষ নেতারা ছিলেন বক্তা। একটায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনসভায় লোক সমাগম না হওয়ায় জয় সভায় উপস্থিত হননি। আর একটি জনসভায় মন্ত্রী নেতারা উপস্থিত ছিলেন বটে, কিন্তু তাদের বক্তব্য শোনার জন্য কোনো শ্রোতা ছিল না। ফলে তারা সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ বেতারের শিল্পীদের দিয়ে গান গাইয়ে লোক সমাগমের চেষ্টা করেছিলেন তারা। কিন্তু সে চেষ্টাও হাস্যকর রকম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সর্বশেষ জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। কিন্তু তাতেও দুই-তিন হাজারের বেশি লোক সমাগম হয়নি। যা-ও-বা হয়েছিল তাদেরও বেশিরভাগ ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। মিউনিসিপ্যালিটির গাড়িতে করে এদের জনসভাস্থলে নিয়ে আসা হয়েছিল।
কিন্তু তার আগের কয়েক মাস বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই জনসভা করতে গেছেন, সেখানেই স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা শঙ্কিত ছিলেন ৫ জানুয়ারি সোহরোওয়ার্দীতে তিনি যে জনসভার ডাক দিয়েছিলেন, সেটিও একইভাবে ফ্লপ করে যাবে। আর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিশদলীয় জোট নয়াপল্টনের যে জনসভার ডাক দিয়েছিলেন, তাতে কমপক্ষে ১০ লক্ষ লোক সমাগম হবে। এবং অথর্ব গোয়েন্দা বিভাগ রিপোর্ট দিয়েছিলো যে, এই ১০ লক্ষ লোক রাজপথে বসে পড়বে আর সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই বসে পড়বে আর সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পতন ঘটবে, তা কি আদৌ সম্ভব? এই দশ লাখ লোককে রাস্তায় বসে থাকতে হবে বেশ কিছুদিন। তারা খাবে কি? থাকবে কোথায়? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিবে কীভাবে? তাদের জন্য তো আর শাহবাগীদের মতো সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমান টয়লেট-গোসলখানা ব্যবহার করবে না। প্রতিদিন হাজার হাজার প্যাকেট খাবারও বিতরণ করবে না। এমনকি আসবে না লক্ষ লক্ষ পানির বোতল। গোয়েন্দা বিভাগ সেসব খতিয়ে দেখেনি। এসব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হলো, বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে না।
৩ তারিখ রাতেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীকে গ্রেফতার করে অনেকটা এরশাদ স্টাইলে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বিএনপির কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। সে সময় বিশদলীয় জোট নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে ১১টায় তিনি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে সরকার তার কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সকল গেইটে তালা লাগিয়ে দেয়। তিনি তার কার্যালয়েই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরদিন থেকে শুরু হয় নানা নাটক। রাস্তা থেকে ডজনখানেক ইট-বালুর ট্রাক ধরে এনে বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ের পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্যালয়ের সামনে নিয়ে আসা হয় প্রিজন ভ্যান, জলকামান, অ্যাম্বুলেন্স। এলাকাটি হয়ে ওঠে রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র।
৫ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৩টায় নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া সমাবেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সরকার তো তাকে বের হতে দেয়ইনি, বরং তার ও তার নেতাকর্মীদের উপর বিষাক্ত ও নিষিদ্ধ বিষ পেপার স্প্রে ছুঁড়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পরের ঘটনাগুলো ঘটে দ্রুত। বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় ঘিরে একের পর এক নাটক চলতে থাকে। কখনও নিরাপত্তা বেষ্টনী দুই স্তরে নেমে আসে। কখনও ছয় স্তরে উঠে যায়। কখনও তার গেইটের তালা খোলে। কখনও আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ার ইন্তেকাল করেন। শোকের ছায়া নেমে আসে সারাদেশে। ২৭ তারিখ তার লাশ নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। আদরের সন্তানের লাশ দেখে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে শোক জানাতে গেইট পর্যন্ত গিয়ে ফেরত আসেন। সেদিনই দুপুরে যাত্রাবাড়িতে বাস পোড়ানোর কেসে হুকুমের আসামী করে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সরকার। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তাকে সমবেদনা জানাতে যান প্রধানমন্ত্রী। তা নিয়েও নাটক এবং প্রশ্নের শেষ নেই। তার তিনদিন পর গুলশানস্থ বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। সঙ্গে টিএনটি টেলিফোন ও মোবাইল সংযোগ, ডিস লাইন, ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করে সরকার।
তার পরের ঘটনাই সবচাইতে মারাত্মক। ৫ তারিখে বিশদলীয় জোট ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের শান্তিপূর্ণ অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত আছে। কিন্তু বাড়তে থাকে পেট্রল বোমা হামলা। সরকার নামিয়ে দেয় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাহিনী। অপারেশনে নেমে তারা যে ভাষায় কথা বলতে শুরু করলো, তাতে মনে হয়, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ঐ তিনবাহিনীই গ্রহণ করেছে। তাদের ভাষা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর ভাষা নয়। সে ভাষা অধম তথা ‘হাইব্রিড’ আওয়ামী নেতাদের চেয়েও নিকৃষ্ট। সরকারই যদি প্রকৃত ক্ষমতাধর হতো, তাহলে ঐ তিন বাহিনী প্রধান এ ধরনের উক্তি করতে পারতেন না। এরপর রহস্যজনকভাবে বেড়ে গেছে পেট্রল বোমা হামলার ঘটনা।
সত্য যে এই পেট্রল বোমা হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগুনে পুড়ে যারা হাসপাতালের বেড়ে কাতরাচ্ছেন, তারা নিরীহ মানুষ। কিন্তু কে চালাচ্ছে এই পেট্রল বোমা হামলা সে প্রশ্নে আওয়ামী ঘরানার লোকেরা এবং ক্ষীয়মান বামদলের নেতারা একযোগে বলার চেষ্টা করছেন যে, পেট্রল বোমা হামলার জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী, বিএনপি তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন চিত্র উঠে আসে। ইতিমধ্যে সরকার অবরোধ কর্মসূচী ভ-ুল করে দেওয়ার জন্য বাস-ট্রাক চালকদের এই বলে আশ্বাস দেয় যে, আপনারা গাড়ি চালান, সরকার র্যাব-পুলিশ-বিজিবি দিয়ে পাহারা দিবে। পাহারা দেওয়া শুরু হয়। পেট্রল বোমা হামলাও বাড়তে থাকে। এ পর্যন্ত যে কয়েকটি বড় ধরনের পেট্রল বোমা হামলা হয়েছে, তার সব ক’টি বাস-ট্রাকের সামনে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, আনসার বাহিনী নিয়োজিত ছিল। তার মাঝখানেই পেট্রল বোমাবাজরা বাস-ট্রাকে হামলা চালায়। ডজন ডজন মানুষের পুড়িয়ে মারা ও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ সরকার শত স্টান্টবাজি সত্ত্বেও মানুষের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। আরও আশ্চর্য ঘটনা এই যে, ঐসব বন্দুকধারী পাহারাদাররা ঘটনাস্থলে কোনো বোমাবাজকেই পাকড়াও করতে পারেনি বা গুলি করে হত্যা করেনি। পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে।
সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় যে, ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে পুলিশ ১০টি পেট্রল বোমা উদ্ধার করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদের ভাড়া বাড়িতে ৭ ফেব্রুয়ারি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এ বিস্ফোরণের পর পুলিশ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কাউকে ঢুকতে দেয়নি। বাড়িতে আগুন লাগলে দমকল বাহিনী সে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিস্ফোরণ নিয়ে কেউ কোনো কথাই বলতে চায়নি। আসলে সেটি ছিল সম্ভবত ঐ সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণাধীন পেট্রল বোমার কারখানা। গত ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকা থেকে বিপুল পেট্রল বোমাসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। সংবাদপত্রের খবরে দেখা যায়, ৫ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে চার ছাত্রলীগ নেতা আহত হয়েছে। একইদিন রাজশাহীতে রাজশাহী বিশ্বদ্যালয়ের ফেসবুকের অফিসিয়াল পেজ-এ ঘোষণা দিয়ে জানায় যে, বোমা আমরা মেরেছি। দোষ হচ্ছে ছাত্রদল-জামায়াত শিবিরের। এই হচ্ছে পলিটিক্স। ৫ ফেব্রুয়ারি চৌদ্দগ্রামে পেট্রল বোমাসহ দুই যুগলীগ নেতাকে আটক করা হয়।
৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর শীর্ষ সংবাদে বলা হয় ‘জামিনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রত্যায়নপত্র/ বোমাবাজরা সৎ ও মেধাবী’। তাতে বলা হয়, নাশকতার দায়ে কমপক্ষে ৫০০ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মুক্তির জন্য সৎ ও মেধাবী সার্টিফিকেট দিয়েছেন আওয়ামী লীগের এমপিসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা। গ্রেফতারকৃতরা যদি আওয়ামী লীগের না-ই হবেন, তবে তাদের সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দেওয়াও প্রয়োজন আওয়ামী নেতাদের কেনো হবে? এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব হানিফ বলেছেন, বিএনপি যদি হরতাল-অবরোধ তুলে নেয়, তাহলে ২৪ ঘণ্টা মধ্যে তারা পেট্রল বোমাবাজির অবসান ঘটাতে পারবে। তবে কি পেট্রল বোমাবাজরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন? এদিকে আবার প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, পেট্রল বোমা হামলার ধরন দেখে মনে হয় ‘এটা যেন মিলিটারী অপারেশন। যারা করেছে তারা দক্ষতার সঙ্গে করেছে। তার মনে হয়েছে তারা আগে থেকেই এলাকা রেকি করেছে। আর পেট্রল বোমায় যে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো সাধারণ দাহ্য পদার্থ নয়। বিশেষ ধরনের পদার্থ যা বিশেষ ধরনের লোকদের কাছে থাকাই স্বাভাবিক।’
এই হলো পেট্রল বোমা কাহিনী। আমি এদেশের নাগরিক, সুশীল সমাজ, রাজনীতিক সকলের কাছে একটি চিত্র তুলে ধরলাম মাত্র। বিবেচনার ভার দেশবাসীর।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন