মানবাধিকার কথাটি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের নিকট অতি সুপরিচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি শব্দ। মানবাধিকার শব্দের ইংরেজি প্রতি শব্দ হচ্ছে Human rights. বাংলা ভাষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দের সমন্বয়ে মানবাধিকার শব্দটি গঠিত হয়েছে। একটি শব্দ ‘মানব’ অপরটি ‘অধিকার’। প্রথমটির অর্থ হচ্ছে-মানুষ আর দ্বিতীয়টির অর্থ হচ্ছে যারা মানুষ তাদের অধিকার। অর্থাৎ মানবাধিকার কথাটির পরিপূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় মানুষের অধিকার। এ অধিকার মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। যা স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। তাই এ অধিকার সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কাজ করা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। অতএব মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বলা যায়, মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবাধিকার বা Human rights।
আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত ও বৈদগ্ধ্য ব্যক্তিবর্গ বলে থাকেন; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এগুলোই শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি, এগুলোর পাশাপাশি মানুষের সুষ্ঠু জীবনধারণের প্রয়োজনে আরও অনেক অধিকার রয়েছে। যেগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে পরিগণিত। যেমন: বাকস্বাধীনতার অধিকার, নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, জীবনধারণের অধিকার, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার পরিচালনার অধিকার, রাষ্ট্রে শান্তিতে বসবাস করার অধিকার, চুরি- ডাকাতি ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা থেকে বাঁচার অধিকার, নিজের জমি-জমা, গাছ-পালা ও বাগান-বাড়ি সন্ত্রাসীদের লুট-পাট থেকে রক্ষার অধিকার, অন্যায়ভাবে কারো হামলা থেকে বাঁচার অধিকার, স্বাধীনভাবে চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার, শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে বাঁচার অধিকার, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর অনৈতিক হামলা থেকে নিজেকে আত্মরক্ষার অধিকার, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলার পরিবেশ পাবার অধিকার, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার, দেশ, জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কল্যাণরূপে গড়ে তোলার অধিকার, মানব সেবার অধিকার, পেট্রোল বোমার আঘাত থেকে বেঁচে থাকার অধিকার, জনসভা ও সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সর্বোপরি জননিরাপত্তার অধিকারও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। মোটকথা মানুষের মৌলিক জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবাধিকার।
মানবাধিকারের গুরুত্ব
মনুষ্যত্বের বা The quality of being human-এর পরিপূর্ণ বিকাশে মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিহার্য। মৌলিক চাহিদা পূরণসহ নিরাপত্তামূলক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করা সরকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এছাড়া মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমেই মানবাধিকার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। তাই শুধু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নয়; বরং এগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সকল অধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিতে জীবনযাপন করার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার সুরক্ষিত হতে পারে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। গোটা পৃথিবীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও রক্ষায় তিনি সংগ্রাম করেছেন। আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্যাতিত-নিপিড়ীত মানবাত্মার পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন; ‘কি কারণে তোমরা সেসব নারী, পুরুষ ও শিশুদের খাতিরে আল্লাহর অনুসৃত পথে সংগ্রাম করছো না? অথচ যারা নির্যাতিত, নিপিড়ীত ও দুর্বল হবার কারণে আমার নিকট ফরিয়াদ করছে এবং বলছে; হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে এ জালিমদের অত্যাচার থেকে বের করে নাও, অথবা তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন দরদী-বন্ধু ও সাহায্যকারী পাঠিয়ে দাও’ (সূরা নিসা-৭৫)। আমাদের দেশে অতীত নেতৃত্ব দানে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তারাও আমরণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের পবিত্র সংবিধানেও গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা সন্নিবেশিত আছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে- ”The Republic Shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed, and in which effective participation by the people through their elected representatives in administration at all level shall be ensured-’’ অর্থাৎ ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে, এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’। আমাদের দেশের সরকারও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় অত্যন্ত যতœশীল বলে আমি মনে করি। কিন্তু সংবিধানের ধারায় বর্ণিত বিধান অনুযায়ী আমাদের দেশে বর্তমানে গণতন্ত্রের আবরণে চলছে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র। কোথায় আজ ন্যায় বিচার, কোথায় আইনের শাসন, কোথায় প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ? মানবাধিকার আজ বস্তাবন্দী ও সিন্দুকে তালাবদ্ধ। তাই এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন। যা মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত বিবেককে উজ্জীবিত করবে, বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে জাগ্রত করবে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশে মানবাধিকার আন্দোলন দিন দিন জোরদার হচ্ছে। তাছাড়া মানব সভ্যতাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য অন্যতম দিকনির্দেশক হচ্ছে-জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র। এ ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র প্রায় সকল দেশ এখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণও চায় এদেশে সঠিকভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ অধিকার ফিরে পাক। কারণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র তার আসল রূপ ফিরে পাবে। প্রশাসন নির্বিঘেœ প্রশাসনিক কর্মকা- পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তার বিচারিক কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতাবলী নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে।
মানবাধিকার সংস্থাসমূহের করণীয়
দেশের সামগ্রিক স্বার্থে রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং মানবাধিকার সংস্থাসমূহের উচিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। কোন সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার মেনে নিতে পারে না, নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, বিচারবহির্ভূত অথবা বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকা-কে মেনে নিতে পারে না। সমাজের অসহায়, নির্যাতিত-নিপড়ীত মানুষের অধিকার সংরক্ষণে সহায়তা প্রদান এবং তাদেরকে অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনে কাজ করতে পারে সকলেই। আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের অসহায়, দরিদ্র, নির্যাতিত-নিপিড়ীত মানুষদেরকে তাদের মানবিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সচেতন করে গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্যাডসর্বস্ব এ সংস্থাগুলো মানবতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবতার দুর্বলতার সুযোগে তাদেরকে আইনগত সহায়তা প্রদানের নামে তাদের নিকট থেকে অমানবিকভাবে লুটে নেয়া হচ্ছে অঢেল অর্থ। ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ তো দূরের কথা, তা আরো ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আমার জানা মতে, এমন কিছু মানবাধিকার সংস্থা আছে, ‘যেগুলো নামে তাল পুকুর কিন্তু ঘোটি ডুবে না। বাইরে হাঁক-ডাক, কিন্তু ভিতরে অন্তসারশূন্য সদরঘাট’। আবার কোন কোন মানবাধিকার সংস্থার হেড অফিসে একজন তথাকথিত চেয়ারম্যান, একজন পিয়ন এবং কতিপয় চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য তারা বিজ্ঞাপন সাঁটেন পত্রিকায়। ইন্টারভিউ এর সময় মোটা বেতনের প্রলোভন ও উৎসাহ ভাতার অফার দেয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের পর মাসের পর মাস অতিক্রান্ত হলেও বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় না তাদের। অবশেষে নিজেদের মান-মর্যাদা বাঁচানোর তাগিদে তারা চাকরি ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।
এখানেই শেষ নয়। মানবাধিকারের নামে মদ, জুয়া, নেশা আর অনৈতিক আড্ডাখানায় পরিণত করেছে তারা অফিসকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ অফিস যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক অভয়ারণ্য। দেশব্যাপী জেলা-উপজেলা, থানা এবং পৌরসভায় শাখা কমিটি গঠনের নামে মানুষকে সদস্য করার অজুহাতে তাদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে! পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে নেয়া হচ্ছে প্রতারণার আশ্রয়। নারী নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে Victim এর শিকার অসহায় মানুষগুলো তাদের নিকট আইনী সহায়তার জন্য এলে চাঁদা নেয়া হয়। সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোরপূর্বক চাপ প্রয়োগ করে অফিসে তালাবদ্ধ করে আটকিয়ে রেখে পুলিশে সোপর্দ করার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টকাও দাবি করা হয়! লোক দেখানোর জন্য তারা বছরে একটি বা দুটি সভা করে। মাঝে মাঝে একটি ব্যানার ও দু-পাঁচজন ধার করা লোক এনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে থাকে এবং রমযান মাসে বড় জোর একটি ইফতার পার্টি করে থাকে এ সংগঠনগুলোর কোন কোনটি। শুধু মিড়িয়ায় কাভারেজ পাওয়ার জন্যে তারা এগুলো করে থাকে। এছাড়া কার্যত তাদের কোন এজেন্ডা নেই। এ বিষয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে মগবাজার সংগ্রাম অফিসের কোল ঘেঁষে অবস্থিত একটি মানবাধিকার সংগঠনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদেরকে কোন বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। অথচ নিয়োগের আগে উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন ফান্ডে টাকা নেই তো বেতন দেব কিভাবে ইচ্ছা করলে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে পারেন। একই অফিসের অন্য একজন কর্মকর্তার নিকট জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের ব্যাপারে সত্যতা স্বীকার করেন’। জানা যায় যে, ঐ মানবাধিকার সংস্থাটি নিজেদের অপকর্মের কারণে সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়ার ভয়ে সম্প্রতি অফিস অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্য জাতিকে হতাশ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘জনগণের জান-মাল ও অধিকার রক্ষার জন্য কখনো কখনো শক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে’ (সূত্র: প্রথম আলো ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। তার এ বক্তব্যে মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে তা চরমভাবে লংঘিত হয়েছে। এ ধরনের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডেের কারণে প্রকৃত মানবসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা হতাশ হচ্ছেন। ফলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তবে টিআইবি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ কিছু কিছু মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার রক্ষায় গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছে যা প্রশংসনীয়। এ অবস্থায় দুর্নীতিপরায়ণ মানবাধিকার সংস্থাগুলো চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানবাধিকার
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এক মেরুতে সরকার পক্ষ এবং আরেক মেরুতে ২০ দলীয় জোটের অবস্থান। ৫ জানুয়ারি বিএনপি জোটের সমাবেশ করতে না দেয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। অথচ সভা-সমাবেশ করা রাজনৈতিক দলসমূহের একটি সাংবিধানিক অধিকার। সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর উচিত সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়া। আমাদের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে-‘‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভা যাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে’’। অথচ বিরোধী দলগুলো তাদের সাংবিধানিক এ অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর সরকারি দল নির্বিঘ্ন সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। এটি কোন সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি হতে পারে না। এরই সূত্র ধরে বিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে অনির্ধারিতভাবে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে সারা দেশে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় নেতাকর্মীদের মতো করে জনগণের বিরুদ্ধে। যাদের মূলকাজ জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা, তারা সরকারের নির্দেশে বিরোধী শক্তিকে নির্যাতন করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানগণ প্রকাশ্যে জনগণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাদের আদলে বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা দেশের জন্য অশনি সংকেত। সরকারের অতি উৎসাহী কয়েকজন মন্ত্রীও সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি জনগণের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে বোমা হামলা এবং আগুনে পুড়ে মরছে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশুরা। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো হত্যার শিকার হচ্ছে বার বার। অথচ তাদের কথা কেউ ভেবেও দেখছেন না। ফেসবুকে দেখা যায় পুলিশের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বুট-হেলমেটবিহীন যুবকরা রাস্তায় মানুষকে বেধড়ক পিটাচ্ছে অমানবিকভাবে। এরা কারা? এদেরকে নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে ব্যাপকভাবে। পুলিশের গাড়িতে পেট্রোল বোমা মারা হচ্ছে, অথচ তারা গ্রেফতার হচ্ছে না। এরাই বা কারা? এদের কর্মকা- দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে-দেশ এখন মারাত্মকভাবে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আর স্থিতিশীলতা আনয়নে মুখ্য ভূমিকা রাজনৈতিক দলসমূহের। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের। তাহলেই দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল হবে, মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে। ফলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ অত্যাচার-নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পাবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক মর্যাদা রীতি-নীতি ও সংস্কৃতিতে দেশ উচ্চ শিখরে পদার্পণ করবে। তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে দেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যায়।
আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত ও বৈদগ্ধ্য ব্যক্তিবর্গ বলে থাকেন; অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এগুলোই শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি, এগুলোর পাশাপাশি মানুষের সুষ্ঠু জীবনধারণের প্রয়োজনে আরও অনেক অধিকার রয়েছে। যেগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে পরিগণিত। যেমন: বাকস্বাধীনতার অধিকার, নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার, জীবনধারণের অধিকার, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিবার পরিচালনার অধিকার, রাষ্ট্রে শান্তিতে বসবাস করার অধিকার, চুরি- ডাকাতি ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার অধিকার, মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা থেকে বাঁচার অধিকার, নিজের জমি-জমা, গাছ-পালা ও বাগান-বাড়ি সন্ত্রাসীদের লুট-পাট থেকে রক্ষার অধিকার, অন্যায়ভাবে কারো হামলা থেকে বাঁচার অধিকার, স্বাধীনভাবে চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার, শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে বাঁচার অধিকার, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর অনৈতিক হামলা থেকে নিজেকে আত্মরক্ষার অধিকার, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলার পরিবেশ পাবার অধিকার, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার, দেশ, জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কল্যাণরূপে গড়ে তোলার অধিকার, মানব সেবার অধিকার, পেট্রোল বোমার আঘাত থেকে বেঁচে থাকার অধিকার, জনসভা ও সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সর্বোপরি জননিরাপত্তার অধিকারও মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। মোটকথা মানুষের মৌলিক জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে মানবাধিকার।
মানবাধিকারের গুরুত্ব
মনুষ্যত্বের বা The quality of being human-এর পরিপূর্ণ বিকাশে মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিহার্য। মৌলিক চাহিদা পূরণসহ নিরাপত্তামূলক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করা সরকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এছাড়া মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমেই মানবাধিকার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। তাই শুধু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা নয়; বরং এগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য সকল অধিকার যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল মানবাধিকার নিশ্চিত হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিতে জীবনযাপন করার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার সুরক্ষিত হতে পারে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। গোটা পৃথিবীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও রক্ষায় তিনি সংগ্রাম করেছেন। আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্যাতিত-নিপিড়ীত মানবাত্মার পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন; ‘কি কারণে তোমরা সেসব নারী, পুরুষ ও শিশুদের খাতিরে আল্লাহর অনুসৃত পথে সংগ্রাম করছো না? অথচ যারা নির্যাতিত, নিপিড়ীত ও দুর্বল হবার কারণে আমার নিকট ফরিয়াদ করছে এবং বলছে; হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে এ জালিমদের অত্যাচার থেকে বের করে নাও, অথবা তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোন দরদী-বন্ধু ও সাহায্যকারী পাঠিয়ে দাও’ (সূরা নিসা-৭৫)। আমাদের দেশে অতীত নেতৃত্ব দানে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন, তারাও আমরণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের পবিত্র সংবিধানেও গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা সন্নিবেশিত আছে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে- ”The Republic Shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed, and in which effective participation by the people through their elected representatives in administration at all level shall be ensured-’’ অর্থাৎ ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে, এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’। আমাদের দেশের সরকারও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় অত্যন্ত যতœশীল বলে আমি মনে করি। কিন্তু সংবিধানের ধারায় বর্ণিত বিধান অনুযায়ী আমাদের দেশে বর্তমানে গণতন্ত্রের আবরণে চলছে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র। কোথায় আজ ন্যায় বিচার, কোথায় আইনের শাসন, কোথায় প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ? মানবাধিকার আজ বস্তাবন্দী ও সিন্দুকে তালাবদ্ধ। তাই এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলী অর্জন। যা মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত বিবেককে উজ্জীবিত করবে, বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে জাগ্রত করবে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশে মানবাধিকার আন্দোলন দিন দিন জোরদার হচ্ছে। তাছাড়া মানব সভ্যতাকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য অন্যতম দিকনির্দেশক হচ্ছে-জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র। এ ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র প্রায় সকল দেশ এখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণও চায় এদেশে সঠিকভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ অধিকার ফিরে পাক। কারণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র তার আসল রূপ ফিরে পাবে। প্রশাসন নির্বিঘেœ প্রশাসনিক কর্মকা- পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তার বিচারিক কার্যাবলী সম্পন্ন করতে পারবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও ক্ষমতাবলী নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে।
মানবাধিকার সংস্থাসমূহের করণীয়
দেশের সামগ্রিক স্বার্থে রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং মানবাধিকার সংস্থাসমূহের উচিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। কোন সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার মেনে নিতে পারে না, নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, বিচারবহির্ভূত অথবা বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকা-কে মেনে নিতে পারে না। সমাজের অসহায়, নির্যাতিত-নিপড়ীত মানুষের অধিকার সংরক্ষণে সহায়তা প্রদান এবং তাদেরকে অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনে কাজ করতে পারে সকলেই। আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের অসহায়, দরিদ্র, নির্যাতিত-নিপিড়ীত মানুষদেরকে তাদের মানবিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সচেতন করে গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্যাডসর্বস্ব এ সংস্থাগুলো মানবতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বরং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবতার দুর্বলতার সুযোগে তাদেরকে আইনগত সহায়তা প্রদানের নামে তাদের নিকট থেকে অমানবিকভাবে লুটে নেয়া হচ্ছে অঢেল অর্থ। ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ তো দূরের কথা, তা আরো ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আমার জানা মতে, এমন কিছু মানবাধিকার সংস্থা আছে, ‘যেগুলো নামে তাল পুকুর কিন্তু ঘোটি ডুবে না। বাইরে হাঁক-ডাক, কিন্তু ভিতরে অন্তসারশূন্য সদরঘাট’। আবার কোন কোন মানবাধিকার সংস্থার হেড অফিসে একজন তথাকথিত চেয়ারম্যান, একজন পিয়ন এবং কতিপয় চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য তারা বিজ্ঞাপন সাঁটেন পত্রিকায়। ইন্টারভিউ এর সময় মোটা বেতনের প্রলোভন ও উৎসাহ ভাতার অফার দেয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের পর মাসের পর মাস অতিক্রান্ত হলেও বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় না তাদের। অবশেষে নিজেদের মান-মর্যাদা বাঁচানোর তাগিদে তারা চাকরি ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।
এখানেই শেষ নয়। মানবাধিকারের নামে মদ, জুয়া, নেশা আর অনৈতিক আড্ডাখানায় পরিণত করেছে তারা অফিসকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ অফিস যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক অভয়ারণ্য। দেশব্যাপী জেলা-উপজেলা, থানা এবং পৌরসভায় শাখা কমিটি গঠনের নামে মানুষকে সদস্য করার অজুহাতে তাদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে! পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে নেয়া হচ্ছে প্রতারণার আশ্রয়। নারী নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে Victim এর শিকার অসহায় মানুষগুলো তাদের নিকট আইনী সহায়তার জন্য এলে চাঁদা নেয়া হয়। সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোরপূর্বক চাপ প্রয়োগ করে অফিসে তালাবদ্ধ করে আটকিয়ে রেখে পুলিশে সোপর্দ করার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টকাও দাবি করা হয়! লোক দেখানোর জন্য তারা বছরে একটি বা দুটি সভা করে। মাঝে মাঝে একটি ব্যানার ও দু-পাঁচজন ধার করা লোক এনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে থাকে এবং রমযান মাসে বড় জোর একটি ইফতার পার্টি করে থাকে এ সংগঠনগুলোর কোন কোনটি। শুধু মিড়িয়ায় কাভারেজ পাওয়ার জন্যে তারা এগুলো করে থাকে। এছাড়া কার্যত তাদের কোন এজেন্ডা নেই। এ বিষয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে মগবাজার সংগ্রাম অফিসের কোল ঘেঁষে অবস্থিত একটি মানবাধিকার সংগঠনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদেরকে কোন বেতন-ভাতা দেয়া হয় না। অথচ নিয়োগের আগে উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। চেয়ারম্যান সাহেব বলেন ফান্ডে টাকা নেই তো বেতন দেব কিভাবে ইচ্ছা করলে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে পারেন। একই অফিসের অন্য একজন কর্মকর্তার নিকট জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের ব্যাপারে সত্যতা স্বীকার করেন’। জানা যায় যে, ঐ মানবাধিকার সংস্থাটি নিজেদের অপকর্মের কারণে সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়ার ভয়ে সম্প্রতি অফিস অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্য জাতিকে হতাশ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘জনগণের জান-মাল ও অধিকার রক্ষার জন্য কখনো কখনো শক্তি প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে’ (সূত্র: প্রথম আলো ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। তার এ বক্তব্যে মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে তা চরমভাবে লংঘিত হয়েছে। এ ধরনের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডেের কারণে প্রকৃত মানবসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা হতাশ হচ্ছেন। ফলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। তবে টিআইবি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ কিছু কিছু মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার রক্ষায় গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছে যা প্রশংসনীয়। এ অবস্থায় দুর্নীতিপরায়ণ মানবাধিকার সংস্থাগুলো চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানবাধিকার
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এক মেরুতে সরকার পক্ষ এবং আরেক মেরুতে ২০ দলীয় জোটের অবস্থান। ৫ জানুয়ারি বিএনপি জোটের সমাবেশ করতে না দেয়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। অথচ সভা-সমাবেশ করা রাজনৈতিক দলসমূহের একটি সাংবিধানিক অধিকার। সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর উচিত সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়া। আমাদের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে-‘‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভা যাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে’’। অথচ বিরোধী দলগুলো তাদের সাংবিধানিক এ অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর সরকারি দল নির্বিঘ্ন সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছে। এটি কোন সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি হতে পারে না। এরই সূত্র ধরে বিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে অনির্ধারিতভাবে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি দেয়া হচ্ছে সারা দেশে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় নেতাকর্মীদের মতো করে জনগণের বিরুদ্ধে। যাদের মূলকাজ জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা, তারা সরকারের নির্দেশে বিরোধী শক্তিকে নির্যাতন করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানগণ প্রকাশ্যে জনগণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাদের আদলে বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা দেশের জন্য অশনি সংকেত। সরকারের অতি উৎসাহী কয়েকজন মন্ত্রীও সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি জনগণের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে বোমা হামলা এবং আগুনে পুড়ে মরছে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশুরা। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো হত্যার শিকার হচ্ছে বার বার। অথচ তাদের কথা কেউ ভেবেও দেখছেন না। ফেসবুকে দেখা যায় পুলিশের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বুট-হেলমেটবিহীন যুবকরা রাস্তায় মানুষকে বেধড়ক পিটাচ্ছে অমানবিকভাবে। এরা কারা? এদেরকে নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে ব্যাপকভাবে। পুলিশের গাড়িতে পেট্রোল বোমা মারা হচ্ছে, অথচ তারা গ্রেফতার হচ্ছে না। এরাই বা কারা? এদের কর্মকা- দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে-দেশ এখন মারাত্মকভাবে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আর স্থিতিশীলতা আনয়নে মুখ্য ভূমিকা রাজনৈতিক দলসমূহের। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের। তাহলেই দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল হবে, মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে। ফলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ অত্যাচার-নির্যাতন থেকে পরিত্রাণ পাবে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক মর্যাদা রীতি-নীতি ও সংস্কৃতিতে দেশ উচ্চ শিখরে পদার্পণ করবে। তাই আসুন, আমরা সকলে মিলে দেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যায়।
অধ্যক্ষ শহীদুল ইসলাম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন