রবিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

সমঝোতার জন্য সংলাপ


বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘দীর্ঘ অবরোধ ও হরতালে দেশের জেলা শহরগুলোর অবস্থা বিপজ্জনক।’ সাদা চোখে আর গভীর বিশ্লেষণে সমসময়ে দেশের চরম পরিস্থিতি আরো নজর এড়ায় না। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে আছে। জনজীবন বিপর্যস্ত। আর রাজনীতি? রাজনীতি চরম অচলাবস্থায় স্থবির। যে রাজনীতির কাজ নানা রাজনৈতিক সঙ্কট রাজনৈতিকভাবে সুরাহা করার, সেটা করা সম্ভব না হলে রাজনীতিকে মানুষ দোষারোপ করবেই। বলবে, রাজনীতি নিজের সমস্যার সমাধান তো করতে পারছেই না; বরং সেসব সমস্যার চাপ-বিপদ-আগুন মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। মানুষ এমন কথা বলতেই পারে। কারণ, বাংলাদেশ এখন আত্মক্ষয়ী পথে এগুচ্ছে। নেতৃত্ব সবার সামনে গ্রহণযোগ্য সমাধান তুলে ধরতে পারছে না। এমন কি, সঙ্কটের মীমাংসার পথকেও উন্মুক্ত করার বদলে রুদ্ধ করা হচ্ছে।
এখন বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতা কি? মাসাধিককালের আন্দোলন-সংগ্রাম, অবরোধ, হরতাল চলছেই। দাবি আদায় না হলে বিরোধীরা থামবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে থামানোর জন্য কোনো রাজনৈতিক সমাধানমূলক ব্যবস্থা নেয়াও হচ্ছে না। বরং আগুনে ঘি ঢেলে বা শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত ও মারমুখী করা হচ্ছে। ফলে চারদিকে আগুন, মৃত্যু, হানাহানি, তান্ডব, হামলা আর পাল্টা-হামলা, অভিযোগ আর প্রতি-অভিযোগের বিরাট পাহাড় জমছে। একদল যেন আরেক দলের বিনাশের যজ্ঞে উন্মাদের মতো মেতে উঠেছে। মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিরীহ জনতা। সবার মধ্যে তীব্র আকুতি, ‘কবে শেষ হবে বিনাশের ধাবমান অগ্নিকু-?’ কিন্তু জনতার  আর্তনাদ কর্তাদের কানেও পৌঁছাচ্ছে না।
এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক সঙ্কটের বলি হয়ে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষার্থীরা পড়তে বা পরীক্ষা দিতে পারছে না। ক্ষুদ্র-বড়-মাঝারি শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীরা আটকে আছে অচলাবস্থায়। থমকে আছে রাজপথ, রেলপথ। মাঝে মাঝে জ্বলছে হিংসার আগুন। অকাতরে মরছে মানুষ। ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ বন্দী এখন দেশের জেলখানাগুলোতে। দগ্ধ হয়ে মরেছে অর্ধ-শতাধিক লোক। হানাহানিতে এ যাবত মারা গেছে শতাধিক মানুষ। আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজার। গ্রেফতার শত শত। কোথাও কল্যাণ বা ইতিবাচকতার সামান্য আলোকরেখাও দেখা যাচ্ছে না। মানুষ বেঁচে থাকার স্বাভাবিক নিয়মের আকাক্সক্ষায় কাতর হয়ে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ সমাধান সূত্র দিতে বা সঙ্কট মোচনের পথ খুলতে পারছে না। দলীয় হিংস্রতা আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বৃত্তেই আবদ্ধ হয়ে আছে।
বিদ্যমান বিক্ষত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের শত আহাজারি, প্রত্যাশা আর চাওয়া পদদলিত হচ্ছে। সবাই সংলাপ আর সমঝোতার পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বললেও বিবদমান পক্ষসমূহ অনড়। মনে হচ্ছে, আলোচনা বা সমঝোতা নয়, বিনাশেই যেন অবসান হবে সঙ্কট। সবার সর্বনাশেই  যেন কারো কারো প্রাপ্তি অপেক্ষা করছে! হায়! কা-জ্ঞান বা বিবেক নামে বিষয়টি কি সমাজ আর দায়িত্বশীল মানুষের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে? কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থের কথা বাদ দিয়ে সাধারণের কল্যাণ চিন্তা করতে পারছে না কেন? কেন দলীয় বলয় আর ক্ষমতার মোহের স্বর্গই একমাত্র কাম্য হয়ে আছে?
বাংলাদেশের রক্তলিপ্ত পরিস্থিতি দেখে-শুনে মনে হচ্ছে হিন্দু-পৌরাণিক মহাভারত-এর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের মধ্যে লিপ্ত হয়েছি আমরা। নানা দলের ও এলাকার নিজেদের দেশ ও সমাজবাসীকেই আমরা মারছি নানা উগ্রতার নামে। একবারও ভাবছি না তার বিপন্ন পরিবার-পরিজন-স্বজনদের কথা। সংঘাত যেন সকল স্পর্শকাতরতা আর মানবিকতার অবসান ঘটিয়েছে। যেন চরম উগ্রতা আর নৃশংসতার মুখোশে আড়াল করেছে নিজেদের মানবিক-মুখ! শক্তির অন্ধ-দাপটের কাছে বার বার পরাজিত হচ্ছে মানবতা। দেশের প্রান্তে প্রান্তে এখন শুধু স্বজন হারানোর তীব্র বেদনার স্রোত বয়ে চলেছে। আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠছে প্রতিরোধের সুতীব্র দুর্গ।
সবাই জানেন যে, চলমান সমস্যাটির সূত্রপাত ও বিস্তার রাজনৈতিক অঙ্গনে। বিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী, যে কোনো সমস্যার সমাধান নিহিত থাকে সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতেই। অর্থাৎ যে সমস্যার সৃষ্টি ও বিকাশ রাজনৈতিক কারণে, সেটার সমাধানও রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। অর্থনৈতিক বা শক্তির মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে বিবদমানরা সমস্যায় আবর্তিত হচ্ছে এবং এর কারণে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষকে আক্রান্ত করছে। কিন্তু সমস্যার সমাধানের সূত্র সন্ধান করছে না। পরস্পরের প্রতি দোষারোপ করছে কেবল। এতে সমস্যার বিস্তার ঘটছে। সমাধানের পথ বের হচ্ছে না। সরকার ভাবছে, বিরোধীদের আন্দোলন জনগণ গ্রহণ করছে না। বিরোধীরা ভাবছে, আন্দোলনে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। সবাই অপর পক্ষের কি কি ক্ষতি হচ্ছে, সেটারই তালিকা করছে। নিজেদের কি ক্ষতি হচ্ছে, সেটা দেখারও প্রয়োজন বোধ করছে না। মানুষের কি দুর্ভোগ আর বিপদ হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এমনই বিনাশকামিতায় নিমজ্জিত সংশ্লিষ্টরা। এর চেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি কি হতে পারে! তবুও পরিস্থিতির ভয়াবহতা যে কর্তৃপক্ষের অনুধাবন করার কথা, তারা সেটা করছেন কি? রাজনৈতিক সমস্যা কি রাজনৈতিকভাবে সুরাহা করা হচ্ছে?
অথচ ইতিহাস আর সভ্যতা বলে অন্য কথা। বিনাশকাল চিরস্থায়ী হয় না ইতিহাসের পাতায় কিংবা সভ্যতার শরীরে। তবে বাংলাদেশে এমনই বিনাশকালের কালো ছায়া প্রলম্বিত হচ্ছে কেন? কেন এখনো লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে না বিনাশের  নানা আয়োজন আর বলদর্পী উন্মাদনার? কেন চলছেই ক্ষতিকর ধারা? কেন ধরা হচ্ছে না যে, আত্মধ্বংসী লড়াইয়ে নিজেদেরই ক্ষতিই হচ্ছে এবং হবে সবচেয়ে বেশি। আর এই বিনাশের পথ প্রশস্ত করছে বিপদের নানা পথ ও পন্থা।
রাজনৈতিকভাবে সচেতন বাংলাদেশের মানুষ এখনো আশায় চেয়ে আছে। প্রত্যাশা করছে, সকলের মধ্যে শুভবোধের উদ্বোধন হোক। মানবিক বিবেক আর ইতিবাচকতা জেগে উঠুক। মানুষ আর সমাজের জন্য হানিকর তৎপরতা সংশ্লিষ্টরা পরিত্যাগ করুক। নিজের আর অপরের ভালোর দিকটিকেই সামনে নিয়ে আসুক। ত্যাগ, ক্ষমা, সংযমের চিরায়ত আদর্শে ক্ষমতা, লোভ, লাভ আর শক্তির রণমূর্তিকে ভেঙে ফেলুক সবাই মিলে। তা না করা হলে বিনাশকাল থামানো যাবে না। বিনাশের মহাঅগ্নিকুন্ডে নিমজ্জিত হয়ে সবারই ক্ষতি বন্ধ করতে সবাইকেই উদ্যোগী হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এমন উদ্যোগ নেয়া হবে, ততই মানুষ আর সমাজের কল্যাণ ত্বরান্বিত হবে। আমরা বিনাশকাল নয়, মঙ্গল, সুস্থতা, শান্তি আর বিকাশের কাল দেখতে চাই আমাদের বর্তমান আর আগামীর দিনগুলোতে। আমরা রাজনৈতিক সংলাপ, আলোচনা ও সমঝোতার পথে সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ উত্তরণ প্রত্যাশা করি। প্রতিটি মানবিক, বিবেকবান মানুষই সংঘাত ও হিংসার পথ নয়, কামনা করেন শান্তির পন্থা। যে শান্তিময় পন্থায় বিশ্বের নানা দেশে বহু সঙ্কট ও সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। নিরসন করা হয়েছে বহুবিধ অচলাবস্থা। বাংলাদেশেও এমনই একটি শান্তিবাদী ও সংলাপমূলক পন্থা অচিরেই গৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে।
যারা শান্তি ও সমঝোতাকে বিশ্বাস করেন, ইতিহাসে তারাই বিজয়ী হয়েছেন। একগুঁয়েমি আর উগ্রতা পরাজিত হয়েছে। কোনো সংলাপ হবে না, কোনো আলাপ-আলোচনা হবে না, এমন কথা সঙ্কটকে আরো তীব্রভাবে বাড়িয়ে দেবে। সমাধানের পথকে সঙ্কুচিত করবে। কেউ কেউ এমন একপেশে কথা বলে বিপদ বাড়াচ্ছেনও বটে। এদের আরো সচেতন হতে হবে। বর্তমান বিপদ যেন ভবিষ্যতের আরো ভয়াবহ বিপদের কারণ না হয়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। সর্বোপরি জনগণের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা আর দাবিসমূহকে উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে। জনগণের দাবি ও ইচ্ছাই যে রাজনৈতিকভাবে চূড়ান্ত, সেটা মেনে নেয়াই গণতন্ত্রের কথা। বিবেকের কথা। বুদ্ধি ও সচেতনার কথা। এই কথা মেনে নিলে লাভ বৈ ক্ষতি নেই।
একটি সুদীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ পাড়ি দিচ্ছে। যে কোনো আন্দোলনের নিয়মই হলো, সেটা তার যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছাতে চায়। আন্দোলন-সংগ্রাম জনগণের শক্তিতে সে চেষ্টাই করে। জনগণের শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়াগ বা হিংস্রতার অবলম্বন সুবিবেচনার কাজ নয়। সঙ্কট বাড়াতে হিংসার আশ্রয় নেয়া হলেও পরিশেষে আলাপ-আলোচনাই কাম্য এবং একমাত্র প্রতিষেধক। কারণ, সমঝোতার জন্য সংলাপ ও আলাপ-আলোচনার বিকল্প নেই। এই বিকল্পহীন পথে তাড়াতাড়ি এসে মানুষ ও রাজনীতির সঙ্কট নিরসন করা হবে বলেই সকলে প্রত্যাশা করেন। এমন শান্তির পথেই সমাধান আসুক।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads