প্রথমে দু-একটি খবর শুনুন। একটি খবর হলো, দেশব্যাপী চলমান অবরোধ ও হরতালের মধ্যেই সরকার হঠাৎ ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন যে কতোটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে সঙ্গে সঙ্গে। এতোদিন কোনো এক ওয়ার্ডের সীমানা নিয়ে ঝামেলার কথা শুনিয়ে নির্বাচন করেনি কমিশন। কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেয়ার পরপর একই কমিশন জানিয়েছে, সীমানার সমস্যা নাকি আগেই মীমাংসা করা হয়েছে এবং সে কারণে যে কোনো সময় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এ দুটি করপোরেশনেরই নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। ১০ মার্চের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। মানতেই হবে, যথেষ্ট যোগ্য ও পারঙ্গম বর্তমান নির্বাচন কমিশন! এরই পাশাপাশি একদিকে বহুদিন ধরে মেয়র পদের জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসা মাহমুদুর রহমান মান্নাকে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে, অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা এমন ধাওয়ার মুখেই রয়েছেন যে, তাদের কারো পক্ষে আর যা-ই হোক, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ফাঁকা মাঠ পেয়ে যাবে আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে ধারণাও স্পষ্ট করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হককে ঢাকা উত্তরের এবং সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকনকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। গণভবন থেকে ফেরার পর দু’জন নিজেদের সম্মতির কথা জানাতেও দেরি করেননি। ফলে ধরে নেয়া যায়, অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকনকেই আগামীতে মেয়র পদে দেখা যাবে। খবর শুধু এটুকুই নয়। সরকারের ‘অপারেশন’ চলছে অন্য অনেক এলাকাতেও। এসবের মধ্যে গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে এরই মধ্যে গ্রেফতার ও বরখাস্ত করা হয়েছে। ওদিকে সিলেট এবং হবিগঞ্জের দুই মেয়র সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিদায় নেয়ার অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। আর চট্টগ্রামের মেয়রকে তো দীর্ঘদিন ধরেই অঘোষিতভাবে বন্দীজীবন কাটাতে হচ্ছে। এদের সবাই যে বিএনপি করেন সে কথা নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি ধরনের আরো কয়েকটি নির্বাচন করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলা যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, ২০১৩ সালের ৬ জুলাই সর্বশেষ অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শুধু নয়, তার আগের মাসে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছিলেন বিরাট ব্যবধানে। ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সরকার গঠন করার পর পর ২০১০ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের নির্বাচনেও বিএনপিই জিতেছিল। বিএনপি জিতেছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনেও। নারায়ণগঞ্জে যেহেতু বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ডা. আইভি জিতেছিলেন সেহেতু ওই আসনটিও আওয়ামী লীগকে দেয়া যায় না। সে হিসেবে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছিল সাত-এক গোলের ব্যবধানে। প্রতিটি নির্বাচনেই বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির প্রার্থীরা। অন্যদিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে দেশের আটটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে একমাত্র রংপুর এবং এক অর্থে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া সবগুলোতেই মেয়রের আসনে বসেছিলেন বিএনপির প্রতিনিধিরাÑ অবশ্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে।
প্রসঙ্গক্রমে পরিসংখ্যানের পর্যালোচনাও উল্লেখ করা দরকার। দেখা গেছে, গাজীপুরের নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান বেড়েছিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে। তৎকালীন ১৮ দল সমর্থিত বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান যেখানে পেয়েছিলেন তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট সেখানে মহাজোটের তথা আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান পেয়েছিলেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। দু’জনের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল এক লাখ ছয় হাজার ৫৫৭। বিরোধী দলের এই বিজয় অবশ্য মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, ক্ষমতাসীনরা গাজীপুরকে গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ‘ঘাঁটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ‘ঘাঁটি’ তারা অবশ্যই হারাতে চাননি। এজন্যই নির্বাচনের ময়দানে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেননি তারা। বিপুল টাকা তো ছড়িয়েছেনই, হুমকি দেয়া থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করা পর্যন্ত সব বিষয়েই খুবই তৎপর দেখা গিয়েছিল তাদের। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নির্বাচনী অফিস বসানো হয়েছিল। দ্বিতীয় একটি অফিস স্থাপন করা হয়েছিল টঙ্গীর এক বিলাসবহুল হোটেলে। তোফায়েল আহমেদের মতো জাঁদরেল নেতারা নির্বাচনের তদারকি করেছিলেন। ওদিকে নির্বাচনের দিন বিরোধী দলের সমর্থক ভোটারদের বাধা দেয়া, পুলিশের সহযোগিতায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটপেপারে সিলমারা এবং ব্যালটবাক্স থানায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন তারা। পুলিশ ও প্রশাসনের সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ তো ছিলই। ধান গবেষণা ইনস্টিউটসহ বিভিন্নস্থানে দফায় দফায় গোপন সভা করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও যথেষ্টই চালিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পর্যন্ত অনেক রথি-মহারথিকেও ন্যক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। কিন্তু সব জেনেও এবং বিরোধী প্রার্থীর পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ জানানোর পরও নির্বাচন কমিশনকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। ফলে ভোট ডাকাতি হওয়ার এবং বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার আশংকা ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ভোটাররা সব চেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। প্রবাদের এই সত্যকেও তারা সত্য প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন যে, চোরের শুধু নয়, ‘গৃহস্তেরও’ দিন আসে! ফলে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী।
এখানে গাজীপুরের উদাহরণ টেনে আনার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সম্ভবত দরকার পড়ে না। প্রধান কারণ হলো, এই গাজীপুরকে কেন্দ্র করেই বর্তমান সংকটের সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলেও গাজীপুরের ওই নির্বাচন উপলক্ষে সেবার জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্যে এসে গিয়েছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, শেয়ার বাজারের লক্ষ-হাজার কোটি টাকার লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেংকারি, রানা প্লাজার ধস ও প্রায় ১২০০ শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু এবং দেশজুড়ে আওয়ামীকরণের মতো কারণগুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে উঠে এসেছিল সরকারের রাজনৈতিক নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এবং গুম ও খুন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে চলমান নিষ্ঠুর অভিযানের পাশাপাশি একটি বড় কারণ হিসেবে প্রাধান্যে এসেছিল ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে রাতের অন্ধকারে চালানো গণহত্যার ভয়ংকর অভিযান। এর প্রতিক্রিয়াও ভোটারদের প্রবলভাবেই আন্দোলিত করেছিল। সে কারণে গাজীপুরের ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের ওপর গুলী ও নির্যাতন চালানোর এবং তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরিণতি শুভ হতে পারে না। অর্থাৎ মূলত জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুর কারণেই গাজীপুরের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা।
গাজীপুরে ক্ষমতাসীন দলের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে সঙ্গত কারণেই সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। নাটকীয়তাও কম হয়নি। যেমন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছিলেন, দলের চেয়ারম্যান এরশাদ যদি সমর্থন না দিতেন তাহলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরো দুই লাখ ভোট কম পেতেন। অর্থাৎ আজমত উল্লাহ খান পেতেন ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট- যাকে ‘মাত্তরই’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ওদিকে ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর গাজীপুরের ভোটাররা যেখানে ‘দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চপেটাঘাত’ কথাটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাসহ বিশিষ্টজনেরা সেখানে যার যার মতো মূল্যায়ন, অভিমত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। কারো কারো অভিমতও আবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ এখন আর ‘তেমন জনপ্রিয় নয়’! সরকারদলীয় প্রার্থীদের এই হারের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে বলেও আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও মন্দ শোনাননি। আওয়ামী লীগের মধ্যে যখন গোপালগঞ্জের পর দলের দ্বিতীয় প্রধান ‘ঘাঁটি’ গাজীপুরে হেরে যাওয়ার কারণে ‘মাতম’ চলছিল, তখনই তিনি বলে বসেছিলেন, জনগণের কাছে ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’ বলে কিছু নেই। তারা আস্থা হারিয়ে ফেললে যে কোনো ‘দুর্গ’ ভেঙে ফেলতে পারে। জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের অবশ্য অন্য মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দেশে ভিন্ন চিত্র থাকবে এবং ‘মাতাল হাওয়া’ বইতে থাকবে। এ হাওয়া কোনদিকে যাবে তা নাকি এখনই বলা যাবে না! তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য ছিল আরো কৌতুহলোাদ্দীপক। মন্তব্য করার পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, অহেতুক আমরা কিছু জায়গাকে সিটি করপোরেশন করেছি। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশন করে কি লাভ হয়েছে তা নাকি তার জানা নেই! অর্থাৎ সব কাজের মধ্যে তারা কেবল নিজেদের লাভই খোঁজেন, জনগণের নয়! তোফায়েল আহমেদ অবশ্য স্বীকার না করে পারেননি যে, ভোটাররা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এভাবেই পর্যালোচনার পাশাপাশি মন্তব্য ও অভিমত প্রকাশ করা হয়েছিল গাজীপুরের ফলাফল নিয়ে। লক্ষ্য করা দরকার, মনের অজান্তে হলেও মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কিছু কঠিন সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর ‘আওয়ামী লীগ এখন আর তেমন জনপ্রিয় নয়’-এর পাশাপাশি ওবায়দুল কাদেরের ‘দুর্গ’ বিষয়ক মন্তব্য এবং সবশেষে তোফায়েল আহমেদের ভোটাররা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অভিমতকে বিচেনায় নেয়া যেতে পারে। বলা দরকার, ঠিক এ কথাটাই কিন্তু চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে বলে আসছিলেন বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতারা। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন থেকে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি, হলমার্ক ও ডেস্টিনি কেলেংকারি এবং সবশেষে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে চালানো দমন-নির্যাতন-হত্যাসহ হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো গণহত্যা পর্যন্ত অসংখ্য ‘জাতীয়’ ইস্যুর পাশাপাশি সে সময় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিটি। সাধারণ ভোটাররা বুঝলেও ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই চাননি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করার মধ্যেই তাদের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে। সুতরাং কথিত ‘ভুলগুলো’ শোধরাতে চাইলে সবার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা দরকার। তা সে সরকার যে নামেই হোক না কেন। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের জন্য সে সময় পর্যন্তও সুযোগ ছিল। চাইলে তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতেন। অন্যদিকে তারা এগিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে। এজন্যই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১০ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে যাননি। বর্তমান সংকটের শুরুটাও সেখান থেকেই হয়েছিল।
সরকার ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একবার একদিকে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকার এবং অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, নির্বাচন কমিশনের আদৌ কোনো স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনেও এখন আর কোনো সংশয় নেই। তার ওপর রয়েছে আওয়ামী প্রশাসন, যাকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এখনো সাজানোর কাজ চলছে পুরো দমে। ওদিকে প্রশাসনের পাশাপাশি র্যাব ও পুলিশ তো রয়েছেই। ফলে যতো মিষ্টি কথায়ই আশ্বাস দেয়া হোক না কেন, ঢাকা সিটির আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না। প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনরা যে বাঁকা তথা উল্টো পথেই হাঁটার চেষ্টা চালাবেন সে বিষয়েও সন্দেহ নেই সচেতন কোনো মানুষের। সত্যিই সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীরা দাঁড়িয়ে পড়লে ভোট ডাকাতি এবং ইচ্ছামতো সিল মারা ও ব্যালটবাক্স ছিনিয়ে নেয়া প্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। পুলিশ ও প্রশাসন পালন করবে সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা। ওদিকে নির্বাচন কমিশন তো রয়েছেই! এ ধরনের আশংকা ও সম্ভাবনার ভিত্তিতেই জনগণের সচেতন অংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা এবং নিজেদের অবদানের ব্যাপারে সৎসাহস থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত সবচেয়ে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ধাওয়ার মুখে রাখার পরিবর্তে প্রথমে দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার-মামলা ও গুম-খুন বন্ধ করা এবং তারপর যথেষ্ট সময় দিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তখন দেখা যাবে, ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা আসলে কতটুকু। সেটা না করে সিটি নির্বাচনকেও যদি ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা করার পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, ক্ষমতার জোরে শোরগোল করা হলেও আওয়ামী লীগের ভোট আদৌ বাড়েনি বরং অনেক কমেছে এবং অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতসহ দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোর ভোট বহুগুণে বেড়ে গেছে- যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এজন্যই নতুন পর্যায়ে আবারও কুপোকাত হওয়ার লজ্জাকর পরিণতি এড়ানোর কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তা সত্ত্বেও একটা কথা আগাম বলে রাখা যায়। কথাটা হলো, যতো কূটিকৌশলই নেয়া হোক না কেন, ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়ও ভোটার জনগণ আসলে নতুন করে নিজেদের ইচ্ছা ও মনোভাবের জানান দেবেন।
অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি ধরনের আরো কয়েকটি নির্বাচন করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলা যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, ২০১৩ সালের ৬ জুলাই সর্বশেষ অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শুধু নয়, তার আগের মাসে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছিলেন বিরাট ব্যবধানে। ডিজিটাল নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সরকার গঠন করার পর পর ২০১০ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের নির্বাচনেও বিএনপিই জিতেছিল। বিএনপি জিতেছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনেও। নারায়ণগঞ্জে যেহেতু বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ডা. আইভি জিতেছিলেন সেহেতু ওই আসনটিও আওয়ামী লীগকে দেয়া যায় না। সে হিসেবে ক্ষমতাসীনদের পরাজয় ঘটেছিল সাত-এক গোলের ব্যবধানে। প্রতিটি নির্বাচনেই বিরাট ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির প্রার্থীরা। অন্যদিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে দেশের আটটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে একমাত্র রংপুর এবং এক অর্থে নারায়ণগঞ্জ ছাড়া সবগুলোতেই মেয়রের আসনে বসেছিলেন বিএনপির প্রতিনিধিরাÑ অবশ্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে।
প্রসঙ্গক্রমে পরিসংখ্যানের পর্যালোচনাও উল্লেখ করা দরকার। দেখা গেছে, গাজীপুরের নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান বেড়েছিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে। তৎকালীন ১৮ দল সমর্থিত বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান যেখানে পেয়েছিলেন তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট সেখানে মহাজোটের তথা আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান পেয়েছিলেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। দু’জনের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল এক লাখ ছয় হাজার ৫৫৭। বিরোধী দলের এই বিজয় অবশ্য মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, ক্ষমতাসীনরা গাজীপুরকে গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ‘ঘাঁটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ‘ঘাঁটি’ তারা অবশ্যই হারাতে চাননি। এজন্যই নির্বাচনের ময়দানে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেননি তারা। বিপুল টাকা তো ছড়িয়েছেনই, হুমকি দেয়া থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করা পর্যন্ত সব বিষয়েই খুবই তৎপর দেখা গিয়েছিল তাদের। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নির্বাচনী অফিস বসানো হয়েছিল। দ্বিতীয় একটি অফিস স্থাপন করা হয়েছিল টঙ্গীর এক বিলাসবহুল হোটেলে। তোফায়েল আহমেদের মতো জাঁদরেল নেতারা নির্বাচনের তদারকি করেছিলেন। ওদিকে নির্বাচনের দিন বিরোধী দলের সমর্থক ভোটারদের বাধা দেয়া, পুলিশের সহযোগিতায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটপেপারে সিলমারা এবং ব্যালটবাক্স থানায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন তারা। পুলিশ ও প্রশাসনের সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ তো ছিলই। ধান গবেষণা ইনস্টিউটসহ বিভিন্নস্থানে দফায় দফায় গোপন সভা করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও যথেষ্টই চালিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পর্যন্ত অনেক রথি-মহারথিকেও ন্যক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। কিন্তু সব জেনেও এবং বিরোধী প্রার্থীর পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ জানানোর পরও নির্বাচন কমিশনকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। ফলে ভোট ডাকাতি হওয়ার এবং বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার আশংকা ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ভোটাররা সব চেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। প্রবাদের এই সত্যকেও তারা সত্য প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন যে, চোরের শুধু নয়, ‘গৃহস্তেরও’ দিন আসে! ফলে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী।
এখানে গাজীপুরের উদাহরণ টেনে আনার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার সম্ভবত দরকার পড়ে না। প্রধান কারণ হলো, এই গাজীপুরকে কেন্দ্র করেই বর্তমান সংকটের সৃষ্টি করেছেন ক্ষমতাসীনরা। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলেও গাজীপুরের ওই নির্বাচন উপলক্ষে সেবার জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্যে এসে গিয়েছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, শেয়ার বাজারের লক্ষ-হাজার কোটি টাকার লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেংকারি, রানা প্লাজার ধস ও প্রায় ১২০০ শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু এবং দেশজুড়ে আওয়ামীকরণের মতো কারণগুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে উঠে এসেছিল সরকারের রাজনৈতিক নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এবং গুম ও খুন। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে চলমান নিষ্ঠুর অভিযানের পাশাপাশি একটি বড় কারণ হিসেবে প্রাধান্যে এসেছিল ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে রাতের অন্ধকারে চালানো গণহত্যার ভয়ংকর অভিযান। এর প্রতিক্রিয়াও ভোটারদের প্রবলভাবেই আন্দোলিত করেছিল। সে কারণে গাজীপুরের ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের ওপর গুলী ও নির্যাতন চালানোর এবং তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরিণতি শুভ হতে পারে না। অর্থাৎ মূলত জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুর কারণেই গাজীপুরের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা।
গাজীপুরে ক্ষমতাসীন দলের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে সঙ্গত কারণেই সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। নাটকীয়তাও কম হয়নি। যেমন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছিলেন, দলের চেয়ারম্যান এরশাদ যদি সমর্থন না দিতেন তাহলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরো দুই লাখ ভোট কম পেতেন। অর্থাৎ আজমত উল্লাহ খান পেতেন ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট- যাকে ‘মাত্তরই’ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ওদিকে ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর গাজীপুরের ভোটাররা যেখানে ‘দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চপেটাঘাত’ কথাটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাসহ বিশিষ্টজনেরা সেখানে যার যার মতো মূল্যায়ন, অভিমত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। কারো কারো অভিমতও আবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যেমন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ এখন আর ‘তেমন জনপ্রিয় নয়’! সরকারদলীয় প্রার্থীদের এই হারের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে বলেও আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও মন্দ শোনাননি। আওয়ামী লীগের মধ্যে যখন গোপালগঞ্জের পর দলের দ্বিতীয় প্রধান ‘ঘাঁটি’ গাজীপুরে হেরে যাওয়ার কারণে ‘মাতম’ চলছিল, তখনই তিনি বলে বসেছিলেন, জনগণের কাছে ‘দুর্ভেদ্য দুর্গ’ বলে কিছু নেই। তারা আস্থা হারিয়ে ফেললে যে কোনো ‘দুর্গ’ ভেঙে ফেলতে পারে। জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের অবশ্য অন্য মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দেশে ভিন্ন চিত্র থাকবে এবং ‘মাতাল হাওয়া’ বইতে থাকবে। এ হাওয়া কোনদিকে যাবে তা নাকি এখনই বলা যাবে না! তোফায়েল আহমেদের বক্তব্য ছিল আরো কৌতুহলোাদ্দীপক। মন্তব্য করার পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, অহেতুক আমরা কিছু জায়গাকে সিটি করপোরেশন করেছি। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাকে সিটি করপোরেশন করে কি লাভ হয়েছে তা নাকি তার জানা নেই! অর্থাৎ সব কাজের মধ্যে তারা কেবল নিজেদের লাভই খোঁজেন, জনগণের নয়! তোফায়েল আহমেদ অবশ্য স্বীকার না করে পারেননি যে, ভোটাররা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এভাবেই পর্যালোচনার পাশাপাশি মন্তব্য ও অভিমত প্রকাশ করা হয়েছিল গাজীপুরের ফলাফল নিয়ে। লক্ষ্য করা দরকার, মনের অজান্তে হলেও মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কিছু কঠিন সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর ‘আওয়ামী লীগ এখন আর তেমন জনপ্রিয় নয়’-এর পাশাপাশি ওবায়দুল কাদেরের ‘দুর্গ’ বিষয়ক মন্তব্য এবং সবশেষে তোফায়েল আহমেদের ভোটাররা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অভিমতকে বিচেনায় নেয়া যেতে পারে। বলা দরকার, ঠিক এ কথাটাই কিন্তু চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে বলে আসছিলেন বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতারা। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন থেকে পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি, হলমার্ক ও ডেস্টিনি কেলেংকারি এবং সবশেষে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে চালানো দমন-নির্যাতন-হত্যাসহ হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো গণহত্যা পর্যন্ত অসংখ্য ‘জাতীয়’ ইস্যুর পাশাপাশি সে সময় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছিল সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিটি। সাধারণ ভোটাররা বুঝলেও ক্ষমতাসীনরা বুঝতেই চাননি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করার মধ্যেই তাদের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে। সুতরাং কথিত ‘ভুলগুলো’ শোধরাতে চাইলে সবার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা দরকার। তা সে সরকার যে নামেই হোক না কেন। এ ব্যাপারে বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই ছাড় দিয়ে রেখেছিলেন। সুতরাং ক্ষমতাসীনদের জন্য সে সময় পর্যন্তও সুযোগ ছিল। চাইলে তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতেন। অন্যদিকে তারা এগিয়েছিলেন শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে। এজন্যই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ১০ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে যাননি। বর্তমান সংকটের শুরুটাও সেখান থেকেই হয়েছিল।
সরকার ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো একবার একদিকে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকার এবং অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, নির্বাচন কমিশনের আদৌ কোনো স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনেও এখন আর কোনো সংশয় নেই। তার ওপর রয়েছে আওয়ামী প্রশাসন, যাকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো হয়েছে। এখনো সাজানোর কাজ চলছে পুরো দমে। ওদিকে প্রশাসনের পাশাপাশি র্যাব ও পুলিশ তো রয়েছেই। ফলে যতো মিষ্টি কথায়ই আশ্বাস দেয়া হোক না কেন, ঢাকা সিটির আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারবে না। প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীনরা যে বাঁকা তথা উল্টো পথেই হাঁটার চেষ্টা চালাবেন সে বিষয়েও সন্দেহ নেই সচেতন কোনো মানুষের। সত্যিই সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীরা দাঁড়িয়ে পড়লে ভোট ডাকাতি এবং ইচ্ছামতো সিল মারা ও ব্যালটবাক্স ছিনিয়ে নেয়া প্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। পুলিশ ও প্রশাসন পালন করবে সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা। ওদিকে নির্বাচন কমিশন তো রয়েছেই! এ ধরনের আশংকা ও সম্ভাবনার ভিত্তিতেই জনগণের সচেতন অংশ মনে করেন, গণতন্ত্রের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা এবং নিজেদের অবদানের ব্যাপারে সৎসাহস থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত সবচেয়ে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ধাওয়ার মুখে রাখার পরিবর্তে প্রথমে দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার-মামলা ও গুম-খুন বন্ধ করা এবং তারপর যথেষ্ট সময় দিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। তখন দেখা যাবে, ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা আসলে কতটুকু। সেটা না করে সিটি নির্বাচনকেও যদি ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা করার পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, ক্ষমতার জোরে শোরগোল করা হলেও আওয়ামী লীগের ভোট আদৌ বাড়েনি বরং অনেক কমেছে এবং অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতসহ দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোর ভোট বহুগুণে বেড়ে গেছে- যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এজন্যই নতুন পর্যায়ে আবারও কুপোকাত হওয়ার লজ্জাকর পরিণতি এড়ানোর কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। তা সত্ত্বেও একটা কথা আগাম বলে রাখা যায়। কথাটা হলো, যতো কূটিকৌশলই নেয়া হোক না কেন, ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়ও ভোটার জনগণ আসলে নতুন করে নিজেদের ইচ্ছা ও মনোভাবের জানান দেবেন।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন