দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা থেকে উত্তরণে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে লেখা পৃথক দুটি চিঠিতে বান কি মুন সংলাপের এ আহ্বান জানান। নিউইয়র্ক ও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে দুই নেত্রীকে চিঠি দেয়ার বিষয়টি গত রোববার নিশ্চিত করেছেন। প্রথম আলোর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বান কি মুন গত ৩০ জানুয়ারি চিঠি লিখেন। এর কয়েকদিন পর চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছান হয়। একই সময়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টিও ওই দুটি চিঠিতে বান কি মুন উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেশের বর্তমান অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন সুদূর জাতিসংঘের মহাসচিব। বিষয়টি শুনতে খারাপ লাগছে না, কিন্তু ভাবতে গেলে লজ্জা পেতে হয়। আমাদের দেশের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন না, তাই দূরদেশ থেকে তাদের সবক শুনতে হচ্ছে। এতে তাদের মর্যাদা কমছে এবং গ্লানির মাত্রা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে হরতাল,অবরোধ, দাহ, গুলী ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের যে তান্ডব চলছে, তাতে জনদুর্ভোগ বাড়ার সাথে সাথে নাগরিকদের আত্মমর্যাদার চেতনাও ক্রমেই ম্লান হয়ে পড়ছে। এর দায় অবশ্যই আমাদের রাজনীতিবিদদের বহন করতে হবে। তবে দেশ পরিচালনায় সরকারের দায়িত্বটাই প্রধান, এ কারণে দেশের বর্তমান দুর্বিষহ পরিস্থিতির জন্য সরকারকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
শুধু জাতিসংঘই যে সংলাপে বসার কথা বলছে তা নয়, দেশ-বিদেশের আরো অনেকেই সংলাপে বসে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের কথা বলছেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সরকার সংলাপের ব্যাপারে শুধু অনীহা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাষাও ব্যবহার করছে। বিষয়টি একেবারেই ব্যতিক্রম। সারা দুনিয়ায় সংলাপের জন্য সরকারকেই আগ্রহী দেখা যায়, সংলাপে বিরোধীদলকে আনার জন্য তাদেরকেই দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। কারণ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেহেতু সরকরের, তাই জনগণের জান-মাল রক্ষা ও দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বও সরকারের উপরই বর্তায়। কিন্তু বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মায়াকান্না করতে দেখা গেলেও বর্তমান অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির কারণ বিশ্লেষণ ও তা দূর করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়টি জনমনে বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। সরকার সংকট দূরকরণে কেন সংলাপে বসছে না এই প্রশ্ন আজ ঘরে ঘরে। এ বিষয়ে কথা বলছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি বদরুদ্দিন উমর। তিনি বলেছেন, বাম দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও আন্দোলনে জনবিচ্ছিন্নতার পূর্ণ সুবিধা নিচ্ছে সরকার। দেশের চলমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের চক্রান্ত বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হয়েছে। কাজেই শাসকদল হিসেবে সংকট সমাধানের ধারেকাছেও যাচ্ছে না তারা। আর যাবেই বা কেন? ওই পথে গেলেই তো ভোট দিতে হবে। আর ভোটে যাওয়া মানেই ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া। বদরুদ্দিন উমরের এমন বিশ্লেষণ থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে সরকারি দল আওয়ামী লীগ কী করবে? গণতন্ত্রে তো ভোটের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের মতামত গ্রহণের একমাত্র পথই হলো ভোট। ভোটে না গেলে তো হরতাল,অবরোধ ও সহিংসতার পথকেই উস্কে দেয়া হবে। আর অস্থির ও সহিংস রাজনীতিতে বিরোধীদল ছাড়াও সুযোগ সন্ধানী নানা পক্ষ মাঠে নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ার সাথে দেশের ক্ষতির মাত্রাও বাড়ে। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যৌক্তিক পদক্ষেপের বদলে সরকার নানা কৌশলে কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা অব্যাহত রাখলে হেরে যেতে পারে বাংলাদেশ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবল বাসনায় দেশের উন্নতি-অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সাথে সাথে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি কোনো গণতন্ত্রমনা সরকার কিংবা রাজনীতিবিদদের কাম্য হতে পারে না। আসলে সরকার ও বিরোধীদল নির্বিশেষে আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণের আদালতে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মানব জমিনে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন ছাড়া সংকটের সুরাহা হবে না’। খবরটিতে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি’র একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন ছাড়া সংকটের সুরাহা হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রেষারেষি কয়েক দশকের। দু’পক্ষের মধ্যে সহিংসতার বিষয়টি নতুন কিছু না। এ অবস্থায় পর্যবেক্ষকরা আতঙ্কিত যে, সর্বশেষ রক্তপাত ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতার জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করা হলেও তার জনপ্রিয়তা এখনও ব্যাপক। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে খালেদা জিয়া সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছেন। তারপর থেকে শত শত যানবাহন পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়েছে। সরকার বলছে এসব হামলা করছে বিরোধীদলের জঙ্গিরা। অন্যদিকে বিএনপি এর দায় চাপাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর। বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মীকেও গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বক্তব্যও উদ্ধৃতি করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, দ্রুত সংকট সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংঘাত চলতেই থাকবে।
সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচনে যে বর্তমান সংকটের সমাধান রয়েছে, তাতো সকলেই উপলব্ধি করেন। কিন্তু যারা সংকট মুক্তির পথে অগ্রসর হয়ে জাতিকে বর্তমান অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে পারেন তারা তো এগিয়ে আসছেন না। বরং কঠোর মনোভাব নিয়ে দমন-অবদমনের পথেই তারা অগ্রসর হচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে তারা রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে চাইছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সরকারের অনুমোদন ও প্রশ্রয় পেয়ে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কিনা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভুল পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে কিনা, সেই খবর রাখার মত ফুরসত বা মানসিকতা বোধহয় এখন আর সরকারের নেই। ফলে প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকার পাতায় সাধারণ মানুষের প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জুলুম-নিপীড়ন ও গ্রেফতার-বাণিজ্যের খবর মুদ্রিত হচ্ছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মানব জমিন পত্রিকায় ‘আমি হিন্দু, শিবির নই’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়। খবরটিতে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র নয়ন বাছার। ছিলেন হাসি-খুশি তরতাজা এক তরুণ। পুলিশের গুলীতে আহত নয়ন বাছারের এখনকার ঠিকানা পঙ্গু হাসপাতালের এবি ওয়ার্ডের ৬৯ নম্বর বেড। অর্থাভাবে তার চিকিৎসাও হচ্ছে না। ৪ ফেব্রুয়ারি টিউশনি শেষ করে একটি বাসে উঠেছিলেন তিনি। ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে এ সময় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাস থেকে নামার পর পুলিশ জানতে চায় তিনি জামায়াত-শিবির করেন কিনা? জবাবে তিনি বলেন, আমার নাম নয়ন বাছার, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এরপরেই হাঁটুর ওপর অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলী করে সাদা পোশাকের পুলিশ। তারপর আর কিছু মনে নেই। এখন মা ও ছেলের প্রশ্ন, এমন হলো কেন? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এমন কর্মকান্ড তাদের দায়িত্বশীলতা ও মনোভঙ্গির ব্যাপারে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধ ও সংঘর্ষে গত প্রায় এক মাসে ১৫ জন গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই ১৫ জনের মধ্যে ৯ জনই কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী নন। তাদের কেউ দিনমজুর, কেউ দোকানি, কেউ ভ্রাম্যমাণ খেলনা বিক্রেতা। একজন প্রবাসী ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও রয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর এদের ৩ জনের পা কেটে ফেলা হয়েছে। আহত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, কোনো অভিযোগ ছাড়াই পুলিশ তাদের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলী করেছে। গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর পুলিশ মামলাও করেছে। সব ঘটনার ক্ষেত্রেই পুলিশ কথিত বন্দুক যুদ্ধ বা হামলার কথা বলেছে। আমরা জানি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাস দমন পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তবে শুধু গুলী দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করা যায় না। এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে অনুরাগ ও বিরাগের মনোভাব পরিহার করে পেশাগত চেতনায় অনুপ্রাণিত হতে হয়। প্রয়োজন হয় যথাযথ তদন্ত ও আইনের প্রতি আনুগত্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের কাছ থেকে যথাযথ আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশকে রাষ্ট্রের বাহিনীর বদলে দলীয় কর্মীর মত আচরণ করতেও দেখা যায়। ফলে পুলিশের রিক্রুটমেন্ট ও প্রশিক্ষণ নিয়ে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে যে ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘এই ব্যাটা গোলা বারুদ কই’ এই কথা বলেই ৩ পুলিশ মিলে জাপটে ধরলো বশিরকে। বশির হতভম্ব। গোলা বারুদ? এমন কিছুর সাথে তো বশিরের জানাশোনা নেই। কিন্তু পুলিশ নাছোড়বান্দা। বশিরের প্যান্ট পর্যন্ত খুলে চেক করেছে পুলিশ। আন্ডার ওয়্যারটিও খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু এলাকার পরিচিত লোকজনের প্রতিবাদের মুখে সে পর্যন্ত যেতে পারেনি পুলিশ সদস্যরা। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বশির পেশায় একজন সাংবাদিক। অফিস রাজধানীর পল্টনে। বাসা বনশ্রী এলাকায়। গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বশির পুলিশের তল্লাশির শিকার হন বনশ্রী এলাকায়। তিনি গাড়িতে ওঠার উদ্দেশ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশের অশোভন আচরণ থেকে তিনি রেহাই পাননি বরং সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এসআই আরিফ ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক হয়েছেন তো কী হয়েছে, আপনার জন্য আইন আলাদা নাকি? স্থানীয় জনগণ জানান, এই এলাকার প্রায়ই সাধারণ পথচারীরা পুলিশের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তল্লাশির নামে পথচারীদের হয়রানি করা হয়ে থাকে। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না। রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার এ সময়ে সরকার ও রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের বড় চাওয়া সংলাপ ও শান্তি। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাতে সঙ্গত আচরণে সতর্ক থাকে সেই দায়িত্বটি তো সরকারের পালন করার কথা। কিন্তু সরকার তা পালন করে কিনা সেটাই এখন জনগণের দেখার বিষয়।
শুধু জাতিসংঘই যে সংলাপে বসার কথা বলছে তা নয়, দেশ-বিদেশের আরো অনেকেই সংলাপে বসে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের কথা বলছেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সরকার সংলাপের ব্যাপারে শুধু অনীহা প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাষাও ব্যবহার করছে। বিষয়টি একেবারেই ব্যতিক্রম। সারা দুনিয়ায় সংলাপের জন্য সরকারকেই আগ্রহী দেখা যায়, সংলাপে বিরোধীদলকে আনার জন্য তাদেরকেই দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। কারণ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেহেতু সরকরের, তাই জনগণের জান-মাল রক্ষা ও দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বও সরকারের উপরই বর্তায়। কিন্তু বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মায়াকান্না করতে দেখা গেলেও বর্তমান অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির কারণ বিশ্লেষণ ও তা দূর করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়টি জনমনে বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। সরকার সংকট দূরকরণে কেন সংলাপে বসছে না এই প্রশ্ন আজ ঘরে ঘরে। এ বিষয়ে কথা বলছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি বদরুদ্দিন উমর। তিনি বলেছেন, বাম দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও আন্দোলনে জনবিচ্ছিন্নতার পূর্ণ সুবিধা নিচ্ছে সরকার। দেশের চলমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের চক্রান্ত বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত হয়েছে। কাজেই শাসকদল হিসেবে সংকট সমাধানের ধারেকাছেও যাচ্ছে না তারা। আর যাবেই বা কেন? ওই পথে গেলেই তো ভোট দিতে হবে। আর ভোটে যাওয়া মানেই ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া। বদরুদ্দিন উমরের এমন বিশ্লেষণ থেকে প্রশ্ন জাগে, তাহলে সরকারি দল আওয়ামী লীগ কী করবে? গণতন্ত্রে তো ভোটের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের মতামত গ্রহণের একমাত্র পথই হলো ভোট। ভোটে না গেলে তো হরতাল,অবরোধ ও সহিংসতার পথকেই উস্কে দেয়া হবে। আর অস্থির ও সহিংস রাজনীতিতে বিরোধীদল ছাড়াও সুযোগ সন্ধানী নানা পক্ষ মাঠে নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ার সাথে দেশের ক্ষতির মাত্রাও বাড়ে। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যৌক্তিক পদক্ষেপের বদলে সরকার নানা কৌশলে কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা অব্যাহত রাখলে হেরে যেতে পারে বাংলাদেশ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবল বাসনায় দেশের উন্নতি-অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সাথে সাথে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতি কোনো গণতন্ত্রমনা সরকার কিংবা রাজনীতিবিদদের কাম্য হতে পারে না। আসলে সরকার ও বিরোধীদল নির্বিশেষে আমাদের রাজনীতিবিদরা জনগণের আদালতে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মানব জমিনে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন ছাড়া সংকটের সুরাহা হবে না’। খবরটিতে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি’র একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন ছাড়া সংকটের সুরাহা হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রেষারেষি কয়েক দশকের। দু’পক্ষের মধ্যে সহিংসতার বিষয়টি নতুন কিছু না। এ অবস্থায় পর্যবেক্ষকরা আতঙ্কিত যে, সর্বশেষ রক্তপাত ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতার জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করা হলেও তার জনপ্রিয়তা এখনও ব্যাপক। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে খালেদা জিয়া সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছেন। তারপর থেকে শত শত যানবাহন পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়েছে। সরকার বলছে এসব হামলা করছে বিরোধীদলের জঙ্গিরা। অন্যদিকে বিএনপি এর দায় চাপাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর। বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মীকেও গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বক্তব্যও উদ্ধৃতি করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, দ্রুত সংকট সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংঘাত চলতেই থাকবে।
সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচনে যে বর্তমান সংকটের সমাধান রয়েছে, তাতো সকলেই উপলব্ধি করেন। কিন্তু যারা সংকট মুক্তির পথে অগ্রসর হয়ে জাতিকে বর্তমান অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে পারেন তারা তো এগিয়ে আসছেন না। বরং কঠোর মনোভাব নিয়ে দমন-অবদমনের পথেই তারা অগ্রসর হচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে তারা রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে চাইছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সরকারের অনুমোদন ও প্রশ্রয় পেয়ে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কিনা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভুল পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে কিনা, সেই খবর রাখার মত ফুরসত বা মানসিকতা বোধহয় এখন আর সরকারের নেই। ফলে প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকার পাতায় সাধারণ মানুষের প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জুলুম-নিপীড়ন ও গ্রেফতার-বাণিজ্যের খবর মুদ্রিত হচ্ছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মানব জমিন পত্রিকায় ‘আমি হিন্দু, শিবির নই’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়। খবরটিতে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র নয়ন বাছার। ছিলেন হাসি-খুশি তরতাজা এক তরুণ। পুলিশের গুলীতে আহত নয়ন বাছারের এখনকার ঠিকানা পঙ্গু হাসপাতালের এবি ওয়ার্ডের ৬৯ নম্বর বেড। অর্থাভাবে তার চিকিৎসাও হচ্ছে না। ৪ ফেব্রুয়ারি টিউশনি শেষ করে একটি বাসে উঠেছিলেন তিনি। ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে এ সময় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বাস থেকে নামার পর পুলিশ জানতে চায় তিনি জামায়াত-শিবির করেন কিনা? জবাবে তিনি বলেন, আমার নাম নয়ন বাছার, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এরপরেই হাঁটুর ওপর অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলী করে সাদা পোশাকের পুলিশ। তারপর আর কিছু মনে নেই। এখন মা ও ছেলের প্রশ্ন, এমন হলো কেন? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এমন কর্মকান্ড তাদের দায়িত্বশীলতা ও মনোভঙ্গির ব্যাপারে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধ ও সংঘর্ষে গত প্রায় এক মাসে ১৫ জন গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই ১৫ জনের মধ্যে ৯ জনই কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী নন। তাদের কেউ দিনমজুর, কেউ দোকানি, কেউ ভ্রাম্যমাণ খেলনা বিক্রেতা। একজন প্রবাসী ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও রয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর এদের ৩ জনের পা কেটে ফেলা হয়েছে। আহত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, কোনো অভিযোগ ছাড়াই পুলিশ তাদের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলী করেছে। গুলীবিদ্ধ হওয়ার পর পুলিশ মামলাও করেছে। সব ঘটনার ক্ষেত্রেই পুলিশ কথিত বন্দুক যুদ্ধ বা হামলার কথা বলেছে। আমরা জানি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সন্ত্রাস দমন পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তবে শুধু গুলী দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করা যায় না। এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে অনুরাগ ও বিরাগের মনোভাব পরিহার করে পেশাগত চেতনায় অনুপ্রাণিত হতে হয়। প্রয়োজন হয় যথাযথ তদন্ত ও আইনের প্রতি আনুগত্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের কাছ থেকে যথাযথ আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশকে রাষ্ট্রের বাহিনীর বদলে দলীয় কর্মীর মত আচরণ করতেও দেখা যায়। ফলে পুলিশের রিক্রুটমেন্ট ও প্রশিক্ষণ নিয়ে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে যে ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘এই ব্যাটা গোলা বারুদ কই’ এই কথা বলেই ৩ পুলিশ মিলে জাপটে ধরলো বশিরকে। বশির হতভম্ব। গোলা বারুদ? এমন কিছুর সাথে তো বশিরের জানাশোনা নেই। কিন্তু পুলিশ নাছোড়বান্দা। বশিরের প্যান্ট পর্যন্ত খুলে চেক করেছে পুলিশ। আন্ডার ওয়্যারটিও খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু এলাকার পরিচিত লোকজনের প্রতিবাদের মুখে সে পর্যন্ত যেতে পারেনি পুলিশ সদস্যরা। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বশির পেশায় একজন সাংবাদিক। অফিস রাজধানীর পল্টনে। বাসা বনশ্রী এলাকায়। গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে বশির পুলিশের তল্লাশির শিকার হন বনশ্রী এলাকায়। তিনি গাড়িতে ওঠার উদ্দেশ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও পুলিশের অশোভন আচরণ থেকে তিনি রেহাই পাননি বরং সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এসআই আরিফ ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক হয়েছেন তো কী হয়েছে, আপনার জন্য আইন আলাদা নাকি? স্থানীয় জনগণ জানান, এই এলাকার প্রায়ই সাধারণ পথচারীরা পুলিশের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তল্লাশির নামে পথচারীদের হয়রানি করা হয়ে থাকে। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না। রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার এ সময়ে সরকার ও রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের বড় চাওয়া সংলাপ ও শান্তি। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাতে সঙ্গত আচরণে সতর্ক থাকে সেই দায়িত্বটি তো সরকারের পালন করার কথা। কিন্তু সরকার তা পালন করে কিনা সেটাই এখন জনগণের দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন