পেট্রোল বোমা, ক্রসফায়ার, সংলাপ। এই তিনটি শব্দ এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত, আলোড়িত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতিক, কূটনীতিক, সরকারি আমলা, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী এমনকি সাধারণ মানুষ- সবার মধ্যে এ নিয়েই যত মাথাব্যথা, এ নিয়েই যত আলোচনা।
বর্তমানে দেশ একটি চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা ও শংকা গোটা জাতিকে গ্রাস করছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারির ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন প্রহসনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। সংকটটি দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আর এই সংকট থেকেই এসেছে পেট্রোল বোমা, ক্রসফায়ার ও সংলাপ।
৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনটির আগে বিরোধীদলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতিসংঘের সহায়তায় সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সংলাপ হয়েছিল। সংলাপে মধ্যস্থতা করতে এসেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত মি. তারানকো। সেই সংলাপে তখন সংকটের মীমাংসা হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার জবরদস্তির মাধ্যমেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যায়। জাতিসংঘের আহ্বান ও আন্দোলনের মুখে সরকার ওই নির্বাচনকে একটি নিয়ম রক্ষা ও নিতান্ত সংবিধান রক্ষার নির্বাচন উল্লেখ করে। সবার আশা ছিল সরকার তাদের কথা অনুযায়ী অচিরেই সংলাপের মাধ্যমে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করে সব দলের অংশ গ্রহণে একটি ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করবে। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় ঐক্যজোটও একটি বছর অপেক্ষা করে। তারা আন্দোলনের কোন কর্মসূচিও দেয়নি। কিন্তু সরকার বলতে থাকে তারা ৫ বছরই ক্ষমতায় থাকবে এবং ২০১৯ সালের আগে কোন নির্বাচন হবে না।
এমন একটি পরিস্থিতিতে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ৫ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটিকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। জোট নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে জাতির সামনে ৭দফা দাবি তুলে ধরেন। সরকার তার এ দাবিকে অগ্রাহ্য করে আবারও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবস্থায় দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ডাক দেয় ২০ দলীয় জোট। জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে দেশব্যাপী শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। অবরোধের মাঝে আবার বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় চলতে থাকে হরতাল। ১৩ ফেব্রুয়ারি অবরোধের ৩৯ দিন অতিবাহিত হচ্ছে। সরকার চলমান এই আন্দোলনকে প্রচণ্ড দমন পীড়ন চালিয়ে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে গোটা দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক সহিংস পরিস্থিতি। একদিকে চলছে পেট্রোল বোমা হামলা, অন্যদিকে ক্রসফায়ারে হত্যা। এ অবস্থায় জনজীবনের শান্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। সারা দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ স্থবিরতা। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘দেশের পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়। ঢাকার বাইরে জেলাগুলোর অবস্থা মারাত্মক’। রাতে মহাসড়কে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ পর্যন্ত সহিংসতায় ৮৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ক্রসফায়ারে ১৯জনকে হত্যা করা হয়েছে।
চলমান এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘসহ সর্বমহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে চরম বৈরী অবস্থান থেকে সরে এসে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে উভয়পক্ষকে সংকট নিরসনে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়। এসব বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলা হয়, একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই চলমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। সরকার যদি মনে করে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে এবং বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ করে এই সংকট থেকে বের হওয়া যাবে তাহলে তারা বিরাট ভুল করবে।
কিন্তু দেশের নিরীহ জনগণ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিরোধী দলের হরতাল অবরোধ চলছে। অন্যদিকে সরকারও বলপ্রয়োগ করে যাচ্ছে। দিন দিনই পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। সরকার ২০দলীয় জোটের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে বিএনপি জামায়াত জঙ্গি সংগঠন। তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ এনে সরকারের মন্ত্রীরা তাকে গ্রেফতারের পর্যন্ত দাবি জানাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার কপালে দুঃখ আছে। ইতোমধ্যে দেখা গেছে খালেদা জিয়াকে নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কৌশল নেয়া হয়েছে। তাঁর গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন ১৯ ঘণ্টা বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। ১০ দিন পর বিচ্ছিন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করলেও ডিশলাইন ও ইন্টারনেট এখনও বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে খাবার প্রবেশেও বাধা দেয়া হয়। অফিসের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ রেজিস্ট্রার খাতা খুলে নাম-ঠিকানা রেকর্ড করে রাখছে। একইভাবে শ্রমিক লীগ, প্রজন্ম লীগ ও সৈনিক লীগকে দিয়ে গুলশান অফিসের সামনে মিছিল ও অবস্থান করানো হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের স্কুল থেকে জোর করে এনে মানববন্ধনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নৌমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিক-জনতা নিয়ে তিনি গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়াকে ঘেরাও করবেন। এর আগে দেখা গেছে ডজনখানে ইট ও বালুর ট্রাক বসিয়ে এ কার্যালয়েই খালেদা জিয়াকে দু’সপ্তাহ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। প্রধান গেট পুলিশ তালা মেরে বন্ধ রাখে। তাকে লক্ষ্য করে পেপার স্প্রে বা মরিচের গুঁড়া নিক্ষেপ করা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী এভাবেই নানা আচরণের শিকার হচ্ছেন।
কী নির্দয়ভাবে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করা হচ্ছে তার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝা যাবে। গণমাধ্যমে গত কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধান ও কর্মকর্তাদের হুশিয়ারি প্রকাশিত হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেছেন,‘আন্দোলন দমনে কঠিন ব্যবস্থা নিন, সব দায়িত্ব আমার’। এরপর থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিজিবি প্রধান সরাসরি গুলী চালানোর হুমকি দেন। র্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ ২৫ জানুয়ারি খুলনায় বলেন, “সরকার গুলী চালাতেই আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে অস্ত্র দিয়েছে, হা-ডু-ডু খেলার জন্যে নয়”। তিনি রংপুরে গিয়ে রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য দেন। বলেন, ‘২০১৯ সালেই নির্বাচন হবে’। একইভাবে গত ৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, ‘শুধু গুলী করা নয়, সহিংসতায় জড়িতদের বংশধর পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়া হবে। অস্ত্র দেয়া হয়েছে নিরাপত্তার জন্য। আমরা কি বসে বসে আঙ্গুল চুষব’। ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম কুমিল্লায় বলেন, ‘একটি লাশ পড়লে দুটি লাশ ফেলে দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে’। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এম হাফিজ আক্তার ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে বলেন, কেউ সহিংসতা ঘটালে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলী করবে। একইভাবে সরকারের সহযোগী জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় বলেন, “ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে পায়ে গুলী করবে, কাজ না করলে বুকে গুলী করবে”। এটর্নী জেনারেল মাহবুবুল আলম এই মিলনায়তনে দাঁড়িয়ে বলেন, যদি দেখা যায় গাড়িতে কেউ বোমা মারছে, সঙ্গে সঙ্গে গুলী করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা তোমাদের ধরবই। সেটি জ্যান্ত হোক বা যেভাবেই হোক’।
এ অবস্থায় ‘ক্রসফায়ার’ ও বন্দুকযুদ্ধের নামে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ভিন্নমত পোষণ করার কারণে নাগরিকদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা হচ্ছে। পায়ে গুলী করে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। ক্রসফায়ারে হত্যা করে বলা হচ্ছে যে, তিনি বিপথগামী মানুষ। দৈনিক প্রথম আলো ৬ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্রসফায়ারে ১৯ জনের হত্যার তথ্য প্রকাশ করেছে। দৈনিক মানবজমিন ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ৭ দিনে ১২ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ১ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে শুধু জানুয়ারি মাসেই দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। বিএনপির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ ও বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি এবং সাদা পোশাকে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হাতে ৭৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এরমধ্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সংখ্যা ৪৩ জন। ক্রসফায়ার ও বন্ধুকযুদ্ধের নামে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে রংপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নোয়াখালী, কুড়িগ্রাম, যশোর, সাতক্ষীরা, ঢাকার আগারগাঁও, যাত্রাবাড়ি, বরিশালের উজিরপুর ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, শামসুজ্জামান দুদুসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করে কয়েক দফায় রিমাণ্ডে নেয়া হয়েছে। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন স্তরের ১৮ হাজার দলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার আসামীর সংখ্যা ৭ লাখ। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও ট্রাকের নিচে ফেলে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি পায়ে গুলী করে অনেক নেতাকর্মীকে পঙ্গুও করা হয়েছে। মাসের পর মাস বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, মহানগর কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। কোন মিছিল, কোন সভাসমাবেশ কিংবা অফিসে বসার কোন সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। এক কথায় কোনো রাজনৈতিক অধিকার চর্চাই করতে দেয়া হচ্ছে না।
চলমান পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেছে তার আরো একটি জঘন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বাসভবন লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তদের গুলিবর্ষণের ঘটনা। এর আগে প্রখ্যাত কূটনীতিক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ ও তার গাড়ি বোমা মেরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সরকার ভিন্নমতের গণমাধ্যমগুলো আগেই বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে যেসব গণমাধ্যম চালু আছে, সেখানে ছিটেফোঁটা সমালোচনাও সহ্য করা হচ্ছে না। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় বাংলাভিশনের জনপ্রিয় টকশো ফ্রন্টলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। এরশাদ আমলের মত অলিখিত ‘প্রেস অ্যাডভাইস’ জারি করে খবর সেন্সর করা হচ্ছে। টকশো নিয়ন্ত্রণ তো অনেক আগ থেকেই করা হচ্ছে। মেধাবী সাংবাদিক শওকত মাহমুদের নামে পেট্রোল বোমা ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ৬টি মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। মামলা দেয়া হয়েছে পেশাজীবী নেতা সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে। এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী, ইটিভি চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে দফায় দফায় রিমাণ্ডে নেয়া হচ্ছে।
দেশে আজ যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার মূলে ৫ জানুয়ারির ভূয়া নির্বাচন। ওই নির্বাচনটি ছিল দেশে বিদেশে একটি চরম প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। দেশের জনগণের ভোটের অধিকারকে এ নির্বাচনে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জনকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। বাকি ১৪৬টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। ৫৯টি কেন্দ্রে একজন ভোটারও যায়নি। সেদিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে কুকুর বিড়াল ঘুমিয়ে থাকার ছবি প্রধান প্রধান দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়। নির্বাচনের দিনেই ১৯জন প্রাণ হারায়। আর নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয় ১২৩ জন। জনগণ কোনভাবেই সেই ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন সহিংস নির্বাচন মেনে নেয়নি। দেশ-বিদেশে এ নির্বাচন কোন বৈধতা পায়নি। চরম বিতর্কিত এ নির্বাচনে সংসদে একটি কৃত্রিম ও গৃহপালিত বিরোধী দল সাজানো হয়েছে। আবার ওই বিরোধী দল থেকেই কয়েকজনকে মন্ত্রীও করা হয়েছে। রওশন এরশাদকে করা হয়েছে বিচিত্র এই বিরোধী দলের নেতা। জেনারেল এরশাদকে করা হয়েছে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূত। এর কোনটাই গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর কারণেই আজ জাতি সংকটে পড়েছে। এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সংকট হলেও সরকার তা মানছে না। একে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সংকট প্রচার করে বলপ্রয়োগ করে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক এ সংকটকে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের জন্য দেশের নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সমাজ সভা, সমাবেশ বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট নিরসনে সরকার ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তন থেকে অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম মতিঝিলে তার অফিসের সামনের ফুটপাতে আজ ১৫ দিন ধরে অবস্থান করে দুই নেত্রীর মধ্যে, দুই জোটের মধ্যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার দাবি জানাচ্ছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অবস্থান কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ড. শাহদীন মালিক নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে বিশিষ্ট নাগরিকদের অংশগ্রহণে একটি গোলটেবিল আয়োজন করে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বরাবরে চিঠি পাঠিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংলাপ অনুষ্ঠান ও একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের অনুরোধ জানিয়েছেন। এ সবই শুভ উদ্যোগ। দেশের সংকটকালে যারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সফল হলে উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন না। দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। আর তাতে অংশ নেবেন রাজনৈতিক নেতারাই। উদ্যোক্তাদের সন্তুষ্টি এতটুকুই হবে যে, দেশ সংকট মুক্ত হবে এবং জনগণের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে।
তবে দেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হলেও সরকার এখনও সংলাপের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ নাগরিক সমাজের চিঠির পরদিনই বলে দেন এ প্রস্তাব অবাস্তব এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোন সংলাপ নয়। সংলাপের উদ্যোক্তাদের এক-এগারোর কুশীলব বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিট পরিদর্শনে গিয়ে নাগরিক সমাজের আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কার সঙ্গে আলোচনা করব, খুনির সঙ্গে? একইদিন সংসদে প্রশ্নোত্তরে তিনি বিএনপিকে জঙ্গি সংগঠন উল্লেখ করে নিষিদ্ধ করাও হুমকি দেন। তারপরও নিরাশ হলে চলবে না। সবার অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনই জাতিকে বর্তমান মহাসংকট থেকে উত্তরণে সহায়তা করতে পারে। এ ধরনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গঠনমূলক সংলাপই জাতির আকাঙ্খা। সবার আশা, সরকার বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেশের সম্ভাব্য আরো ভয়াবহ পরিণামের কথা অনুধাবন করে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করবে এবং দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা করবে। বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েই সমাধান করতে হবে, বল প্রয়োগে নয়। একতরফা নির্বাচন থেকে উদ্ভূত সংকট কেবল আলোচনার মাধ্যমেই সুরাহা সম্ভব। কথা না বলার সংস্কৃতি গণতন্ত্রে অচল। একই সঙ্গে এ ধরনের সংকট আর যাতে সৃষ্টি হতে না পারে এবং দেশে যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি চলছে তা চিরতরে বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছে একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করাও জরুরি। এমন উদ্যোগ যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তার উদাহরণ ’৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের রূপরেখা স্বাক্ষর। এমন উদাহরণ দেখা গেছে পাকিস্তানেও। কয়েক বছর আগে লন্ডনে বেনজীর ভুট্টো, নওয়াজ শরীফসহ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ‘চার্টার অব ডেমোক্রেসি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে পিপিপির পাঁচ বছরের শাসনামলে পাকিস্তানে বিরোধীদলের একজন রাজনৈতিক নেতাকর্মীকেও জেলে যেতে হয়নি। বিরোধীদলও সরকারের কাজে বাধা দেয়নি। তেমনি বর্তমান নওয়াজ শরীফ সরকারও একইভাবে তা অনুসরণ করে যাচ্ছেন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি এ ধরনের একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয় এবং এ জন্যে হরতাল-অবরোধ, সংসদ বর্জন, জ্বালাও-পোড়াও, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ হয়, তাহলে সেটাই হবে দেশের জন্য মঙ্গল। এর ফলে দেশের রুগ্ন ও অসুস্থ রাজনীতিরও অবসান হবে। দেশের মানুষ এমন একটি শুভদিনের প্রত্যাশা করছে।
বর্তমানে দেশ একটি চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা ও শংকা গোটা জাতিকে গ্রাস করছে। গত বছরের ৫ জানুয়ারির ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন প্রহসনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। সংকটটি দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আর এই সংকট থেকেই এসেছে পেট্রোল বোমা, ক্রসফায়ার ও সংলাপ।
৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনটির আগে বিরোধীদলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতিসংঘের সহায়তায় সরকার ও বিরোধীদলের মধ্যে সংলাপ হয়েছিল। সংলাপে মধ্যস্থতা করতে এসেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত মি. তারানকো। সেই সংলাপে তখন সংকটের মীমাংসা হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার জবরদস্তির মাধ্যমেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যায়। জাতিসংঘের আহ্বান ও আন্দোলনের মুখে সরকার ওই নির্বাচনকে একটি নিয়ম রক্ষা ও নিতান্ত সংবিধান রক্ষার নির্বাচন উল্লেখ করে। সবার আশা ছিল সরকার তাদের কথা অনুযায়ী অচিরেই সংলাপের মাধ্যমে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করে সব দলের অংশ গ্রহণে একটি ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করবে। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় ঐক্যজোটও একটি বছর অপেক্ষা করে। তারা আন্দোলনের কোন কর্মসূচিও দেয়নি। কিন্তু সরকার বলতে থাকে তারা ৫ বছরই ক্ষমতায় থাকবে এবং ২০১৯ সালের আগে কোন নির্বাচন হবে না।
এমন একটি পরিস্থিতিতে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ৫ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটিকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। জোট নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে জাতির সামনে ৭দফা দাবি তুলে ধরেন। সরকার তার এ দাবিকে অগ্রাহ্য করে আবারও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবস্থায় দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ডাক দেয় ২০ দলীয় জোট। জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে দেশব্যাপী শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। অবরোধের মাঝে আবার বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় চলতে থাকে হরতাল। ১৩ ফেব্রুয়ারি অবরোধের ৩৯ দিন অতিবাহিত হচ্ছে। সরকার চলমান এই আন্দোলনকে প্রচণ্ড দমন পীড়ন চালিয়ে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে গোটা দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক সহিংস পরিস্থিতি। একদিকে চলছে পেট্রোল বোমা হামলা, অন্যদিকে ক্রসফায়ারে হত্যা। এ অবস্থায় জনজীবনের শান্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত। সারা দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ স্থবিরতা। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘দেশের পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়। ঢাকার বাইরে জেলাগুলোর অবস্থা মারাত্মক’। রাতে মহাসড়কে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ পর্যন্ত সহিংসতায় ৮৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ক্রসফায়ারে ১৯জনকে হত্যা করা হয়েছে।
চলমান এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘসহ সর্বমহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে চরম বৈরী অবস্থান থেকে সরে এসে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে উভয়পক্ষকে সংকট নিরসনে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়। এসব বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলা হয়, একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই চলমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। সরকার যদি মনে করে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে এবং বিরোধী দল হরতাল-অবরোধ করে এই সংকট থেকে বের হওয়া যাবে তাহলে তারা বিরাট ভুল করবে।
কিন্তু দেশের নিরীহ জনগণ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিরোধী দলের হরতাল অবরোধ চলছে। অন্যদিকে সরকারও বলপ্রয়োগ করে যাচ্ছে। দিন দিনই পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। সরকার ২০দলীয় জোটের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে বিএনপি জামায়াত জঙ্গি সংগঠন। তাদের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ এনে সরকারের মন্ত্রীরা তাকে গ্রেফতারের পর্যন্ত দাবি জানাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার কপালে দুঃখ আছে। ইতোমধ্যে দেখা গেছে খালেদা জিয়াকে নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার কৌশল নেয়া হয়েছে। তাঁর গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ লাইন ১৯ ঘণ্টা বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। ১০ দিন পর বিচ্ছিন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করলেও ডিশলাইন ও ইন্টারনেট এখনও বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে খাবার প্রবেশেও বাধা দেয়া হয়। অফিসের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশ রেজিস্ট্রার খাতা খুলে নাম-ঠিকানা রেকর্ড করে রাখছে। একইভাবে শ্রমিক লীগ, প্রজন্ম লীগ ও সৈনিক লীগকে দিয়ে গুলশান অফিসের সামনে মিছিল ও অবস্থান করানো হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের স্কুল থেকে জোর করে এনে মানববন্ধনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। নৌমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিক-জনতা নিয়ে তিনি গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়াকে ঘেরাও করবেন। এর আগে দেখা গেছে ডজনখানে ইট ও বালুর ট্রাক বসিয়ে এ কার্যালয়েই খালেদা জিয়াকে দু’সপ্তাহ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। প্রধান গেট পুলিশ তালা মেরে বন্ধ রাখে। তাকে লক্ষ্য করে পেপার স্প্রে বা মরিচের গুঁড়া নিক্ষেপ করা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী এভাবেই নানা আচরণের শিকার হচ্ছেন।
কী নির্দয়ভাবে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করা হচ্ছে তার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝা যাবে। গণমাধ্যমে গত কয়েকদিনে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধান ও কর্মকর্তাদের হুশিয়ারি প্রকাশিত হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেছেন,‘আন্দোলন দমনে কঠিন ব্যবস্থা নিন, সব দায়িত্ব আমার’। এরপর থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিজিবি প্রধান সরাসরি গুলী চালানোর হুমকি দেন। র্যাব প্রধান বেনজীর আহমেদ ২৫ জানুয়ারি খুলনায় বলেন, “সরকার গুলী চালাতেই আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে অস্ত্র দিয়েছে, হা-ডু-ডু খেলার জন্যে নয়”। তিনি রংপুরে গিয়ে রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য দেন। বলেন, ‘২০১৯ সালেই নির্বাচন হবে’। একইভাবে গত ৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, ‘শুধু গুলী করা নয়, সহিংসতায় জড়িতদের বংশধর পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়া হবে। অস্ত্র দেয়া হয়েছে নিরাপত্তার জন্য। আমরা কি বসে বসে আঙ্গুল চুষব’। ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম কুমিল্লায় বলেন, ‘একটি লাশ পড়লে দুটি লাশ ফেলে দেয়ার ক্ষমতা পুলিশের আছে’। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এম হাফিজ আক্তার ১৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে বলেন, কেউ সহিংসতা ঘটালে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলী করবে। একইভাবে সরকারের সহযোগী জাসদ নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় বলেন, “ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে পায়ে গুলী করবে, কাজ না করলে বুকে গুলী করবে”। এটর্নী জেনারেল মাহবুবুল আলম এই মিলনায়তনে দাঁড়িয়ে বলেন, যদি দেখা যায় গাড়িতে কেউ বোমা মারছে, সঙ্গে সঙ্গে গুলী করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা তোমাদের ধরবই। সেটি জ্যান্ত হোক বা যেভাবেই হোক’।
এ অবস্থায় ‘ক্রসফায়ার’ ও বন্দুকযুদ্ধের নামে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানোর লাইসেন্স পেয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ভিন্নমত পোষণ করার কারণে নাগরিকদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা হচ্ছে। পায়ে গুলী করে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। ক্রসফায়ারে হত্যা করে বলা হচ্ছে যে, তিনি বিপথগামী মানুষ। দৈনিক প্রথম আলো ৬ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্রসফায়ারে ১৯ জনের হত্যার তথ্য প্রকাশ করেছে। দৈনিক মানবজমিন ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ৭ দিনে ১২ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ১ ফেব্রুয়ারি রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে শুধু জানুয়ারি মাসেই দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৭ জন। বিএনপির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ ও বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি এবং সাদা পোশাকে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হাতে ৭৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এরমধ্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সংখ্যা ৪৩ জন। ক্রসফায়ার ও বন্ধুকযুদ্ধের নামে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে রংপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নোয়াখালী, কুড়িগ্রাম, যশোর, সাতক্ষীরা, ঢাকার আগারগাঁও, যাত্রাবাড়ি, বরিশালের উজিরপুর ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, শামসুজ্জামান দুদুসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করে কয়েক দফায় রিমাণ্ডে নেয়া হয়েছে। সারা দেশ থেকে বিভিন্ন স্তরের ১৮ হাজার দলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার আসামীর সংখ্যা ৭ লাখ। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও ট্রাকের নিচে ফেলে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি পায়ে গুলী করে অনেক নেতাকর্মীকে পঙ্গুও করা হয়েছে। মাসের পর মাস বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, মহানগর কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। কোন মিছিল, কোন সভাসমাবেশ কিংবা অফিসে বসার কোন সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। এক কথায় কোনো রাজনৈতিক অধিকার চর্চাই করতে দেয়া হচ্ছে না।
চলমান পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেছে তার আরো একটি জঘন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের বাসভবন লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তদের গুলিবর্ষণের ঘটনা। এর আগে প্রখ্যাত কূটনীতিক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ ও তার গাড়ি বোমা মেরে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সরকার ভিন্নমতের গণমাধ্যমগুলো আগেই বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে যেসব গণমাধ্যম চালু আছে, সেখানে ছিটেফোঁটা সমালোচনাও সহ্য করা হচ্ছে না। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় বাংলাভিশনের জনপ্রিয় টকশো ফ্রন্টলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। এরশাদ আমলের মত অলিখিত ‘প্রেস অ্যাডভাইস’ জারি করে খবর সেন্সর করা হচ্ছে। টকশো নিয়ন্ত্রণ তো অনেক আগ থেকেই করা হচ্ছে। মেধাবী সাংবাদিক শওকত মাহমুদের নামে পেট্রোল বোমা ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ৬টি মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। মামলা দেয়া হয়েছে পেশাজীবী নেতা সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে। এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী, ইটিভি চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে দফায় দফায় রিমাণ্ডে নেয়া হচ্ছে।
দেশে আজ যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার মূলে ৫ জানুয়ারির ভূয়া নির্বাচন। ওই নির্বাচনটি ছিল দেশে বিদেশে একটি চরম প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। দেশের জনগণের ভোটের অধিকারকে এ নির্বাচনে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জনকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। বাকি ১৪৬টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। ৫৯টি কেন্দ্রে একজন ভোটারও যায়নি। সেদিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে কুকুর বিড়াল ঘুমিয়ে থাকার ছবি প্রধান প্রধান দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়। নির্বাচনের দিনেই ১৯জন প্রাণ হারায়। আর নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয় ১২৩ জন। জনগণ কোনভাবেই সেই ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন সহিংস নির্বাচন মেনে নেয়নি। দেশ-বিদেশে এ নির্বাচন কোন বৈধতা পায়নি। চরম বিতর্কিত এ নির্বাচনে সংসদে একটি কৃত্রিম ও গৃহপালিত বিরোধী দল সাজানো হয়েছে। আবার ওই বিরোধী দল থেকেই কয়েকজনকে মন্ত্রীও করা হয়েছে। রওশন এরশাদকে করা হয়েছে বিচিত্র এই বিরোধী দলের নেতা। জেনারেল এরশাদকে করা হয়েছে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূত। এর কোনটাই গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর কারণেই আজ জাতি সংকটে পড়েছে। এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সংকট হলেও সরকার তা মানছে না। একে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সংকট প্রচার করে বলপ্রয়োগ করে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক এ সংকটকে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের জন্য দেশের নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সমাজ সভা, সমাবেশ বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সংকট নিরসনে সরকার ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তন থেকে অধ্যাপক এমাজ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম মতিঝিলে তার অফিসের সামনের ফুটপাতে আজ ১৫ দিন ধরে অবস্থান করে দুই নেত্রীর মধ্যে, দুই জোটের মধ্যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার দাবি জানাচ্ছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অবস্থান কর্মসূচিতে যাচ্ছেন। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ড. শাহদীন মালিক নাগরিক ঐক্যের ব্যানারে বিশিষ্ট নাগরিকদের অংশগ্রহণে একটি গোলটেবিল আয়োজন করে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বরাবরে চিঠি পাঠিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংলাপ অনুষ্ঠান ও একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের অনুরোধ জানিয়েছেন। এ সবই শুভ উদ্যোগ। দেশের সংকটকালে যারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সফল হলে উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন না। দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। আর তাতে অংশ নেবেন রাজনৈতিক নেতারাই। উদ্যোক্তাদের সন্তুষ্টি এতটুকুই হবে যে, দেশ সংকট মুক্ত হবে এবং জনগণের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে।
তবে দেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হলেও সরকার এখনও সংলাপের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ নাগরিক সমাজের চিঠির পরদিনই বলে দেন এ প্রস্তাব অবাস্তব এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোন সংলাপ নয়। সংলাপের উদ্যোক্তাদের এক-এগারোর কুশীলব বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিট পরিদর্শনে গিয়ে নাগরিক সমাজের আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কার সঙ্গে আলোচনা করব, খুনির সঙ্গে? একইদিন সংসদে প্রশ্নোত্তরে তিনি বিএনপিকে জঙ্গি সংগঠন উল্লেখ করে নিষিদ্ধ করাও হুমকি দেন। তারপরও নিরাশ হলে চলবে না। সবার অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনই জাতিকে বর্তমান মহাসংকট থেকে উত্তরণে সহায়তা করতে পারে। এ ধরনের একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গঠনমূলক সংলাপই জাতির আকাঙ্খা। সবার আশা, সরকার বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেশের সম্ভাব্য আরো ভয়াবহ পরিণামের কথা অনুধাবন করে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করবে এবং দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা করবে। বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েই সমাধান করতে হবে, বল প্রয়োগে নয়। একতরফা নির্বাচন থেকে উদ্ভূত সংকট কেবল আলোচনার মাধ্যমেই সুরাহা সম্ভব। কথা না বলার সংস্কৃতি গণতন্ত্রে অচল। একই সঙ্গে এ ধরনের সংকট আর যাতে সৃষ্টি হতে না পারে এবং দেশে যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি চলছে তা চিরতরে বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছে একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করাও জরুরি। এমন উদ্যোগ যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তার উদাহরণ ’৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের রূপরেখা স্বাক্ষর। এমন উদাহরণ দেখা গেছে পাকিস্তানেও। কয়েক বছর আগে লন্ডনে বেনজীর ভুট্টো, নওয়াজ শরীফসহ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ‘চার্টার অব ডেমোক্রেসি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর ফলে পিপিপির পাঁচ বছরের শাসনামলে পাকিস্তানে বিরোধীদলের একজন রাজনৈতিক নেতাকর্মীকেও জেলে যেতে হয়নি। বিরোধীদলও সরকারের কাজে বাধা দেয়নি। তেমনি বর্তমান নওয়াজ শরীফ সরকারও একইভাবে তা অনুসরণ করে যাচ্ছেন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে যদি এ ধরনের একটি জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয় এবং এ জন্যে হরতাল-অবরোধ, সংসদ বর্জন, জ্বালাও-পোড়াও, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ হয়, তাহলে সেটাই হবে দেশের জন্য মঙ্গল। এর ফলে দেশের রুগ্ন ও অসুস্থ রাজনীতিরও অবসান হবে। দেশের মানুষ এমন একটি শুভদিনের প্রত্যাশা করছে।
সৈয়দ আবদাল আহমদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন