বিশেষ মহলের কেউ কেউ সুচিন্তিতভাবে কারণ সৃষ্টি করেন বলেই মাঝে-মধ্যে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য শুধু নয়, অসত্য তথ্য সংশোধন করার এবং অনেকের স্বার্থচিন্তাপ্রসূত ভুল ব্যাখ্যা ধরিয়ে দেয়ার জন্যও এটা দরকার হয়ে পড়ে। তখন পেছনে ফিরে যেতে হয়। বর্তমান পর্যায়ে এর উপলক্ষ তৈরি করেছেন সুদূর লন্ডনে বসবাসরত বুদ্ধিজীবী নামধারী সেই আওয়ামী মোড়ল- ইতিহাস বর্ণনার নামে গল্প ফেঁদে বসার ব্যাপারে যার তুলনা নেই বললেই চলে। নিজের মতো করে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে ব্যাখ্যা হাজির করেন তিনি। ইতিহাসের ছাত্র এবং তার বর্ণিত অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে আমাকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। কারণ, সঠিক ইতিহাস যাদের জানা নেই, তারা বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং গালগল্পকেই সত্য বলে ধরে নিতে পারেন। এজন্যই ওই মোড়লের কথার পিঠে কিছু বলতে হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ব্যাপারে রীতিমতো প্যাঁচাল পেরেছেন এবং ইতিহাস উল্লেখের নামে নিজের ইচ্ছামতো তথ্য ও ব্যাখ্যা হাজির করেছেন।
আপত্তির প্রধান কারণ ঘটিয়েছেন তিনি ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিতে গিয়ে। দুই নেত্রী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে টেনে এনেছেন। আওয়ামী মোড়ল তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব নাকি পরস্পরের ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ ছিলেন, খালেদা-হাসিনার মতো ‘রাজনৈতিক শত্রু’ ছিলেন না! এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হয়তো আপত্তি জানানোর জন্য বেশি কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু আফটার অল, আওয়ামী মোড়ল তিনি- এত অল্প কথায় থেমে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। তিনি তাই প্রথমে পিছিয়ে গেছেন এবং তারপর কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলে বসেছেন, তিনিই সে তিনি, যিনি তার সম্পাদিত সান্ধ্য দৈনিকে ‘ভাসানী-মুজিব ঐক্য চাই’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। কেন লিখেছিলেন, তার কারণও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘আইয়ুব-মোনেমের স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সফল হতে হলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাসানী-মুজিব ঐক্য চাই’। এই সম্পাদকীয় দেখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে বন্দী নেতা শেখ মুজিব নাকি তাকে বলেছিলেন, ‘...তোমাকে ভাসানী-মুজিব ঐক্যের জন্য স্লোগান দিতে হবে না। আমি সবার চেয়ে মওলানা সাহেবকে ভাল চিনি। আমার জন্য তার মনে গভীর দরদ। সময় হলে আমি ডাক দিলেই তিনি চলে আসবেন।...’ নিবন্ধের এই পর্যায়ে এসে আওয়ামী মোড়ল জানিয়েছেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষদিকে এসে বুঝলাম, ভাসানী-মুজিব ঐক্যের দাবিতে আর কিছু লেখার দরকার নেই। দুই নেতার মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হয়ে গেছে।...’ এখানেও শেষ নয়, আওয়ামী মোড়ল তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান নাকি ছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী গণঅভ্যুত্থান’ এবং ভাসানী-মুজিবের ‘গোপন যোগাযোগ ও সমঝোতার ফল’! ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতি মওলানা ভাসানীর ‘সমর্থন’ও আবিষ্কার করেছেন তিনি। বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর অনুসৃত নীতি-কৌশল নাকি ছিল ‘রীতিমতো মাস্টার স্ট্রোক’!
ওপরে অতিসংক্ষেপে উল্লেখিত তথ্যগুলো থেকে যে কারো ধারণা হবে যেন বন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করা এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করানোই ছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভু্যুত্থানের একমাত্র উদ্দেশ্য! শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী মোড়লের ভাষায় ‘প্রায় দা-কুমড়োর মতো’ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী তাঁর ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ শেখ মুজিবকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন, একে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। আপত্তি উঠেছে একাধিক কারণে। প্রথম কারণ হলো, নিজের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দেয়ার পেছনেও মওলানা ভাসানীর বিপুল অবদান ছিল। পাকিস্তান আমলে তো বটেই, জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও দু’জনের সম্পর্ক ছিল ঠিক পিতা ও পুত্রের মতো। এই সম্পর্ক কোনো ‘চৌধুরী’ বা ‘মিয়া’-ই নষ্ট করতে পারেননি- বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্রের পথে প্রচেষ্টা চালিয়েও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। নীতি-কর্মসূচী, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলের ব্যাপারে যথেষ্ট মতপার্থক্য থাকলেও তাই এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় যে, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সম্পর্ক ছিল ‘প্রায় দা-কুমড়োর মতো’ কিংবা দু’জন পরস্পরের ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ ছিলেন।
আপত্তির দ্বিতীয় কারণ হিসেবে এসেছে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান সংক্রান্ত মন্তব্য। এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ এসে যায়। আওয়ামী মোড়ল বলেই তিনি সবকিছুর মধ্যে শুধু নিজেদের নেতা শেখ মুজিবকে দেখেছেন, ছাত্র-জনতার আশা-আকাংক্ষার প্রতি সামান্য সম্মান দেখাননি। তিনি সেই সাথে বলতে চেয়েছেন, যেন ওই অভ্যুত্থানের পেছনে শেখ মুজিব শুধু নন, তার ঘোষিত ৬ দফাও প্রধান ভূমিকা রেখেছিল! যেন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলই ছিল না সেখানে! অন্যদিকে তথ্যানিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু সেকথা বলে না। কারণ, ৬ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন প্রচেষ্টার প্রাথমিক পর্যায়ে, ১৯৬৬ সালের ৯ মে শেখ মুজিবকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে, ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করে এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় পর্যন্ত তিনি কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। দল হিসেবে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগও সে সময় অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এর কারণ, একদিকে ৬ দফা প্রভাব সৃষ্টি করার মতো জনসমর্থন অর্জন করতে পরেনি, অন্যদিকে ৬ দফার প্রশ্নেই আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ২৩ ও ২৭ আগস্ট গঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ‘পিডিএমপন্থী’ এবং ‘৬ দফাপন্থী’ নামে পরিচিতি পাওয়া পৃথক দু’টি আওয়ামী লীগ। বন্দী নেতা শেখ মুজিবকে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের সভাপতি বানানো হয়। দলটির তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে দুটি মাত্র তথ্যের উল্লেখ করলে। প্রথম তথ্যটি হলো, ১৯৬৬ সাল থেকে তো বটেই, দলের সভাপতি শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী বানানোর পরও ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়ার সাহস পায়নি। দলের ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত নেতাকে ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য’ সরকারের প্রতি ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল (২১ জানুয়ারি, ১৯৬৮)।
দ্বিতীয় তথ্যটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঘোষিত ১১ দফার সমর্থনে এগিয়ে আসার পরিবর্তে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ৮ জানুয়ারি গঠিত আটদলীয় জোট ড্যাক বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটিতে যোগ দিয়েছিল। ড্যাক-এর ৮ দফা কর্মসূচিতে সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি স্বায়ত্তশাসন শব্দটিরই উল্লেখ ছিল না, অনুপস্থিত ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রসঙ্গও। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের দুই নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং খান আবদুল ওয়ালী খানের সঙ্গে তৃতীয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হয়েছিল পঞ্চম তথা ‘ঙ’ দফায়। অন্য একটি কারণেও শেখ মুজিব অসম্মানিত হয়েছিলেন। ড্যাক-এর আহ্বায়ক ছিলেন পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। অর্থাৎ, ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই শোচনীয় ছিল যে, দলটিকে শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বাধীন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সাতটি দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট ড্যাক-এর শরিক হতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর দল ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কিন্তু এই জোটে যোগ দেয়নি বরং স্বাধীন অবস্থানে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
১৯৬৬ সালের মে থেকে কারাগারে থাকায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান নির্মাণে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- যে কথা অওয়ামী মোড়লও স্বীকার না করে পারেননি। স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক ‘ঘেরাও’ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় আগত হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে সেদিনই ঘেরাও করেন গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন)। ঘেরাওকারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরদিন ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেন। ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যু ঘটলে মওলানা ভাসানী ৮ ডিসেম্বর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের ডাক দেন। তিনি নিজে সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন এবং বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শহীদদের গায়েবানা জানাযা নামাজে ইমামতি করেন। মওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন স্বল্প সময়ের মধ্যে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে এবং মূলত এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় তিনটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। ১১ দফা ঘোষিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি।
২০ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু আন্দোলনকে প্রচন্ড করে তোলে এবং মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ভিত নাড়িয়ে দেয়। বিপন্ন আইয়ুব খান আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)। ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগসহ আটদলীয় জোট ড্যাক-এর পক্ষ থেকে প্রথম সুযোগেই বৈঠকে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, মওলানা ভাসানী একে ‘আত্মহত্যার শামিল’ বলে বর্ণনা করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় ‘চরমপত্র’ উচ্চারণ করতে গিয়ে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন, ‘প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করা হবে।’ উল্লেখ্য, আন্দোলনে অগ্রগতির পাশাপাশি শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি তখন প্রাধান্যে চলে এসেছিল এবং শেখ মুজিব বন্দী অবস্থায়ই প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার চাপ এবং মওলানা ভাসানীর বিরোধিতায় সে আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়। ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে নতিস্বীকার করতে হয়। ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিবসহ মামলার অভিযুক্তরা ও অন্য রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তিলাভ করেন।
এই সাফল্যের পর থেকেই নিশ্চিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হতে শুরু করেছিল। মওলানা ভাসানীর আপত্তি সত্ত্বেও আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে ‘নিশ্চিন্ত থাকার’ উপদেশ দিয়ে শেখ মুজিব ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকে তাকে বক্তৃতা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল আরো পরে, ১০ মার্চ। ঘটনাক্রমে ১১ দফার কথা উচ্চারণ করলেও এই ভাষণেই শেখ মুজিব তার বিস্মৃত প্রায় ৬ দফাকে প্রাধান্যে নিয়ে আসেন এবং গোপন সমঝোতার উদ্যোগ নেন। কিন্তু বৈঠক বর্জনকারী প্রধান নেতা মওলানা ভাসানীর প্রবল বিরোধিতায় সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং অবনতিশীল পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয় (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)।
আইয়ুব সরকারের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির নীতিগত স্বীকৃতি ছিল গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার মূল দাবিগুলো আদায় করা সম্ভব হয়নি। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের আন্দোলনবিমুখ নীতি ও ভূমিকা ছিল অসফলতার প্রধান কারণ। গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার কৌশল হিসেবেই যে গোলটেবিল বৈঠক পরিকল্পিত হয়েছিল, সেকথা ইতিহাস প্রমাণ করেছে। শেখ মুজিবের মুক্তি অর্জন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করানোর মতো দাবি আদায়ের জন্য যেখানে কোনো বৈঠকের প্রয়োজন হয়নি, সেখানে অন্য দাবিগুলোও আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করা সম্ভব হতো। কিন্তু ৬ দফাপন্থী অওয়ামী লীগ সে গণঅভ্যুত্থানকেই স্তিমিত ও বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিল, যে গণঅভ্যুত্থানের প্রচন্ড চাপে শেখ মুজিব ফাঁসির মুখ থেকে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর ফলে এই অভিযোগ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, জনগণের মুক্তি অর্জনের মৌলিক প্রশ্নেই আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতি ছিল ক্ষতিকর ও প্রশ্নসাপেক্ষ। সেই সাথে ছিল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংকীর্ণ উদ্দেশ্য। না হলে আওয়ামী লীগ ছাত্র সমাজের ১১ দফাকে নিয়েই এগিয়ে যেতো। কারণ, ১১ দফার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা দু’টি মূলত ৬ দফার আলোকে প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ১১ দফাকে পাশ কাটিয়ে গেছে এবং কিছুদিন পর্যন্ত ‘৬ দফা ও ১১ দফা’ বলার পর এক পর্যায়ে ১১ দফাকে সম্পূর্ণরূপে বিদায় করেছে, প্রাধান্যে এনেছে কেবলই ৬ দফাকে। এই প্রক্রিয়ায় ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত শেখ মুজিবের প্রভাব ও জনপ্রিয়তাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৬ দফাকে একমাত্র কর্মসূচি বানিয়েছে এবং সে নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে এমন প্রচারণাকে শক্তিশালী করেছে, যেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানও ঘটেছিল ৬ দফার ভিত্তিতে, ১১ দফার ভিত্তিতে নয়! যেন শেখ মুজিব একাই ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের প্রধান নেতা! অথচ ইতিহাস প্রমাণ করেছে, গণঅভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত ছাত্র-জনতা ৬ দফার সমর্থনে সামান্যও ভূমিকা পালন করেনি। আর সে কারণেই ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
এখানে ইতিহাসের বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। এ নিবন্ধোর উদ্দেশ্য আসলে আওয়ামী মোড়লের মিথ্যাচার সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা এবং তাকেও জানিয়ে দেয়া যে, গালগল্পকে ইতিহাস হিসেবে চালানোর অপচেষ্টায় সাফল্যলাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। তার উদ্দেশ্য অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। তিনি কথার মারপ্যাঁচে চেষ্টা চালালেও মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সম্পর্ক কোনো সময়ই ‘প্রায় দা-কুমড়োর মতো’ ছিল না। পরস্পরের ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ও ছিলেন না তারা। পাকিস্তান আমলে একযোগে তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধেও দু’জনের বিপুল অবদান ছিল মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, অন্যদিকে গ্রেফতার বরণ করলেও শেখ মুজিব থেকেছেন জাতীয় নেতার অবস্থানে। লক্ষ্যণীয় যে, শেখ মুজিবকে প্রাধান্যে রাখার উদ্দেশ্য থেকে একটু এদিক-সেদিক করতে চাইলেও আওয়ামী মোড়লের পক্ষে কিন্তু মওলানা ভাসানীর অবদান অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। ‘রীতিমতো মাস্টার স্ট্রোক’ ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করেছেন, মাওলানা ভাসানীর সমর্থন পেয়েছিলেন বলেই শেখ মুজিব এতটা এগোতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশও স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বলা দরকার, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার কল্পিত সংলাপ ও সমঝোতা নিয়ে প্যাঁচালের মধ্য দিয়ে আওয়ামী মোড়ল যে শোরগোল তুলতে চেয়েছিলেন, সে চেষ্টাও এখনো সাফল্যের মুখ দেখেনি।
আপত্তির প্রধান কারণ ঘটিয়েছেন তিনি ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিতে গিয়ে। দুই নেত্রী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে টেনে এনেছেন। আওয়ামী মোড়ল তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব নাকি পরস্পরের ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ ছিলেন, খালেদা-হাসিনার মতো ‘রাজনৈতিক শত্রু’ ছিলেন না! এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হয়তো আপত্তি জানানোর জন্য বেশি কষ্ট করতে হতো না। কিন্তু আফটার অল, আওয়ামী মোড়ল তিনি- এত অল্প কথায় থেমে যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। তিনি তাই প্রথমে পিছিয়ে গেছেন এবং তারপর কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলে বসেছেন, তিনিই সে তিনি, যিনি তার সম্পাদিত সান্ধ্য দৈনিকে ‘ভাসানী-মুজিব ঐক্য চাই’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। কেন লিখেছিলেন, তার কারণও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘আইয়ুব-মোনেমের স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সফল হতে হলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাসানী-মুজিব ঐক্য চাই’। এই সম্পাদকীয় দেখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে বন্দী নেতা শেখ মুজিব নাকি তাকে বলেছিলেন, ‘...তোমাকে ভাসানী-মুজিব ঐক্যের জন্য স্লোগান দিতে হবে না। আমি সবার চেয়ে মওলানা সাহেবকে ভাল চিনি। আমার জন্য তার মনে গভীর দরদ। সময় হলে আমি ডাক দিলেই তিনি চলে আসবেন।...’ নিবন্ধের এই পর্যায়ে এসে আওয়ামী মোড়ল জানিয়েছেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষদিকে এসে বুঝলাম, ভাসানী-মুজিব ঐক্যের দাবিতে আর কিছু লেখার দরকার নেই। দুই নেতার মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হয়ে গেছে।...’ এখানেও শেষ নয়, আওয়ামী মোড়ল তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান নাকি ছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী গণঅভ্যুত্থান’ এবং ভাসানী-মুজিবের ‘গোপন যোগাযোগ ও সমঝোতার ফল’! ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রতি মওলানা ভাসানীর ‘সমর্থন’ও আবিষ্কার করেছেন তিনি। বলেছেন, আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর অনুসৃত নীতি-কৌশল নাকি ছিল ‘রীতিমতো মাস্টার স্ট্রোক’!
ওপরে অতিসংক্ষেপে উল্লেখিত তথ্যগুলো থেকে যে কারো ধারণা হবে যেন বন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করা এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করানোই ছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভু্যুত্থানের একমাত্র উদ্দেশ্য! শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী মোড়লের ভাষায় ‘প্রায় দা-কুমড়োর মতো’ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী তাঁর ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ শেখ মুজিবকে বাঁচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন, একে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। আপত্তি উঠেছে একাধিক কারণে। প্রথম কারণ হলো, নিজের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দেয়ার পেছনেও মওলানা ভাসানীর বিপুল অবদান ছিল। পাকিস্তান আমলে তো বটেই, জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্তও দু’জনের সম্পর্ক ছিল ঠিক পিতা ও পুত্রের মতো। এই সম্পর্ক কোনো ‘চৌধুরী’ বা ‘মিয়া’-ই নষ্ট করতে পারেননি- বিভিন্ন সময়ে ষড়যন্ত্রের পথে প্রচেষ্টা চালিয়েও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। নীতি-কর্মসূচী, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলের ব্যাপারে যথেষ্ট মতপার্থক্য থাকলেও তাই এমন মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় যে, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সম্পর্ক ছিল ‘প্রায় দা-কুমড়োর মতো’ কিংবা দু’জন পরস্পরের ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ ছিলেন।
আপত্তির দ্বিতীয় কারণ হিসেবে এসেছে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান সংক্রান্ত মন্তব্য। এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ এসে যায়। আওয়ামী মোড়ল বলেই তিনি সবকিছুর মধ্যে শুধু নিজেদের নেতা শেখ মুজিবকে দেখেছেন, ছাত্র-জনতার আশা-আকাংক্ষার প্রতি সামান্য সম্মান দেখাননি। তিনি সেই সাথে বলতে চেয়েছেন, যেন ওই অভ্যুত্থানের পেছনে শেখ মুজিব শুধু নন, তার ঘোষিত ৬ দফাও প্রধান ভূমিকা রেখেছিল! যেন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলই ছিল না সেখানে! অন্যদিকে তথ্যানিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু সেকথা বলে না। কারণ, ৬ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন প্রচেষ্টার প্রাথমিক পর্যায়ে, ১৯৬৬ সালের ৯ মে শেখ মুজিবকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে, ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করে এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় পর্যন্ত তিনি কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। দল হিসেবে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগও সে সময় অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এর কারণ, একদিকে ৬ দফা প্রভাব সৃষ্টি করার মতো জনসমর্থন অর্জন করতে পরেনি, অন্যদিকে ৬ দফার প্রশ্নেই আওয়ামী লীগ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ২৩ ও ২৭ আগস্ট গঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ‘পিডিএমপন্থী’ এবং ‘৬ দফাপন্থী’ নামে পরিচিতি পাওয়া পৃথক দু’টি আওয়ামী লীগ। বন্দী নেতা শেখ মুজিবকে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের সভাপতি বানানো হয়। দলটির তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে দুটি মাত্র তথ্যের উল্লেখ করলে। প্রথম তথ্যটি হলো, ১৯৬৬ সাল থেকে তো বটেই, দলের সভাপতি শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী বানানোর পরও ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়ার সাহস পায়নি। দলের ওয়ার্কিং কমিটির এক প্রস্তাবে অভিযুক্ত নেতাকে ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য’ সরকারের প্রতি ‘আবেদন’ জানানো হয়েছিল (২১ জানুয়ারি, ১৯৬৮)।
দ্বিতীয় তথ্যটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ঘোষিত ১১ দফার সমর্থনে এগিয়ে আসার পরিবর্তে ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ৮ জানুয়ারি গঠিত আটদলীয় জোট ড্যাক বা ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটিতে যোগ দিয়েছিল। ড্যাক-এর ৮ দফা কর্মসূচিতে সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় দাবি স্বায়ত্তশাসন শব্দটিরই উল্লেখ ছিল না, অনুপস্থিত ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রসঙ্গও। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের দুই নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং খান আবদুল ওয়ালী খানের সঙ্গে তৃতীয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের মুক্তি চাওয়া হয়েছিল পঞ্চম তথা ‘ঙ’ দফায়। অন্য একটি কারণেও শেখ মুজিব অসম্মানিত হয়েছিলেন। ড্যাক-এর আহ্বায়ক ছিলেন পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান। অর্থাৎ, ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের অবস্থা সে সময় এতটাই শোচনীয় ছিল যে, দলটিকে শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খানের নেতৃত্বাধীন এবং জামায়াতে ইসলামীসহ পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সাতটি দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট ড্যাক-এর শরিক হতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর দল ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কিন্তু এই জোটে যোগ দেয়নি বরং স্বাধীন অবস্থানে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল।
১৯৬৬ সালের মে থেকে কারাগারে থাকায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান নির্মাণে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- যে কথা অওয়ামী মোড়লও স্বীকার না করে পারেননি। স্বায়ত্তশাসন, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক ‘ঘেরাও’ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় আগত হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে সেদিনই ঘেরাও করেন গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন)। ঘেরাওকারী ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী পরদিন ঢাকায় হরতাল আহ্বান করেন। ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যু ঘটলে মওলানা ভাসানী ৮ ডিসেম্বর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের ডাক দেন। তিনি নিজে সেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন এবং বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শহীদদের গায়েবানা জানাযা নামাজে ইমামতি করেন। মওলানা ভাসানীর ঘেরাও আন্দোলন স্বল্প সময়ের মধ্যে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে এবং মূলত এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় তিনটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। ১১ দফা ঘোষিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি।
২০ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু আন্দোলনকে প্রচন্ড করে তোলে এবং মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ভিত নাড়িয়ে দেয়। বিপন্ন আইয়ুব খান আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)। ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগসহ আটদলীয় জোট ড্যাক-এর পক্ষ থেকে প্রথম সুযোগেই বৈঠকে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে, মওলানা ভাসানী একে ‘আত্মহত্যার শামিল’ বলে বর্ণনা করে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় ‘চরমপত্র’ উচ্চারণ করতে গিয়ে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন, ‘প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করা হবে।’ উল্লেখ্য, আন্দোলনে অগ্রগতির পাশাপাশি শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি তখন প্রাধান্যে চলে এসেছিল এবং শেখ মুজিব বন্দী অবস্থায়ই প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার চাপ এবং মওলানা ভাসানীর বিরোধিতায় সে আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যায়। ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে নতিস্বীকার করতে হয়। ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিবসহ মামলার অভিযুক্তরা ও অন্য রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তিলাভ করেন।
এই সাফল্যের পর থেকেই নিশ্চিত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হতে শুরু করেছিল। মওলানা ভাসানীর আপত্তি সত্ত্বেও আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে ‘নিশ্চিন্ত থাকার’ উপদেশ দিয়ে শেখ মুজিব ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকে তাকে বক্তৃতা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল আরো পরে, ১০ মার্চ। ঘটনাক্রমে ১১ দফার কথা উচ্চারণ করলেও এই ভাষণেই শেখ মুজিব তার বিস্মৃত প্রায় ৬ দফাকে প্রাধান্যে নিয়ে আসেন এবং গোপন সমঝোতার উদ্যোগ নেন। কিন্তু বৈঠক বর্জনকারী প্রধান নেতা মওলানা ভাসানীর প্রবল বিরোধিতায় সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং অবনতিশীল পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন, পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয় (২৫ মার্চ, ১৯৬৯)।
আইয়ুব সরকারের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির নীতিগত স্বীকৃতি ছিল গণঅভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কিন্তু যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ ১১ দফার মূল দাবিগুলো আদায় করা সম্ভব হয়নি। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের আন্দোলনবিমুখ নীতি ও ভূমিকা ছিল অসফলতার প্রধান কারণ। গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার কৌশল হিসেবেই যে গোলটেবিল বৈঠক পরিকল্পিত হয়েছিল, সেকথা ইতিহাস প্রমাণ করেছে। শেখ মুজিবের মুক্তি অর্জন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল করানোর মতো দাবি আদায়ের জন্য যেখানে কোনো বৈঠকের প্রয়োজন হয়নি, সেখানে অন্য দাবিগুলোও আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করা সম্ভব হতো। কিন্তু ৬ দফাপন্থী অওয়ামী লীগ সে গণঅভ্যুত্থানকেই স্তিমিত ও বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়েছিল, যে গণঅভ্যুত্থানের প্রচন্ড চাপে শেখ মুজিব ফাঁসির মুখ থেকে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর ফলে এই অভিযোগ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, জনগণের মুক্তি অর্জনের মৌলিক প্রশ্নেই আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতি ছিল ক্ষতিকর ও প্রশ্নসাপেক্ষ। সেই সাথে ছিল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংকীর্ণ উদ্দেশ্য। না হলে আওয়ামী লীগ ছাত্র সমাজের ১১ দফাকে নিয়েই এগিয়ে যেতো। কারণ, ১১ দফার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা দু’টি মূলত ৬ দফার আলোকে প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ১১ দফাকে পাশ কাটিয়ে গেছে এবং কিছুদিন পর্যন্ত ‘৬ দফা ও ১১ দফা’ বলার পর এক পর্যায়ে ১১ দফাকে সম্পূর্ণরূপে বিদায় করেছে, প্রাধান্যে এনেছে কেবলই ৬ দফাকে। এই প্রক্রিয়ায় ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত শেখ মুজিবের প্রভাব ও জনপ্রিয়তাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৬ দফাকে একমাত্র কর্মসূচি বানিয়েছে এবং সে নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে এমন প্রচারণাকে শক্তিশালী করেছে, যেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানও ঘটেছিল ৬ দফার ভিত্তিতে, ১১ দফার ভিত্তিতে নয়! যেন শেখ মুজিব একাই ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের প্রধান নেতা! অথচ ইতিহাস প্রমাণ করেছে, গণঅভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত ছাত্র-জনতা ৬ দফার সমর্থনে সামান্যও ভূমিকা পালন করেনি। আর সে কারণেই ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়।
এখানে ইতিহাসের বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। এ নিবন্ধোর উদ্দেশ্য আসলে আওয়ামী মোড়লের মিথ্যাচার সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা এবং তাকেও জানিয়ে দেয়া যে, গালগল্পকে ইতিহাস হিসেবে চালানোর অপচেষ্টায় সাফল্যলাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। তার উদ্দেশ্য অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। তিনি কথার মারপ্যাঁচে চেষ্টা চালালেও মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের সম্পর্ক কোনো সময়ই ‘প্রায় দা-কুমড়োর মতো’ ছিল না। পরস্পরের ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ও ছিলেন না তারা। পাকিস্তান আমলে একযোগে তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধেও দু’জনের বিপুল অবদান ছিল মওলানা ভাসানী প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, অন্যদিকে গ্রেফতার বরণ করলেও শেখ মুজিব থেকেছেন জাতীয় নেতার অবস্থানে। লক্ষ্যণীয় যে, শেখ মুজিবকে প্রাধান্যে রাখার উদ্দেশ্য থেকে একটু এদিক-সেদিক করতে চাইলেও আওয়ামী মোড়লের পক্ষে কিন্তু মওলানা ভাসানীর অবদান অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। ‘রীতিমতো মাস্টার স্ট্রোক’ ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করেছেন, মাওলানা ভাসানীর সমর্থন পেয়েছিলেন বলেই শেখ মুজিব এতটা এগোতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশও স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বলা দরকার, বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার কল্পিত সংলাপ ও সমঝোতা নিয়ে প্যাঁচালের মধ্য দিয়ে আওয়ামী মোড়ল যে শোরগোল তুলতে চেয়েছিলেন, সে চেষ্টাও এখনো সাফল্যের মুখ দেখেনি।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন