গত ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করলেও বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সমঝোতায় পৌঁছানোর এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রাজধানীর পল্টন এলাকায় অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমাবেশে বলেছিলেন, সরকারকে সব দলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও তিনি দাবি জানিয়েছিলেন। নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিংসা ও শত্রুতা ভুলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার এবং দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার বিষয়কে প্রাধান্যে এনেছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। গত বছরের তিন মাসব্যাপী অবরোধ এবং আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যাসহ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও আহ্বানে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা যথারীতি নেতিবাচক অবস্থানই বজায় রেখেছেন। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিক্রিয়ায়। বেগম খালেদা জিয়া বক্তৃতা শেষ করতে না করতেই তারা সংলাপ ও সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, ‘খুনির’ সঙ্গে কোনো সমঝোতা নয়। কোনো কোনো নেতা এমনকি খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানে পর্যন্ত পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে একটি কথাই আরো একবার স্পষ্ট করা হয়েছে। সে কথাটা হলো, ক্ষমতাসীনরা কোনো রকম সমঝোতা চান না। তারা বরং জিইয়ে রাখার পাশাপাশি রাজনৈতিক সংকটকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান, যখন আর কোনো মীমাংসা বা সমাধান করাই সম্ভব হবে না।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এ ধরনের নীতি-কৌশল ও মনোভাব যে মোটেও গ্রহণযোগ্য হওয়ার নয় সেকথা নিশ্চয়ই বলার অক্ষো রাখে না। বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত আশংকাজনক এজন্য যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে একদলীয় ও একতরফা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশকে এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সেই থেকে গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেফতারসহ দমন-নির্যাতনের কারণে সামগ্রিক পরিস্থিতির কেবল অবনতিই ঘটে চলেছে। যৌথ অভিযানের নামে কোনো মামলা ও ওয়ারেন্ট ছাড়াই বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষকেও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। এমন অবস্থায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভয়ে মানুষ বাধ্য হয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আশা করা হয়েছিল, অন্তত পৌর নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার দমন-নির্যাতনের লাগাম টেনে ধরবে। কিন্তু নির্বাচনের প্রাক্কালে উল্টো দমন ও গ্রেফতারের অভিযানকেই আরো শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী করা হয়েছিল। এর ফলে বেশিরভাগ এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষে কার্যকরভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়াই সম্ভব হয়নি। একই কারণে চারদিকে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে, জনগণও রয়েছে প্রবল আতংকের মধ্যে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশপ্রেমিক সকল মহলের পক্ষ থেকে গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করে সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি উঠেছে একযোগে। বেগম খালেদা জিয়া আসলে জনগণের সে আকাক্সক্ষারই প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র। তিনি সেই সাথে সমঝোতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে সংলাপে বসার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা নিয়েছেন স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থান। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তারা বেগম খালেদা জিয়ার মতো দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রীকে ‘খুনি’ বানিয়ে ছেড়েছেন, তাকে এমনকি ভিন্ন রাষ্ট্র পাকিস্তানেও পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন!
বলা বাহুল্য, এভাবে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আর সমঝোতা ছাড়া গণতন্ত্রসম্মত পরিবেশেরও সৃষ্টি হতে পারে না। আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো, পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটলে দমন-নির্যাতনকবলিত ও ঘরছাড়া মানুষ এক সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেÑ যে বিষয়েও বলে রেখেছেন বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির সমাবেশে সরকারের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছেন, জনগণ কখন জেগে উঠবে তা ক্ষমতাসীনরা টেরও পাবেন না। আর জনগণ একবার জেগে উঠলে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তেমন অবস্থার পরিণতি বিশেষ করে সরকারের জন্য অত্যন্ত অশুভ হয়ে উঠতে পারে। শুধু তা-ই নয়, সরকার যদি অব্যাহতভাবে জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে ও দমন-নির্যাতন চালাতে থাকে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে না আনে তাহলে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরাও পরিস্থিতির সুযোগ নেবে এবং এদেশ সত্যি সত্যি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশংকা দেখা দেবে। কারণ, গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকলে একটি দেশে জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। অমন অশুভ ও ভয়ংকর পরিণতি এড়ানোর উদ্দেশ্যেই বেগম খালেদা জিয়া দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে ও সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন। তারও আগে তিনি সমঝোতার লক্ষ্যে সব দলের সঙ্গে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা মনে করি, এই আহ্বানে সাড়া দেয়ার মাধ্যমেই সম্ভব সকল সংকট কাটিয়ে ওঠা, গণতন্ত্রের পাশাপাশি দেশে শান্তি-স্থিতিশীলতাও ফিরিয়ে আনা। বিষয়টি নিয়ে সময় নষ্ট না করার জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন